ঝা ঝা দুপুরে শুধু হাঁটে। মাঝে মাঝে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ সেই বাড়ির বারান্দায় একজন রূপবতী তরুণীকে দেখা যায়। তাদের মধ্যে কোন কথা হয় না। দেখা হল – এই একমাত্র আনন্দ। রূপবতী তরুণীর যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে রূপার খুব মিল। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। মিল আরেকটু কম থাকলে ভাল হত। বাঙালী মেয়ের নীলবর্ণ চোখ খুব বিশ্বাসযােগ্যও নয়। বই বন্ধ করে আমি বারান্দায় এসে দেখি অনিদ্রারােগে আক্রান্ত আমার জাজ সাহেব বাবা ইজিচেয়ারে বসে আছেন। বাবার ঘর থেকে ইজিচেয়ার আবার ট্রান্সফার হয়েছে বারান্দায়। বাবার হাতে চায়ের কাপ। তিনি নিঃশব্দে চা খাচ্ছেন। গভীর রাতের এই চা তিনি নিজে বানান। তার বানানাে চা একদিন খেয়ে দেখতে হয়। তাকে কি বলব, বাবা এক কাপ চা বানিয়ে দাও? যদি বলি তিনি কিভাবে রিএক্ট করবেন ?
‘আজ রাতে তােমার সঙ্গে যেসব কথা বলেছি তার জন্যে আমি দুঃখিত। এবং খানিকটা লজ্জিত।
‘দুঃখিত এবং লজ্জিত হবার কিছু নেই বাবা। আপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন।
‘না ঠিক বলিনি। তােমার উপর অবিচার করা হয়েছে। আই এ্যাম সরি। চেয়ারটায় বস।
আমি বসলাম। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তােমার প্রতি
আমার যে বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা আছে তা–কি তুমি জান ?
‘না তুমি জান না। তবে তােমার জানা থাকা প্রয়ােজন। জানলে পিতা–পুত্রের সম্পর্ক সহজ হবে।
‘আমাদের সম্পর্ক সহজই আছে।”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘সম্পর্ক সহজ নেই, তা আমি যেমন জানি তুমিও জান। তােমার প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতার কারণ বলি। তােমার জন্মের এক মাস পরের ঘটনা। আমি তােমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। ছােট বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটার অভ্যাস নেই। হঠাৎ কি যে হল তুমি আমার কোল থেকে নিচে পড়ে গেলে। | ‘এই ঘটনা আমি জানি, অনেকবার শুনেছি।
‘না শােনার কোন কারণ নেই। এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা। তােমার জীবন সংশয় হয়েছিল। এরপর থেকে তুমি যখন উদ্ভট কিছু কর আমি নিজেকেই দোষ দেই। তােমাকে দেই না। তােমার বিচিত্র কাণ্ড কারখানার জন্যে নিজেকে দায়ী করি। আমার মনে হয় মাথায় আঘাত পাওয়ার ফলে তােমার বুদ্ধিবৃত্তি ঠিকমত বিকশিত হয়নি। এর ফল খুব শুভ হয় নি। তুমি ভয়বাহ ধরনের প্রশ্রয় পেয়েছ। প্রশ্রয়ের ফল। কখনাে শুভ হয় না। আমার কথা তাে শুনলে — এখন তােমার কি কিছু বলার
আছে ?
‘আছে।”
বল, আমি শুনব। খুব পেশেন্ট হিয়ারিং দেব।
আমি সহজ গলায় বললাম, বাবা, আপনি কি আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াবেন ?
জাজ সাহেব বাবা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকিয়ে রইলাম সজনে গাছটার দিকে। গাছটা মরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মরছে।
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মুনিয়ার ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কি সব যেন বলছেন। লাবণ্যও জেগে উঠেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে –“মামীর ঘরে যাব। মামীর ঘরে যাব।” | ছাদের সিঁড়িতে খটখট শব্দ করতে করতে বাবু নেমে এল। তার চোখে মুখে চাপা আতংক। সে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, দাদা, তুমি কি আমার ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছ?
‘কখন ? ‘এই ধর পাঁচ মিনিট আগে ?
না। বাবু চোখ বড় বড় করে বলল, দাদা, একটু আস তাে আমার ঘরে।
বাবাকে ইজিচেয়ারে রেখে আমি বাবুর সঙ্গে ছাদে উঠে গেলাম। বাবু বলল, ঘুমুচ্ছিলাম বুঝলে, কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। আমি বললাম, কে? কোন উত্তর নেই। আবার কড়া নাড়া। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। ব্যাপার কি বল তাে?
আমি শান্ত স্বরে বললাম, ভূত বলেই তাে মনে হচ্ছে। ‘ভূত মানে? কি বলছ তুমি ! ভূত আবার কি?” ‘ভূত হচ্ছে অশরিরী আত্মা। তােদের ফিজিক্স কি ভূত স্বীকার করে না ?”
‘দাদা তুমি আমার সামনে থেকে যাও। উদ্ভট সব কথাবার্তা ... ভূত! আমি কি কচি খােকা?”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি বললাম, তুই এক কাজ কর, বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাক – ভূত হলে আবার কড়া নাড়বে। ওর নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত কোন সমস্যা আছে। তাের সঙ্গে ডিসকাস করতে চায়।
‘দাদা তুমি নিচে যাও। তােমাকে বলাই ভুল হয়েছে।”
আমি আমার ঘরে ঢুকে দেখি – রূপাও জেগে আছে। রাত তিনটা। এই সময়ে বাড়ির প্রতিটি মানুষ জেগে – ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।
লাব্যণকে তার বাবা নিয়ে গেছে। এক ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবার কথা। ফেরত দেয়নি। চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দুপুর একটার সময় নিয়েছে – এখন বাজছে পাঁচটা। শীতের সময় পাঁচটাতেই চারদিক অন্ধকার। মুনিয়ার মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে। আমি বললাম, চোর ডাকাত তাে মেয়েকে নেয়নি। মেয়ের বাবা নিয়ে গেছে। ফিরতে দেরি হচ্ছে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে।
মুনিয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে তিন ঘণ্টা লাগবে?
‘তাহলে অন্য কোন ব্যাপার। তারা হয়ত ঠিক করেছে রাতে এক সঙ্গে ডিনার করবে। কোন একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ...‘
‘চুপ কর। আমাকে না বলে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে নেবে? মেয়ে তার না আমার ?
‘দু‘ জনেরই, ফিফটি ফিফটি। ‘আমি ন‘মাস পেটে ধরলাম আর মেয়ে দু‘জনের ফিফটি ফিফটি ?”
পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
‘অনুচিত ধরনের ভাগভাগি তাে বটেই। অনুচিত হলেও কিছু করার নেই — সমাজ ঠিক করে দিয়েছে।
মুনিয়া এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমিই সেই সমাজ। এক্ষুণি সে ঝাপিয়ে পড়বে আমার উপর। তাকে দেখাচ্ছে বাঘিনীর মত। আমি বললাম, তুই আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সমাজের নিয়ম কানুন তাে আমার তৈরি না।
‘দাদা, তুই ওর খোঁজ নিয়ে আয়।”
‘কোখেকে খোঁজ আনব? বাসায় যাব? তুই যেভাবে তাকাচ্ছিস তাতে মনে হয় বাসায় যাওয়াই উচিত। ঠিকানা দে; যাচ্ছি।
ঠিকানা জানি না। ‘টেলিফোন নাম্বার ?”
মুনিয়া কোন কথা বলল না। দেখা গেল সে টেলিফোন নাম্বারও জানে না। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা তুই কিছুই জানিস না?
‘ঐ পিশাচটার ঠিকানা আমি রাখব কেন?”
‘তা তো বটেই। তার কোন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা আছে? সেখান থেকে পিশাচ সাহেবের ঠিকানা বের করার একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।
‘কারাে ঠিকানাই আমি জানি না। ওর এক মামা থাকে নারায়ণগঞ্জে। কোথায় জানি না। মােজা কারখানার ম্যানেজার।
আমি বললাম, এই ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এর মধ্যে এসে পড়বে। পিশাচ সাহেব নতুন সংসার পেতেছেন। এর মধ্যে একটা মেয়ে নিয়ে ঢুকাবেন না। ঢুকালে তাঁরই যন্ত্রণা। মেয়েকে তাের কাছেই দিয়ে যাবেন।