বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

ছুটি নাছাত্ররা মারামারি করে সব বন্ধ ইন্ধ করে দিয়েছেএকমাত্র আমাদের মেডিকেল কলেজটাই খােলা ছিলঐটাও বন্ধ হল

বহুব্রীহি

একা এসেছিস? নাসব মেয়েরা একসঙ্গে এসেছিসন্ধ্যাবেলা লঞ্চে উঠলাম, ঢাকা পৌঁছলাম রাত তিনটায়একটু সকাল হতেই চলে এসেছি‘ 

ভাল করেছিস মাখুব ভাল করেছিস। 

সােবাহান সাহেবের ইচ্ছা করছে চেঁচিয়ে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙ্গাতে, তিনি তা করলেন নানিজেই রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেনবড় মেয়ের সঙ্গে কিছু সময় একা 

একা থাকার আনন্দওতাে কম নয়। 

দুজন চায়ের কাপ নিয়ে বসেছেবিলু এক হাতে বাবাকে জড়িয়ে রেখেছেতার এত ভাল লাগছে। 

বাসার খবর বল বাবা। 

কোন খবরটা শুনতে চাস? মামা নাকি ছবি বানাচ্ছেমিলি চিঠি লিখেছিল। 

সােবাহান সাহেব মুখ বিকৃত করে বললেন, গাধাটা বড় যন্ত্রণা করছেরিহার্সেল টিহার্সেল কি কি করছেবিকেলে বাসায় থাকা মুশকিল। 

বিলু আপন মনে হাসলফরিদ তার খুবই পছন্দের মানুষবিলু হালকা গলায় বলল, মামার পাগলামী কমেনি

না বেড়েছেআমার মনে হয় কিছুদিন পর তালা বন্ধ করে রাখতে হবে। 

ধরে বেঁধে মামার একটা বিয়ে দিয়ে দাও। 

সব কথাই মনে আনবি নাএকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন মানে হয়

বিলু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘর থেকে ঘরে ঘুরতে লাগলমাত্র চার মাস পরে সে ফিরেছে অথচ মনে হচ্ছে যেন কত যুগ পরে ফিরলসব কেমন যেন অচেনা। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

আরে আফা কোন সময়ে আইলেন?কি তাজ্জব! | বিলু প্রথম দেখায় চিনতে পারল নাঅবাক হয়ে তাকিয়ে রইলচোখে চশমা, মুখ ভর্তি দাড়ি চেনা ভঙ্গিতে কে যেন হাসছে। 

আফা আমি কাদেরতুমি দাড়ি কবে রাখলে কাদের? সিনেমায় পাট করতাছি আফামামার সিনেমা, আমার হিরাের পাটখেয়া নৌকার মাঝিতাই নাকি? খেয়া নৌকার মাঝির বুঝি দাড়ি থাকতে হয়?ডিরেকটর সাব চাইছে। 

বিলু হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বললতোমরা বেশ সুখে আছ বলে মনে হচ্ছে কাদের। 

আর সুখসিনেমা করা কি সােজা যন্ত্রণা? চিন্তাভাবনা আছে না? এইটা কি পানিভাত যে মরিচ দিয়া এক ডলা দিলাম আর মুখের মইদ্যে ফেললাম?| বিলু অনেক কষ্টে মুখের হাসি আটকালতার খুব মজা লাগছেকাদেরের মুখও আনন্দে উজ্জ্বলকাদেরের ধারণা এই পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ মহিলা হচ্ছে বিলু আফাবাড়ির সবাই তাকে তুই করে বলে, একমাত্র বিলু আফা বলে তুমি করেএক গ্লাস পানির দরকার হলে বিলু আফা জনে জনে হুকুম দেয় নানিজের পানি নিজে নিয়ে আসে

একবার কাদেরের জ্বর হলচাকর বাকরের জ্বর হলে কে আর খোঁজ করেঘরের এক কোনায় কাবা শড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে হয়কাদের তাই করেছে, শুয়ে আছেজ্বর খুব বেশীচারপাশের পৃথিবী কেমন হলুদ হলুদ লাগছেআচ্ছন্নের মত অবস্থাএমন সময় লক্ষ্য করগ কে যেন তার মাথায় পানি ঢালছেঠান্ডা পানিবড় আরাম লাগছেকাদের চোখ মেলে দেখে বিলুএকমনে পানি ঢালছে এবং রহিমার মাকে কড়া গলায় বলছে, জ্বর এত বেড়েছে, তুমি লক্ষ্য করলে না এটা কেমন কথা! রহিমার মা ? একশ চার টেম্পারেচারকত সময় ধরে রকম জ্বর কে জানে। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

রহিমার মা বলল, আমারে দেন আফাআমি পানি ঢালিথাক তােমার আর কষ্ট করতে হবে নাতবে তােমার উপর আজ আমি খুব রাগ করেছি‘ 

সেই প্রবল জ্বরের ঘােরের মধ্যে কাদের ঠিক করে ফেলল বড় আপার জন্যে যদি কোনদিন প্রয়ােজন হয় সে জীবন দিয়ে দিবেবড় আপার যদি কোন শত্রু থাকেতাকে খুন করে সে ফাঁসি যাবে। 

দুপুর নাগাত গত তিন মাসে বাড়িতে কি কি ঘটেছে বিলু জেনে গেলকোন কোন ঘটনা তিনবার চারবার করে শুনতে হলএকবার বলল মিলি, একবার মা, একবার কাদেরপ্রতিবারেই বিলু ভান করল যে সে ঘটনাটা প্রথম বারের মত শুনহে। 

বিলু আসা উপলক্ষ্যে মিলি ইউনিভার্সিটিতে গেল নাসারাক্ষণ বড় আপার পেছনে পেছনে ঘুরতে লাগল এবং অনবরত কথা বলতে লাগল। 

টগর আর নিশার সঙ্গে ভােমার এখনাে দেখা হয় নি পৃথিবীতে এরকম দুষ্ট ছেলেপুলে আছে, না দেখলে তােমার বিশ্বাস হবে না। 

তাই বুঝি

হ্যাতবে মুখের দিকে তাকালে তােমার মনে হবে এরা দেব শিশু। ভয়ানক ইন্টেলিজেন্টওদের মা নেই, তােমাকে তাে আগেই চিঠি লিখে জানিয়েছি‘ 

বিলু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, আচ্ছা তাের ডাক্তার সাহেবের খবর কি? মিলি হকচকিয়ে বলল, আমার ডাক্তার সাহেব মানে? আমার ডাক্তার সাহেব বলছ কেন

বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

এনি বললাম, তাের চিঠিতে ভদ্রলােকের কথা প্রথম জানলাম তােতুই লজ্জায় এমন লাল হয়ে যাচ্ছিস ব্যাপার কি? সত্যি করে বলতােউনাকে কি তাের পছন্দ

মিলি রেগে গেলমাথা ঝাকিয়ে বলল, কি যে তুমি বল আপাছাগলকে আমি পছন্দ করব কেন? আমার তাে আর মাথা খারাপ হয় নি। 

তুই রেগে মেগে কেমন হয়ে গেছিসএটাতে সন্দেহজনকআমি সত্যি কিন্তু রাগিছি আপাভদ্রলােককে খবর দেনা, আমার দেখতে ইচ্ছে করছেতাকে খবর দেবার কোন দরকার নেইদিনের মধ্যে তিনবার করে আসছেরিহার্সেল করছেমামার সিনেমায় সেও তাে আছে। 

বাহ ভালতােতােমরা দুজন আবার নায়কনায়িকা না তাে

রাগিয়ে দিওনাতাে আপাএতদিন পর এসেছ বলে ঝগড়া করলাম নানয়ত প্রচন্ড ঝগড়া হয়ে যেতএর মধ্যে আবার নায়কনায়িকা কি? | বিলু হাসি মুখে ফরিদের ঘরে ঢুকলবাড়ির সবার সঙ্গেই কথা হয়েছে শুধু মামার সঙ্গে কথা হয় নি| ফরিদ মাথা নীচু করে কি যেন লিখছেবিলুকে এক নজর দেখেও সে লিখেই যেতে লাগলযেনবিলুকে সে চেনে না। 

আসব মামা

না বললেতাে হবে নাএতদিন পর এসেছি তােমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাও বলব না?নাকাজ করছিআগামীকাল হে মাছছবির অন দ্যা স্পট রিহার্সেলনিঃশ্বাস ফেলার সময় নেইলাষ্ট মিনিট চেঞ্জ যা করার এখনি করতে হবে‘ 

তাই বলে তােমাকে আমি সালামও করতে পারব না? বিলু এগিয়ে এসে ফরিদের পা ছুঁয়ে সালাম করলফরিদ বলল, তুই এত ভাল মেয়ে কি করে হলি ব্রে বিল? ছােট বেলায় তাে এত ভাল ছিলি নাযতই দিন যাচ্ছে ততই ভাল হচ্ছিল_ শুনে খুশী হলাম মামা। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

খুব খুশী হবার কোন কারণ নেইবুদ্ধি কম মানুষরাই সাধারণত ভাল হয়আমার ধারণা যত দিন যাচ্ছে তাের বুদ্ধি তত কমে যাচ্ছে। 

বিলু খিল খিল করে হেসে উঠলএমন গাঢ় আনন্দে অনেক দিন সে হাসে নিএই মানুষটাকে তার বড় ভাল লাগে। 

সােবাহান সাহেব তাঁর মনের মত একটা প্রবন্ধ পেয়েছেনপ্রবন্ধের নাম থাইল্যান্ডে মাগুর মাছের চাষএই মাছের চাষে বিশাল পুকুর কাটার দরকার নেইট্যাংক বা চৌবাচ্চা জাতীয় জলাধার থাকলেই হলমাছের খাবারের জন্যও আলাদা ভাবে কিছু ভাবতে হবে নাসঙ্গে হাঁস মুরগীর চাষ করতে হবেমাছের খাবার হবে সােবাহান সাহেব থমকে গেলেনমাছের খাবার হিসেবে যে সব জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। 

মালিকুম স্যারসােবাহান সাহেব পত্রিকা থেকে মুখ তুলে দেখলেন, আনিস দাঁড়িয়ে আছেবিব্রত মুখ 

কিছু বলবে

বুলএই মাসের বাড়ি ভাড়াটা স্যার দিতে পারছি নাবাড়ি ভাড়া কি তােমার কাছে চাওয়া হয়েছে? ‘জ্বি নাতাহলে বিরক্ত কর কেন? পড়ার মাঝখানে একবার বাধা পড়লে কনসানট্রেসন কেটে যায়। 

সরি স্যারকি পড়ছেন

থাইল্যান্ডের মাগুর চাষআপনি তাহলে মাছের ব্যাপারটা নিয়ে সত্যি সত্যি খুব ভাবছেনহা ভাবছিআপনি বাংলাদেশ মাছে মাছে ছয়লাপ করে দিতে চান তাই না স্যার

হা চাই। 

এখন আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি একটা মজার কথা বলতে চাই শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলাদেশ খুব সত্তা গন্ডার দেশ ছিলপ্রচুর খাদ্য হিল, মাছ মাংস হিলমূল্য ছিল নাম মাত্রঅথচ তখনো দেশে প্রচুর লােক হিল অনাহারেনাম মাত্র মূল্যেও খাদ্য কেনার মত অর্থ তাদের ছিল নাযদি আপনি সত্যি সত্যি এই দেশ একদিন মাছে মাছে ছয়লাপ করে দেন তাতেও লাভ হবে না। যারা এখন মাছ খেতে পারছে না তারা তখনাে খেতে পারবে নাতাদের টাকা নেইমূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৫)- হুমায়ূন আহমেদ

কোথায়? আরেকদিন আপনাকে বলবআজ আমার একটু কাজ আছেহেমাছ সুবির অন লােকেন রিহার্সেল হবেআপনি হয়ত জানেন না ছবিতে আমার একটা রােল আছেস্যার যাই স্লামালিকুম। 

আনিস চলে গেলদীর্ঘ সময় সােবাহান সাহেব মূর্তির মত রইলেনতাঁর মন আনিসের কথায় সায় দিচ্ছেতিনি আসল সমস্যা ধরতে পারেন নিনকল সমস্যা নিয়ে মাতামাতি করছেনদেশের লােক যদি খেতেই না পারে তাহলে কি হবে মাছের চাষ বাড়িয়ে

হে মাই ছবির অন লােকেসন রিহার্সেল শুরু হয়েছেজায়গাটা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পার। বেশ নিরিবিলিসঙ্গে ক্যামেরা নেই বলে লােকজন জড়াে হয়নি| ফরিদের মাথায় ক্রিকেট আম্পায়ারদের টুপীর মত সাদা একটা টুপীসত্যজিৎ রায় নাকি এরকম একটা টুপী পরে স্যুটিং করেনফরিদের হাতে কালাে একটা চোঙ। এই চোঙের মাধ্যমে নৌকায় বসা ডাক্তার এবং কাদেরের সাথে যােগাযোেগ হচ্ছেডাঙায় আছে মিলি, বিলু এবং আনিসআনিসের বাচ্চা দুটিও আছেএরা মনের আনন্দে ছুটাছুটি করছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *