বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

সকালদশটার উপর বাজে। 

খাবার টেবিলে ফরিদের নাশতা সাজানােফরিদ নাশতা খেতে আসছে না সে বাগানে বসে আছেতাকে দেখেই মনে হচ্ছে সারারাত ঘুম হয়নি

বহুব্রীহি

অঘুমােজনিত ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের চাপা উত্তেজনাও তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছেমিলিকে খবর পাঠানাে হয়েছেফরিদ অপেক্ষা করছে মিলির জন্যেমিলি ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্যে তৈরী হয়েই নীচে নামলমামার খোঁজে বাগানে গেল। 

কি ব্যাপার মামা?সারারাত ঘুম হয়নিরে মিলিতাতে তাে তােমার খুব অসুবিধা হবার কথা নাপ্রচুর ঘুম তােমার একাউন্টে জমা আছেবছর খানেক না ঘুমালেও কিছু হবে না‘ 

তাের কি খুব তাড়া আছে? হ্যাঁ আছেএগারােটায় ক্লাস, এখন বাজেদশটাদশআজকের ক্লাসটা না করলে হয় না? না হয় নাব্যাপারটা কি বলে ফেলঅদ্ভুত একটা আইডিয়া মাথায় চলে এসেছেঅন্ধকারে যেন একটা এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

তাই নাকি?দুলা ভাইয়ের মৎস্য ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলামকি করে তাঁকে সাপাের্ট করা যায় এই সবভাবতে ভাবতে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছি হঠাৎ মাথার মধ্যে দপ করে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠলআমি ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলাম। 

আইডিয়া পেয়ে গেলে

রাইটআইডিয়া পেয়ে গেলাম, ছবি বানাবছবি বানাবে মানে? দেশের মৎস্য সম্পদ নিয়ে একটা শট ফ্লিমমাছের জীবন কথা বলতে পারিসমাহদের জীবনের আনন্দবেদনার কাব্যছবির নামও ঠিক করে ফেললামছবির নামহে মাছ। 

হে মাছ ?হাহে মাছএই ছবি যখন রিলিজ হবে তখন চারদিকে হৈ চৈ পরে যাবেমৎস্য সমস্যার টু জেডপাবলিক জেনে যাবেদুলাভাই যা চাচ্ছিলেন তাই হবে তবে অনেক তাড়াতাড়ি হবেএক গুলিতে যুদ্ধ জয় যাকে বলে। 

ছবি যে বানাবে টাকা পাবে কোথায়? কোন মহৎ কাজ কখনাে টাকার অভাবে আটকে থাকে বল? মামা যাই, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। 

একদিন ইউনিভার্সিটিতে না গেলে কি হয়? অনেক কিছু হয়তুমি তােমার চিন্তা ভাবনা করতে থাক পরে শুনবফরিদ সারা দুপুর দরজা বন্ধ করে বসে রইলকাদেরের কাজ হল কিছুক্ষণ পর পর চা এনে দেয়াফরিদ কোথায় যেন পড়েছিল তামাকের নিকোটিন ক্রিয়েটিভিটিতে সাহায্য করে

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

কাদেরকে দিয়ে সিগারেট আনানাে হলসিগারেটের ধূয়া মাথা ঘুরা, বমি ভাব এবং কাশি তৈরী ছাড়া অন্যকোন ভাবে সাহায্য করল নাদুপুরে ফরিদ কিছু খেল নাশুধু একটা টোস্ট বিসকিট এবং আধ কাপ দুধকারণ ফুল ঈমাকে ক্রিয়েটিভ কাজ কিছু হয় নাজগতে বড় বড় ক্রিয়েটিভ কাজ করছে প্রতিভাবান ক্ষুধার্ত মানুষক্ষুধার সঙ্গে প্রতিভার ঘনিষ্ট যােগাযােগ আছে। 

সন্ধ্যা নাগাদ হে মাছচিত্রনাট্যের খসড়া তৈরী হয়ে গেলপ্রথম পাঠক সৈয়দ মােহাম্মদ কাদেরফরিদ বলল, কেমন বুঝছিস কাদের

কাদের গাড় স্বরে বলল, বােঝাবুঝির কিছু নাই মামাফাডাফাডি জিনিস হইছেক্লাইমেক্সগুলি কেমন এসেছে

কেলাইমেক্সের কথা কইয়া আর কাম কি মামা? ফলে পরিচয়এই দেহেন শইলের লােম খাড়া হইয়া গেছেহাতদিয়ে দেহেন। 

ফরিদ হাত দিয়ে দেখলযে কোন কারণেই হােক কাদেরের গায়ের লােম সত্যি সত্যি খাড়া হয়ে আছে। 

কাদের

জ্বি মামাএখনাে ফাইন্যাল করিনি তবে মনে হচ্ছে তােকে একটা ব্রোল দেকি কইলেন মামা? নৌকার হতদরিদ্র মাঝির ভূমিকা তোের পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছেকাদের স্তম্ভিতসে মূর্তির মত বসে রইলনড়াচড়া করতে পারল না। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

সােবাহান সাহেবের শরীর আজ বেশ ভালজ্বর নেইক্লান্তির ভাব ছাড়া তার কোন শারিরীক অসুবিধাও নেইতিনি যথারীতি বারান্দায় তীর ইজিচেয়ারে বসে আছেনতার কোলে বিশাল খাতা যার মলাটে লেখা মৎস্য সমস্যাআজ আবার মৎস্য সমস্যা নিয়ে বসেছেনবাংলাদেশের মাছের পূর্ণ তালিকা এখনাে তৈরী হয়নিছােট প্রজাতির মাছগুলির একেক অঞ্চলে একেক নামএও এক যন্ত্রণা। 

রহিমার মা সােবাহান সাহেবের সামনে বসে আছেমাছের নাম বলছেবেশ কিছু নাম সােবাহান সাহেব তার কাছ থেকে পেয়েছেন। 

কি নাম বললে? দাড়কিনি মাছ।  

দাড়কিনি মাছ? সত্যি সত্যি এই নামে কোন মাছ আছে না বসে বসে বানাচ্ছ? দাঁড়কাকের কথা জানিদাড়কিনিতাে কখনাে শুনিনি। 

আছে, আফনে লেহেনপিতল্ল্যা মাছপিতা মাহ

জ্বিসেটা কেমন? খুব ছােড, লেজ আছেফাজলামী করছ নাকি রহিমার মা? লেজ তাে সব মাছেরই আছেএমন কোন মাছ আছে যার লেজ নেই

থাকতেও পারেআল্লাহর খুদরতেরতাে কোনাে সীমা নাইআচ্ছা তুমি এখন যাওনামডা লেখছেনতােপিতল্লা মাছপিতলের লাহান রং এই কারণে নাম পিতা মাছসােবাহান সাহেব পিতা মাহ লিখলেন তবে ব্র্যাকেটে প্রশ্নবােধক চিহ্ন দিয়ে রাখলেন। 

আনিসকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেলতার সঙ্গে টগর এবং নিশাআনিস হাসি মুখে বলল, স্নামালিকুম স্যার। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

টগর এবং নিশাও সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্নামালিকুম স্যার, স্লামালিকুম স্যারযাচ্ছ কোথায় আনিস? কোথাও নাওদের নিয়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছিআপনি কি করছেন

আমি মাছের নাম লিখছিতােমাকে বলেছিলাম না মৎস্য সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিআমাদের দেশ হচ্ছে মাছের দেশ অথচ মাছের কি ভয়াবহ আকাল। 

তাতাে বটেই!| দুটা মিনিট দাঁড়াওততা আনিসআমি নামগুলি তােমাকে পড়ে শুনাচ্ছিদেখ কোন নাম বাদ পড়েছে কিনা। 

সােবাহান সাহেব পড়তে শুরু করলেনরুই, কাতল, মৃগেল, পাঙ্গাশ, চিতল, বোয়াল, কালি বাউস, নানিদ, চিংড়ি, কৈ, মাগুর, শিং, পুটি, শােল, মহাশােল, রিঠা, ভেটকি, টেংরা, খইলসা, কাইক্যা, পাবদা, লাটি, বাতাসী, আইড়, বাইম, তপশে, নল, ফইল্যা, দাড়কিনি, পিতল্লাকিছু কি বাদ পড়ল আনিস

আনিস কিছু বলার আগেই নিশা বললইলিশ বাদ পড়েছে স্যারসােবাহান সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেনসত্যি সত্যি ইলিশবাদ পড়েছেএটা কি করে হল? আসল মাছটাই বাদ পড়ে গেলসােবাহান সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, এটা কেমন করে হল আনিস? এত বড় ভুল কি করে করলাম? | আনিস হাসিমুখে বলল, এটা কোন বড় ভুল না, খুবই সাধারণ ভুলযা আমরা সব সময় করিযে জিনিস চোখের সামনে থাকে তাকে আমরা ভুলে যাইযে ভালবাসা সব সময় আমাদের ঘিরে রাখে তার কথা আমাদের মনে থাকে নামনে থাকে হঠাৎ আসা ভালবাসার কথা। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

ঠিকই বলেছ আনিসস্যার যাই স্নামালিকুম। 

তিনি জবাব দিলেন নাটগর বলল, স্যার যাই স্নামালিকুমনিশাও বলল, স্যার যাই স্নামালিকুমসােবাহান সাহেব হেসে ফেললেনহঠাৎ তার কাছে মনে হল এই পৃথিব৷ বড়ই 

আনন্দের স্থানএই পৃথিবীতে বাস করতে পারার সৌভাগ্যের জন্যে তিনি নিজের প্রতিই খানিক ঈর্ষা অনুভব করতে লাগলেন। 

খাবার টেবিলে হে মাছেচিত্রনাট্য নিয়ে আলােচনা শুরু হয়েছেখেতে বসেছেমিলি এবং ফরিদমিলির চিত্রনাট্য বিষয়ক কথা বার্তা শােনার আগ্রহ নেই, কিন্তু ফরিদ শােনাবেইফরিদ গম্ভীর গলায় বলছে 

সব মিলিয়ে চরিত্র হচ্ছে চারটিজেলে, জেলের স্ত্রী, খেয়া নৌকার মাঝি এবং একটা 

চোর। 

মিলি বলল, মাছ নিয়ে ছবি এর মধ্যে আবার চোর কেন

পুরােটা না শুনেই কথা বলিস এটাই হচ্ছে তাের বড় সমস্যাচোরের প্রয়ােজন আছেবলেই চোর আছেএকটা হাই ড্রামা স্টোরীএখানে টেনশান বিল্ড আপ করতে চোর লাগবে

বহুব্রীহি পর্ব (১৩)- হুমায়ূন আহমেদ

জেলের নিজস্ব কোন নৌকা নেই, সে খেয়া নৌকায় করে মাছ মারতে বের হয়েছেসেই নৌকায় বসে আছে একজন চোরওপেনিং শটে নৌকা দেখা যাচ্ছেদিনের অবস্থা ভাল নাঢেউ উঠেছেনৌকা টালমাটাল করছেফাই ডায়লগ জেলে দিচ্ছেক্যামেরা জুম করে জেলের মুখে চলে গেল, মিলি শুনছিসতাে কি বলছি

হ্যাঁ শুনছি। 

জেলে বলল, মাঝি বাই, একখান গীত গানমাঝি বলল, পেড়ে যদি ভাত না থাহে, গীত আইৰ ক্যামনে। জেলে বলল, কথা সত্যনদীত নাই মাছতখন হঠাৎ কি মনে করে যেন মাঝি গান ধরল, আমার সােনা বন্ধুরে আমার রসিয়া বন্ধুরে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *