ছুটি না–ছাত্ররা মারামারি করে সব বন্ধ ইন্ধ করে দিয়েছে। একমাত্র আমাদের মেডিকেল কলেজটাই খােলা ছিল। ঐটাও বন্ধ হল।
একা এসেছিস? ‘না। সব মেয়েরা একসঙ্গে এসেছি। সন্ধ্যাবেলা লঞ্চে উঠলাম, ঢাকা পৌঁছলাম রাত তিনটায়। একটু সকাল হতেই চলে এসেছি।‘
‘ভাল করেছিস মা। খুব ভাল করেছিস।
সােবাহান সাহেবের ইচ্ছা করছে চেঁচিয়ে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙ্গাতে, তিনি তা করলেন না। নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। বড় মেয়ের সঙ্গে কিছু সময় একা
একা থাকার আনন্দওতাে কম নয়।
দুজন চায়ের কাপ নিয়ে বসেছে। বিলু এক হাতে বাবাকে জড়িয়ে রেখেছে। তার এত ভাল লাগছে।
‘বাসার খবর বল বাবা।
কোন খবরটা শুনতে চাস? ‘মামা নাকি ছবি বানাচ্ছে। মিলি চিঠি লিখেছিল।
সােবাহান সাহেব মুখ বিকৃত করে বললেন, গাধাটা বড় যন্ত্রণা করছে। রিহার্সেল টিহার্সেল কি কি করছে। বিকেলে বাসায় থাকা মুশকিল।
বিলু আপন মনে হাসল। ফরিদ তার খুবই পছন্দের মানুষ। বিলু হালকা গলায় বলল, মামার পাগলামী কমেনি?
“না বেড়েছে। আমার মনে হয় কিছুদিন পর তালা বন্ধ করে রাখতে হবে।
ধরে বেঁধে মামার একটা বিয়ে দিয়ে দাও।
‘ঐ সব কথাই মনে আনবি না। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন মানে হয়?
বিলু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘর থেকে ঘরে ঘুরতে লাগল। মাত্র চার মাস পরে সে ফিরেছে অথচ মনে হচ্ছে যেন কত যুগ পরে ফিরল। সব কেমন যেন অচেনা।
বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
‘আরে আফা কোন সময়ে আইলেন?কি তাজ্জব! | বিলু প্রথম দেখায় চিনতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চোখে চশমা, মুখ ভর্তি দাড়ি চেনা ভঙ্গিতে কে যেন হাসছে।
‘আফা আমি কাদের। ‘তুমি দাড়ি কবে রাখলে কাদের? ‘সিনেমায় পাট করতাছি আফা–মামার সিনেমা, আমার হিরাের পাট। খেয়া নৌকার মাঝি। ‘তাই নাকি? খেয়া নৌকার মাঝির বুঝি দাড়ি থাকতে হয়?” ‘ডিরেকটর সাব চাইছে।
বিলু হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল– তোমরা বেশ সুখে আছ বলে মনে হচ্ছে কাদের।
‘আর সুখ। সিনেমা করা কি সােজা যন্ত্রণা? চিন্তা–ভাবনা আছে না? এইটা কি পানি–ভাত যে মরিচ দিয়া এক ডলা দিলাম আর মুখের মইদ্যে ফেললাম?” | বিলু অনেক কষ্টে মুখের হাসি আটকাল। তার খুব মজা লাগছে। কাদেরের মুখও আনন্দে উজ্জ্বল। কাদেরের ধারণা এই পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ মহিলা হচ্ছে বিলু আফা। এ বাড়ির সবাই তাকে তুই করে বলে, একমাত্র বিলু আফা বলে তুমি করে। এক গ্লাস পানির দরকার হলে বিলু আফা জনে জনে হুকুম দেয় না। নিজের পানি নিজে নিয়ে আসে।
একবার কাদেরের জ্বর হল। চাকর বাকরের জ্বর হলে কে আর খোঁজ করে। ঘরের এক কোনায় কাবা শড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে হয়। কাদের তাই করেছে, শুয়ে আছে। জ্বর খুব বেশী। চারপাশের পৃথিবী কেমন হলুদ হলুদ লাগছে। আচ্ছন্নের মত অবস্থা। এমন সময় লক্ষ্য করগ কে যেন তার মাথায় পানি ঢালছে। ঠান্ডা পানি। বড় আরাম লাগছে। কাদের চোখ মেলে দেখে বিলু। একমনে পানি ঢালছে এবং রহিমার মাকে কড়া গলায় বলছে, জ্বর এত বেড়েছে, তুমি লক্ষ্য করলে না এটা কেমন কথা! রহিমার মা ? একশ চার টেম্পারেচার। কত সময় ধরে এ রকম জ্বর কে জানে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
রহিমার মা বলল, আমারে দেন আফা। আমি পানি ঢালি। ‘থাক তােমার আর কষ্ট করতে হবে না। তবে তােমার উপর আজ আমি খুব রাগ করেছি।‘
সেই প্রবল জ্বরের ঘােরের মধ্যে কাদের ঠিক করে ফেলল বড় আপার জন্যে যদি কোনদিন প্রয়ােজন হয় সে জীবন দিয়ে দিবে। বড় আপার যদি কোন শত্রু থাকে–তাকে খুন করে সে ফাঁসি যাবে।
দুপুর নাগাত গত তিন মাসে এ বাড়িতে কি কি ঘটেছে বিলু জেনে গেল। কোন কোন ঘটনা তিনবার চারবার করে শুনতে হল। একবার বলল মিলি, একবার মা, একবার কাদের। প্রতিবারেই বিলু ভান করল যে সে ঘটনাটা প্রথম বারের মত শুনহে।
বিলু আসা উপলক্ষ্যে মিলি ইউনিভার্সিটিতে গেল না। সারাক্ষণ বড় আপার পেছনে পেছনে ঘুরতে লাগল এবং অনবরত কথা বলতে লাগল।
টগর আর নিশার সঙ্গে ভােমার এখনাে দেখা হয় নি পৃথিবীতে এরকম দুষ্ট ছেলেপুলে আছে, না দেখলে তােমার বিশ্বাস হবে না।
‘তাই বুঝি?
‘হ্যা। তবে মুখের দিকে তাকালে তােমার মনে হবে এরা দেব শিশু। ভয়ানক ইন্টেলিজেন্ট। ওদের মা নেই, তােমাকে তাে আগেই চিঠি লিখে জানিয়েছি।‘
বিলু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, আচ্ছা তাের ঐ ডাক্তার সাহেবের খবর কি? মিলি হকচকিয়ে বলল, আমার ডাক্তার সাহেব মানে? আমার ডাক্তার সাহেব বলছ কেন?
বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
‘এনি বললাম, তাের চিঠিতে ভদ্রলােকের কথা প্রথম জানলাম তাে। তুই লজ্জায় এমন লাল হয়ে যাচ্ছিস ব্যাপার কি? সত্যি করে বলতাে–উনাকে কি তাের পছন্দ?
মিলি রেগে গেল। মাথা ঝাকিয়ে বলল, কি যে তুমি বল আপা। ঐ ছাগল’ কে আমি পছন্দ করব কেন? আমার তাে আর মাথা খারাপ হয় নি।
‘তুই রেগে মেগে কেমন হয়ে গেছিস। এটাতে সন্দেহজনক।‘ ‘আমি সত্যি কিন্তু রাগিছি আপা। ‘ভদ্রলােককে খবর দে–না, আমার দেখতে ইচ্ছে করছে।” ‘তাকে খবর দেবার কোন দরকার নেই। দিনের মধ্যে তিনবার করে আসছে। রিহার্সেল করছে। মামার সিনেমায় সেও তাে আছে।
‘বাহ ভালতাে। তােমরা দু’জন আবার নায়ক–নায়িকা না তাে?
‘রাগিয়ে দিওনাতাে আপা। এতদিন পর এসেছ বলে ঝগড়া করলাম না। নয়ত প্রচন্ড ঝগড়া হয়ে যেত। এর মধ্যে আবার নায়ক–নায়িকা কি? | বিলু হাসি মুখে ফরিদের ঘরে ঢুকল। বাড়ির সবার সঙ্গেই কথা হয়েছে শুধু মামার সঙ্গে কথা হয় নি। | ফরিদ মাথা নীচু করে কি যেন লিখছে। বিলুকে এক নজর দেখেও সে লিখেই যেতে লাগল। যেনবিলুকে সে চেনে না।।
‘আসব মামা?
না বললেতাে হবে না। এতদিন পর এসেছি তােমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাও বলব না?” ‘না। কাজ করছি। আগামীকাল ‘হে মাছ’ ছবির অন দ্যা স্পট রিহার্সেল। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। লাষ্ট মিনিট চেঞ্জ যা করার এখনি করতে হবে।‘
তাই বলে তােমাকে আমি সালামও করতে পারব না? বিলু এগিয়ে এসে ফরিদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। ফরিদ বলল, তুই এত ভাল মেয়ে কি করে হলি ব্রে বিল? ছােট বেলায় তাে এত ভাল ছিলি না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ভাল হচ্ছিল। _ শুনে খুশী হলাম মামা।
বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
খুব খুশী হবার কোন কারণ নেই। বুদ্ধি কম মানুষরাই সাধারণত ভাল হয়। আমার ধারণা যত দিন যাচ্ছে তাের বুদ্ধি তত কমে যাচ্ছে।
বিলু খিল খিল করে হেসে উঠল। এমন গাঢ় আনন্দে অনেক দিন সে হাসে নি। এই মানুষটাকে তার বড় ভাল লাগে।
সােবাহান সাহেব তাঁর মনের মত একটা প্রবন্ধ পেয়েছেন। প্রবন্ধের নাম থাইল্যান্ডে মাগুর মাছের চাষ। এই মাছের চাষে বিশাল পুকুর কাটার দরকার নেই–ট্যাংক বা চৌবাচ্চা জাতীয় জলাধার থাকলেই হল। মাছের খাবারের জন্যও আলাদা ভাবে কিছু ভাবতে হবে না। সঙ্গে হাঁস মুরগীর চাষ করতে হবে। মাছের খাবার হবে ––– সােবাহান সাহেব থমকে গেলেন। মাছের খাবার হিসেবে যে সব জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না।
‘মালিকুম স্যার। সােবাহান সাহেব পত্রিকা থেকে মুখ তুলে দেখলেন, আনিস দাঁড়িয়ে আছে। বিব্রত মুখ
‘কিছু বলবে?
‘বুল। ‘এই মাসের বাড়ি ভাড়াটা স্যার দিতে পারছি না। বাড়ি ভাড়া কি তােমার কাছে চাওয়া হয়েছে? ‘জ্বি না।‘ ‘তাহলে বিরক্ত কর কেন? পড়ার মাঝখানে একবার বাধা পড়লে কনসানট্রেসন কেটে যায়।
‘সরি স্যার। কি পড়ছেন?
থাইল্যান্ডের মাগুর চাষ। ‘আপনি তাহলে মাছের ব্যাপারটা নিয়ে সত্যি সত্যি খুব ভাবছেন। ‘হা ভাবছি। ” ‘আপনি বাংলাদেশ মাছে মাছে ছয়লাপ করে দিতে চান তাই না স্যার?
হা চাই।
এখন আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি একটা মজার কথা বলতে চাই শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলাদেশ খুব সত্তা গন্ডার দেশ ছিল। প্রচুর খাদ্য হিল, মাছ মাংস হিল। মূল্য ছিল নাম মাত্র। অথচ তখনো এ দেশে প্রচুর লােক হিল অনাহারে। নাম মাত্র মূল্যেও খাদ্য কেনার মত অর্থ তাদের ছিল না। যদি আপনি সত্যি সত্যি এই দেশ একদিন মাছে মাছে ছয়লাপ করে দেন তাতেও লাভ হবে না। যারা এখন মাছ খেতে পারছে না তারা তখনাে খেতে পারবে না। তাদের টাকা নেই। মূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ
কোথায়? ‘আরেকদিন আপনাকে বলব। আজ আমার একটু কাজ আছে। হে–মাছ সুবির অন লােকেন রিহার্সেল হবে। আপনি হয়ত জানেন না ঐ ছবিতে আমার একটা রােল আছে। স্যার যাই স্লামালিকুম।
আনিস চলে গেল। দীর্ঘ সময় সােবাহান সাহেব মূর্তির মত রইলেন। তাঁর মন আনিসের কথায় সায় দিচ্ছে। তিনি আসল সমস্যা ধরতে পারেন নি। নকল সমস্যা নিয়ে মাতামাতি করছেন। দেশের লােক যদি খেতেই না পারে তাহলে কি হবে মাছের চাষ বাড়িয়ে?
হে মাই ছবির অন লােকেসন রিহার্সেল শুরু হয়েছে। জায়গাটা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পার। বেশ নিরিবিলি। সঙ্গে ক্যামেরা নেই বলে লােকজন জড়াে হয়নি। | ফরিদের মাথায় ক্রিকেট আম্পায়ারদের টুপীর মত সাদা একটা টুপী। সত্যজিৎ রায় নাকি এরকম একটা টুপী পরে স্যুটিং করেন। ফরিদের হাতে কালাে একটা চোঙ। এই চোঙের মাধ্যমে নৌকায় বসা ডাক্তার এবং কাদেরের সাথে যােগাযোেগ হচ্ছে। ডাঙায় আছে মিলি, বিলু এবং আনিস। আনিসের বাচ্চা দুটিও আছে। এরা মনের আনন্দে ছুটাছুটি করছে।