এই গানের সঙ্গে সঙ্গে জাল ফেলা হবে। ক্যামেরা মাঝির মুখ থেকে কাট করে চলে যাবে জালে। সেখান থেকে কাট করে পানিতে, কাট করে লং শটে নৌকা। কাট মিড ক্লোজ আপ তাের মুখ।
‘আমার মুখ মানে?
‘জেলের স্ত্রীর ভূমিকায় তুই অভিনয় করছিস। দুঃখ, অভাব অনটনে পর্যদস্ত বাংলার শাশত নারী। হৃদয়ে মমতার সমুদ্র, পেটে ক্ষুধার অগ্নি।
মামা, তােমার এইসব ঝামেলায় কিন্তু আমি নেই। ‘আমি কি বাইরে থেকে আর্টিস্ট আনব না–কি? নিজেদেরই কাজ করতে হবে। আমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দেব–অভিনয়ের অ’ জানে না এমন সব মানুষ নিয়েও ছবি হয় এবং এ ক্লাব ছবি হয়। ডায়ালগ মুখস্ত করে ফেলবি, পরশু থেকে রিহার্সেল।
মিলি বিরক্ত গলায় বলল, তােমার এই পাগলামীর কোন মানে হয় মামা? মুখে বললেই ছবি হয়ে যাবে? টাকা পয়সা লাগবে না?‘
‘আমার কি টাকা পয়সার অভাব? দুলাভাইয়ের কাছে আমার কত টাকা জমা আছে তুই জানিস? প্রয়ােজন হলে মগবাজারের বাড়ি বিক্রি করে দেব। মরদকা বাত, হাতীকা দীত। একবার যখন বলে ফেলেছি
হবে না। শুধু শুধু ‘আগেই টের পেয়ে গেছিস শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না? জীবন সম্পর্কে এমন পেসিমিষ্টিক ভিউ রাখবি না। মনটাকে বড় কর।
বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
‘আর কে কে অভিনয় করছে তােমার ছবিতে? ‘এখনাে ফাইন্যাল হয় নি। ডাক্তার ছােকরাকে বলে দেখব, আর দেখি নতুন ভাড়াটে আনিস রাজি হয় কিনা।
‘ওরা ছবিতে অভিনয় করবে কেন?
‘শিল্পের প্রতি মমত্ববােধ থেকে করবে। মহৎ কাজে শরিক হবার স্পিরিট থেকে করবে। আনিস ছােকরাকে আজ রাতেই ধরব। | মিলি তাকিয়ে আছে মামার দিকে। সে যে খুব উৎসাহ বােধ করছে তা মনে হচ্ছে না।
‘আনিস আছ নাকি?
আনিস দরজা খুলল। ফরিদকে দেখে অবাক হলেও ভাব ভঙ্গিতে তার কোন প্রকাশ হল না। সে হাসি মুখে বলল, স্নামালিকুম।
‘ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি করে বললাম। কিছু মনে করনিতাে? আমি মিলির মামা। ‘জ্বি আমি জানি। আসুন ভেতরে আসুন। | ভেতরে যাব না। কাজের কথা সেরে চলে যাব। খুব ব্যস্ত। ছবির স্ক্রীপ্ট করছি, মাছ নিয়ে শর্ট ফ্লিম বানাচ্ছি। নাম হচ্ছে–‘হে মাছ।
‘তাই না কি? ‘হ্যাঁ! তাই। এখন কথা হচ্ছে তুমি কি ছবিতে অভিনয় করবে? এক গাদা কথা বলার দরকার নেই। বল হ্যা কিংবা না।”
আনিস হকচকিয়ে গেল। কেউ তাকে অভিনয়ের জন্যে ডাকতে পারে তা তার মাথায় কখনাে আসে নি। ফরিদ বলল, আমার ছবিতে একটা চোরের ক্যারেক্টার আছে। এই জন্যেই তােমার কাছে আসা নয়ত আসতাম না। তোমার চেহারায় একটা চোর চোর ভাব আছে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিস হতভম্ব হয়ে বলল, আমার চেহারায় চোর চোর ভাব আছে? ‘হ্যা আছে।
আনিস বিস্মিত গলায় বলল, ‘নিজের সম্পর্কে আজে বাজে কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু আমার চেহারা চোরের মত এটা এই প্রথম শুনলাম।
সত্যি কথা আমি পেটে রাখতে পারি না। বলে ফেলি। তুমি আবার কিছু মনে করনি তাে? জ্বি না, কিছু মনে করিনি। ‘অভিনয় করবে না–করবেনা?
করব। এ জীবনে অনেক কিছুই করেছি। অভিনয়টাই বা বাদ থাকবে কেন?”
ফরিদ হৃষ্ট চিত্তে নীচে নেমে এল। এখন ডাক্তার ছােকরা রাজী হলেই কাজ শুরু করা যায়। তবে ছকরার ব্রেইন বলে কিছু নেই। তার কাছ থেকে অভিনয় আদায় করা কষ্ট হবে। ব্যাটা হয়তাে রাজিও হতে চাইবে না। ফরিদের ধারণা ডাক্তার এবং ইনজিনীয়ার এই দুই সম্প্রদায়, অভিনয় কলার প্রতি খু। উৎসাহী নয়। আজ রাতেই ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেললে কেমন হয় ?
ফরিদ কাদেরকে পাঠাল মনসুরকে ডেকে আনতে। মনসুর সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। মনে হল যেন কাপড় পরে এ বাড়িতে আসার জন্যে তৈরী হয়েই ছিল। মনসুরের সঙ্গে ফরিদের নিম্নলিখিত কথােপকথন হল।
ফরিদঃ তােমাকে একটি বিশেষ কারণে ডেকেছি। অসুখ বিসুখের সঙ্গে এর কোন
সম্পর্ক নেই। মনসুর : জ্বি বলুন।
ফরিদঃ আচ্ছা স্ত্রী হিসাবে মিলি কি তােমার জন্যে মানানসই হবে বলে মনে হয়?
মিলি আবার একটু বেঁটে, ভেবে চিন্তে বল। মনসুরঃ (তােতলাতে তােতলাতে) জ্বি মামা, অবশ্যই হবে। বেঁটে কি বলছেন?
বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
পারফেক্ট হাইট। মানে আমার ধারণা মানে ফরিদঃ মিলির স্বামী হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে? মনসুরঃ অবশ্যই পারব। একশ বার পারব। ফরিদঃ তাহলে কাল থেকে রিহার্সেল শুরু করে দাও। মনসুরঃ (বিঘিত) কিসের রিহার্সেল ? ফরিদঃ মিলি করবে জেলের স্ত্রীর ভূমিকা আর তুমি হচ্ছ জেলে। মনসুরঃ আমি মামা কিছুই বুঝতে পারছি না। ফরিদঃ ছবি বানাচ্ছি। শর্ট ফ্লিম। সেখানে তােমার ভূমিকা হচ্ছে অভাব অনটনে পর্যুদস্ত
জেলে, আর মিলি তােমার স্ত্রী। মনসুরঃ ছবির কথা বলছেন? ফরিদঃ অফকোর্স ছবির কথা বলছি। তুমি কি ভেবেছিলে? মনসুরঃ (শুকনাে গলায়) একগ্লাস ঠান্ডা পানি খাব। একগ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, মিস মিলি কি আমার সঙ্গে অভিনয় করতে রাজী হবেন?
সেতো রাজী হয়েই আছে।
তাই নাকি—আরেক গ্লাস পানি খাব। | মনসুর দ্বিতীয় গ্লাস পানি খেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জানাল যে সে অতি আগ্রহের সঙ্গে মিস মিলির সঙ্গে অভিনয় করবে।
‘তুমি আগে অভিনয় করেছ? ‘জ্বি না।‘ ‘অসুবিধা হবে না–আমি শিখিয়ে দেব। অভিনয় কঠিন কিছু না। জাল ফেলতে জান? ‘জি না। ‘শিখে নেবে।‘ ‘জি আচ্ছা। ‘মাথাটা কাল পরশু কামিয়ে ফেল। ডাক্তার হকচকিয়ে গেল। ঢোঁক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল, কি বললেন মামা?
‘মাথাটা কামিয়ে ফেলতে বললাম। জেলেদের মাথায় থাকে কদমছাট চুল। মাথা না কামালে ঐ জিনিস পাব কোথায়? কোন অসুবিধা আছে?
‘জ্বি না। কোন অসুবিধা নেই। আপনি যা বলবেন তাই করব।
ভেরি গুড়। ‘অভিনয় নিয়ে মিস মিলির সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?
ফরিদ বিরক্ত হয়ে বলল, তার সঙ্গে আবার কি কথা? সে অভিনয়ের জানে কি? যা জানতে চাইবে আমাকে প্রশ্ন করলেই জানবে।
ডাক্তার বলল, জ্বি আচ্ছা।
বহুব্রীহি পর্ব (১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
ফজরের নামাজ শেষ করে সােবাহান সাহেব তসবি হাতে বাগানে খানিকক্ষণ হাঁটেন। আজও তাই করছেন। হঠাৎ মনে হল কে যেন গেটে টোকা দিচ্ছে। এত ভােরে কে আসবে এ বাড়িতে? তিনি বিস্মিত হয়ে গেট খুললেন–বিলু দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা বিশ্বাসই হল না। বিলুর মেডিকেল কলেজ খােলা। ক’দিন পরই পরীক্ষা। এই সময় সে ঢাকায় আসবে কেন? আনন্দ ও বিস্ময়ে সােবাহান সাহেব অভিভূত হয়ে গেলেন। | ‘আরে তুই? বিলু মা, তুই?
বিলু বেবীটেক্সী ভাড়া মেটাতে মেটাতে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। ভােরবেলার আলােয় হলুদ রঙের শাল জড়ানাে বিলুকে অপ্সরীর মত লাগছে। তার এই মেয়ে বড় সুন্দর। স্বর্গের সব রূপ নিয়ে এই মেয়ে পৃথিবীতে চলে এসেছে। | ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার উপরই বিলু নীচু হয়ে বাবার পা স্পর্শ করল। নরম গলায় বলল, তুমি এতাে রােগা হয়েই কেন বাবা? সােবাহান সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তার বড় মেয়ের সামান্য কথাতেই তীর চোখ ভিজে উঠে। তিনি ধরা গলায় বললেন,
কলেজ ছুটি না–কি মা?