পাখি আমার একলা পাখি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি পত্রিকা হাতে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলামকি সমস্যা ! বাবু এসে বলল, দাদা, ভাবী নাকি সিনেমা করছে? পাখি আমার একলা পাখি

আমি বললাম, হ্যাছবিটা দেখতে চাচ্ছিপরীক্ষার পর রিলিজ হবে তাে

জানি নাকাহিনীটা কি তুমি জান ?” 

রূপা এল সন্ধ্যার পর। 

কুচকুচে কালাে রঙের একটা টয়োটা গাড়ি রূপাকে নামিয়ে দিয়ে গেলরূপা দোতলায় উঠে এল লাবণ্যকে কোলে নিয়েবাইরে থেকে এলেই রূপা কিছুটা সময় লাবণ্যর সঙ্গে কাটাবে। 

রূপ লাবণ্যকে নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লআমার দিকে ফিরেও তাকাল নালাবণ্যর সঙ্গে কথাবার্তা এবং হুটোপুটি হতে থাকলআমি যে পাশেই আছি, তার কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছি, নিয়ে রূপার কোনাে মাথাব্যথা নেই ..

লাবণ্য সােনা, ভুনভুনা, খুনখুনা, ঝুনঝুনা

আপনি কি করছেন?” আমি কিছু করছি নাকে আপনাকে আদর করছে?তুমিতুমিটা কে ? তুমি হচ্ছ রূপারূপাকে তুমি কি ডাক?মামী ডাকিতােমার মামী কি সুন্দর? হ্যাঅল্প সুন্দর না খুব বেশি সুন্দর?খুব বেশি সুন্দরকিসের মতাে সুন্দর ?চাঁদের মতোচাঁদের কবিতাটা বলেন তাে লাবণ্য সােনা। 

বলব নাবলতে হবেনা, বলব নাবলতেই হবে, বলতেই হবে, বলতেই হবেবলব না, বলব নাতাহলে একটু হাসেনহাসব নাতাহলে একটু কাঁদেন প্লীজ, প্লীজপ্লীজ লাবণ্যকাঁদব নাতাহলে একটু নিচে গিয়ে বলুন তাে আমাকে এক কাপ চা দিতে। 

লাবণ্য নিচে চলে গেলআমার মনে হল আদরের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সেহাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, খবর কি

আমি বললাম, কোনাে খবর নেইসারাদিন ঘরেই ছিলে, না কোথাও গিয়েছিলে?| ঘরেই ছিলামআচ্ছা রূপা শােন, তুমি আমাকে বললে সেগুনবাগিচায় নামিয়ে দিতে, তারপর আমাকে না নিয়েই চলে গেলে

শেষ মুহূর্তে তােমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না। 

রূপা বাথরুমে ঢুকে গেলবাথরুম থেকেই বলল, সারাদিন ঘরে বসে আছি এটা তাে ভাল কথা নাবাইরে থেকে ঘুরেটুরে এসাে। 

কোথায় যাব ?” 

কোনাে বন্ধুর বাড়ি যাওতাসটাস খেলে এসােসারাক্ষণ ঘরে থাকলে কি হয় জান? সবার সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করেতােমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছ। 

অনেকদিন কারাের বাসায় যাওয়া হয় নাযেতে ইচ্ছা করে নাবন্ধুবান্ধব কারাের সঙ্গে দেখা হলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করিরিকশায় হুড উঠিয়ে চলাফেরা করিসেদিন মজিদ বাসায় এসেছিলআমি বলে পাঠালাম, বাসায় নেইঅথচ মজিদের সঙ্গে কথা বলে আমি আরাম পাইসে মজার কথা বলে খুব হাসাতে পারেএরকম হচ্ছে কেন আমি জানি নাবিয়ের পর মানুষ খানিকটা বদলায়, এতটা কি বদলায়? মুনিয়ার ধারণা, কাফকাগল্পের নায়কের মতাে আমার মেটামরফসিস হচ্ছেআমি ধীরে ধীরে মানুষ থেকে ফার্নিচার হয়ে যাচ্ছিআমি বললাম, কি ফার্নিচার হচ্ছি বলে তাের ধারণা ? সে বলল, তুমি খুব ধীরে ধীরে একটা ইজিচেয়ার হয়ে যাচ্ছ। 

সত্যি বােধহয় তাই হচ্ছিছিলাম মানুষ, হয়ে যাচ্ছি ইজিচেয়ার| আমি রূপাকে ঘরে রেখে অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হলামকোথায় যাব ঠিক করা নেইরাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটবমােড়ের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনলামদোকানদার আমার চেনাসে হাসিমুখে বলল, ভাইজানরে তাে 

আইজকাইল দেখি না। 

আমি কোনাে উত্তর দিলাম নাএক ধরনের অস্বস্তি বােধ করতে লাগলামব্যাটা কি কথার কথা বলছে না সত্যি সত্যিই লক্ষ করছে যে, আমি আজকাল ঘর থেকে কম বেরুচ্ছি। 

ভাইজানের শইল ভালাে তাে? আপনেরে কেমুন জানি কাহিল লাগতাছে। 

আমি এই কথারও জবাব দিলাম নাতার এই কথাটা সম্ভবত সত্যি, আমাকে কাহিল যে দেখাচ্ছে তা নিজেই বুঝতে পারছিকারণ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে নাপ্রায় জেগে জেগেই রাত পার করছিআমার পাশে শুয়ে রূপা এক ঘুমে রাত পার করে দিচ্ছেঅনিদ্রার রুগীরা সাধারণত দিনে ঘুমিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়আমার সেই 

অবস্থাও নেইদিনে আমি কখনাে ঘুমতে পারি না। 

সিগারেটের দোকানের সামনে থেকেই আমি রিকশা নিয়ে নিলামসেই রিকশা। 

নিয়ে চলে গেলাম সফিকের বাসায়জানি তাকে পাওয়া যাবে নাসে কখনো রাত দশটার আগে বাসায় ফেরে নাসফিককে না পাওয়াই ভালো, পাওয়া গেলে ঘণ্টা দুই সময় নষ্ট হবেদুঘন্টার আগে সে ছাড়বে নাসফিক বাসায় না থাকলেও জানবে আমি এসেছিলামএক ধরনের সামাজিকতা রক্ষা হবেআমি নিজেও খানিকটা স্বস্তি পাবাে যে অকারণে রিকশায় করে ঘুরছি নাকাজে যাচ্ছি। 

 সফিক বাসায় ছিল নাসফিকের ছোট বােন সুমি দরজা খুলে বিস্মিত গলায় বলল, মা কি সর্বনাশ, আপনি

সুমি এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেডাক্তারিতে ভর্তি হবার জন্য দিনরাত পড়াশােনা করছে। 

কেমন আছিস রে সুমি?আমি তাে ভালই আছিআপনি এরকম কঙ্কাল হয়ে গেছেন কেন? কঙ্কাল হয়ে গেছি ? আয়না নেই আপনার ঘরে ? তুই নিজেও তাে কঙ্কাল হয়ে গেছিসহেভি পড়াশােনা হচ্ছে? তা হচ্ছেতবে লাভ হবে নাগােল্লা খাবসফিককে ডেকে দে তোভাইয়া বাসায় নেইঢাকাতেও নেই, টাঙ্গাইল গেছেনটাঙ্গাইল কেন? সাহিত্য সভা, ভাইয়া হচ্ছে বিশেষ অতিথিবলিস কি! আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে খুব ঝােলাকুলি করছিল, আমি যাইনি। 

খুব ভাল করেছিসকোনাে বুদ্ধিমান লােক সাহিত্য সভায় যায় নাআচ্ছা, সুমি, আমি যাইপ্রধান অতিথি সাহেবকে বলিস আমি এসেছিলাম। 

এক সেকেণ্ডে দাঁড়ানদাদার একটা নতুন বই বের হয়েছেবইটা নিয়ে যানবই বেরিয়েছে মানে! বই লিখল কবে

বিয়ের পর তাে আপনি নিবাসিত জীবন যাপন করছেনভাইয়া বই লিখে ছাপিয়ে ফেলেছেবারােশ কপি ছাপিয়েছেবন্ধুবান্ধবকে ধরে ধরে জোর করে বই কেনাচ্ছেআপনার কাছে কি চল্লিশ টাকা আছে? চল্লিশ টাকা দিয়ে বই নিয়ে যানবিনা পয়সাতেই আপনাকে দিতামভাইয়া শুনলে রাগ করবে। 

চল্লিশ টাকা আমার কাছে আছেতুই বই নিয়ে আয়চা খাবেন

খান একটু, কি হবে খেলে? আপনি তাে আসেনই না, বিয়ের পর প্রথম এলেনবিয়ের পর প্রথম এলে মিষ্টি খাওয়াতে হয়ঘরে কোনাে মিষ্টি নেইচিনি খাবেন? এক চামচ চিনি এনে দিতে পারি। 

ফাজলামি ধরনের কথাসুমি আমার সঙ্গে ফাজলামি ধরনের কথা কখনাে বলে , আজ বলছেচোখমুখ কঠিন করেই বলছেতাকে ক্ষমা করে দিলাম কারণ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই মেয়েটি দুবছর আগে নপাতার একটি প্রেমপত্র লিখে রেজিস্ট্রি করে আমার নামে পাঠিয়েছিলপুরাে চিঠি পড়ার ধৈর্য ছিল নাদুতিন পাতা পড়েই আমার আক্কেল গুড়ুমকি সর্বনাশ! সফিকের বাসায় তিন মাস যাওয়া বন্ধ রাখলামতিন মাস পর যখন গেলাম সুমির সঙ্গে খুব স্বাভাবিক আচরণ করলামসুমি চা দিতে এসে ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি কি কোনাে রেজিস্ট্রি চিঠি পেয়েছেন

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আমাকে রেজিস্ট্রি চিঠি কে লিখবে? সুমি বিস্মিত হয়ে বলল, কোনাে চিঠি পাননি

আমি বললাম, না তাে! সুমির প্রণয় উপাখ্যানের এইখানেই সমাপ্তি। 

চায়ের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতেই সফিকের বাবা আইডিয়েল গার্লস স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক মােজাহার সাহেব এলেনযতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, ততবারই আমার মনে হয় তাঁর বয়েস অনেকখানি বেড়েছেআজ দেখি নিচের পটির একটা দাঁত পড়ে গেছেতিনি ভারি চশমার আড়ালে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কে, রঞ্জু

সফিকের খোঁজে এসেছ

বাসায় এসে তাকে পাবে নাবাসার সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্ক নাইসে গ্রামে গঞ্জে সাহিত্য করে বেড়াচ্ছেকেন্দুয়া উপজেলায় তার একটা চাকরি হয়েছিলউপজেলা হেলথ অফিসারসে চাকরি নিল নাতার নাকি ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব 

তাতে বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

আমি কিছু বললাম নাতিনি বিড়বিড় করে বললেন, হারামজাদা এখন দাড়ি কামানাে বন্ধ করে দিয়েছেঅনেক দিন পরে দেখলামচিনতে পারিনিএই অবস্থা! আবার শুনেছি এর মধ্যে নাকি একটা বই লিখে ছাপিয়ে ফেলেছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *