থাকবে। তবে সাইড রােল। সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার হচ্ছেন দুলাভাই! দেখি আপার সঙ্গে ব্যাপারটা আগে ফয়সালা করে নেই।
মিনু রাগ করে বিলুর ঘরে শুয়ে আছেন। সকালে তিনিও নাস্তা করেননি। তাঁর প্রচন্ড মাথা ধরেছে। যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যে বাড়ি থেকে চলে যাবার কথাও মনে আসছে। রাগারাগী তার স্বভাবে নেই তবু সবাই বেশ কয়েকবার তাঁর কাছে ধমক খেয়েছে। তিনি বলে দিয়েছেন কেউ
যেন তাকে বিরক্ত না করে। কাজেই ফরিদ যখন বিশাল একটা খাতা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, আপা আসব?
তিনি কড়া গলায় বললেন, ভাগ এখান থেকে।
‘তুমি যা বলবে তাই হবে কিন্তু তার আগে তােমার কয়েকটা মিনিট সময় আমাকে দিতে হবে। দুলাভাইকে নিয়ে ছবি করছি আপা। ছবির নাম “ক্ষুধা হে।” দুলাভাই সেখানে মানুষ না। দুলাভাই হচ্ছেন ক্যামেরা–যে ক্যামেরা ক্ষুধা কি বুঝতে চেষ্টা করছে। পনেরাে মিনিটের ছবি। পনেরাে মিনিটই যথেষ্ট। শেষ দৃশাটা নিয়েছি সুকান্তের কবিতা থেকে। ঘন নীল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। হঠাৎ সেই চাঁদটা হয়ে গেল একটা আটার রুটি। দুটা রােগা রােগা হাত আকাশ থেকে সেই চাঁদটা অথাৎ রুটিটা নামিয়ে এনে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে খেয়ে ফেলল। কেমন হবে আপা বলতাে? অসাধারণ না?”
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
মিনু একটিও কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ফরিদের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। সে নিজের মনে বকবক করতে থাকুক।
মানুষের অবহেলা ফরিদকে তেমন বিচলিত করে না। এবারাে করল না। আসলে এই মুহুর্তে ক্ষুধা হে ছবির শেষ দৃশ্য তাকে অভিভূত করে রেখেছে। রােগা রােগা দুটা হাত আকাশ থেকে চাঁদটা নামিয়ে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে কপ কপ করে খেয়ে ফেলছে। এই দৃশ্যের কোন তুলনা হয় না।
ফরিদ ঘর থেকে বের হয়েই পুতুলের মুখােমুখি পড়ে গেল। ফরিদ কড়া গলায় বলল, এই যে মেয়ে দীড়াও তাে। দেখি হাত দু’টা মেলতাে। পুতুল ভয়ে ভয়ে হাত মেলল।
ইরােগা রােগা হাত আছে মনে হচ্ছে তােমাকে দিয়ে হবে। তুমি কি একটা কাজ করতে পারবে?
“কি কাজ?” ‘অতি সামান্য কাজ। পারবে কি পারবে না সেটা বল।” পুতুল ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব। ‘ভেরী গুড। কাজটা অতি সামান্য। আকাশ থেকে চাঁদটা টেনে নামাবে তারপর ছিড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলবে!
পুতুল অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার সব চিন্তা ভাবনা এলােমেলাে হয়ে গেছে।
ফরিদ দাঁড়াল না–লম্বা লম্বা পা ফেলে বারান্দায় চলে গেল। ছবিটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবা দরকার। খুবই ঠান্ডা মাথায়। দরকার হলে ছবির লেংথ কমিয়ে পনেরাে থেকে দশ মিনিটে নিয়ে আসতে হবে। তবে সেই দশ মিনিটও হবে অসাধারণ দশ মিনিট–গােল্ডেন মিনিটস!
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
যতটা কষ্ট হবে বলে ডেবেছিলেন ততটা কষ্ট সােবাহান সাহেবের হচ্ছে না। কষ্ট একটিই, পরিবারের সদস্যরা সবাই বড় বিরক্ত করছে। এদের যন্ত্রণায় বড় কিছু করা যায় না। দৃষ্টিটাকে এরা কিছুতেই ছড়িয়ে দিতে পারে না। কয়েকটা দিন না খেয়ে থাকা যে কঠিন কিছু না এটা তারা বুঝে না।
সােবাহান সাহেব একটা বড় খাতায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথাও লিখে রাখছেন। খুব গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছেন। তেমন গুছিয়ে লিখতে পারছেন না। কিছুক্ষণ লেখালেখি করলেই মাথায় চাপ পড়ছে। তাঁর ডায়েরীর কিছু কিছু অংশ এরকম
বুধবার
রাত দশটা পাচ। অনশন পর্ব শুরু করা গেল। এই অনশন দাবী আদায়ের অনশন নয়। এই অনশন নিজেকে জানার অনশন। আমি ক্ষুধার প্রকৃত স্বরূপ জানতে চাই। আমি এর ভয়াবহ রূপ জানতে চাই। যদি জানতে পারি তাহলে হয়তবা ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী সম্পর্কে আমার কিঞ্চিৎ ধারণা হবে। এই যে পৃথিবী জুড়ে হত্যাকান্ড হচ্ছে এর মূল কারণগুলির একটি নিশ্চয়ই ক্ষুধা। আজকের খবরের কাগজের একটি খবর দেখে অত্যন্ত বিষন্ন বােধ করেছি। সাভার উপজেলার জনৈক কাল মিয়া অভাবে অতিষ্ট হয়ে তার স্ত্রী, ছ‘বছরের পুত্র এবং তিন বছরের কন্যাকে হত্যা করে পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে। স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে ক্ষুধার তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে সে এটা করেছে। হায়রে ক্ষুধা। অথচ এই সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
বৃহস্পতিবার।
ভাের এগারােটা। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত বােধ করছি। আমি একটা পরীক্ষা করছি তাও তারা করতে দেবে না। তাদের ধারণা হয়েছে অল্প কয়েক ঘন্টা না খেয়ে থাকার কারণে আমি মারা যাব। মৃত্যু এত সহজ নয়। বিয়াল্লিশ দিন শুধুমাত্র পানি খেয়ে জীবিত থাকার রেকর্ড আছে। এরা এই জিনিষটা বুঝতে চায় না। আমার মৃত্যু প্রসঙ্গে এদের অতিরিক্ত সচেতনতাও আমার ভাল লাগছে না। মৃত্যু একটি অমােঘ ব্যাপার।
একে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? পবিত্র কোরান শরীফেলতা স্পষ্ট উল্লেখ আছে প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে। বর্তমানে ধর্মগ্রন্থ পাঠের একটা প্রবল ইচ্ছা বােধ করছি। ক্ষুধার্ত মানুষ কি পরলৌকিক চিন্তা করে? একটি জরুরী বিষয় লিখে রাখা দরকার বােধ করছি। মিনু বড় কান্নাকাটি করছে। এত কান্নাকাটির কি আছে তাতাে বুঝতে পারছি না। বিলু এসে বলে গেল আমি যদি না খাই তাহলে তার মা–ও খাওয়া বন্ধ করে দেবে। এ দেখি আরেক যন্ত্রণা হল।
বৃহস্পতিবার
বেলা একটা দশ মিনিট। ফুরিদের ফাজলামীর সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। শুনলাম এই গাধা এখন না –কি আমাকে নিয়ে ছবি করবে। ছবির নাম “ক্ষুধা হে।” এই গাধাটাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে তা করতে পারছি না। মিনু ফরিদকে বড়ই পছন্দ করে। আমিও করি। কেন করি তা জানি না। ভাল কথা এখন একটু কষ্ট হওয়া শুরু হয়েছে। মাথা ঘুরছে। প্রেসারের কোন সমস্যা কি না কে জানে।
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
ক্রমাগত ধর্ম গ্রন্থ পাঠ করার চেষ্টা করছি। পবিত্র কোরান শরীফে যে এত সুন্দর সুন্দর অংশ আছে আগে লক্ষ্য করিনি। মূল আরবীতে পড়তে পারলে ভাল হত। বয়স কম থাকলে আরবী পড়া শুরু করতাম। সেই সময় নেই। এখন ঠিক করেছি কোরান শরীফের পছন্দের কিছু আয়াত লিখে রাখব।
“If it were His will He could destroy you O mankind, and create
Another race: for He Hath power this to do.
সূরা নিসা, ১৩৪ নং আয়াত) আল্লাহতালা নতুন জাতি সৃষ্টি করার কথা বলছেন। যদি সত্যি সত্যি তিনি করতেন তাহলে কেমন হত সেই জাতি? তাদের কি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লােভ, কামনা থাকত না? তারা এইসব থেকে পুরােপুরি মুক্ত হত?
ফরিদ চোখে চশমা দিয়ে গভীর মনযােগে খাতায় শট ডিভিসন করছে। হাতে সময় নেই। দুলাভাইয়ের অনশন চলাকালীন সময়েই কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। একটা ফিস আই লেন্স দরকার ট্রিক শটের জন্যে। এই লেন্সটাই জোগাড় হচ্ছে না।
‘বাবাজী আসব?
ফরিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাকাল। এমদাদ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদ রাগী গলায় বলল, কি চান? ‘কিছু না। আমার নাতনী অর্থাৎ পুতুল চিন্তার মইদ্যে পড়েছে–আফনে না–কি তারে বলেছেন আসমানের চাঁদ ধইরা নামাইয়া ছিড়া কুটি কুটি কইরা খাইয়া ফেলতে।
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
‘হা বলেছি। হতভম্ভ এমদাদ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, খাইয়া ফেলতে বলছেন? ‘হ্যাবলেছি। কেন কোন অসুবিধা আছে?
এমদাদ শুকনাে গলায় বলল, জ্বিনা অসুবিধার কি? অসুবিধার কিছুই নাই। আপনার কথা শেষ হয়েছে?
‘তাহলে দয়া করে ঘর থেকে বের হয়ে যান। ‘অবশ্যই অবশ্যই।
এমদাদ প্রায় ছুটেই ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই লােকটির মাথা যে খানিকটা উলট পালট আছে তা সে শুরুতেই বুঝে গিয়েছিল। সেই উলট পালট যে এতখানি তা বােঝে নি। কিন্তু যে আকাশের চাঁদ ছিড়ে কুচি কুচি করে খেয়ে ফেলার কথা ভাবে তাকে সহজ পাগলের দলে ফেলা ঠিক হবে না। এর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। পুতুলকেও বলে দিতে হবে যেন এই লােকের ত্রি সীমানায় না আসে।
মনসুরকে আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেবে। সে এখন পুরােপুরি সুস্থ। ফুসফুসে পানি ঢুকে যাওয়ায় যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল তা এখন নেই। আর হাসপাতালে পরে থাকার কোন মানে হয় না। অবশ্যি মনসুর চাচ্ছে আরাে কিছুদিন থেকে যেতে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে তার মন্দ লাগে না। বই পত্র পড়া যায়। আরাম করে ঘুমানাে যায়। সবচে বড় কথা প্রায় দিনই মিলি এসে দেখে যায়। সে হাসপাতাল ছেড়ে দিলে নিশ্চয়ই মিলি তাকে দেখতে আসবেনা।
হাসপাতালের বিছানায় মনসুরের বেশীর ভাগ সময় মিলির কথা ভেবে ভেবেই কাটে। মিলিকে নিয়ে পেনসিল দিয়ে সে কবিতাও লিখেছে। সম্ভবত কিছুই হয়নি। কাউকে দেখাতে পারলে হত। দেখাতে লজ্জা লাগে। একটা কবিতা এরকম ।
বহুব্রীহি পর্ব (২০)- হুমায়ূন আহমেদ
একটু আগে এসে ছিলেন মিলি চারদিকে তাই এমন ঝিলিমিলি। মনটা আমার হল উড়ু উড়ু। বুকের ভেতর শব্দ দুরু দুরু। যখন মিলি বিদায় নিতে চান আমি বলি–একটু বসে যান। হাত বাড়িয়ে আমার দু’হাত ধরম
বাকিটা আর পারা যায় নি। ধরুনের সঙ্গে ভাল কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন, করুন, মরুন। কোনটাই ভাল লাগে না। আপাতত খাতা বন্ধ রেখে মনসুর গভীর মনােযােগে একটা চটি বই পড়ছে। বইটি ইংরেজীতে লেখা। বইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ। বইয়ের লৈখক পনেরাে বছর গবেষণা করার পর এই বই লিখেছেন এবং এই বইয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে মেয়েদের বিষয়ে প্রচলিত অধিকাংশ ধারনাই মিথ্যা। আমাদের আগে বিশ্বাস ছিল মেয়েদের রূপের প্রশংসা করলে তারা খুশী হয়। এই বইয়ের লেখক দেখিয়েছেন যে রূপের প্রশংসায় অধিকাংশ মেয়ে বিরক্ত হয়।
বইটির ব্যাক কভারে প্রকাশক লিখেছেন–নারী চরিত্র বােঝার জন্যে বইটি অপরিহার্য। অবিবাহিত যুবক যারা সঙ্গী খুঁজছেন বইটি তাদের জন্য বাইবেল স্বরূপ। মনসুরের কাছেও তাই মনে হচ্ছে। বইটা আরাে আগে হাতে এলে উপকার হত।