‘কি সর্বনাশ। আমি শুধুমাত্র কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম যে আমরা যারা সৌখিন সমস্যাবিদ তারা মূল সমস্যা নিয়ে ভাসা ভাসা কথাবাতা বলি। কারণ মূল সমস্যা আমরা জানি না। ক্ষুধা যে কি ভয়াবহ ব্যাপার তা আমরা অর্থাৎ তথাকথিত মধ্যবিত্ত সমস্যা বিশারদরা জানি না।
কারণ আমাদের কখনাে ক্ষুধার্ত থাকতে হয় না। রােজার সময় বেশ কিছু সময় ক্ষুধার্ত থাকি সেও খুবই সাময়িক ব্যাপার। তখন আমাদের মনের মধ্যে থাকে সূর্যটা ডুবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর খাদ্য দ্রব্য চলে আসবে। কাজেই ক্ষুধার স্বরূপ
বিলু আনিসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনাকে হাত জোর করে অনুরােধ করছি আপনার এই সব চমৎকার থিওরী দয়া করে নিজের মধ্যেই রাখবেন। বাবাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন
না। উনি সব কিছুই খুব সিরিয়াসলি নেন। নিজের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করেন, আমাদের জন্যেও। সমস্যা সৃষ্টি করেন। আমি কি বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন?
‘জ্বি পারছি।
‘সুযােগ যখন পাওয়া গেছে তখন আরাে একটা কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছি। কথাটা হচ্ছে–আপনি যে আপনার বাচ্চাদের মাধ্যমে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছেন এতে আমি শুধু অবাক হয়েছি তাই না–দুঃখিত হয়েছি, রাগ করেছি, বিরক্ত হয়েছি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা আমি পছন্দ করি না বলেই এতদিন চুপচাপ ছিলাম। আজ বলে ফেললাম।
বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিসকে একটি কথা বলারও সুযােগ না দিয়ে বিলু নীচে নেমে গেল। আনিস ডাকল, টগর টগর। টগর জেগে আছে তবু কথা বলছে না। কথা বললেই বাজীতে হারতে হয়। আনিস বলল, টগর কথা বল এখন কথা বললে বাজীর কোন হেরফের হবে না। টগর।
‘বিলু মেয়েটিকে তুমি কি বলে? ‘আমি কিছু বলিনি–নিশা বলেছে। ‘নিশা, তুমি কি বলেছ? ‘আমার মনে নেই। ‘মনে করার চেষ্টা কর। তুমি কি বলে? নিশা কোন শব্দ করল না। টগর বলল, নিশা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে বাবা। আনিস বলল, তােমার কি মনে আছে নিশা কি বলেছে?
‘মনে আছে। “বলতে শুনি। “নিশা উনাকে বলেছে–আৰু আপনাকে বিয়ে করবে। তখন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তখন আমরা আপনাকে আম্মু ডাকব।‘ | আনিস হতভম্ভ হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেক কষ্টে বলল, ভদ্র মহিলা নিশার কথা শুনে কি বলল?
সে তখন বলল, টগর–তােমার বাবা এইসব কথা তােমাদের বলেছেন? আমি বললাম–হু। ‘তুমি হুঁ বললে ? ‘হ্যা।” ‘কিন্তু আমি তাে কখনাে এ রকম কথা বলিনি–তুমি ই বললে কেন?” ‘আর বলব না বাবা। | নিশা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমিও বলব না বাবা। এতক্ষণ সে জেগেই ছিল! কোন পর্যায়ে। কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করবে এইটাই শুধু বুঝতে পারছিল না।
বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
একটা মানুষ ক্ষুধা কেমন এটা জানার জন্যে না খেয়ে আছে এই ব্যাপারটা পুতুলকে অভিভূত করে ফেলেছে। সে কয়েকবার দাদাজানের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করল—এমদাদ কোন পাত্তা দিল না। এনিতেই তার মেজাজ খারাপ, পকেট মারের ব্যাপারটায় উল্টা পাল্টা কথা বলে মেয়েটা তাকে ডুবিয়েছে। শুরুতেই বেইজ্জত হতে হল। এটাকে যে কোন ভাবেই হােক সামলাতে হবে। কি ভাবে সামলাবে তাই নিয়ে এমদাদ চিন্তা ভাবনা করছে। এর মধ্যে পুতুল ঘ্যান ঘ্যান করছে সােবহান সাহেবের না খাওয়া নিয়ে। এই মেয়েটাকে কড়া একটা ধমক দেয়া দরকার। ধমক দিতেও ইচ্ছা করছে না !
ও দাদাজান ঘুমাইলা? ‘না।
‘কেমন আশ্চর্য মানুষ দেখলা দাদাজান? ক্ষুধা কেমন জিনিষ এইটা জাননের জইন্যে না খাইয়া আছে।
‘দুনিয়া ভর্তি বেকুবে–এইডাও বেকুবির এক নমুনা। “ছিঃ দাদাজান–এমন কথা কইও না। ‘এই বুড়া বেকুব তাে বেকুবই, তুইও বেকুব। তুই আমার সাথে কথা কইস না। ‘আমি কি দোষ করলাম দাদাজান? ‘চুপ, কোন কথা না।
বুড়াে বয়সের ব্যধি রাতে ঘুম হয় না। এমদাদ রাত দেড়টায় ঘুমের আশায় জলাঞ্জলী দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে বসে থাকতেও আরাম। মশা না থাকলে পাটি পেতে বারান্দায় ঘুমানােরই ব্যবস্থা করা যেত কিন্তু বড় মশা।
বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
মিনু দরজা বন্ধ করতে এসে দেখেন এমদাদ সাহেব বারান্দার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে আছেন। হাতে সিগারেট। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, কে এমদাদ সাহেব না?
‘জি মা জননী।
এত রাতে এখানে কি করছেন? ‘মনটা খুব খারাপ। ঘুম আসেনা।
‘মন খারাপ কেন? | ‘বাড়ির কতা না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জন্যেই মনটা খারাপ মা জননী! আমরা হইলাম গেরামের মানুষ, ক্ষুধা পেটে কেউ ঘুমাইতে গেছে শুনলে মনটা খারাপ হয়।
ঐসব নিয়ে ভাববেন না। বিলুর বাবার এই রকম পাগলামী আছে। সকালে দেখবেন ঠিকই নাশতা করছে।
শুনে বড় ভাল লাগছে মা জননী। ‘আসুন ভেতরে চলে আসুন। আমি দরজা বন্ধ করে দেব।
এমদাদ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আরেকটা বিষয় আপনেরে বলা হয় নাই মা জননী মানিব্যাগের বিষয়ে! মানিব্যাগ ছিল পুতুলের কাছে। মাইয়া খুব সাবধানতাে–গুছায়ে রাখছে। এদিকে আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ছিল রুমাল। পকেটমার সেই রুমাল নিয়ে চলে গেছে। হা হা হা।
মিনু বললেন, টাকা পয়সার প্রয়ােজন হলে বলবেন। সংকোচ করবেন না। ‘আলহামদুলিল্লাহ। কোনসংকোচ করব না। আপনারা হইলেন বটবৃক্ষ।
যান ঘুমুতে যান।‘ ‘জ্বি আচ্ছা। ঘুম আসবে না তবু শুইয়া থাকব। বাড়ির আসল লােক দানাপানি খায় নাই এরপরেও কি ঘুম আসে কন মা জননী?
‘এইসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। সকাল হলেই দেখবেন খাওয়া দাওয়া শুরু করেছে। উদ্দেশ্য তাে আর কিছু না। উদ্দেশ্য হলাে আমাকে যন্ত্রণা দেয়া!
বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
এই কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না মা জননী–ক্ষুধা কি যে বুঝতে চায় সে কি সাধারণ লােক? সেতাে বলতে গেলে আল্লাহর অলি। ঠিক বলছি না–মা জননী?” | মিনু জবাব দিলেন না। এই লােক কি মতলবে এসেছে কে জানে। বিনা কারণে আসে নি বােঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বড় কোন সমস্যা। সমস্যা টেনে টেনে তিনি এখন ক্লান্ত ও বিরক্ত। আর ভাল লাগে না।
সােবাহান সাহেব ভােরবেলায় কাপে করে এক কাপ পানি খেলেন। আর কিছুই খেলেন না। মিনু বললেন, তুমি সত্যি সত্যি কিছু মুখে দেবে না?
কেন? ‘কেনর জবাব দিয়েছি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাই।
রাগে দুঃখে মিনুর চোখে পানি এসে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ যদি এরকম যন্ত্রণা করে তাহলে কিভাবে হয়? মিলির ইউনিভার্সিটিতে যাবার খুব প্রয়ােজন ছিল সে গেল না। বাসার আবহাওয়া মনে হচ্ছে ভাল না। বাবার প্রেসারের কি অবস্থা কে জানে। ডাক্তারকে খবর দেয়া প্রয়ােজন। তবে এক্ষুণী ছুটে যাওয়ার দরকার নেই। দুপুর পর্যন্ত যাক তারপর দেখা যাবে।
দুপুরে ফরিদ দুলাভাইয়ের অনশনের খবর পেল। তার উৎসাহের সীমা রইল না। কাদেরকে ডেকে বলল, সাবজেক্ট পাওয়া গেছে– অসাধারণ সাবজেক্ট–ছবি হবে ক্ষুধা নিয়ে। ক্ষুধা কি একজন জানতে চাচ্ছে। ক্যামেরা তার মুখের উপর ধরে রাখা। মাঝে মাঝে ক্যামেরা সরে নানান ধরনের খাবার দাবারের উপর চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে তার মুখে। লােকটার অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ক্ষুধার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃষ্ণা। ক্যামেরা প্যান করে চলে গেল ঝর্ণীয়। ঝির ঝির করে ঝণার পানি পড়ছে—অথচ ঐ মানুষটির মুখে এক ফোটা পানি নেই। ক্যামেরা চলে গেল আকাশের মেঘে।
বহুব্রীহি পর্ব (১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
কাদের উৎসাহী গলায় বলল, আবার ছবি হইব মামা?
ফরিদ বলল, ছবি হবে না মানে? একটা প্রজেক্ট ফেল করেছে বলে সব কটা প্রজেক্ট ফেল করবে নাকি? বলতে গেলে আজ থেকেই ছবির কাজ শুরু হল। ছবির নাম–হে ক্ষুধা।
‘কি নাম কইলেন মামা?
‘হে–কথাড়া বাদ দেন মামা। অপয়া কথা। এর আগের বারও ‘হে আছিল বইল্যা ছবি অয় নাই।
‘কথা মন্দ বলিস নি। তাহলে বরং হে’টা পেছনে নিয়ে যাই। ছবির নাম–‘ক্ষুধা হে‘ কি বলিস?
মন্দ না।
কাগজ কলম দে। ইমিডিয়েট যে সব চিন্তা মাথায় আসছে সেগুলি নােট ডাউন করে ফেলি। দুলাভাইয়ের সঙ্গেও আলাপ দরকার। ছবিটা যখন তাঁকে নিয়েই হচ্ছে।”
কাদের ক্ষীণ স্বরে বলল, “আমরার কোন পাট থাকত না মামা?”