নৌকায় ডাক্তারকে খুব নাভাস দেখাচ্ছে। তার হাতে একটা জাল। গােল করে জাল ফেলার প্যাকটিস সে ভালই করেছে। জাল এখন সে ফেলতে পারে। তবে নৌকা দুলছে, দুলুনির মধ্যে ।
জাল ঠিকমত ফেলতে পারবে কিনা এই নিয়ে সে চিন্তিত। ডাক্তারের পরনে জেলের পােষাক তবে চুল এখনাে ছাটা হয়নি। কাদের বৈঠা নিয়ে বসে আছে। তাকে খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। ফরিদের নির্দেশে তারা নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকা মাঝ নদীতে যাবার পর অভিনয় হবে। ডাক্তার ভীত গলায় বলল, কাদের ভয় লাগছে।
কাদের বলল ভয়ের কি আছে ডাক্তার সাব? উপরে আল্লাহ নীচে মাডি। ‘মাটি কোথায় ? নীচে তাে পানি। ‘একই হইল। আল্লাহর কাছে মাডি যা, পানিও তা। আল্লাহর চোউখ্যে সব সমান। ‘সাঁতার জানিনা যে কাদের। ‘সীতার আমিও জানি না ডাক্তার সাব। মরণতাে একদিন হইবই। অত চিন্তা করলে চলবে । পানিতে ডুইব্যামরার মজা আছে।
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, মরার মধ্যে আবার কি মজা? ‘শহীদের রক্ষা পাওয়া যায়। হাদিস কোরানের কথা।
‘শহীদের দরজার আমার দরকার নেই কাদের। নৌকা এত দুলছে কেন?” ডাঙ্গা থেকে চোঙ মারফত ফরিদের নির্দেশ ভেসে এল–ডাক্তার স্টার্ট করে দাও–রেডি ওয়ান–টু–এ্যাকসান।
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
‘একসানে যাবার আগেই দৃশ্য কাট হয়ে গেল। ফরিদ বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল–কাট, কাট, এই হারামজাদা কাদের চশমা পরেছিস কেন? খােল চশমা।
কাদের চশমা খুলল। সে খুব শখ করে চশমা পরেছিল। একসান। ডাক্তার তুমি বিষন্ন চোখে আকাশের দিকে তাকাও। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেল। আবার তাকাও আকাশের দিকে। গুড়। কাদের তুই কানের ফাঁকে রাখা বিড়ি ধরা। গুড। পানিতে থুথু ফেল। পুরাে ব্যাপারটা ন্যাচারেল হতে হবে। ডাক্তার তুমি জালকে তিনবার সালাম কর। গুড়। ভাল হচ্ছে। এই বার জাল ফেল।
ডাক্তার জাল ফেলল। আশ্চর্য কান্ড পানিতে শুধু জাল পড়ল না, জালের সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডাক্তারও পড়ে গেল। জাল এবং ডাক্তার দুইই মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য, ব্যাপারটা ঘটল চোখের পলকে।
কাদের বিড় বিড় করে বলল, বিষয় কিছুই বুঝলাম না। ফরিদ হতভম্ব।। মিলি বলল, মামা ডাক্তার তাে ডুবে গেছে।
ফরিদ থমথমে গলায় বলল, ‘তাইতাে দেখছি। এই গাধা কি সাঁতারও জানে না ? গরু গাধা নিয়ে ছবি করতে এসে দেখি বিপদে পড়লাম।
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
ডাক্তারের মাথা ভুস করে ভেসে উঠল। কি যেন বলে আবার ডুবে গেল। আবার ভাসল, আবার ডুবল। ফরিদ বলল, ছেলেটাতােবড় যন্ত্রণা করছে।
আনিস চেঁচিয়ে বলল, ডাক্তার মরে যাচ্ছে। আমি সাঁতার জানিনা। সাঁতার জানা কে আছেন? কে আছেন সীতার জানা? ঝুপঝুপ করে দু’বার শব্দ হল। বিলু এবং মিলি দুজনই পানিতে ঝাপিয়ে পড়েছে। দ্রুত
এগিয়ে যাচ্ছে ভুবন্ত ডাক্তারের দিকে। ফরিদ চমৎকৃত। এই মেয়ে দুটি সাঁতার শিখল কবে?
আবার ঝুপ ঝুপ শব্দ। টগর এবং নিশাও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওদের তুলে আনার জন্যে আনিস এবং ফরিদকেও পানিতে লাফিয়ে পড়তে হল।
ডাক্তারের জ্ঞান ফিরল হলি ফেমিলি হাসপাতালে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কোথায়? মিলি বলল, আপনি হাসপাতালে। ‘কেন?
ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, উজবুকটাকে একটা চড় লাগাততা। আবার জিজ্ঞেস করে ‘কেন?’ ফাজিল কোথাকার।
ডাক্তার ক্ষীণ গলায় বলল, আমি কি এখনাে বেঁচে আছি?
রিকশা এসে থেমেছে নিরিবিলির সামনে। রিকশায় বসে আছে পাকুন্দিয়ার এমদাদ খােন্দকার। সঙ্গে তার নাতনী পুতুল। এমদাদ খােন্দকারের বয়স ষাটের উপরে। অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। মামলা মুকদ্দমায় মিথ্যা সাক্ষি দেয়া তাঁর আজীবন পেশা। গ্রামের জমি জমা সংক্রান্ত মামলায় তিনি দুই পক্ষেই শলা পরামর্শ দেন। নিয়ম থাকলে দু‘পক্ষের হয়ে সাক্ষিও দিতেন, নিয়ম নেই বলে দিতে পারেন না। জাল দলিল তৈরীর ব্যাপারেও তার প্রবাদ তুল্য খ্যাতি আছে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
পুতুলের বয়স পনেরো। এবার মেট্রিক পাশ কৱেহে। ফাষ্ট ডিভিশন এবং দু‘টা ৫
লেটার। রেজাল্ট বের হবার পর এমদাদ খােন্দকার খুব আফসােস করেছে–নাতনী যদি নকল করতে রাজি হত তাহলে ফাটাফাটি ব্যাপার হত, নকল ছাড়াই এই অবস্থা।
পুতুলকে নিয়ে এমদাদ খােন্দকার নিরিবিলিতে কেন এসেছে তা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে না। পুতুলও কিছু জানে না। তাকে বলা হয়েছে ঢাকায় কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে যাচ্ছে, উঠবে সােবাহান সাহেবের বাড়ি। সােবাহান সাহেব তাদের কোন আত্মীয় না হলেও অপরিচিত নন। পাকুন্দিয়া গ্রামের কলেজটি তিনি নিজের টাকায় নিজের জমিতে করে দিয়েছেন। মেয়েদের একটি স্কুল দিয়েছেন, মসজিদ বানিয়েছেন।
সােবাহান সাহেব তাঁর যৌবনের রােজগারের একটি বড় অংশ এই গ্রামে ঢেলে দিয়েছেন, কাজেই গ্রামের মানুষদের কাছে তিনি অপরিচিত নন। পুতুল তাঁকে চেনে। তাঁর স্কুল থেকেই সে মেট্রিক পাশ করেছে। | রিকশা থেকে নামতে নামতে পুতুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, কী বড় বাড়ি দেখছ দাদাজান?
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
এমদাদ মুখ বিকৃত করে বলল, পয়সার মা–বাপ নাই বাড়ি বড় হইব না–তাে কি। চোরা পয়সা।
পুতুল দুঃখিত গলায় বলল, “চোরা–পয়সা ? কি যে তুমি কও দাদাজান। এমন একটা বালা মানুষ। কত টেকা পয়সা দিছে গেরামে –
‘টেকা পয়সা দিলেই মানুষ বালা হয়? এদের শইল্যে আছে বদ রক্ত। এরারে আমি চিনি। না? হাড়ে গােশতে চিনি। | পুতুল কিছু বলল না। তার দাদাজানের চরিত্র সে জানে, মানুষের ভাল দিক তার চোখে পড়ে না। হয়ত কোনদিন পড়বে না।
“জ্বি দাদাজান।
এমদাদ গলা নীচু করে বলল, ‘সােবাহান সাহেবের দাদার বাপ ছিল বিখ্যাত চোর। এরা হইল চোর বংশ।
“চুপ করতাে দাদাজান। “আইচ্ছা চুপ করলাম।
এমদাদ নাতনীকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। সােবাহান সাহেব বারান্দায় বসে ছিলেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চিনতে পারলাম নাতাে। এমদাদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘আমি এমদাদ। পাকুন্দিয়ার এমদাদ খােন্দকার।
ও আচ্ছা আচ্ছা–আমি অবশ্যি এখনাে চিনতে পারিনি।‘ ‘চিনবার কথাও না–আমি হইলাম জুতার ময়লা। আর আপনে হইলেন–বটবৃক্ষ।” ‘বটবৃক্ষ।
‘জ্বি বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষে কি হয়–রাজ্যের পাখি আশ্রয় নেয়। আপনে হইলেন আমাদের আশ্রয়। বিপদে পড়ে আসছি জনাব।”
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কি বিপদ?
‘বলব। সব বলব। আপনেরে বলবনাতাে বলব কারে? পুতুল ইনারে সেলাম কর। ইনারা মহাপুরুষ মানুষ। দেখলেই পূণ্য হয়।
পুতুল এগিয়ে গেল। সােবাহান সাহেব পুতুলের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন, যাও ভিতরে যাও। হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া কর। তারপর শুনব কি সমস্যা।
এমদাদ বলল, ভাইসাব আমারে একটু নামাজের জায়গা দিতে হয়। দুই ওক্ত নামাজ কাজী হয়েছে। নামাজ কাজা হইলে ভাইসাব আমার মাথা ঠিক থাকে না।
‘অজুর পানি লাগবে? ‘অজু লাগবে না।, অজু আছে। আমার সব ভাঙ্গে অজু ভাঙ্গে না। হা হা হা।
সােবাহান সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। আর তখন ঘরে ঢুকল ফরিদ। এমদাদ বলল, ভাইজান পশ্চিম কোন দিকে?
ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, পশ্চিম কোন দিকে আমি কি জানি? আমি কি কম্পাস না কি? ‘বাবাজীর পরিচয়? ‘বাবাজী ডাকবেন না।‘ “রাগ করেন কেন ভাই সাহেব। ‘আপনি কে? ‘আমার নাম এমদাদ। এমদাদ খােন্দকার। “ও আচ্ছা।
ভাইসাব ভাল আছেন?
ফরিদ অগ্নিদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল। এমদাদ ধাঁধায় পড়ে গেল। এই মানুষটির চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষের চরিত্র পুরােপুরি বুঝতে না পারা পর্যন্ত তার বড় অশান্তি লাগে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিস বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। সুন্দর লাগছে ছাদটা। টবের ফুলগাছগুলিতে চাঁদের আলাে এসে পড়েছে। ছাদে আলাে–ছায়ার নকশী। হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ছে, নকশাগুলিও বদলে যাচ্ছে। আনিস ভারী গলায় বলল,
আলােটুকু তােমায় দিলাম। ছায়া থাক আমার কাছে।
আনিসের কথা শেষ হল না তার আগেই নারী কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আওয়াজ পাওয়া গেল–কে আপনি? আপনি কে?
আনিস হকচকিয়ে গেল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে লম্বামত একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখ দেখা যাচ্ছে না।