বহুব্রীহি পর্ব ( ১)- হুমায়ূন আহমেদ

ভূমিকা বহুব্রীহি নাম দিয়ে একটি টিভি সিরিয়েল লিখেছিলাম, এই বহুব্রীহিকে সেই টিভি সিরিয়েলের উপন্যাস রূপান্তর মনে করা ঠিক হবে না। আমি যা করেছি তা হচ্ছে মূল কাঠামাে ঠিক রেখে একটা মজার উপন্যাস লেখার চেষ্টাকিছু অন্য ধরনের কথা হাসি তামশার মাঝখানে আছেআশা করছি সেই সব কথা রঙ্গ রসিকতায় পুরােপুরি ঢাকা পড়বে নাকিছু না কিছু থেকেই যাবে

বহুব্রীহি

পাঠক পাঠিকাদের আমার এই উপন্যাস টিভি সিরিয়েলের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে হোঁচট খাবেনসেই চেষ্টা না করাই ভাল । 

এই লেখাটি আমি গভীর আগ্রহ আনন্দ নিয়ে লিখেছি সেই আনন্দের ভগ্নাংশও যদি পাঠক পাঠিকাদের কাছে পৌছাতে পারি তাহলেই আমার সকল শ্রম স্বার্থক হয়েছে ধরে নেব। 

হুমায়ূন আহমেদ 

//৯০ শহীদুল্লাহ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । 

উচু দেয়ালে ঘেরা পুরানাে ধরণের বিশাল দোতলা বাড়িবাড়ির সামনে এবং পেছনে গাছ গাছালিতে জঙ্গলের মত হয়ে আছেকিছু কিছু গাছের গুড়ি কালাে সিমেন্টে বাঁধানােবাড়ির নাম নিরিবিলি, শ্বেত পাথরে গেটের উপর নাম লেখা, অবশ্যি এর ফোটা মুছে গেছেপাড়ার কোন দুষ্ট ছেলে হারিয়ে যাওয়া ফোটাটা বসিয়ে দিয়েছে এর উপরএখন বাড়ির নাম নিবিরিলি। 

সাধারণত যে সব বাড়ির নাম নিরিবিলি হয়, সেসব বাড়িতে সারাক্ষণই হৈ চৈ হতে থাকেএই মুহূর্তে বাড়িতে অবশ্যি কোন হৈ চৈ হচ্ছে নাবাড়ির প্রধান ব্যক্তি সােবাহান সাহেবকে বারান্দার ইজি চেয়ারে পা মেলে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছেতার মুখ চিন্তাক্লিষ্টচোখে সুস্পষ্ট বিরক্তি| সােবাহান সাহেব বছর দুই হল ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছেনকর্মহীন জীবনে এখনাে অভ্যস্ত হতে পারেন নিদিনের শুরুতেই তাঁর মনে হয় সারাটা দিন কিছুই করার নেইতাঁর মেজাজ সেই কারণে ভােরবেলায় খুবই খারাপ থাকেআজ অন্য দিনের চেয়েও বেশি খারাপ, কেন তা তিনি বুঝতে পারছেন নাশরৎকালের একটা চমৎকার সকালঝকঝকে রােদ, বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধরকম একটা সকালে মন খারাপ থাকার প্রশ্নই আসে না| সােবাহান সাহেবের গায়ে হলুদ রঙের একটা সূতির চাদরগলায় বেগুনী রঙের মাফলার। আবহাওয়া বেশ গরম, তবু তিনি কেন যে মাফলার জড়িয়ে আছেন তা বােঝা যাচ্ছে নাতাঁর হাতে একটা পেপার ব্যাক, ডিটেকটিভ গল্পকাল রাতে বত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছিলেনগত এক ঘন্টা ধরে তেত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠা পড়তে চেষ্টা করছেন, পারছেন না

বার বার ইচ্ছে করছেবই ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতেতেত্রিশ পৃষ্ঠায় নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে স্মীথ নামে একটি লােকের বা চোখ তুলে নেবার বিষদ বর্ণনা আছে। সােবাহান সাহেব অবাক হয়ে পড়লেনচোখ উপড়ে তুলে নেবার সময়ও মিঃ স্মীথ রসিকতা করছে এবং গুন গুন করে গাইছেব্রীজ ইজ ফলিং ডাউন| কোন মানে হয়? যে লেখক এই বইটি লিখেছে সােবাহান সাহেবের ইচ্ছে করছে তার বী চোখটা নেইল কাটার দিয়ে তুলে ফেলতে। 

সােবাহান সাহেবের ছােট মেয়ে মিলি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় ঢুকলবাবার সামনের গােল টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হাসিমুখে বলল, বাবা তােমার চা। 

সােবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, কিসের চা? চা পাতায় তৈরী চা, আবার কিসের

এখন কেন?তুমি সকাল আটটায় এক কাপ চা খাও এই জন্যে এখনসকাল আটটা কিছুক্ষণ আগে বাজল। 

সােবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, পিরিচে চা পড়ে আছে কেন? চা থাকবে চায়ের কাপে। 

তাই আছে বাবা, পিরিচে এক ফোটা চা নেইতুমি ভাল করে তাকিয়ে দেখ। 

তিনি চায়ের কাপ হাতে নিলেনমনে মনে ঠিক করলেন চা অতিরিক্ত মিষ্টি হলে বা মিষ্টি কম হলে মেয়েকে প্রচন্ড ধমক দেবেনকাউকে ধমকাতে ইচ্ছা করছেতিনি অত্যন্ত মনমরা হয়ে লক্ষ্য করলেন, চায়ে চিনি ঠিকই আছেচা আনতে আনতে ঠান্ডাও হয় নি, যতটুকু গরম থাকার কথা ততটুকুই আছে, বেশিও না কমও না। 

মিলি বলল, সব ঠিক আছে বাবা

তিনি জবাব দিলেন নামিলি হালকা গলায় বলল, ভােরবেলা তােমার জন্যে চা আনতে যা ভয় লাগেএকটা না একটা খুঁত ধরে বিশ্রী করে বকা দাওবাবা, তােমার পাশে খানিকক্ষণ বসব

সােবাহান সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন নামিলি, গােলটেবিলের এক কোণায় বসলতার বয়স একুশএকুশ বছরের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছেসেই সৌন্দর্যে সে ঝলমল করছেতার পরনে কমলা রঙের শাড়িশরৎকালের ভােরের সঙ্গে এই শাড়িটি চমৎকার মানিয়ে গেছেমিলি হাসিমুখে বলল, এই গরমে গলায় মাফলার জড়িয়ে আছ কেন বাবা? দাও খুলে দেই। 

 সােবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, খােলার প্রয়ােজন মনে করলে নিজেই খুলতামমাফলার খােলা খুব জটিল কোন বিষয় নয় যে দ্বিতীয় ব্যক্তির সাহায্য লাগবে। 

 মিলি হেসে ফেললহেসেই চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল, বাবা তার হাসি দেখতে পেলে রেগে যেতে পারেনমিলি মুখের হাসি মুছে বাবার দিকে তাকালহাসি অবশ্যি পুরােপুরি গেল নাতার চোখে ঝিলমিল করতে লাগল। 

বাবা, রােজ ভােরে তুমি একটা ঝগড়া বাধাতে চাও কেন বলতাে? ভােরবেলা তােমার ভয়ে আমি অস্থির হয়ে থাকি| এই বলে মিলি আবার হেসে ফেললএখন তার হাসি দেখে মনে হল না বাবার ভয়ে সে অস্থিরসােবাহান সাহেব কিছুই বললেন নাবই খুললেন, তেত্রিশ পৃষ্ঠাটা পড়ার একটা শেষ চেষ্টা করা যাক। 

মিলি বলল, তুমি মাডার ইন দা ডার্ক পড়ছ? অসাধারণ একটা বইতাই না বাবা? সােবাহান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, অসাধারণ ? হ্যাঁ অসাধারণ, স্মীথ নামের একটা লােকের বা চোখ নেইল কাটার দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলা হয় • • • 

এটা অসাধারণ? | লােকটার সাহস তুমি দেখবে না? লােকটা তখন গান গাইতে থাকেলন্ডন ব্রীজ ইজ ফলিং ভাউন, ফলিং ডাউন তারপর কি হয় জান? এই অবস্থায় সে কোক করে একটা লাথি বসায় মাডারারটার পেটেমাডারার এক মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হতেই সে উপড়ে তােলা চোখটা ছিনিয়ে তিনতলার জানালা দিয়ে নীচে লাফ দেয়তার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছেতীব্র ব্যথায় সে দিশাহারা, তবু সে ছুটে যায় একটা হাসপাতালে, ডাক্তারকে হাসি মুখে বলেডাক্তার সাহেব আপনি কি এই চোখটা জায়গামত বসিয়ে দিতে পারেন? যদি পারেন তাহলে আপনাকে আমি লন্ডন শহরের সবচে বড় গােলাপটি উপহার দেবসৌভাগ্য ক্রমে সেই হাসপাতালে তখন ছিলেন ইউরােপের সবচে বড় আই সার্জন ডঃ এসিল নায়ারতিনি । 

সােবাহান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে লােকটার চোখ লাগিয়ে দিল? হা অপটিক নার্ভ গুলি জোড়া লাগিয়ে দিল এই কুৎসিত বইটাকে তুই বলছিস অসাধারণ? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী যে ইকনমিক্সে অনার্স পড়ছে সে এই বইকে বলছে অসাধারণ

‘ইকনমিক্সে অনার্স পড়লে থ্রিলার পড়া যাবে না? সােবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, বইটা আমার সামনে ছিড়ে কুটি কুটি করকি বললে বাবা? বইটা কুটি কুটি করে ছিড়ে ফেল, আমি দেখি। 

মিলি আঁৎকে উঠে বলল, এই বই আমার না বাবাআমার এক বান্ধবীর বইআমি এক সপ্তার জন্যে ধার এনেছি| বই যারই হােকনষ্ট করা দরকারসমাজের মঙ্গলের জন্যেই দরকারআমি এই বিষয়ে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই নাআমি দেখতে চাই যে বইটা কুটি কুটি করে ফেলা হয়েছে। 

আমার বইতাে না বাবাআমার বই হলে একটা কথা ছিল। 

বললাম তাে এই বিষয়ে আমি আর কোন আগুমেন্ট শুনতে চাই নাডেস্ট্রয়মিলি বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, কেদে ফেলার চেষ্টা করল, কাঁদতে পারল নাকেদে ফেলতে পারলে বইটা রক্ষা করা যেতসােবাহান সাহেব বললেন, কি ব্যাপার বসে আছিস যে? কি বলছি কানে যাচ্ছে না

 মিলি উঠে দাঁড়ালবাবার কোল থেকে বই নিয়ে ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেললএই সময় তার চোখে পানি এসে গেলমিলি জানে চোখের পানি দেখা মাত্র তার বাবার মেজাজ ঠান্ডা হয়ে যায়এখন ঠান্ডা হলেই বা লাভ কি? সর্বনাশ যা হবার ততাে হয়েই গেছেছেড়া বইতে আর জোড়া লাগবে নামৌসুমীকে সে কি জবাব দেবে তাই ভেবে মিলির চোখ আবার জলে ভরে উঠছেসে ছেড়া বই চারিদিকে ছড়িয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেলতার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বারান্দায় ঢুকল ফরিদ| ফরিদ, মিলির মামাসাত বছর বয়স থেকে এই বাড়িতেই আছেপাঁচ বছর আগে অংকে অনার্স পাশ করেছেএম, করেনি কারণ তার ধারণা তাকে পড়াবার মত বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেই

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *