বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

থাকবেতবে সাইড রােলসেন্ট্রাল ক্যারেক্টার হচ্ছেন দুলাভাই! দেখি আপার সঙ্গে ব্যাপারটা আগে ফয়সালা করে নেই। 

বহুব্রীহিমিনু রাগ করে বিলুর ঘরে শুয়ে আছেন। সকালে তিনিও নাস্তা করেননিতাঁর প্রচন্ড মাথা ধরেছেযন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যে বাড়ি থেকে চলে যাবার কথাও মনে আসছেরাগারাগী তার স্বভাবে নেই তবু সবাই বেশ কয়েকবার তাঁর কাছে ধমক খেয়েছেতিনি বলে দিয়েছেন কেউ 

যেন তাকে বিরক্ত না করেকাজেই ফরিদ যখন বিশাল একটা খাতা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আপা আসব

তিনি কড়া গলায় বললেন, ভাগ এখান থেকে। 

তুমি যা বলবে তাই হবে কিন্তু তার আগে তােমার কয়েকটা মিনিট সময় আমাকে দিতে হবেদুলাভাইকে নিয়ে ছবি করছি আপা। ছবির নাম ক্ষুধা হেদুলাভাই সেখানে মানুষ নাদুলাভাই হচ্ছেন ক্যামেরাযে ক্যামেরা ক্ষুধা কি বুঝতে চেষ্টা করছেপনেরাে মিনিটের ছবিপনেরাে মিনিটই যথেষ্টশেষ দৃশাটা নিয়েছি সুকান্তের কবিতা থেকেঘন নীল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদহঠাৎ সেই চাঁদটা হয়ে গেল একটা আটার রুটিদুটা রােগা রােগা হাত আকাশ থেকে সেই চাঁদটা অথাৎ রুটিটা নামিয়ে এনে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে খেয়ে ফেললকেমন হবে আপা বলতাে? অসাধারণ না?” 

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

মিনু একটিও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেনফরিদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীনসে নিজের মনে বকবক করতে থাকুক। 

মানুষের অবহেলা ফরিদকে তেমন বিচলিত করে নাএবারাে করল নাআসলে এই মুহুর্তে ক্ষুধা হে ছবির শেষ দৃশ্য তাকে অভিভূত করে রেখেছেরােগা রােগা দুটা হাত আকাশ থেকে চাঁদটা নামিয়ে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে কপ কপ করে খেয়ে ফেলছেএই দৃশ্যের কোন তুলনা হয় না। 

ফরিদ ঘর থেকে বের হয়েই পুতুলের মুখােমুখি পড়ে গেলফরিদ কড়া গলায় বলল, এই যে মেয়ে দীড়াও তােদেখি হাত দুটা মেলতােপুতুল ভয়ে ভয়ে হাত মেলল। 

ইরােগা রােগা হাত আছে মনে হচ্ছে তােমাকে দিয়ে হবে। তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে

কি কাজ?অতি সামান্য কাজপারবে কি পারবে না সেটা বলপুতুক্ষীণ স্বরে বলল, পারবভেরী গুডকাজটা অতি সামান্যআকাশ থেকে চাঁদটা টেনে নামাবে তারপর ছিড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলবে

পুতুঅপলক চোখে তাকিয়ে আছেতার সব চিন্তা ভাবনা এলােমেলাে হয়ে গেছে। 

ফরিদ দাঁড়াল নালম্বা লম্বা পা ফেলে বারান্দায় চলে গেলছবিটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবা দরকারখুবই ঠান্ডা মাথায়দরকার হলে ছবির লেংথ কমিয়ে পনেরাে থেকে দশ মিনিটে নিয়ে আসতে হবেতবে সেই দশ মিনিটও হবে অসাধারণ দশ মিনিটগােল্ডেন মিনিটস

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

যতটা কষ্ট হবে বলে ডেবেছিলেন ততটা কষ্ট সােবাহান সাহেবের হচ্ছে নাকষ্ট একটিই, পরিবারের সদস্যরা সবাই বড় বিরক্ত করছেএদের যন্ত্রণায় বড় কিছু করা যায় নাদৃষ্টিটাকে এরা কিছুতেই ছড়িয়ে দিতে পারে নাকয়েকটা দিন না খেয়ে থাকা যে কঠিন কিছু না এটা তারা বুঝে না। 

সােবাহান সাহেব একটা বড় খাতায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও লিখে রাখছেনখুব গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছেনতেমন গুছিয়ে লিখতে পারছেন নাকিছুক্ষণ লেখালেখি করলেই মাথায় চাপ পড়ছেতাঁর ডায়েরীর কিছু কিছু অংশ এরকম 

বুধবার 

রাত দশটা পাচঅনশন পর্ব শুরু করা গেলএই অনশন দাবী আদায়ের অনশন নয়এই অনশন নিজেকে জানার অনশনআমি ক্ষুধার প্রকৃত স্বরূপ জানতে চাইআমি এর ভয়াবহ রূপ জানতে চাইযদি জানতে পারি তাহলে হয়তবা ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী সম্পর্কে আমার কিঞ্চিৎ ধারণা হবেএই যে পৃথিবী জুড়ে হত্যাকান্ড হচ্ছে এর মূল কারণগুলির একটি নিশ্চয়ই ক্ষুধাআজকের খবরের কাগজের একটি খবর দেখে অত্যন্ত বিষন্ন বােধ করেছিসাভার উপজেলার জনৈক কাল মিয়া অভাবে অতিষ্ট হয়ে তার স্ত্রী, বছরের পুত্র এবং তিন বছরের কন্যাকে হত্যা করে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছেস্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে ক্ষুধার তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে সে এটা করেছেহায়রে ক্ষুধাঅথচ এই সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। 

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

বৃহস্পতিবার। 

ভাের এগারােটাআমি আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত বােধ করছিআমি একটা পরীক্ষা করছি তাও তারা করতে দেবে নাতাদের ধারণা হয়েছে অল্প কয়েক ঘন্টা না খেয়ে থাকার কারণে আমি মারা যাবমৃত্যু এত সহজ নয়বিয়াল্লিশ দিন শুধুমাত্র পানি খেয়ে জীবিত থাকার রেকর্ড আছেএরা এই জিনিষটা বুঝতে চায় নাআমার মৃত্যু প্রসঙ্গে এদের অতিরিক্ত সচেতনতাও আমার ভাল লাগছে নামৃত্যু একটি অমােঘ ব্যাপার

একে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? বিত্র কোরান শরীফেলতা স্পষ্ট উল্লেখ আছে প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবেবর্তমানে ধর্মগ্রন্থ পাঠের একটা প্রবল ইচ্ছা বােধ করছি। ক্ষুধার্ত মানুষ কি পরলৌকিক চিন্তা করে? একটি জরুরী বিষয় লিখে রাখা দরকার বােধ করছিমিনু বড় কান্নাকাটি করছেএত কান্নাকাটির কি আছে তাতাে বুঝতে পারছি না। বিলু এসে বলে গেল আমি যদি না খাই তাহলে তার মাখাওয়া বন্ধ করে দেবেদেখি আরেক যন্ত্রণা হল। 

বৃহস্পতিবার 

বেলা একটা দশ মিনিটফুরিদের ফাজলামীর সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে আমার ধারণাশুনলাম এই গাধা এখন না কি আমাকে নিয়ে ছবি করবেছবির নাম ক্ষুধা হেএই গাধাটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলে মন শান্ত হতমিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে তা করতে পারছি নামিনু ফরিদকে বড়ই পছন্দ করেআমিও করিকেন করি তা জানি নাভাল কথা এখন একটু কষ্ট হওয়া শুরু হয়েছেমাথা ঘুরছেপ্রেসারের কোন সমস্যা কি না কে জানে। 

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

ক্রমাগত ধর্ম গ্রন্থ পাঠ করার চেষ্টা করছিপবিত্র কোরান শরীফে যে এত সুন্দর সুন্দর অংশ আছে আগে লক্ষ্য করিনিমূল আরবীতে পড়তে পারলে ভাল হতবয়স কম থাকলে আরবী পড়া শুরু করতামসেই সময় নেইএখন ঠিক করেছি কোরান শরীফের পছন্দের কিছু আয়াত লিখে রাখব। 

If it were His will He could destroy you O mankind, and create 

Another race: for He Hath power this to do

সূরা নিসা, ১৩৪ নং আয়াত) আল্লাহতালা নতুন জাতি সৃষ্টি করার কথা বলছেনযদি সত্যি সত্যি তিনি করতেন তাহলে কেমন হত সেই জাতি? তাদের কি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লােভ, কামনা থাকত না? তারা এইসব থেকে পুরােপুরি মুক্ত হত

ফরিদ চোখে চশমা দিয়ে গভীর মনযােগে খাতায় শট ডিভিসন করছে। হাতে সময় নেইদুলাভাইয়ের অনশন চলাকালীন সময়েই কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। একটা ফিস আই লেন্স দরকার ট্রিক শটের জন্যেএই লেন্সটাই জোগাড় হচ্ছে না। 

বাবাজী আসব

ফরিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকাল। এমদাদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেফরিদ রাগী গলায় বলল, কি চান? কিছু নাআমার নাতনী অর্থাৎ পুতুল চিন্তার মইদ্যে পড়েছেআফনে নাকি তারে বলেছেন আসমানের চাঁদ ধইরা নামাইয়া ছিড়া কুটি কুটি কইরা খাইয়া ফেলতে। 

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

হা বলেছিহতভম্ভ এমদাদ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, খাইয়া ফেলতে বলছেন? হ্যাবলেছিকেন কোন অসুবিধা আছে

এমদাদ শুকনাে গলায় বলল, জ্বিনা অসুবিধার কি? অসুবিধার কিছুই নাইআপনার কথা শেষ হয়েছে

তাহলে দয়া করে ঘর থেকে বের হয়ে যানঅবশ্যই অবশ্যই। 

এমদাদ প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বের হয়ে এলএই লােকটির মাথা যে খানিকটা উলট পালট আছে তা সে শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলসেই উলট পালট যে এতখানি তা বােঝে নিকিন্তু যে আকাশের চাঁদ ছিড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলার কথা ভাবে তাকে সহজ পাগলের দলে ফেলা ঠিক হবে না। এর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হবেপুতুলকেও বলে দিতে হবে যেন এই লােকের ত্রি সীমানায় না আসে। 

মনসুরকে আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেবেসে এখন পুরােপুরি সুস্থফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ায় যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল তা এখন নেইআর হাসপাতালে পরে থাকার কোন মানে হয় নাঅবশ্যি মনসুর চাচ্ছে আরাে কিছুদিন থেকে যেতেহাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে তার মন্দ লাগে নাবই পত্র পড়া যায়আরাম করে ঘুমানাে যায়সবচে বড় কথা প্রায় দিনই মিলি এসে দেখে যায়সে হাসপাতাল ছেড়ে দিলে নিশ্চয়ই মিলি তাকে দেখতে আসবেনা। 

  হাসপাতালের বিছানায় মনসুরের বেশীর ভাগ সময় মিলির কথা ভেবে ভেবেই কাটেমিলিকে নিয়ে পেনসিল দিয়ে সে কবিতাও লিখেছেসম্ভবত কিছুই হয়নিকাউকে দেখাতে পারলে হতদেখাতে লজ্জা লাগেএকটা কবিতা এরকম ।

বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ

একটু আগে এসে ছিলেন মিলি চারদিকে তাই এমন ঝিলিমিলিমনটা আমার হল উড়ু উড়ুবুকের ভেতর শব্দ দুরু দুরুযখন মিলি বিদায় নিতে চান আমি বলিএকটু বসে যানহাত বাড়িয়ে আমার দুহাত ধরম 

বাকিটা আর পারা যায় নিধরুনের সঙ্গে ভাল কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে নাধরুন, করুন, মরুন। কোনটাই ভাল লাগে নাআপাতত খাতা বন্ধ রেখে মনসুর গভীর মনােযােগে একটা চটি বই পড়ছেবইটি ইংরেজীতে লেখাবইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দবইয়ের লৈখক পনেরাে বছর গবেষণা করার পর এই বই লিখেছেন এবং এই বইয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে মেয়েদের বিষয়ে প্রচলিত অধিকাংশ ধারনাই মিথ্যাআমাদের আগে বিশ্বাস ছিল মেয়েদের রূপের প্রশংসা করলে তারা খুশী হয়এই বইয়ের লেখক দেখিয়েছেন যে রূপের প্রশংসায় অধিকাংশ মেয়ে বিরক্ত হয়। 

বইটির ব্যাক কভারে প্রকাশক লিখেছেননারী চরিত্র বােঝার জন্যে বইটি অপরিহার্যঅবিবাহিত যুবক যারা সঙ্গী খুঁজছেন বইটি তাদের জন্য বাইবেল স্বরূপমনসুরের কাছেও তাই মনে হচ্ছেবইটা আরাে আগে হাতে এলে উপকার হত

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *