প্লেটো এর জীবনী

প্লেটো এর জীবনী

প্লেটো [খ্রীস্টপূর্ব ৩২৭- খ্রীস্টপূর্ব ৩৪]

সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল– মানুষের চিন্তা আর জ্ঞানের জগতে তিন উজ্জ্বল নক্ষত্র । সক্রেটিসের মধ্যে যে চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল, প্লেটো, অ্যারিস্টটল তাকেই সুসংহত দর্শনের রূপ দিলেন । তাঁরা শুধু যে গ্রীসের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক তাই নয়, সমগ্র ইউরোপের জ্ঞানের জগতে যুগপুরুষ । প্লেটো ছিলেন সেই সব সীমিত সংখ্যক মানুষদের একজন যারা ঈশ্বরের অকৃপণ করুণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে ।

অপরুপ ছিল তাঁর দেহলাবণ্য, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞানের প্রতি আকাঙ্ক্ষা, সক্রেটিসের মত গুরুর শিষ্যত্ব লাভ করা, সব কিছুতেই তিনি ছিলেন সৌভাগ্যবান । পিতা ছিলেন এথেন্সের বিশিষ্ট ব্যক্তি । কিন্তু আভিজাত্যের কৌলিন্য তাঁকে কোনদিন স্পর্শ করেনি । রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তিনি বরাবরই ছিলেন উদাসীন । বাস্তব জীবনের জটিলতা, সমস্যার চেয়ে জ্ঞানের সীমাহীন জগৎ তাঁর মনকে আরো আকৃষ্ট করত । ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক আর কল্পনাপ্রবণ । এক সময় এথেন্স সর্ববিষয়ে সমৃদ্ধ ছিল ।

প্লেটো এর জীবনী

প্লেটো যখন কিশোর সেই সময় সিসিলির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এথেন্স । এই যুদ্ধের পর থেকেই শুরু হল এথেন্সের বিপরযয়। দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হল স্বৈরাচারী শাসন । সমাজরে সর্বক্ষেত্রে দেখা দিল অবক্ষয় আর দুর্নীতি । প্লেটো বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা লাভ করেছে । তাঁদের কারোর কাছে শিখেছেন সংগীত, কারোর কাছে শিল্প, কেউ শিখিয়েছেন সাহিত্য আবার কারো কাছে পাঠ নিয়েছেন বিজ্ঞানের । সক্রেটিসের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই ছিল প্লেটোর গভীর শ্রদ্ধা । সক্রেটিসের জ্ঞান, তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতির প্রতি কিশোর বয়েসেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন । ২০ বছর বয়সে তিনি সক্রেটিসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন । তরুণ প্লেটো অল্পদিনের মধ্যেই হয়ে উঠলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য । গুরুর বিপদের মুহূর্তেও প্লেটো ছিলেন তাঁর নিত্য সঙ্গী ।

বিচারের নামে মিথ্যা প্রহসন করে সক্রেটিসকে হত্যা করা হল । সক্রেটিসের মৃত্যু হল কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞার আলো জ্বলে উঠল শিষ্য প্লেটোর মধ্যে । প্লেটো শুধু ‍যে সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন গুরুর জ্ঞানের ধারক-বাহক । গুরুর প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা খুব কম শিষ্যের মধ্যেই দেখা যায় । প্লেটো যা কিছু লিখেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর প্রধান নায়ক সক্রেটিস । এর ফলে উত্তর কালের মানুষদের কাছে একটা সমস্যার সৃষ্ট হয়েছে । সক্রেটিসকে কেন্দ্র করে প্লেটো তাঁর সব সংলাপ তত্ত্বকথা প্রকাশ করেছেন । সবসময়ই প্লেটো নিজেকে আড়ালে রেখেছেন- কখনোই প্রকাশ করেননি । সক্রেটিসের জীবনের অন্তিম পর্যায়ের যে অসাধারণ বর্ণনা করেছেন প্লেটো তাঁর “সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন” গ্রন্থে,জগতে তাঁর কোন তুলনা নেই ।

প্লেটো এর জীবনী

প্লেটোর মত প্রতিভাবান পুরুষ যে শুধুমাত্র সক্রেটিসকে অন্ধ অনুসরণ করে তাঁর অভিমতকেই প্রকশ করেছেন, এ কথা মেনে নেওয়া কষ্টকর । তাঁর কথোপকথনগুলি দীর্ঘকাল ধরে রচনা করা হয়েছে । প্লেটোর মত একজন মহান চিন্তাবিদ দার্শনিক সমস্ত জীবন ধরে শুধু সক্রেটিসের বাণী প্রচার করবেন, একথা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না । তাই পণ্ডিত ব্যক্তিদের ধারণা, প্লেটো তাঁর নিজের অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন ।

তাঁর এই সব অভিমতের উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে সক্রেটিসের জীবন ও তাঁর বাণী । গুরুর মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন প্লেটো । তার কয়েক বছরের মধ্যেই এথেন্সে স্পার্টার হাতে সম্পূর্ণ হাতেবিধ্বস্ত হল । আর এথেন্সে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে বেরিয়ে পড়লেন । তিনি যখন যে দেশেই গিয়েছেন সেখানকার জ্ঞানী-গুণী- পণ্ডিতদের সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন । এতে একদিকে যেমন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের প্রসার ঘটছিল, অন্যদিকে তেমনি পণ্ডিত দার্শনিক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারদিক । দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রবাসে জীবন কাটিয়ে অবশেষে ফিরে এলেন এথেন্সে ।

প্লেটো এর জীবনী

মহান গুরুর মহান শিষ্য । ভ্রমর যেমন ফুলের সুবাসে চারদিকে থেকে ছুটে আসে দলে দলে, ছাত্ররা এসে ভিড় করল প্লেটোর কাছে । সক্রেটিস শিষ্যদের নিয়ে প্রকাশ্য স্থানে গিয়ে শিক্ষা দিতেন কিন্তু প্লেটোর একটি উন্মক্ত কল-কোলাহলে শিক্ষাদানকে মেনে নিতে পারতেন না । নগরের উপকন্ঠে প্লেটোর একটি বাগানবাড়ি ছিল, সেখানেই তিনি শিক্ষাকেন্দ্র খুললেন, এর নাম দিলেন একাডেমি । এই একাডেমির ছাত্রদের কাছেই প্লেটো উজাড় করে দিলেন তাঁর জ্ঞান চিন্তা মনিষী ।

তাঁর জীবনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা হল সিসিলি দ্বীপের শাসকদের আহ্বানে তিনি উপদেষ্টা হিসাবে সেখানে যান । তিনি চেয়েছিলেন সিসিলিকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গঠক করতে । দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার সাথে রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তাভাবনার কোনদিনই  মিল হয় না । তাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে এলেন এথেন্সে । তাঁর এই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন রিপাবলিক- এক আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে ।

প্লেটো এর জীবনী

আসরে প্লেটোর আগে দর্শনাশাস্ত্রের কোন শৃঙ্খলা ছিল না । তিনিই তাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করলেন । তাকে নতুন ব্যঞ্চনা দিলেন । তিনি জীবনব্যাপী সাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষকে দিয়েছেন এক নতুন প্রজ্ঞার আলো । ইউরোপ তাঁকে বর্জন করলেও আরবরাও তাঁকে গ্রহণ আদর্শবাদ । ইউরোপের মানুষের চিন্তাভাবনা মননের জগতে যে দু’জন মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভব বিস্তার করেছিলেন, তাঁদের একজন প্লেটো, অপরজন অ্যারিস্টটল ।

প্লেটোর চিন্তাবাভনা তাঁর যুগকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে এক চিরকালীন সত্য । প্লেটোর চিন্তাভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে । বিশ্ব সাহিত্যের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ । যদিও বইখানিতে মূলত রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনে এখানে নানান প্রসঙ্গ এসেছে । মানব জীবন এবং সমাজ জীবনে যা কিছু প্রয়োজন-শরীরচর্চা, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, এমনকি সু-প্রজনন বিদ্যা-এছাড়াও কাব্য অলঙ্কার নন্দন তত্ত্ব এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ।

প্লেটো এর জীবনী

প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন – (১) শাসক সম্প্রদায়, (২) সৈনিক, (৩) জনসাধারণ ও ক্রীতদাস । রাষ্ট্র তখনই সুপরিচালিত হয় যখন তিনি বিভাগের কাজের মধ্যে সুসামঞ্জস্য বর্তমান থাকে এবং প্রত্যেকেই তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে । তিনি বলেছেন শাসক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন জ্ঞান, শাসন ক্ষমতা-সৈনিকদের চাই সাহস বীরত্ব, জনগণের প্রয়োজন সংযম ও শাসকদের প্রতি আনুগত্য । রাষ্ট্রের উন্নতি-অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে শাসকদের উপর । তাই প্লেটো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন  শাসক নির্বাচনের উপর ।

তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোন স্বৈরাচারীর স্থান নেই । ”রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শুধু জীবন ধারণের জন্য নয় । যতদিন মানুষ জীবিত থাকবে ততদিনই সে শ্রেষ্ঠ জীবন যাপন করবে ।” তাঁর রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চ-নীচের ভেদ থাকবে না, থাকবে পারস্পরিক সৌহার্দ ও প্রীতির সম্পর্ক । দি লস গ্রন্থে তিনি বলেছেন, নগরবাসীরা সকলে পরস্পরকে জানবে বুঝবে । এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর কিছুই হতে পারে না ।

