এমদাদ প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। সহজ গলায় বলল, জ্বি জনাব দেখেছি। চোখ মেলে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে ঘুমাতে দেখেছি।
‘কাকে দেখেছেন? ‘ঘােড়াকে। ঘােড়া দাঁড়ায়ে দাঁড়ায় ঘুমায়। লােকটির স্পধায় ফরিদ হতভম্ব।। ‘আমাকে দেখে আপনার কি ধারণা হয়েছে যে আমি একটা ঘােড়া? ‘জি না। ‘আপনি বয়স্ক প্রবীণ একজন মানুষ বলেই আমি এই দফায় আপনাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আর করা হবে না।’
জি আচ্ছা। ‘আপনি কখনাে আমার ঘরে ঢুকবেননা। ‘জিআচ্ছা।
দাড়িয়ে আছেন কেন চলে যান। একটা সিগারেটের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। বাবাজী কি সিগারেট খান? ‘খাই কিন্তু আপনাকে সিগারেট দেয়া হবে না। আপনি যেতে পারেন। ‘জ্বি আচ্ছা। জিনিযুটা অবশ্য স্বাস্থ্যের জইন্যেও খারাপ।
এমদাদ বের হয়ে এল। ফরিদের ঘরের ঘটনা তাকে খুব একটা বিচলিত করল না। বরংচ সে খানিকটা মজাই পেল। বড় ধরনের বেকুব সংসারে থাকা ভাল। যে সংসারে বড় ধরনের কোন বেকুব থাকে সেই সংসারে কখনাে ভয়াবহ কোন সমস্যা হয় না। বােকাগুলি কোন না কোনভাবে সমস্যা পাতলা করে দেয়। এমদাদ রাস্তায় বের হল। চাপ খাওয়ার পর তার একটা সিগারেট দরকার।
বহুব্রীহি পর্ব (১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
অপরিচিত মানুষের কাছে টাকা চাওয়া সমস্যা কিন্তু সিগারেট চাওয়া কোন সমস্যা না। এমদাদ আধ ঘন্টার মধ্যে ছ’টা সিগারেট জোগাড় করে ফেলল। তার টেকনিকটা এ রকম সিগারেট ধরিয়ে কোন ভদ্রলােক হয়ত আসছে—এমদাদ হাসি মুখে এগিয়ে যাবে।
‘স্নামালিকুম ভাইসাব। অপরিচিত ভদ্রলােক থমকে দআতড়য়ে বিস্মিত গলায় বললেন, আমাকে কিছু বলছেন? ‘জ্বি। “বলুন
‘আমার হার্টের অসুখ। ডাক্তার সিগারেট বন্ধ করে দিয়েছে। লুকিয়ে চুকিয়ে যে একটা টান দিব সেই উপায় নাই। ঘর থেকে একটা পয়সা দেয় না। ভাই এখন আপনি যদি একটা সিগারেট দেন জীবনটা রক্ষা হয়।
ডাক্তার যখন নিষেধ করেছে তখন তাে সিগারেট খাওয়া উচিত হবে না।’ ‘কয়দিন আর বাঁচব বলেন ? এখন সিগারেট খাওয়া না খাওয়া তাে সমান।
এরপর আর কথা চলে না। অপরিচিত ভদ্রলােক পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করেন। এমদাদ হাসি মুখে বলে, দুটা দিয়ে দেন ভাই সাহেব। রাতে খাওয়ার পর একটা খাব।
এমদাদ যখন সিগারেটের সঞ্চয় বাড়াতে ব্যস্ত তখন বাড়ির ভেতর ছােট্ট একটা নাটক হল। মিনু তিনশ টাকা হাতে নিয়ে পুতুলকে বললেন, মা এই টাকাটা তােমার দাদাকে দিও। পুতুল বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের টাকা?
‘উনার মানিব্যাগ পকেটমার হয়ে গেল। উনি বলছিলেন।
‘পুতুল কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, কই দাদাজানের কোন টাকাতাে পকেটমার হয় নাই। ঐতাে দাদাজানের মানিব্যাগ।
বহুব্রীহি পর্ব (১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
কাটা রাখ। ‘মানা-আমি টাকা রাখবনা। মিনু বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন-পুতুলের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি বেশ অবাক হলেন। মিনু কোমল গলায় বললেন, কি ব্যাপার পুতুল? পুতুল ধরা গলায় বলল-দাদাজান মিথ্যা কথা বললে আমার বড় কষ্ট হয়।
‘হয়ত মিথ্যা কথা না। হয়ত উনি ভুলে গেছেন। ‘না উনি ভুলেন নাই। উনি সহজে কিছু ভুলেন না।
পুতুলের কান্নার বেগ ক্রমেই বাড়তে লাগল। মিনু পুরােপুরি হকচকিয়ে গেলেন। এই মেয়েটা মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য রকম। তিনি নিতান্ত অপরিচিত এই মেয়েটির প্রতি এক ধরনের মমতা অনুভব করলেন।
নিরিবিলি বাড়িতে ক্রাইসিস তৈরী হতে বেশী সময় লাগে না। রাত আটটা দশ মিনিটে একটা ক্রাইসিস তৈরী হয়ে গেল। অবশ্যি এটা যে একটা ক্রাইসিস শুরুতে তা বােঝা গেল না। রাতের টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। সােবাহান সাহেব হাত ধুয়েছেন। তাঁর প্লেটে বিলু ভাত দিতে যাচ্ছে তিনি বললেন, ঔপ।
বিলু বলল, ভাত দেব না বাবা?
না।’ প্লেট বােধহয় ভাল করে দেয়া হয়নি তাই না? ওসব কিছুনা। সােবাহান সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মিনু বললেন, শরীর খারাপ লাগছে? সােবাহান সাহেব অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ করলেন। এই শব্দের কোন অর্থ নেই।
রাত সাড়ে নটার দিকে জানা গেল ক্ষুধার প্রকৃত স্বরূপ কি তা জানার জন্যে তিনি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আগামী দশদিন তিনি পানি ছাড়া কিছুই খাবেন না!
বহুব্রীহি পর্ব (১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
বিলু বাবাকে বােঝানাের জন্যে তাঁর ঘরে গেল। হাইপারটেনসনের রুগীকে অনিয়ম করলে চলে না। বিলুর সঙ্গে সােবাহান সাহেবের নিম্ন লিখিত কথাবাতা হল।
‘বিলুঃ বাবা তুমি ভাত খাবে না।’ বাবাঃ না। বিলুঃ ভাত খাবে না কারণ তােমাকে ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে হবে? বাবাঃ হ্যাঁ। বিলুঃ কেন বলতাে? ক্ষুধার স্বরূপ বুঝে তােমার হবেটা কি? তুমি যদি একজন কবি
হতে তাহলে একটা কথা হত। ক্ষুধা সম্পর্কে কবিতা লিখতে। গদ্যকার হলে আমরা ক্ষুধার অসাধারণ বর্ণনা পেতাম। তুমি যদি রাজনীতিবিদ হতে তাহলেও লাভ ছিল, গরীব দুঃখীদের কষ্ট বুঝতে-তুমি বলতে গেলে কিছুই না। তাহলে
তুমি কেন কষ্ট করছ? বাবাঃ তুই ঘর থেকে যা। তুই বড় বিরক্ত করছিস। বিলুঃ তুমি যদি কিছু না খাও তাহলে মা-ও খাবে না। বাবাঃ সেটা তার ব্যাপার। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।
বিলুঃ না খেয়ে কতদিন থাকবে? বাবাঃ যতদিন পারি। বিলুঃ অনশনে যাবার এই বুদ্ধি তােমাকে কে দিয়েছে বাবা? দোতলার আনিস সাহেব? বাবাঃ হ্যাঁ। বিলুঃ আমিও তাই ভেবেছিলাম। বিলু দোতলায় উঠে এল। তার মুখ থম থম করছে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিসের দুটি বাচ্চাই শুয়ে আছে। দু’জনের চোখই বন্ধ। কোন সাড়াশব্দ করছে না। কারণ আনিস ঘােষণা করেছে সবচে বেশী সময় যে কথা না বলে থাকতে পারবে সে পাঁচ টাকা পুরস্কার পাবে। পুরস্কারের পাচটা টাকা খামে ভর্তি করে টেবিলের উপর রেখে দেয়া আছে। আনিসের ধারণা পুরস্কারের লােভে চুপ করে থাকতে থাকতে দুজনই এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে। যদিও লক্ষণ তেমন মনে হচ্ছে না। টগর এবং নিশা মুখে কথা বলছে না ঠিকই কিন্তু ইশারায় কথা বলছে। দুজনই হাত ও ঠেটি নাড়ছে। এই সব কীর্তি কলাপ বিলুকে ঢুকতে দেখে থেমে গেল। দুজনই চোখ বন্ধ করে মরার মত পড়ে রইল। যেন ঘুমুচ্ছে।
বিলু বলল, আনিস সাহেব, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি? আনিস হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। কোমল গলায় বলল, অবশ্যই পারেন। ‘আপনার সঙ্গে আমার ফরমাল পরিচয় হয়নি-আমার নাম
আনিস বলল, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আপনার হয়ত মনে নেই। আপনার নাম বিলু, বরিশাল মেডিকেল কলেজে পড়েন। একবার ছাদে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন। আপনি বসুন।
বহুব্রীহি পর্ব (১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
‘না আমি বসার জন্যে আসিনি। ‘ঝগড়া করতে এসেছেন?” ‘হ্যা।
আনিস হাসতে হাসতে বলল, এটা অদ্ভুত ব্যাপার যে সবাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে। এতদিন পর্যন্ত এ বাড়ি আছি অথচ এখন পর্যন্ত একজন কেউ এসে বলল , আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
বিলু আনিসের হালকা কথাবাতার ধার দিয়েও গেল না। কঠিন গলায় বলল, আপনি কি বাবাকে উপােষ দিতে বলেছেন?
‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’ ‘আপনি কি বাবাকে বুঝিয়েছেন ক্ষুধার স্বরূপ বােঝার জন্যে না খেয়ে থাকার প্রয়ােজন।
আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কি না খেয়ে আছেন না-কি?