বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

নৌকায় ডাক্তারকে খুব নাভাস দেখাচ্ছেতার হাতে একটা জালগােল করে জাল ফেলার প্যাকটিস সে ভালই করেছেজাল এখন সে ফেলতে পারেতবে নৌকা দুলছে, দুলুনির মধ্যে ।

বহুব্রীহি

জাল ঠিকমত ফেলতে পারবে কিনা এই নিয়ে সে চিন্তিতডাক্তারের পরনে জেলের পােষাক তবে চুল এখনাে ছাটা হয়নিকাদের বৈঠা নিয়ে বসে আছেতাকে খুব উৎফুল্ল মনে হচ্ছেফরিদের নির্দেশে তারা নৌকা ছেড়ে দিলনৌকা মাঝ নদীতে যাবার পর অভিনয় হবেডাক্তার ভীত গলায় বলল, কাদের ভয় লাগছে। 

কাদের বলল ভয়ের কি আছে ডাক্তার সাব? উপরে আল্লাহ নীচে মাডিমাটি কোথায় ? নীচে তাে পানিএকই হইলআল্লাহর কাছে মাডি যা, পানিও তাআল্লাহর চোউখ্যে সব সমানসাঁতার জানিনা যে কাদেরসীতার আমিও জানি না ডাক্তার সাবমরণতাে একদিন হইবইঅত চিন্তা করলে চলবে পানিতে ডুইব্যামরার মজা আছে। 

ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, মরার মধ্যে আবার কি মজা? শহীদের রক্ষা পাওয়া যায়হাদিস কোরানের কথা। 

শহীদের দরজার আমার দরকার নেই কাদেরনৌকা এত দুলছে কেন?ডাঙ্গা থেকে চোঙ মারফত ফরিদের নির্দেশ ভেসে এলডাক্তার স্টার্ট করে দাওরেডি ওয়ানটুএ্যাকসান। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

একসানে যাবার আগেই দৃশ্য কাট হয়ে গেল। ফরিদ বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলকাট, কাট, এই হারামজাদা কাদের চশমা পরেছিস কেন? খােল চশমা। 

কাদের চশমা খুললসে খুব শখ করে চশমা পরেছিলএকসানডাক্তার তুমি বিষন্ন চোখে আকাশের দিকে তাকাওদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলআবার তাকাও আকাশের দিকেগুড়কাদের তুই কানের ফাঁকে রাখা বিড়ি ধরাগুডপানিতে থুথু ফেলপুরাে ব্যাপারটা ন্যাচারেল হতে হবেডাক্তার তুমি জালকে তিনবার সালাম করগুড়ভাল হচ্ছেএই বার জাল ফেল। 

ডাক্তার জাল ফেললআশ্চর্য কান্ড পানিতে শুধু জাল পড়ল না, জালের সঙ্গে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ডাক্তারও পড়ে গেলজাল এবং ডাক্তার দুইই মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য, ব্যাপারটা ঘটল চোখের পলকে। 

কাদের বিড় বিড় করে বলল, বিষয় কিছুই বুঝলাম নাফরিদ হতভম্বমিলি বলল, মামা ডাক্তার তাে ডুবে গেছে। 

ফরিদ থমথমে গলায় বলল, তাইতাে দেখছিএই গাধা কি সাঁতারও জানে না ? গরু গাধা নিয়ে ছবি করতে এসে দেখি বিপদে পড়লাম। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তারের মাথা ভুকরে ভেসে উঠলকি যেন বলে আবার ডুবে গেলআবার ভাসল, আবার ডুবলফরিদ বলল, ছেলেটাতােবড় যন্ত্রণা করছে। 

আনিস চেঁচিয়ে বলল, ডাক্তার মরে যাচ্ছেআমি সাঁতার জানিনাসাঁতার জানা কে আছেন? কে আছেন সীতার জানা? ঝুপঝুপ করে দুবার শব্দ হলবিলু এবং মিলি দুজনই পানিতে ঝাপিয়ে পড়েছেদ্রুত 

এগিয়ে যাচ্ছে ভুবন্ত ডাক্তারের দিকেফরিদ চমৎকৃতএই মেয়ে দুটি সাঁতার শিখল কবে

আবার ঝুপ ঝুপ শব্দটগর এবং নিশাও পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেওদের তুলে আনার জন্যে আনিস এবং ফরিদকেও পানিতে লাফিয়ে পড়তে হল। 

ডাক্তারের জ্ঞান ফিরল হলি ফেমিলি হাসপাতালে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কোথায়? মিলি বলল, আপনি হাসপাতালে। কেন

ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, উজবুকটাকে একটা চড় লাগাততাআবার জিজ্ঞেস করে কেন?ফাজিল কোথাকার। 

ডাক্তার ক্ষীণ গলায় বলল, আমি কি এখনাে বেঁচে আছি

রিকশা এসে থেমেছে নিরিবিলির সামনেরিকশায় বসে আছে পাকুন্দিয়ার এমদাদ খােন্দকারসঙ্গে তার নাতনী পুতুলএমদাদ খােন্দকারের বয়স ষাটের উপরেঅতি ধুরন্ধর ব্যক্তিমামলা মুকদ্দমায় মিথ্যা সাক্ষি দেয়া তাঁর আজীবন পেশাগ্রামের জমি জমা সংক্রান্ত মামলায় তিনি দুই পক্ষেই শলা পরামর্শ দেননিয়ম থাকলে দুপক্ষের হয়ে সাক্ষিও দিতেন, নিয়ম নেই বলে দিতে পারেন নাজাল দলিল তৈরীর ব্যাপারেও তার প্রবাদ তুল্য খ্যাতি আছে। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

পুতুলের বয়স পনেরোএবার মেট্রিক পাশ কৱেহে। ফাষ্ট ডিভিশন এবং দুটা ৫ 

লেটাররেজাল্ট বের হবার পর এমদাদ খােন্দকার খুব আফসােস করেছেনাতনী যদি নকল করতে রাজি হত তাহলে ফাটাফাটি ব্যাপার হত, নকল ছাড়াই এই অবস্থা। 

পুতুলকে নিয়ে এমদাদ খােন্দকার নিরিবিলিতে কেন এসেছে তা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে নাপুতুলও কিছু জানে নাতাকে বলা হয়েছে ঢাকায় কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে যাচ্ছে, উঠবে সােবাহান সাহেবের বাড়িসােবাহান সাহেব তাদের কোন আত্মীয় না হলেও অপরিচিত ননপাকুন্দিয়া গ্রামের কলেজটি তিনি নিজের টাকায় নিজের জমিতে করে দিয়েছেনমেয়েদের একটি স্কুল দিয়েছেন, মসজিদ বানিয়েছেন

সােবাহান সাহেব তাঁর যৌবনের রােজগারের একটি বড় অংশ এই গ্রামে ঢেলে দিয়েছেন, কাজেই গ্রামের মানুষদের কাছে তিনি অপরিচিত ননপুতুল তাঁকে চেনেতাঁর স্কুল থেকেই সে মেট্রিক পাশ করেছে| রিকশা থেকে নামতে নামতে পুতুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, কী বড় বাড়ি দেখছ দাদাজান

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

এমদাদ মুখ বিকৃত করে বলল, পয়সার মাবাপ নাই বাড়ি বড় হইব নাতাে কিচোরা পয়সা। 

পুতুল দুঃখিত গলায় বলল, চোরাপয়সা ? কি যে তুমি কও দাদাজানএমন একটা বালা মানুষকত টেকা পয়সা দিছে গেরামে – 

টেকা পয়সা দিলেই মানুষ বালা হয়? এদের শইল্যে আছে বদ রক্তএরারে আমি চিনিনা? হাড়ে গােশতে চিনি| পুতুল কিছু বলল নাতার দাদাজানের চরিত্র সে জানে, মানুষের ভাল দিক তার চোখে পড়ে নাহয়ত কোনদিন পড়বে না। 

জ্বি দাদাজান। 

এমদাদ গলা নীচু করে বলল, সােবাহান সাহেবের দাদার বাপ ছিল বিখ্যাত চোরএরা হইল চোর বংশ। 

চুপ করতাে দাদাজানআইচ্ছা চুপ করলাম। 

এমদাদ নাতনীকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলসােবাহান সাহেব বারান্দায় বসে ছিলেনতিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চিনতে পারলাম নাতােএমদাদ বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, আমি এমদাদপাকুন্দিয়ার এমদাদ খােন্দকার। 

আচ্ছা আচ্ছাআমি অবশ্যি এখনাে চিনতে পারিনিচিনবার কথাও নাআমি হইলাম জুতার ময়লাআর আপনে হইলেনবটবৃক্ষবটবৃক্ষ। 

জ্বি বটবৃক্ষবটবৃক্ষে কি হয়রাজ্যের পাখি আশ্রয় নেয়আপনে হইলেন আমাদের আশ্রয়বিপদে পড়ে আসছি জনাব” 

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

কি বিপদ

বলবসব বলবআপনেরে বলবনাতাে বলব কারে? পুতুইনারে সেলাম করইনারা মহাপুরুষ মানুষদেখলেই পূণ্য হয়। 

পুতুল এগিয়ে গেলসােবাহান সাহেব পুতুলের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন, যাও ভিতরে যাওহাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করতারপর শুনব কি সমস্যা। 

এমদাদ বলল, ভাইসাব আমারে একটু নামাজের জায়গা দিতে হয়দুই ওক্ত নামাজ কাজী হয়েছেনামাজ কাজা হইলে ভাইসাব আমার মাথা ঠিক থাকে না। 

অজুর পানি লাগবে? অজু লাগবে না, অজু আছেআমার সব ভাঙ্গে অজু ভাঙ্গে নাহা হা হা। 

সােবাহান সাহেব ভেতরে চলে গেলেনআর তখন ঘরে ঢুকল ফরিদএমদাদ বলল, ভাইজান পশ্চিম কোন দিকে

ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, পশ্চিম কোন দিকে আমি কি জানি? আমি কি কম্পাস না কি? বাবাজীর পরিচয়? বাবাজী ডাকবেন নারাগ করেন কেন ভাই সাহেবআপনি কে? আমার নাম এমদাদএমদাদ খােন্দকারআচ্ছা। 

ভাইসাব ভাল আছেন

ফরিদ অগ্নিদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলএমদাদ ধাঁধায় পড়ে গেলএই মানুষটির চরিত্র সে ঠিক বুঝতে পারছে নামানুষের চরিত্র পুরােপুরি বুঝতে না পারা পর্যন্ত তার বড় অশান্তি লাগে। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৬)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিস বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছেসুন্দর লাগছে ছাদটাটবের ফুলগাছগুলিতে চাঁদের আলাে এসে পড়েছেছাদে আলােছায়ার নকশীহাওয়ায় গাছের পাতা নড়ছে, নকশাগুলিও বদলে যাচ্ছেআনিস ভারী গলায় বলল

আলােটুকু তােমায় দিলামছায়া থাক আমার কাছে। 

আনিসের কথা শেষ হল না তার আগেই নারী কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আওয়াজ পাওয়া গেলকে আপনি? আপনি কে

আনিস হকচকিয়ে গেলদেয়ালে ঠেস দিয়ে লম্বামত একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছেতার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকামুখ দেখা যাচ্ছে না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *