সকাল। দশটার উপর বাজে।
খাবার টেবিলে ফরিদের নাশতা সাজানাে। ফরিদ নাশতা খেতে আসছে না সে বাগানে বসে আছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সারারাত ঘুম হয়নি।
অঘুমােজনিত ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের চাপা উত্তেজনাও তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিলিকে খবর পাঠানাে হয়েছে। ফরিদ অপেক্ষা করছে মিলির জন্যে। মিলি ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্যে তৈরী হয়েই নীচে নামল। মামার খোঁজে বাগানে গেল।
“কি ব্যাপার মামা?” সারারাত ঘুম হয়নিরে মিলি। ‘তাতে তাে তােমার খুব অসুবিধা হবার কথা না। প্রচুর ঘুম তােমার একাউন্টে জমা আছে। বছর খানেক না ঘুমালেও কিছু হবে না।‘
‘তাের কি খুব তাড়া আছে? “হ্যাঁ আছে। এগারােটায় ক্লাস, এখন বাজেদশটাদশ। ‘আজকের ক্লাসটা না করলে হয় না? না হয় না। ব্যাপারটা কি বলে ফেল। ‘অদ্ভুত একটা আইডিয়া মাথায় চলে এসেছে। অন্ধকারে যেন একটা এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
“তাই নাকি?‘ ‘দুলা ভাইয়ের মৎস্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। কি করে তাঁকে সাপাের্ট করা যায় এই সব–ভাবতে ভাবতে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছি হঠাৎ মাথার মধ্যে দপ করে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠল। আমি ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলাম।
‘আইডিয়া পেয়ে গেলে?
রাইটআইডিয়া পেয়ে গেলাম, ছবি বানাব। “ছবি বানাবে মানে? ‘দেশের মৎস্য সম্পদ নিয়ে একটা শট ফ্লিম। মাছের জীবন কথা বলতে পারিস। মাহদের জীবনের আনন্দ–বেদনার কাব্য। ছবির নামও ঠিক করে ফেললাম। ছবির নাম–হে মাছ।
হে মাছ ?” ‘হা–হে মাছ। এই ছবি যখন রিলিজ হবে তখন চারদিকে হৈ চৈ পরে যাবে। মৎস্য সমস্যার এ টু জেড’ পাবলিক জেনে যাবে। দুলাভাই যা চাচ্ছিলেন তাই হবে তবে অনেক তাড়াতাড়ি হবে। এক গুলিতে যুদ্ধ জয় যাকে বলে।
‘ছবি যে বানাবে টাকা পাবে কোথায়? ‘কোন মহৎ কাজ কখনাে টাকার অভাবে আটকে থাকে বল? ‘মামা যাই, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
একদিন ইউনিভার্সিটিতে না গেলে কি হয়? অনেক কিছু হয়। তুমি তােমার চিন্তা ভাবনা করতে থাক পরে শুনব।‘ ফরিদ সারা দুপুর দরজা বন্ধ করে বসে রইল। কাদেরের কাজ হল কিছুক্ষণ পর পর চা এনে দেয়া। ফরিদ কোথায় যেন পড়েছিল তামাকের নিকোটিন ক্রিয়েটিভিটিতে সাহায্য করে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
কাদেরকে দিয়ে সিগারেট আনানাে হল। সিগারেটের ধূয়া মাথা ঘুরা, বমি ভাব এবং কাশি তৈরী ছাড়া অন্যকোন ভাবে সাহায্য করল না। দুপুরে ফরিদ কিছু খেল না–শুধু একটা টোস্ট বিসকিট এবং আধ কাপ দুধ। কারণ ফুল ঈমাকে ক্রিয়েটিভ কাজ কিছু হয় না। জগতে বড় বড় ক্রিয়েটিভ কাজ করছে প্রতিভাবান ক্ষুধার্ত মানুষ। ক্ষুধার সঙ্গে প্রতিভার ঘনিষ্ট যােগাযােগ আছে।
সন্ধ্যা নাগাদ হে মাছ’ চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরী হয়ে গেল। প্রথম পাঠক সৈয়দ মােহাম্মদ কাদের। ফরিদ বলল, কেমন বুঝছিস কাদের?
কাদের গাড় স্বরে বলল, ‘বােঝাবুঝির কিছু নাই মামা–ফাডাফাডি জিনিস হইছে। ‘ক্লাইমেক্সগুলি কেমন এসেছে?
কেলাইমেক্সের কথা কইয়া আর কাম কি মামা? ফলে পরিচয়। এই দেহেন শইলের লােম খাড়া হইয়া গেছে। হাতদিয়ে দেহেন।
ফরিদ হাত দিয়ে দেখল– যে কোন কারণেই হােক কাদেরের গায়ের লােম সত্যি সত্যি খাড়া হয়ে আছে।
‘কাদের!
জ্বি মামা। ‘এখনাে ফাইন্যাল করিনি তবে মনে হচ্ছে তােকে একটা ব্রোল দে। ‘কি কইলেন মামা? ‘নৌকার হতদরিদ্র মাঝির ভূমিকা তোের পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাদের স্তম্ভিত। সে মূর্তির মত বসে রইল। নড়াচড়া করতে পারল না।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
সােবাহান সাহেবের শরীর আজ বেশ ভাল। জ্বর নেই। ক্লান্তির ভাব ছাড়া তার কোন শারিরীক অসুবিধাও নেই। তিনি যথারীতি বারান্দায় তীর ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার কোলে বিশাল খাতা যার মলাটে লেখা মৎস্য সমস্যা। আজ আবার মৎস্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন। বাংলাদেশের মাছের পূর্ণ তালিকা এখনাে তৈরী হয়নি। ছােট প্রজাতির মাছগুলির একেক অঞ্চলে একেক নাম। এও এক যন্ত্রণা।
রহিমার মা সােবাহান সাহেবের সামনে বসে আছে। মাছের নাম বলছে। বেশ কিছু নাম সােবাহান সাহেব তার কাছ থেকে পেয়েছেন।
‘কি নাম বললে? ‘দাড়কিনি মাছ।
‘দাড়কিনি মাছ? সত্যি সত্যি এই নামে কোন মাছ আছে না বসে বসে বানাচ্ছ? দাঁড়কাকের কথা জানি। দাড়কিনিতাে কখনাে শুনিনি।
‘আছে, আফনে লেহেন–পিতল্ল্যা মাছ। পিতা মাহ?
জ্বি। সেটা কেমন? ‘খুব ছােড, লেজ আছে। ‘ফাজলামী করছ না–কি রহিমার মা? লেজ তাে সব মাছেরই আছে। এমন কোন মাছ আছে যার লেজ নেই?
থাকতেও পারে। আল্লাহর খুদরতেরতাে কোনাে সীমা নাই। ‘আচ্ছা তুমি এখন যাও। নামডা লেখছেনতাে–পিতল্লা মাছ। পিতলের লাহান রং এই কারণে নাম পিতা মাছ। সােবাহান সাহেব পিতা মাহ লিখলেন তবে ব্র্যাকেটে প্রশ্নবােধক চিহ্ন দিয়ে রাখলেন।
আনিসকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেল। তার সঙ্গে টগর এবং নিশা। আনিস হাসি মুখে বলল, স্নামালিকুম স্যার।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
টগর এবং নিশাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্নামালিকুম স্যার, স্লামালিকুম স্যার। যাচ্ছ কোথায় আনিস? ‘কোথাও না। ওদের নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছি। আপনি কি করছেন?
‘আমি মাছের নাম লিখছি। তােমাকে বলেছিলাম না মৎস্য সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি। আমাদের দেশ হচ্ছে মাছের দেশ অথচ মাছের কি ভয়াবহ আকাল।
“তাতাে বটেই!” | ‘দু’টা মিনিট দাঁড়াওততা আনিস–আমি নামগুলি তােমাকে পড়ে শুনাচ্ছি। দেখ কোন নাম বাদ পড়েছে কিনা।
সােবাহান সাহেব পড়তে শুরু করলেন–রুই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাশ, চিতল, বোয়াল, কালি বাউস, নানিদ, চিংড়ি, কৈ, মাগুর, শিং, পুটি, শােল, মহাশােল, রিঠা, ভেটকি, টেংরা, খইলসা, কাইক্যা, পাবদা, লাটি, বাতাসী, আইড়, বাইম, তপশে, নল, ফইল্যা, দাড়কিনি, পিতল্লা–কিছু কি বাদ পড়ল আনিস?
আনিস কিছু বলার আগেই নিশা বলল–ইলিশ বাদ পড়েছে স্যার। সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সত্যি সত্যি ‘ইলিশ’ বাদ পড়েছে। এটা কি করে হল? আসল মাছটাই বাদ পড়ে গেল। সােবাহান সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, এটা কেমন করে হল আনিস? এত বড় ভুল কি করে করলাম? | আনিস হাসিমুখে বলল, এটা কোন বড় ভুল না, খুবই সাধারণ ভুল–যা আমরা সব সময় করি। যে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাই। যে ভালবাসা সব সময় আমাদের ঘিরে রাখে তার কথা আমাদের মনে থাকে না। মনে থাকে হঠাৎ আসা ভালবাসার কথা।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ঠিকই বলেছ আনিস। ‘স্যার যাই স্নামালিকুম।
তিনি জবাব দিলেন না। টগর বলল, স্যার যাই স্নামালিকুম। নিশাও বলল, স্যার যাই স্নামালিকুম। সােবাহান সাহেব হেসে ফেললেন। হঠাৎ তার কাছে মনে হল এই পৃথিব৷ বড়ই
আনন্দের স্থান। এই পৃথিবীতে বাস করতে পারার সৌভাগ্যের জন্যে তিনি নিজের প্রতিই খানিক ঈর্ষা অনুভব করতে লাগলেন।
খাবার টেবিলে হে মাছে’র চিত্রনাট্য নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছে। খেতে বসেছেমিলি এবং ফরিদ। মিলির চিত্রনাট্য বিষয়ক কথা বার্তা শােনার আগ্রহ নেই, কিন্তু ফরিদ শােনাবেই। ফরিদ গম্ভীর গলায় বলছে
‘সব মিলিয়ে চরিত্র হচ্ছে চারটি। জেলে, জেলের স্ত্রী, খেয়া নৌকার মাঝি এবং একটা
চোর।
মিলি বলল, মাছ নিয়ে ছবি এর মধ্যে আবার চোর কেন?
পুরােটা না শুনেই কথা বলিস এটাই হচ্ছে তাের বড় সমস্যা। চোরের প্রয়ােজন আছে। বলেই চোর আছে। একটা হাই ড্রামা স্টোরী। এখানে টেনশান বিল্ড আপ করতে চোর লাগবে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ
জেলের নিজস্ব কোন নৌকা নেই, সে খেয়া নৌকায় করে মাছ মারতে বের হয়েছে। সেই নৌকায় বসে আছে একজন চোর। ওপেনিং শটে – নৌকা দেখা যাচ্ছে। দিনের অবস্থা ভাল না। ঢেউ উঠেছে। নৌকা টালমাটাল করছে। ফাই ডায়লগ জেলে দিচ্ছে– ক্যামেরা জুম করে জেলের মুখে চলে গেল, মিলি শুনছিসতাে কি বলছি?
‘হ্যাঁ শুনছি।
জেলে বলল, ও মাঝি বাই, একখান গীত গান। মাঝি বলল, পেড়ে যদি ভাত না থাহে, গীত আইৰ ক্যামনে। জেলে বলল, কথা সত্য। নদীত নাই মাছ। তখন হঠাৎ কি মনে করে যেন মাঝি গান ধরল, ও আমার সােনা বন্ধুরে ও আমার রসিয়া বন্ধুরে।