সােবাহান সাহেব তার মাছের সমস্যা নিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছেন। মাছ সম্পর্কে জানার জন্যে তিনি ময়মনসিংহের এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির ফিসারি ডিপার্টমেন্টে টেলিফোন করেছিলেন।
দেখা গেল তারা আমেরিকার মাছ সম্পর্কে প্রচুর জানেন। দেশী মাছ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। বই পত্রও নেই। সােবাহান সাহেব বললেন, বিদেশী মাছ সম্পর্কে জেনে কি হবে?
অধ্যাপক তদ্রলােক রাগী গলায় বললেন, দেশী বিদেশী প্রশ্ন তুলছেন কেন? আমরা মাছ সম্পর্কে জানি, একটা স্পেসিস সম্পর্কে জানি। দেশী মাছ সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানি না তাওতাে না। বই পত্র লেখা হচ্ছে গবেষণা হচ্ছে।
“কি গবেষণা হচ্ছে?
কি গবেষণা হচ্ছে তা আপনাকে বলতে হবে নাকি?” ‘কেন হবে না? আমি একজন নাগরিক। আমাদের টাকায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছে। কাজেই আমাদের জানার অধিকার আছে।
অধ্যাপক ভদ্রলােক রাগে আগুন হয়ে বললেন, অধিকার ফলাবেন না।। ‘কেন অধিকার ফলাব না? আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? এ রকম রেগে গেলে ছাত্র পড়াবেন কিভাবে?
আমার ছাত্র পড়ানাে নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। কেন হবে না?
অধ্যাপক ভদ্রলােক খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। সােবাহান সাহেব ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগেও চেষ্টা করলেন। সেখানেও এই অবস্থা। অধ্যাপকরা অত্যন্ত
সন্দেহজনক ভঙ্গিতে জানতে চান–আপনি কে? মাছ সম্পর্কে জানতে চান কেন?
সােবাহান সাহেব মৎস্য বিভাগের অফিসে গেলেন। সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ। বড় দরের সব অফিসাররাই হয় মিটিং এ নয় সেমিনারে, কয়েকজন দেশের বাইরে। এরচে ছােটপদের অফিসাররা হয় টরে কিংবা ব্যস্ত। একজনকে পাওয়া গেল তিনি তেমন ব্যস্ত না। চা খেতে খেতে চিত্রালী পড়ছেন। সােবাহান সাহেব হুট করে ঢুকে পড়লেন। ভদ্রলােক বিরক্ত মুখে বললেন, কি চান?
‘মাছ সম্পর্কে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
কেন? কারণ আপনারা মৎস্য বিভাগের লােক। “বলুন কি ব্যাপার। ‘আপনি পত্রিকাটা আগে পড়ে শেষ করুন তারপর কথা বলব।‘
ভদ্রলােক পত্রিকা নামিয়ে কঠিন চোখে তাকালেন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, বলুন কি বলতে চান। | সােবাহান সাহেব বললেন, দেশে এই যে মাছের তীব্র অভাব তাই নিয়ে ক‘দিন ধরে চিন্তা ভাবনা করছিলাম।
‘আপনাকে চিন্তা ভাবনা করতে বলেছে কে?
সােবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি কি দেশের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারব না?
‘অবশ্যই পারবেন। চিন্তা করে কি পেলেন সেটা যদি অল্প কথায় বলতে পারেন, বলুন। গল্প করলেতাে আমাদের চলে না, অফিসের কাজকর্ম আছে।
‘আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে আমরা যদি এক বৎসর মাছ না খাই। যদি মাছরা একটা বৎসর নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করতে পারে তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
‘ভাল কথা এটা আমাকে বলছেন কেন?
‘আপনাকে বলছি কারণ আপনারা যদি জনগণকে বােঝাতে পারেন, মাছ না খাওয়ার একটা ক্যাম্পেইন যদি করেন তাহলে––
‘আপনি একটা কথা বলবেন আর ওসি আমরা ঢাক ঢােল নিয়ে সেই কথা প্রচারে লেগে যাব, এটা মনে করলেন কেন?
‘আমার কথায় যদি যুক্তি থাকে তাহলে আপনারা কেনইবা প্রচার করবেন না? ‘আপনার কথায় কোনই যুক্তি নেই। ‘যুক্তি নেই?
‘জ্বি না। প্রথমত দেশে মাছের কোন অভাব নেই। সরকার মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে যে সব প্রকল্প হাতে নিয়েছেন সেই সব প্রকল্প খুব ভাল কাজ করছে। ফিস প্রােটিনে আমরা এখন স্বয়ং সম্পূর্ণ।
‘স্বয়ং সম্পূর্ণ?
‘অবশ্যই। বিদেশেও আমরা মাছ রপ্তানী করছি। চিংড়ি মাছ এক্সপাের্ট করে কি পরিমাণ ফরেন এক্সচেঞ্জ আমাদের আসে আপনি জানেন?
“আপনার জানার দরকারও নেই। আজে বাজে জিনিস নিয়ে মাথা গরম করবেন না এবং আমাদের সময় নষ্ট করবেননা। | সােবাহান সাহেবের মুখ লজ্জায় অপমানে কালাে হয়ে গেল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সামনে বসা ভদ্রলােক সিনেমা পত্রিকাটি মুখের উপর তুলে ধরতে ধরতে নিজের মনে বললেন, পাগল ছাগলে দেশ ভর্তি হয়ে গেছে।
সােবাহান সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, আপনি আমাকে পাগল বললেন? ‘আরে না ভাই আপনাকে বলি নাই। দেশে আপনি ছাড়াও তাে আরাে পাগল আছে? আচ্ছা এখন যান মালিকুম।
সােবাহান সাহেব ঘরে ফিরলেন প্রবল জ্বর নিয়ে। বাড়ির গেটের সামনে মিলি দাঁড়িয়েছিল, সে বাবাকে দেখে চমকে উঠে বলল, তােমার এই অবস্থা কেন বাবা? কি হয়েছে? | সােবাহান সাহেব জড়ানাে গলায় বললেন, আমাকে পাগল বলেছে। মুখের উপর পাগল বলেছে।
মিলি বিস্মিত হয়ে বলল, কে তােমাকে পাগল বলেছে?
কে বলেছে সেটাতাে ইম্পর্টেন্ট না। পাগল বলেছে এটাই ইম্পর্টেন্ট। ‘মােটেই না বাবা। পাগল কোন গালাগালি নয়। পাগল হচ্ছে আদরের ডাক। পৃথিবীর সমস্ত প্রতিভাবান লােকদের আদর করে পাগল ডাকা হয়।
মেয়ের কথায় সােবাহান সাহেব খুব যে একটা সান্তনা পেলেন তা নয়। রাতে ভাত খেলেন । সন্ধ্যার পর পরই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন। মানুষের কুৎসিত রূপ তাঁকে বড় পীড়া দেয়।
ফরিদ রাতের খাওয়া শেষে দুলাভাইকে দেখতে এল। বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল, কে নাকি আপনাকে পাগল বলেছে, আর তাতেই আপনি চুপসে গেছেন।
তােমাকে পাগল বললে কি তুমি খুশী হতে? ‘আমাকে বললে আমি ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতাম। যদি দেখতাম আমাকে পাগল বলার পেছনে যুক্তি আছে, তাহলে সহজভাবে টুথকে একসেপ্ট করতাম। এখন আপনি বলুন, কেন সে আপনাকে পাগল বলল? আপনি কি করেছিলেন বা কি বলেছিলেন?
‘আমি শুধু বলেছিলাম এক বৎসর যদি আমরা মাছ না খাই তাহলে মাছরা নির্বিঘ্নে বংশ বিস্তার করবে। মাহের অভাব দূর হবে।
এই বলায় সে আপনাকে পাগল বলল? হ্যা।‘
ঐ ভদ্রলােকের উপর আমার রেসপেক্ট হচ্ছে দুলাভাই। আপনাকে পাগল বলার তার রাইট আছে। এরচে খারাপ কিছু বললেও কিছু করার ছিল না। একটা মাছের পেটে কতগুলি ডিম থাকে? মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ মাছে ডিম থাকে নয় লক্ষ সাতষট্টি হাজার। মাছের সব ডিম ফুটে যদি বাচ্চা হয়, মাহের কারণে তাহলে নদী নালা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রবল বন্যা হবে। মাছ চলে আসবে ক্ষেতে খামারে। ক্ষুধার্থ মাছ সব ফসল খেয়ে শেষ করে ফেলবে। পুরাে দেশ চাপা পড়ে যাবে এক ফুট মাছের নীচে। কি ভয়াবহ অবস্থা চিন্তা করে দেখুন দুলাভাই।
সােবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। মনে মনে বললেন, গাধার গাধা! ঘর অন্ধকার বলে ফরিদ সােবাহান সাহেবের তীব্র বিরক্তি টের পেল না। সে মহা উৎসাহে বলে চলল, আপনি মনে হয় আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করছেন না। আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি। ধরুন আমাদের দেশে মাছের মােট সংখ্যা একশ কোটি। খুব কম করে ধরলাম, মােট সংখ্যা তারচে অনেক বেশী। একশ কোটি মানে টেন টু দি পাওয়ার এইট। টেন বেস লগারিদমে এটা হল–আট। এই মাছের অর্ধেক যদি স্ত্রী মাছ হয় তাহলে টেন বেস লগে কি দাঁড়ায়? আচ্ছা এক কাজ করা যাক, টেন বেস না ধরে নেচারেল লগারিদমে নিয়ে আসি। এতে পরে হিসেবে সুবিধা হবে।
সােবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, বহিষ্কার, এই মুহূর্তে বহিষ্কার। ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, আমাকে বলছেন? ‘হ্যাঁ, তােমাকে বলছি। বহিষ্কার, বহিষ্কার।
‘আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে চাচ্ছি দুলাভাই যে আপনার আচার আচরণ পরিষ্কার ইংগিত করছে
‘আবার কথা বলে, বহিষ্কার।
ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে, বেশ খারাপ। অবশ্যি তার মন খারাপ কখনােই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আজো হল না। নিজের ঘরে ঢােকা মাত্র মন ভাল হয়ে গেল। রাত কাটানাের খুব ভাল ব্যবস্থা করা আছে। ভিডিও ক্লাব থেকে স্পটকিার্স ছবিটা আবার আনা হয়েছে, এবারের প্রিন্ট বেশ ভাল। আজ রাতে ছবি দেখা হবে। ছবি দেখার ফাঁকে ফাঁকে ডিসকাশন হবে কাদেরের সঙ্গে।