প্লেটো এর জীবনী

সুপ্রজনন বিজ্ঞান, প্রাচীন গ্রীসের মানুষেরা সুস্থ সবল দেহের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত । তার দূর্বল অসুস্থ শিশুকে জীবিত রাখবার পক্ষপাতি ছিলেন না । প্লেটো এই অভিমত সমর্থন করতেন । তাই তিনি বলেছেন, যাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্থ তাদের কোন সন্তান প্রজনন করা উচিত নয় । আপাত দৃষ্টিতে প্লেটোর অভিমত নিষ্ঠর বলে মনে হলেও সামাজিক বিচারে তা একেবারে মূলহীন নয় । সংগীতের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর আকর্ষণ । তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীত মানব জীবনকে পূর্ণতা দেয়, মানবিক গুণকে বিকশিত করে । নারীদের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীল শ্রদ্ধা ।

তাদের শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি উদার নীতিতে বিশ্বাস করতেন । সেই যুগে অনেক মহিলাই পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন । তিনি মনে করতেন পুরুষেরা অহমিকাবশত নারীদের উপেক্ষা করে । গ্রীসের পুরুষদের এই অহমিকা প্লেটোকে স্পর্শ করেনি । তিনি দেখেছেন বিভিন্ন গ্রীক মনীষীদের প্রেরণার উৎসই হচ্ছে নারী । প্লেটো তাঁর আইন সমস্ত শিক্ষার মধ্যে দিয়ে এক আদর্শ রাষ্ট্র, মানব সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ।

প্লেটো এর জীবনী

জীবনের অন্তিম পর্বে এসে বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে উপলব্ধি করেছিরেন, রিপাবলিকের মধ্যে তিনি যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তা কোনদিনই বাস্তব হওয়া সম্ভব নয় । তাই তিনি লিখলেন তাঁর ‘আইন’ (Laws) গ্রন্থ । এতে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন, তাঁর কল্যাণের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রের আদর্শের কথা বলেছেন । 

দার্শনিক প্লেটোর আরেক দিক তাঁর কবিসত্তা । তাঁর প্রবন্ধগুলির মধ্যে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জ্ঞান, গভীরতা, প্রজ্ঞা, অন্যদিকে ফুটে উঠেছে অনুপম লালিত্য । দর্শনের ভাষা যে এমন প্রাণবন্ত, কাব্য সৌন্দয্যে অতুলনীয় হয়ে উঠতে পারে, প্লেটোর রচনা না পড়লে তা অনুভব করা যায় না । প্লেটো কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না কিন্তু তাঁর রচনার মধ্যে কবি আর দার্শনিকসত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেয়েছে ।

তাই তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শকি রাসেল বলেছেন, “প্লেটো শুধু ভাবুক ছিলেন না, ছিলেন কলাকুশলী । তাঁর প্রতিটি রচনাই সাহিত্যিক নিপুণতার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন । কোথাও তাঁর রচনা নাটকীয়, কোথাও ঐতিহাসিক ঘনঘটায় আচ্ছন্ন । ভোরের আলোছায়ার মত তাঁর রচনায় হাস্যরস, গাম্ভীর্য, করুণ রস একই সাথে পরস্পরকে অনুগমন করেছে । বিষয় বৈচিত্রের রননাশৈলীর সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতায় প্লেটোর নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টদের পাশে অমর হয়ে থাকবে ।” 

প্লেটো এর জীবনী

প্লেটো ছিলেন একেশ্বরবাদী । তাঁর ঈশ্বর মঙ্গলময়, তিনি মানুষের কল্যাণ করেন। তিনি পূজা পাঠ উপাসকাকে স্বীকার করেননি । তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রদ্ধা আর পবিত্র চরিত্র । সেই সাথে প্রজ্ঞা, জ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের পূজা করতে হয়। একদিন তাঁর এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন ।  সেখানকার কলকোলাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন । বিশ্রাম নেবার জন্য পাশের ঘরে গেলেন কিন্তু আনন্দ উল্লাসের শব্দ ক্রমশই বেড়ে চলছিল । উপস্থিত সকলেই ভুলে গিয়েছিল বৃদ্ধ দার্শনিকের কথা । এক সময় বিবাহ শেষ হল । নব দম্পতি আর্শীবাদ গ্রহণের জন্য প্লেটোর কক্ষে প্রবেশ করল । প্লেটো তখন গভীর ঘুমে অচেতন । পৃথিবীর কোন মানুষের ডাকেই সে ঘুম ভাঙবে না।

 

সক্রেটিস এর জীবনী

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *