পাশের তিন-চার খানা ফ্ল্যাটে খোঁজ করা হল, পাথরের থালা আছে কি না। নেই। সকলেরই স্বামী-স্ত্রী আর একটা-দুটো বাচ্চার ছিমছাম সংসার। ঠাকুমা-দিদিমাদের অস্তিত্ব নেই, সুতরাং পাথরের থালায় আর কে খাবে এখন। তা ছাড়া, আজকাল বয়স্কা বিধবারাও স্টেইনলেস স্টিলের থালায় ভাত খান!
পাথরের থালা পাওয়া গেল না বলে বাজার থেকে কিনে আনা হল কলাপাতা। তাতে খাবার দেওয়া হল স্বামীজিকে। লুচি, ফুলকপির তরকারি, বেগুন ভাজা, পটলের দোলমা, দই, মিষ্টি। স্নান সেরে খাবারের জায়গায় এসে ওই রকম আয়োজন দেখে সন্ন্যাসী বললেন, এ কি, কলাপাতা কেন?
এ-বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া হয় টেবিল-চেয়ারে। সব ফ্ল্যাট বাড়িতেই তাই। কিন্তু স্বামীজির জন্য বসবার জায়গায় কার্পেট তুলে সেখানটা ভালো করে মুছে একটা পশমের আসন পাতা হয়েছে। জল দেওয়া হয়েছে কাঁসার গেলাসে। দু-চারটে কাঁসার বাসন এখনও রয়ে গেছে মঞ্জুলির কাছে, পশমের আসনটি ধার পাওয়া গেছে পাশের ফ্ল্যাটের ওড়িয়া পরিবারটির কাছ থেকে।
স্বামীজি বললেন, আমার জন্য এরকম আলাদা ব্যবস্থা কেন, তোমাদের সঙ্গেই বসে খেতে পারতুম।
মঞ্জুলি বলল, না, না, আপনি বসুন, আমরা পরে খাব।
নীতিশ বলল, আপনি তো খাওয়ার সময় কথা বলেন না, মাঝখানে কিছু নেনও না। আর কিছু লাগবে? আর দু-খানা লুচি দিক?
স্বামীজি খোলা গলায় হা-হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, হাঁ লাগবে, দুটো কাঁচা লঙ্কা!
স্বামীজি মানে নীতিশের দ্বিজুমামা। তার মায়ের মামাতো ভাই। নীতিশের মনে আছে এক সময় এই দ্বিজু মামা খুব ভালো টেবিল টেনিস খেলতেন, বিহার ক্যাডারের আই এ এস পরীক্ষা দিয়ে এক সময় দ্বারভাঙ্গার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যান! সে প্রায় দশ-বারো বছর আগেকার কথা।
হিসেব অনুযায়ী বছর পঞ্চাশেক বয়েস, কিন্তু সুন্দর, মজবুত চেহারা। এককালে যে খেলোয়াড় ছিলেন তা বোঝা যায়! গায়ের রং-ও যেন আগের চেয়ে ফরসা হয়েছে, সাত্বিক খাওয়া-দাওয়া। করলে বোধহয় এরকম রং ফরসা হয়। মাথার চুল পাকেনি। দাড়ির মধ্যে একটু-আধটু রূপোলি ঝিলিক আছে। গেরুয়া লুঙ্গি ও গেরুয়া চাদর পরা।
সন্ন্যাসীদের নাম ধরে ডাকতে নেই, তাই নীতিশ আর ওঁকে দ্বিজুমামা বলে না। সন্ন্যাসীরা কারুর মামা, কাকা, পিসেও থাকেন না, সেইজন্য ওঁকে কী বলে ডাকবে তাই নিয়ে নীতিশ একটু সমস্যায় পড়েছিল। মঞ্জুলিই প্রথম স্বামীজি বলে সম্বোধন করে। নীতিশ অবশ্য আড়ালে এখনও প্রায়ই দ্বিজুমামা বলে ফেলে।
হৃষীকেশে থাকেন স্বামীজি, চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে কয়েকদিনের জন্য তিনি কলকাতায় আসবেন এবং নীতিশের কাছেই উঠবেন। কেন কলকাতায় আসবেন, সে কথা লেখেননি, নীতিশের ঠিকানা কী করে জানলেন তাই বা কে জানে। মাত্র তিন বছর হল নীতিশ এই নতুন। ফ্ল্যাটে এসেছে। চিঠিতে উনি স্বামী প্রণবানন্দ নামে সই করেছিলেন, দ্বিজুমামার এই নতুন নাম নীতিশ আগেই শুনেছিল।
আসনের ওপর দাঁড়িয়ে স্বামীজি বললেন, তোরা লুচি খাওয়াচ্ছিস। অনেকদিন কাঁচা মুগের ডাল দিয়ে সেদ্ধ চালের ভাত খাইনি। ওদিকে তো সেদ্ধ চাল পাওয়াই যায় না—তাছাড়া আশ্রমে রুটিই খাই।
মঞ্জুলি বলল, ওমা, আপনি ভাত খাবেন তা তো জানতুম না, আমার মামাবাড়িতে একজন স্বামীজি আসতেন আগে, তিনি কোনও বাড়িতে এঁটো রান্না খান না শুনেছিলুম।
স্বামীজি বললেন, ভাত হলেই এঁটো আর লুচি এঁটো নয়, এসব কথা তোকে কে শিখিয়েছে? আমি সব খাই, বুঝলি, মাছ-মাংস ছাড়া। অনেকদিনের অভ্যাস তো, মাছ-মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
খাওয়ার সময় উনি কথা বলেন না ঠিকই। নীতিশ এটা কোথা থেকে জানল? সাধু হওয়ার পর দ্বিজুমামাকে সে একবারও দেখেনি। এমন কি বিয়ের পর যেবার মঞ্জুলিকে নিয়ে সে দিল্লি হরিদ্বার যায়, সেবারও তার এই সাধু হয়ে যাওয়া মামার খোঁজ করার কথা তার মনে আসেনি। আর কোনও সাধু-সন্ন্যাসীও কখনও আসেনি নীতিশের বাড়িতে।
মঞ্জুলিই বা কী করে জানল যে সন্ন্যাসীদের পাথরের থালায়, নিদেনপক্ষে কলাপাতায় খাবার দিতে হয়? স্টেইনলেস স্টিল বা কাচের গেলাসের বদলে কাঁসার গেলাসে জল দিলে সাত্বিক দেখায়? জানবার কথা নয় মঞ্জুলির। সে সিগারেট খায়, স্বামীর সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে নাচে, দু-তিন বোতল বিয়ার উড়িয়ে দেওয়া তার পক্ষে কিছুই না, সে ইংরেজি গান গাইতে পারে। মঞ্জুলি পড়ায় লরেটো কলেজে। এখন সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে খাঁটি বাঙালি গৃহবধূর ভঙ্গিতে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
খাওয়া শেষ করার পর স্বামীজি এক মিনিট চোখ বুজে কোনও স্তব পাঠ করলেন। তারপর চোখ মেলে বললেন, তোদের বাড়িতে পানের ব্যবস্থা নেই নিশ্চয়ই?
মঞ্জুলি জিগ্যেস করলেন, আপনি পান খাবেন? আনিয়ে দিতে পারি!
স্বামীজি বললেন, ঠিক এগারো বছর আট মাস একটাও পান খাইনি! আজ একটা খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।
নীতিশ বললেন, এক্ষুনি আনিয়ে দিচ্ছি। দোকান থেকে সাজা পান কিনে আনলে…আপনার খেতে আপত্তি নেই তো?
স্বামীজি দার্শনিকভাবে বললেন, সারা পৃথিবী জুড়েই তো রয়েছে একটা দোকান। যতদিন বাঁচা, ততদিনই দোকানদারির ওপরে ভরসা। এই যে কাপড়খানা পরে আছি, তাও তো দোকানের।
নীতিশ আর মঞ্জলির দুটি পুত্র সন্তান, দুজনেই পড়ে দার্জিলিং-এ। নীতিশ নিজে দার্জিলিং স্কুলে পড়েছে বলে ওই স্কুলের ওপর তার দারুণ ভক্তি। অফিসের কাজে তাকে মাসে অন্তত দুবার শিলিগুড়ি যেতে হয়। সুতরাং তখন ছেলেদের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারে। মঞ্জুলিকেও সে নিয়ে যায় প্রায়ই।
ছেলেদের ঘরখানাই পরিষ্কার করে, খাটের ওপর নতুন চাদর পেতে স্বামীজির জন্য বিছানা করা। হয়েছে। স্বামীজি অবশ্য তখুনি শুতে গেলেন না, তিনি বললেন, তোমরা আগে খেয়ে নাও, তারপর একটু গল্প গুজব করা যাবে!
প্রাণতোষ নামে কাজের লোকটি পান আনতে যাওয়ার সময় জিগ্যেস করল, কী পান আনব? সাদা না জর্দা?
স্বামীজি বললেন, খাচ্ছিই যখন, তখন জরদা পানই খাওয়া যাক।
নীতিশ একটু চিন্তিত ভাবে বলল, অভ্যেস না থাকলে কিন্তু জরদা খেলে মাথা ঘোরে।
স্বামীজি হেসে বললেন, দেখাই যাক না!
স্বামীজি গিয়ে দাঁড়ালেন বারান্দায়, নীতিশ আর মঞ্জুলি চটপট খাওয়া সেরে নিল। আজ ওদের খাবার নিরামিষ। মঞ্জুলি ভেবেছিল, কী জানি, একই রান্নাঘরে মাছ মাংস রান্না করলে যদি স্বামীজির খাবার অপবিত্র হয়ে যায়!
নীতিশ আজ অফিসে যায়নি। নিতান্ত অসুস্থ হয়ে না পড়লে নীতিশ কখনও অফিস যাওয়া বন্ধ। করে না। ঝড়-বৃষ্টি-ভূমিকম্পও সে অগ্রাহ্য করে। নীতিশের বাবা-মা থাকেন এলাহাবাদে। ওর মামা বাড়ি পাটনা। অর্থাৎ ওরা প্রবাসী বাঙালি। এলাহাবাদ থেকে বাবা এসে কয়েকদিন থেকে যান নীতিশের কাছে। সে উপলক্ষে নীতিশ একবারও অফিস কামাই করেনি! এমনকী হয়তো বাবা আসবার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন, সেই সময়ই নীতিশকে টুরে যেতে হবে। নীতিশ চলে যায়, বাবার সঙ্গে দেখাই হয় না।
অনেকদিন দেখা হয় না যে মামার সঙ্গে, নিতান্ত তিনি সন্ন্যাসী বলেই তাঁর সম্মানে নীতিশ আজ বাড়িতে থেকেছে।
মঞ্জুলিও অনেকদিন পর নিজের হাতে লুচি বেলেছে, ভেজেছে। তাদের কাজের লোকটি ব্রাহ্মণ নয়, যদি তার হাতের রান্না স্বামীজি না খান?
পানটা মুখে দেওয়ার একটু পরেই স্বামীজি বুকে চেপে ধরলেন। তার মাথা ঘুরছে, দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। এক শো বিশ জরদার তেজ তিনি সহ্য করতে পারবেন কেন?
নীতিশ বলল, এই রে! মুখ ধুয়ে ফেলুন! জল খান!
কোনও কথা না বলে হাত উঁচু করে স্বামীজি ইঙ্গিত জানালেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে!
নীতিশ আর মঞ্জুলি উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে রইল। একটু বাদে স্বামীজি ধাতস্থ হয়ে বললেন, বেশ ভয় পাওয়ারই মতন ব্যাপার। তবে, সহ্য করা যায় ঠিকই। সবই সহ্য করা যায়!
তারপর মঞ্জুলির চোখে চোখ রেখে বললেন, তোমার কীসের দুঃখ?
মঞ্জুলি অবাক হয়ে বলল, আমার? দুঃখ? তার মানে?
স্বামীজি বললেন, তুমি ভেতরে-ভেতরে কীসের যন্ত্রণায় যেন জ্বলছো!
মঞ্জুলি হেসে বলল, কই না তো!
দেখি তোমার হাতটা!
মঞ্জুলি আধুনিক মেয়ে, সে হাত দেখা, ঠিকুজী-কুষ্ঠি, গ্রহ-নক্ষত্রের বিচার কিছুই বিশ্বাস করে না। তবু সে বাড়িয়ে দিল তার হাতটা।
স্বামীজি অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন, তারপর কোনও মন্তব্য না করেই ছেড়ে দিলেন। মঞ্জলিও জিগ্যেস করল না কিছু।
নীতিশ বলল, আমার হাতটাও দেখবেন নাকি?
স্বামীজি বললেন, না, তোর সব ঠিক আছে।
নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে গিয়ে স্বামীজি বসলেন খাটের ওপর। দুটো চেয়ারে মঞ্জুলি আর নীতিশ। সিগারেট খাওয়ার জন্য নিশপিশ করছে নীতিশের হাত কিন্তু এখন সম্ভব নয়।
তুই সিগারেট খেতে পারিস!
রীতিমতন চমকে উঠল নীতিশ। দ্বিজুমামা কি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেন? সত্যিই এরকম অলৌকিক ক্ষমতা থাকে কারুর?
দে দেখি তোর সিগারেট আমাকে!
আপনি সিগারেট খাবেন?
কল্কেতে গাঁজা খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে, তা এখানে আর গাঁজা পাওয়া যাবে কোথায়? তাই একটা সিগারেটই খাই।
মঞ্জুলি বলল, সাধু হলেই কল্কেতে গাঁজা খেতে হয় বুঝি?
স্বামীজি বললেন, পাহাড়ি জায়গা, শীত তো, মন্দ লাগে না। প্রথম-প্রথম আমি খেতাম না। ত্রিযুগীনারায়ণে এক সাধুজি আমায় বললেন, তোর মন চঞ্চল, একটু গাঁজা টেনে দ্যাখ, মন স্থির হবে।
স্বামীজিকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজেরটা ধরাল নীতিশ। তারপর মঞ্জুলিকে জিগ্যেস করল, তুমি নেবে?
দু-চোখে ভৎসনা মাখিয়ে মঞ্জুলি দু-দিকে মাথা নাড়ল। তারপরই স্বামীজিকে বললেন, আপনি হঠাৎ একদিন কেন সাধু হয়ে চলে গেলেন, তা আমরা কেউ জানি না। সেই গল্পটা বলবেন? অবশ্য যদি বাধা না থাকে—
স্বামীজি বললেন, গল্প তো কিছু নেই। কোনও আঘাত পেয়ে আমি সংসার ছাড়িনি। কোনও দৈব স্বপ্নও দেখিনি। দীক্ষাও নিইনি কোনও গুরুর কাছে। এমনিই! যখন চাকরিতে ছিলাম, ভীষণ। কাজ করতে হত আমাকে। কাজ, কাজ, দিনরাত কাজ, ঠিক যেন পাগলের মতোন অবস্থা। তাই হঠাৎই একদিন ঠিক করলাম, সব ছেড়ে ছুড়ে নির্জন কোনও জায়গায় চলে যাব। যেখানে একটু। শান্তি পাওয়া যাবে। আমি শুধু শান্তি চেয়েছি।
মঞ্জুলি জিগ্যেস করলেন, শান্তি পেয়েছেন?
দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে স্বামীজি উদাসীন ভাবে বললেন, হ্যাঁ, পেয়েছি, অদ্ভুত শান্তি। এ শান্তি যেন সমস্ত শরীর আর মন ভরিয়ে দেয়। সারাদিন কোনও দুশ্চিন্তা নেই, আকাশ, নদী, পাহাড় যেদিকেই তাকাই চোখ ভরে যায়। স্বামীজির কথার মধ্যে অনেকটা বক্তৃতার সুর এসে যাচ্ছে বলে মঞ্জুলি একটা ছোট্ট হাত তুলল।
নীতিশ বলল, আপনি একটু বিশ্রাম নিন।
স্বামীজি বললেন, হ্যাঁ। শুধু আর একটা কথা বলি। কয়েক বছর পাহাড়ে থাকবার পর দেখলুম, শান্তি পাওয়াও একটা অভ্যেসের মতন দাঁড়িয়ে যায়। প্রত্যেকদিন সব কিছুই এক। সেই ভোরবেলা স্নান করা, তারপর জপ, তারপর সারা দিনরাতে একবারও ঈশ্বরের কথা মনে পড়ে না। চোখ বুজে থাকলেও মনে পড়ে না।
নীতিশ আর মঞ্জুলির কেউই ঈশ্বর নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। ওরা উঠে দাঁড়াল।
স্বামীজি এবার হেসে বললেন, আমি হঠাৎ কলকাতায় এলাম কেন, সে বিষয়ে আমায় কিছু জিগ্যেস করলে না?
নীতিশ বলল, বাঃ, আপনি এমনিই বেড়াতে আসতে পারেন না?
স্বামীজি বললেন, না, বেড়ানো নয়…কিন্তু থাক সে কথাটা এখন বলব না।
নিজেদের ঘরে এসে মঞ্জুলি শাড়িটা খুলে ফেলল। বাড়িতে সে সাধারণত একটা ঢোলা সেজিম তার ওপরে একটা হাউস কোট পরে থাকে। শোওয়ার সময় শাড়ি পরে থাকলে তো তার রীতিমতো অস্বস্তিই হয়। আজ সন্ন্যাসীর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য সে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছিল।
নীতিশ বলল, দ্বিজুমামা হঠাৎ কলকাতায় এলেন কেন বলো তো?
সে কথায় সরাসরি উত্তর না দিয়ে মঞ্জুলি বলল, উনি কি আগে হাত দেখতে জানতেন?
ঠিক জানি না। তবে আগে ধর্ম-টর্মর দিকে কোনও ঝোঁক ছিল বলে শুনিনি।
সাধু হলেই কি হাত দেখা শিখে যায়। উনি আমার হাত দেখতে চাইলেন কেন বুঝতে পারলুম না।
বোধহয় তোমার কোনও গোপন কথা জেনে ফেলেছেন।
বিকেলবেলা স্বামীজিকে ঘরে খুঁজে পাওয়া গেল না। ফ্ল্যাটেও নেই। তবে কি ছাদে গেলেন? সন্ধেবেলা নির্জনে জপতপ করা অভ্যেস।
প্রাণতোষ বলল, সাধুবাবা তো বেরিয়ে গেলেন দেখলুম!
স্বামীজি ফিরলেন রাত সাড়ে আটটায়।
নীতিশ ব্যস্ত হয়ে কয়েকবার তাঁর খোঁজাখুঁজি করেছে, পুলিশে খবর দেবে কি না চিন্তা করছিল।
স্বামীজি বললেন, একটু ঘুরে এলাম কলকাতার রাস্তাঘাট দিয়ে। বারো বছর পাহাড়-পর্বতে আছি, মনে হল অভ্যেসটা একটু পালটানো দরকার। একসময় কলকাতার সব রাস্তা চিনতুম, এখন দেখছি, সবই প্রায় ভুলে গেছি। কত নতুন রকম বাড়ি উঠেছে।
নীতিশ বলল, প্রথম দিনটা আপনি একা না বেরুলেই পারতেন। আমি আপনাকে ঘুরিয়ে আনতাম।
স্বামীজি বললেন, না, আমি একাই ঘুরতে চাই। তবে, মনে হল কলকাতার লোক গেরুয়া কাপড় পরা মানুষদের বিশেষ পছন্দ করে না! কী রকম যেন ব্যাঁকা-বাঁকা ভাবে তাকায়। ট্রামে উঠেছি, একজন লোক ইচ্ছে করে পা মাড়িয়ে দিল!
হেসে উঠল মঞ্জুলি।
নীতিশবলল, বাসে ট্রামে যা ভিড়, কেউ না কেউ পা মাড়িয়ে দেবেই।
মঞ্জুলি বলল, আপনি গলায় একটা গাঁদা ফুলের মালা পরে কয়েকজন ভক্ত-টক্ত সঙ্গে নিয়ে বসুন, দেখবেন, অমনি কত ভিড় হবে। গ্র্যান্ড হোটেলে প্রেস কনফারেন্স করুন, দারুণ বড়লোকেরা এসে আপনার শিষ্য হতে চাইবে। বড়-বড় সাধুরা কলকাতায় ট্রামে-বাসে চাপে না, গাড়ি চড়ে ঘোরে।
নীতিশ বলল, আর একবার যদি রটিয়ে দেওয়া যায়, আপনি হাত দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বিশেষ করে রেস খেলার হার জিৎ আগে থেকে বলে দিতে পারেন, তাহলে তো, আর কথাই নেই!
স্বামীজি মুখ নীচু করে রইলেন। তারপর বললেন, তোর একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা দিস তো, তাই পরে বেরুব!
আপনাদের কি গেরুয়া ছাড়া অন্য পোশাক পরতে আছে?
আমি তো কারুর কাছে দীক্ষা নিইনি। নিজের ইচ্ছেয় সন্ন্যাসী হয়েছি। আমায় যখনই কেউ জিগ্যেস করে, তোমার গুরু কে? আমি হিমালয় পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলি, ওই যে আমার গুরু!
নিজের ব্যবহৃত পাজামা-পাঞ্জাবি নয়, পরদিন সকালেই একজোড়া পাজামা আর পাঞ্জাবি কিনে আনল নীতিশ। তার মা মামা বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন ছেলেবেলায়, সুতরাং ওঁদের কাছে নীতিশরা ঋণী।
সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরার পরই স্বামীজির চেহারাটা যেন একেবারে বদলে গেল।
মঞ্জুলি বলল, এবার দাড়ি গোঁফ কেটে ফেলুন!
নাঃ! এর ওপর বড্ড মায়া পড়ে গেছে। যখনই মনটা চঞ্চল হয়, তখন দাড়িতে হাত বুলালে বেশ ভালো লাগে।
নীতিশ বলল, এরকম চুল দাড়িওয়ালা লোক কলকাতায় অনেক আছে। ছেলে-ছোকরারাও তো দাড়ি রাখে এখন। কিন্তু আপনাকে আর সন্ন্যাসী বলে মনেই হচ্ছে না, দ্বিজুমামা বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
তাই ডাকিস!
একটা কথা বলব, দ্বিজুমামা? কলকাতায় রাস্তায় ঘুরবেন, হাতে কিছু টাকা পয়সা থাকা দরকার। আপনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে রাখবেন,…ইয়ে ধার হিসেবে।
মঞ্জুলি বলল, ধ্যাৎ কোনও সাধু কখনও টাকা ধারেন নাকি?
স্বামীজি হাসতে লাগলেন।
নীতিশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, আমি ঠিক সেই হিসেবে বলিনি, মানে এমনিই কিছু টাকা পয়সা সঙ্গে না থাকলে–
স্বামীজি বললেন, এরপর তোরা ভাববি, এ লোকটা আর কতদিন ঘাড়ে চেপে থাকবে? ভয় নেই, বেশীদিন না, আমি শুধু একটা পরীক্ষা করতে এসেছি নিজের সঙ্গে–
মঞ্জুলি বলল, আমায় জিগ্যেস করেছিলেন, আমার কী কষ্ট! এবার আমারই জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে, আপনার কী কষ্ট!
স্বামীজি এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন মঞ্জুলির দিকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানি না।
পরমুহূর্তেই মেজাজ পালটে তিনি বললেন, একটা মজার ব্যাপার কি জানিস, নিতু! যখন আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, একেবারে সহায় সম্বলহীন হয়ে যাইনি। এক হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, যদি লাগে। সে টাকা খরচ হয়নি, প্রায় সব টাকাটাই আমার কাছে এখনও রয়ে গেছে। আমার পোঁটলার মধ্যে ওই টাকা পড়ে থাকত যেখানে-সেখানে, কেউ নেয়নি।
নীতিশ বলল, কলকাতায় কিন্তু অত টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন না। পকেটমার হয়ে যেতে পারে।
পাজামা-পাঞ্জাবি পরা স্বামীজি একা-একা কলকাতায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলেন। এম.এ. পড়ার সময় দু-বছর ছিলেন কলকাতায়, অনেকদিন আগের কথা, একটু-একটু মনে পড়ে। ময়দানে ফুচকা খাওয়া, গঙ্গার ধারে শুয়ে থাকা। সেইসব জায়গায় ঘুরতে লাগলেন তিনি।
তারপর সেন্ট্রাল এভিনিউ ধরে চলে এলেন বিশেষ একটি পাড়ায়। একবার বন্ধুদের সঙ্গে এখানে এসেছিলেন তিনি, জায়গাটা ঠিক যেন আগের মতোনই আছে।
সেদিন মঞ্জুলির হাতটা ধরার সময় তাঁর শরীরটা ঝনঝন করে উঠেছিল। হাত দেখা তিনি একটু আধটু জানেন। মঞ্জলির মুখ দেখে মনে হয়েছিল, সত্যিই ওর কিছু একটা চাপা কষ্ট আছে। কিন্তু হাত দেখার ব্যাপারটা অন্য রকম হল। তিনি কররেখা দেখতে পেলেন না, ঝাপসা হয়ে এসেছিল তাঁর চোখ। ঠিক বারো বছর পর তিনি কোনও রমণীকে স্পর্শ করলেন। ভেবেছিলেন সারা জীবনই নারী সংসর্গ থেকে দূরে থাকবেন। কোনওদিন এজন্য অভাব বোধও ছিল না। তাহলে কেন এমন হল? এটা একবার ভালো করে যাচাই করে দেখা দরকার।
অন্তত পঁচিশ বছর আগে বন্ধুদের সঙ্গে তিনি যে বাড়িটায় গিয়েছিলেন, ঠিক সেই বাড়িটার সামনে গিয়েই দাঁড়ালেন। দোতলার ডান দিকের কোণের ঘর, তাঁর ঠিক মনে আছে।
আবছা আলোয়, ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন দোতলায়। আশা করেছিলেন যেন সেই মেয়েটিকেই দেখবেন। একই চেহারায়। কিন্তু পঁচিশ বছর কেটে গেছে, অন্য একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, একটু বেশি জমকালো পোশাক। স্বামীজিকে আপাদমস্তক দেখে সে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করল।
স্বামীজি হিন্দি জানেন বাংলার চেয়েও ভালো। মেয়েটি তাঁকে পাঞ্জাবি ভেবেছে বোধহয়। তিনি বাংলায় বললেন, আসতে পারি?
মেয়েটি দরজা থেকে ভেতরে সরে গিয়ে বলল, এসো! এক ঘণ্টা বত্রিশ টাকা, আর যদি সারা রাত থাকতে চাও–
স্বামীজি ভেতরে এসে মেয়েটির বিছানার ওপর বসে বললেন, তোমার হাতটা দাও!
তিনি হাতটা ধরলেন, কিন্তু তাঁর শরীর কাঁপল না। সেই রকম চোখ ঝাপসা হয়ে এল না।
মেয়েটি বলল, আলো নিভিয়ে দেব, না আলো জ্বালা থাকবে? টাকাটা আগে দেবে?
শাড়িটা খুলে ফেলার ব্যাপারে অবশ্য সে অনুমতি নিল না।
স্বামীজি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালেন তার দিকে। তারপর একবার চোখ বুজলেন। তিনি দেখলেন, চূড়ায় বরফের ওপর রোদ পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে বন। নদীর স্রোতের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন।
তিনি আবার দেখলেন মেয়েটিকে। আবার চোখ বুজলেন। সেই একই দৃশ্য। তিনি গঙ্গায় স্নান সেরে উঠে আসছেন, চারপাশে সব চেনা লোক। সেই পাহাড়, সেই বন।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সবই অভ্যেস।
সেই মুহূর্তেই বুঝে গেলেন, তাঁর আর ফেরা হবে না।