পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ

ঝা ঝা দুপুরে শুধু হাঁটেমাঝে মাঝে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকেহঠাৎ হঠাৎ সেই বাড়ির বারান্দায় একজন রূপবতী তরুণীকে দেখা যায়তাদের মধ্যে কোন কথা হয় নাদেখা হল এই একমাত্র আনন্দরূপবতী তরুণীর যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে রূপার খুব মিলব্যাপারটা অস্বস্তিকরমিল আরেকটু কম থাকলে ভাল হতবাঙালী মেয়ের নীলবর্ণ চোখ খুব বিশ্বাসযােগ্যও নয়পাখি আমার একলা পাখিবই বন্ধ করে আমি বারান্দায় এসে দেখি অনিদ্রারােগে আক্রান্ত আমার জাজ সাহেব বাবা ইজিচেয়ারে বসে আছেনবাবার ঘর থেকে ইজিচেয়ার আবার ট্রান্সফার হয়েছে বারান্দায়বাবার হাতে চায়ের কাপতিনি নিঃশব্দে চা খাচ্ছেনগভীর রাতের এই চা তিনি নিজে বানানতার বানানাে চা একদিন খেয়ে দেখতে হয়তাকে কি বলব, বাবা এক কাপ চা বানিয়ে দাও? যদি বলি তিনি কিভাবে রিএক্ট করবেন

আজ রাতে তােমার সঙ্গে যেসব কথা বলেছি তার জন্যে আমি দুঃখিতএবং খানিকটা লজ্জিত। 

দুঃখিত এবং লজ্জিত হবার কিছু নেই বাবাআপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন। 

না ঠিক বলিনিতােমার উপর অবিচার করা হয়েছেআই এ্যাম সরিচেয়ারটায় বস। 

আমি বসলামবাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তােমার প্রতি 

আমার যে বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা আছে তাকি তুমি জান

না তুমি জান নাতবে তােমার জানা থাকা প্রয়ােজনজানলে পিতাপুত্রের সম্পর্ক সহজ হবে। 

আমাদের সম্পর্ক সহজই আছে” 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ

সম্পর্ক সহজ নেই, তা আমি যেমন জানি তুমিও জানতােমার প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতার কারণ বলিতােমার জন্মের এক মাস পরের ঘটনাআমি তােমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছিছােট বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটার অভ্যাস নেইহঠাৎ কি যে হল তুমি আমার কোল থেকে নিচে পড়ে গেলে| এই ঘটনা আমি জানি, অনেকবার শুনেছি। 

না শােনার কোন কারণ নেইএটা একটা ভয়াবহ ঘটনাতােমার জীবন সংশয় হয়েছিলএরপর থেকে তুমি যখন উদ্ভট কিছু কর আমি নিজেকেই দোষ দেইতােমাকে দেই নাতােমার বিচিত্র কাণ্ড কারখানার জন্যে নিজেকে দায়ী করিআমার মনে হয় মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে তােমার বুদ্ধিবৃত্তি ঠিকমত বিকশিত হয়নিএর ফল খুব শুভ হয় নিতুমি ভয়বাহ ধরনের প্রশ্রয় পেয়েছপ্রশ্রয়ের ফলকখনাে শুভ হয় নাআমার কথা তাে শুনলে এখন তােমার কি কিছু বলার 

আছে

আছে” 

বল, আমি শুনবখুব পেশেন্ট হিয়ারিং দেব। 

আমি সহজ গলায় বললাম, বাবা, আপনি কি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবেন

জাজ সাহেব বাবা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেনআমি তাকিয়ে রইলাম সজনে গাছটার দিকেগাছটা মরে যাচ্ছেধীরে ধীরে মরছে। 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ

মুনিয়ার ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছেমা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কি সব যেন বলছেনলাবণ্যও জেগে উঠেছেচেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে মামীর ঘরে যাবমামীর ঘরে যাব| ছাদের সিঁড়িতে খটখট শব্দ করতে করতে বাবু নেমে এলতার চোখে মুখে চাপা আতংকসে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, দাদা, তুমি কি আমার ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছ

কখন ? এই ধর পাঁচ মিনিট আগে

নাবাবু চোখ বড় বড় করে বলল, দাদা, একটু আস তাে আমার ঘরে। 

বাবাকে ইজিচেয়ারে রেখে আমি বাবুর সঙ্গে ছাদে উঠে গেলামবাবু বলল, ঘুমুচ্ছিলাম বুঝলে, কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলআমি বললাম, কে? কোন উত্তর নেইআবার কড়া নাড়াদরজা খুলে দেখি কেউ নেইব্যাপার কি বল তাে

আমি শান্ত স্বরে বললাম, ভূত বলেই তাে মনে হচ্ছেভূত মানে? কি বলছ তুমি ! ভূত আবার কি?ভূত হচ্ছে অশরিরী আত্মাতােদের ফিজিক্স কি ভূত স্বীকার করে না ?” 

দাদা তুমি আমার সামনে থেকে যাওউদ্ভট সব কথাবার্তা ... ভূত! আমি কি কচি খােকা?

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ 

আমি বললাম, তুই এক কাজ কর, বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাক ভূত হলে আবার কড়া নাড়বেওর নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত কোন সমস্যা আছেতাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চায়। 

দাদা তুমি নিচে যাওতােমাকে বলাই ভুল হয়েছে” 

আমি আমার ঘরে ঢুকে দেখি রূপাও জেগে আছেরাত তিনটাএই সময়ে বাড়ির প্রতিটি মানুষ জেগে ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। 

লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছেএক ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবার কথাফেরত দেয়নিচার ঘণ্টা পার হয়ে গেছেদুপুর একটার সময় নিয়েছে এখন বাজছে পাঁচটাশীতের সময় পাঁচটাতেই চারদিক অন্ধকারমুনিয়ার মাথা খারাপের মত হয়ে গেছেআমি বললাম, চোর ডাকাত তাে মেয়েকে নেয়নিমেয়ের বাবা নিয়ে গেছেফিরতে দেরি হচ্ছে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। 

মুনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তিন ঘণ্টা লাগবে

তাহলে অন্য কোন ব্যাপারতারা হয়ত ঠিক করেছে রাতে এক সঙ্গে ডিনার করবেকোন একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ...‘ 

চুপ করআমাকে না বলে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে নেবে? মেয়ে তার না আমার

দুজনেরই, ফিফটি ফিফটিআমি ‘মাস পেটে ধরলাম আর মেয়ে দুজনের ফিফটি ফিফটি ?” 

পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ

অনুচিত ধরনের ভাগভাগি তাে বটেইঅনুচিত হলেও কিছু করার নেই সমাজ ঠিক করে দিয়েছে। 

মুনিয়া এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমিই সেই সমাজএক্ষুণি সে ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপরতাকে দেখাচ্ছে বাঘিনীর মতআমি বললাম, তুই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সমাজের নিয়ম কানুন তাে আমার তৈরি না। 

দাদা, তুই ওর খোঁজ নিয়ে আয়” 

কোখেকে খোঁজ আনব? বাসায় যাব? তুই যেভাবে তাকাচ্ছিস তাতে মনে হয় বাসায় যাওয়াই উচিতঠিকানা দে; যাচ্ছি। 

ঠিকানা জানি নাটেলিফোন নাম্বার ?” 

মুনিয়া কোন কথা বলল নাদেখা গেল সে টেলিফোন নাম্বারও জানে নাআমি বিস্মিত হয়ে বললাম, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা তুই কিছুই জানিস না

পিশাচটার ঠিকানা আমি রাখব কেন?” 

তা তো বটেইতার কোন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা আছে? সেখান থেকে পিশাচ সাহেবের ঠিকানা বের করার একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে। 

কারাে ঠিকানাই আমি জানি নাওর এক মামা থাকে নারায়ণগঞ্জেকোথায় জানি নামােজা কারখানার ম্যানেজার। 

আমি বললাম, এই ক্ষেত্রে কিছুই করার নেইরাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করএর মধ্যে এসে পড়বেপিশাচ সাহেব নতুন সংসার পেতেছেনএর মধ্যে একটা মেয়ে নিয়ে ঢুকাবেন নাঢুকালে তাঁরই যন্ত্রণামেয়েকে তাের কাছেই দিয়ে যাবেন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *