বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

কি সর্বনাশআমি শুধুমাত্র কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম যে আমরা যারা সৌখিন সমস্যাবিদ তারা মূল সমস্যা নিয়ে ভাসা ভাসা কথাবাতা বলিকারণ মূল সমস্যা আমরা জানি নাক্ষুধা যে কি ভয়াবহ ব্যাপার তা আমরা অর্থাৎ তথাকথিত মধ্যবিত্ত সমস্যা বিশারদরা জানি না

বহুব্রীহিকারণ আমাদের কখনাে ক্ষুধার্ত থাকতে হয় নারােজার সময় বেশ কিছু সময় ক্ষুধার্ত থাকি সেও খুবই সাময়িক ব্যাপারতখন আমাদের মনের মধ্যে থাকে সূর্যটা ডুবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর খাদ্য দ্রব্য চলে আসবেকাজেই ক্ষুধার স্বরূপ 

বিলু আনিসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে হাত জোর করে অনুরােধ করছি আপনার এই সব চমৎকার থিওরী দয়া করে নিজের মধ্যেই রাখবেনবাবাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন 

নাউনি সব কিছুই খুব সিরিয়াসলি নেননিজের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করেন, আমাদের জন্যেওসমস্যা সৃষ্টি করেনআমি কি বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন

জ্বি পারছি। 

সুযােগ যখন পাওয়া গেছে তখন আরাে একটা কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছিকথাটা হচ্ছেআপনি যে আপনার বাচ্চাদের মাধ্যমে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছেন এতে আমি শুধু অবাক হয়েছি তাই নাদুঃখিত হয়েছি, রাগ করেছি, বিরক্ত হয়েছিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা আমি পছন্দ করি না বলেই এতদিন চুপচাপ ছিলামআজ বলে ফেললাম। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিসকে একটি কথা বলারও সুযােগ না দিয়ে বিলু নীচে নেমে গেলআনিস ডাকল, টগর টগরটগর জেগে আছে তবু কথা বলছে নাকথা বললেই বাজীতে হারতে হয়আনিস বলল, টগর কথা বল এখন কথা বললে বাজীর কোন হেরফের হবে নাটগর। 

বিলু মেয়েটিকে তুমি কি বলে? আমি কিছু বলিনিনিশা বলেছেনিশা, তুমি কি বলেছ? আমার মনে নেইমনে করার চেষ্টা করতুমি কি বলে? নিশা কোন শব্দ করল নাটগর বলল, নিশা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবাআনিস বলল, তােমার কি মনে আছে নিশা কি বলেছে

মনে আছেবলতে শুনিনিশা উনাকে বলেছেআৰু আপনাকে বিয়ে করবেতখন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেনতখন আমরা আপনাকে আম্মু ডাকব| আনিস হতভম্ভ হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলঅনেক কষ্টে বলল, ভদ্র মহিলা নিশার কথা শুনে কি বলল

সে তখন বলল, টগরতােমার বাবা এইসব কথা তােমাদের বলেছেন? আমি বললামহুতুমি হুঁ বললে ? হ্যাকিন্তু আমি তাে কখনাে রকম কথা বলিনিতুমি বললে কেন?আর বলব না বাবা| নিশা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমিও বলব না বাবাএতক্ষণ সে জেগেই ছিল! কোন পর্যায়েকথাবার্তায় অংশগ্রহণ করবে এইটাই শুধু বুঝতে পারছিল না। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

একটা মানুষ ক্ষুধা কেমন এটা জানার জন্যে না খেয়ে আছে এই ব্যাপারটা পুতুলকে অভিভূত করে ফেলেছেসে কয়েকবার দাদাজানের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করলএমদাদ কোন পাত্তা দিল নাএনিতেই তার মেজাজ খারাপ, পকেট মারের ব্যাপারটায় উল্টা পাল্টা কথা বলে মেয়েটা তাকে ডুবিয়েছেশুরুতেই বেইজ্জত হতে হলএটাকে যে কোন ভাবেই হােক সামলাতে হবেকি ভাবে সামলাবে তাই নিয়ে এমদাদ চিন্তা ভাবনা করছেএর মধ্যে পুতুঘ্যান ঘ্যান করছে সােবহান সাহেবের না খাওয়া নিয়েএই মেয়েটাকে কড়া একটা ধমক দেয়া দরকারধমক দিতেও ইচ্ছা করছে না

দাদাজান ঘুমাইলা? না। 

কেমন আশ্চর্য মানুষ দেখলা দাদাজান? ক্ষুধা কেমন জিনিষ এইটা জাননের জইন্যে না খাইয়া আছে। 

দুনিয়া ভর্তি বেকুবেএইডাও বেকুবির এক নমুনাছিঃ দাদাজানএমন কথা কইও নাএই বুড়া বেকুব তাে বেকুবই, তুইও বেকুবতুই আমার সাথে কথা কইস নাআমি কি দোষ করলাম দাদাজান? চুপ, কোন কথা না। 

বুড়াে বয়সের ব্যধি রাতে ঘুম হয় নাএমদাদ রাত দেড়টায় ঘুমের আশায় জলাঞ্জলী দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে বসে থাকতেও আরামমশা না থাকলে পাটি পেতে বারান্দায় ঘুমানােরই ব্যবস্থা করা যেত কিন্তু ড় মশা। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

মিনু দরজা বন্ধ করতে এসে দেখেন এমদাদ সাহেব বারান্দার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে আছেনহাতে সিগারেটতিনি বিস্মিত গলায় বললেন, কে এমদাদ সাহেব না

জি মা জননী। 

এত রাতে এখানে কি করছেন? মনটা খুব খারাপঘুম আসেনা। 

মন খারাপ কেন? | বাড়ির কতা না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জন্যেই মনটা খারাপ মা জননী! আমরা হইলাম গেরামের মানুষ, ক্ষুধা পেটে কেউ ঘুমাইতে গেছে শুনলে মনটা খারাপ হয়। 

ঐসব নিয়ে ভাববেন নাবিলুর বাবার এই রকম পাগলামী আছেসকালে দেখবেন ঠিকই নাশতা করছে। 

শুনে বড় ভাল লাগছে মা জননীআসুন ভেতরে চলে আসুনআমি দরজা বন্ধ করে দেব। 

এমদাদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আরেকটা বিষয় আপনেরে বলা হয় নাই মা জননী মানিব্যাগের বিষয়ে! মানিব্যাগ ছিল পুতুলের কাছেমাইয়া খুব সাবধানতােগুছায়ে রাখছেএদিকে আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ছিল রুমালপকেটমার সেই রুমাল নিয়ে চলে গেছেহা হা হা। 

মিনু বললেন, টাকা পয়সার প্রয়ােজন হলে বলবেনসংকোচ করবেন নাআলহামদুলিল্লাহকোনসংকোচ করব নাআপনারা হইলেন বটবৃক্ষ। 

যান ঘুমুতে যানজ্বি আচ্ছাঘুম আসবে না তবু শুইয়া থাকববাড়ির আসল লােক দানাপানি খায় নাই এরপরেও কি ঘুম আসে কন মা জননী

এইসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে নাসকাল হলেই দেখবেন খাওয়া দাওয়া শুরু করেছেউদ্দেশ্য তাে আর কিছু নাউদ্দেশ্য হলাে আমাকে যন্ত্রণা দেয়া

বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

এই কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না মা জননীক্ষুধা কি যে বুঝতে চায় সে কি সাধারণ লােক? সেতাে বলতে গেলে আল্লাহর অলিঠিক বলছি নামা জননী?| মিনু জবাব দিলেন নাএই লােক কি মতলবে এসেছে কে জানেবিনা কারণে আসে নি বােঝাই যাচ্ছেনিশ্চয়ই বড় কোন সমস্যাসমস্যা টেনে টেনে তিনি এখন ক্লান্ত বিরক্তআর ভাল লাগে না। 

সােবাহান সাহেব ভােরবেলায় কাপে করে এক কাপ পানি খেলেনআর কিছুই খেলেন নামিনু বললেন, তুমি সত্যি সত্যি কিছু মুখে দেবে না

কেন? কেনর জবাব দিয়েছিআমি ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাই। 

রাগে দুঃখে মিনুর চোখে পানি এসে গেলএকজন বয়স্ক মানুষ যদি এরকম যন্ত্রণা করে তাহলে কিভাবে হয়? মিলির ইউনিভার্সিটিতে যাবার খুব প্রয়ােজন ছিল সে গেল নাবাসার আবহাওয়া মনে হচ্ছে ভাল নাবাবার প্রেসারের কি অবস্থা কে জানেডাক্তারকে খবর দেয়া প্রয়ােজনতবে এক্ষুণী ছুটে যাওয়ার দরকার নেইদুপুর পর্যন্ত যাক তারপর দেখা যাবে। 

দুপুরে ফরিদ দুলাভাইয়ের অনশনের খবর পেলতার উৎসাহের সীমা রইল নাকাদেরকে ডেকে বলল, সাবজেক্ট পাওয়া গেছেঅসাধারণ সাবজেক্টছবি হবে ক্ষুধা নিয়েক্ষুধা কি একজন জানতে চাচ্ছেক্যামেরা তার মুখের উপর ধরে রাখা। মাঝে মাঝে ক্যামেরা সরে নানান ধরনের খাবার দাবারের উপর চলে যাচ্ছেআবার ফিরে আসছে তার মুখেলােকটার অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছেক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃষ্ণাক্যামেরা প্যান করে চলে গেল ঝর্ণীয়ঝির ঝির করে ঝণার পানি পড়ছেঅথচ মানুষটির মুখে এক ফোটা পানি নেইক্যামেরা চলে গেল আকাশের মেঘে। 

বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ

কাদের উৎসাহী গলায় বলল, আবার ছবি হইব মামা

ফরিদ বলল, ছবি হবে না মানে? একটা প্রজেক্ট ফেল করেছে বলে সব কটা প্রজেক্ট ফেল করবে নাকি? বলতে গেলে আজ থেকেই ছবির কাজ শুরু হলছবির নামহে ক্ষুধা। 

কি নাম কইলেন মামা

হেকথাড়া বাদ দেন মামাঅপয়া কথাএর আগের বারও হে আছিল বইল্যা ছবি অয় নাই। 

কথা মন্দ বলিস নিতাহলে বরং হেটা পেছনে নিয়ে যাইছবির নামক্ষুধা হেকি বলিস

মন্দ না। 

কাগজ কলম দেইমিডিয়েট যে সব চিন্তা মাথায় আসছে সেগুলি নােট ডাউন করে ফেলিদুলাভাইয়ের সঙ্গেও আলাপ দরকারছবিটা যখন তাঁকে নিয়েই হচ্ছে” 

কাদের ক্ষীণ স্বরে বলল, আমরার কোন পাট থাকত না মামা?” 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *