বইটির দ্বিতীয় চ্যাপ্টারের শিরােনাম–রসিকতা ও মেয়ে মানুষ। এখানে লেখক বলছেন আমাদের একটি ধারণা আছে মেয়েরা রসিকতা পছন্দ করে। ধারণা সঠিক নয়।
মেয়েরা রসিকতা একেবারেই পছন্দ করে না। কারণ কখনাে কোন মেয়েকে রসিকতা করতে দেখা যায় না। কেউ যদি মেয়েদের সঙ্গে রসিকতা করে তাহলে মেয়েরা তার সম্পর্কে নিম্নলিখিত ধারণা পােষণ করে। এই ধারণা পাচশত মেয়েদের মাঝ থেকে জরীপের মাধ্যমে নেয়া।
শতকরা হিসাব
ধারণা লােকটা ফাজিল লােকটা চালবাজ লােকটা বােকা। লােকটা চালাক
বাকি তিন ভাগ মহিলা কোন রকম মন্তব্য করতে রাজি হননি। কাজেই প্রিয় পাঠক আপনি যাই করুন মেয়েদের সঙ্গে রসিকতা করবেন না। যদি করতেই হয় খুব সহজ রসিকতা করবেন যা কোমলমতি শিশুরাও ধরতে পারে।
যে সব রসিকতা বুঝতে বুদ্ধির প্রয়ােজন ভুলেও সে সব রসিকতা করবেন না। নিম্নে রসিকতার কিছু নমুনা দেয়া গেল। এইসব রসিকতা করা যেতে পারে।
বহুব্রীহি পর্ব (২১)- হুমায়ূন আহমেদ
স্ত্রী স্বামীকে বলছেন, ওগাে পাশের বাসার ভদ্রলােক কত ভাল। অফিসে যাবার সময় রােজ তাঁর স্ত্রীকে চুমু দিয়ে যান। তুমি এ রকম কর না কেন? স্বামী অবাক হয়ে বললেন, আমি কি করে করব? আমি কি ঐ ভদ্র মহিলাকে চিনি?
মন্তব্য: জরীপে দেখা গেছে শতকরা ২৫ ভাগ মহিলা এই রসিকতা বুঝতে পারে না তবু হাসে। কাজেই একটু সাবধান থাকা ভাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যৌন বিষয়ক রসিকতা মেয়েরা না বুঝলেও খুব পছন্দ করে।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন সম্রাট শাজাহান কোথায় মারা গেছেন? ছাত্র বলল, ইতিহাস বই–এ সত্ত্বর পৃষ্ঠায়।
মন্তব্যঃ এই রসিকতা শতকরা ৭৮ ভাগ মহিলা বুঝতে পারেন। যারা বুঝতে পারেন না। তাঁরা সাধারণত অবাক হয়ে বলেন, সত্ত্বর পৃষ্ঠায় মারা গেছে? আপনি তাহলে বলতে চাচ্ছেন সতুর নাম্বারটা আনলাকি?
এক পাগলের খুব বই পড়ার নেশা। সব বই সে পড়ে না শুধু নাটকের বই পড়ে। পড়তে পড়তে নাটকের যাবতীয় বই সে পড়ে শেষ করে ফেলল। আরাে বই চায়। উপায় না দেখে তখন তাকে একটা টেলিফোন ডিরেক্টরি ধরিয়ে দেয়া হল। সে মহানন্দে দিন দশেক ধরে তাই পড়ছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল–কেমন লাগছে পড়তে?
বহুব্রীহি পর্ব (২১)- হুমায়ূন আহমেদ
পাগল বলল, অসাধারণ–তবে চরিত্রের সংখ্যা বেশী। মনে রাখতে একটু কষ্ট হচ্ছে। মন্তব্যঃ এই রসিকতা কোন মহিলাই ধরতে পারেন না তবে সবাই খুব হাসেন। কেন হাসেন এটা একটা রহস্য। দেখা গিয়েছে অনেক মহিলা হাসতে হাসতে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত হয়ে যান। কাজেই এই রসিকতা করার আগে যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা ভাল৷
মহিলাদের সঙ্গে রসিকতা করার সময় পাঞ্চ লাইনে যাবার আগেই উচ্চ স্বরে হাসা শুরু করা উচিত। যাতে মহিলারা বুঝতে পারেন কোথায় হাসতে হবে। মনসুর যখন বইয়ের এই অংশে তখন মিলি ঢুকল। সে ডাক্তারকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছে। কারণ হার্বিশ ঘন্টা পার হয়েছে সােবাহান সাহেব তিন কাপ পানি ছাড়া কিছুই খাননি। তার শরীরের তাপ নেমে এসেছে। চোখ হয়েছে লালচে। আগে নিজেই বসে বসে লিখতেন এখন তাও পারছেন না।
মিলি মনসুরের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। মনসুর হতভম্ব। মিলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, খুব খারাপ খবর আছে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন।
সােবাহান সাহেব কোন কিছু না খেয়ে ১৬৬ ঘন্টা পার করেছেন। মােটামুটি হাসি তামাশা হিসেবে যার শুরু হয়েছিল তার শেষটা সে রকম রইল না। মনসুর ঘােষণা করেছে আর বার
ঘন্টার ভেতর যদি কিছু খাওয়ানাে না যায় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে ফোর্স ফিডিং করা উচিত। রক্তে ইলেকট্রোলাইটে পরিমাণ কমে গেছে।
বহুব্রীহি পর্ব (২১)- হুমায়ূন আহমেদ
একমাত্র ফরিদকেই পুরাে ব্যাপারটায় আনন্দিত মনে হচ্ছে। তার ছবির কাজ এখনাে শুরু হয়নি। কারণ চিত্রনাট্যে শেষ মুহূর্তে একটা রদ বদল করা হয়েছে। ফরিদ ঠিক করে পুরাে দৃশ্যটি একটা গানের উপর করা হবে। গানটা এমন যার সঙ্গে ক্ষুধার কোন সম্পর্ক নেই। সেই গানও সিলেক্ট করা হয়েছে–“হলুদিয়া পাখি সােনার বরণ পাখিটি ছাড়িল কে।
গানের সঙ্গে ছবির যদিও কোন সম্পর্ক নেই তবু ছবিটা এমন ভাবে করা হবে যে একটা সম্পর্ক দীড়িয়ে যাবে। খুবই কঠিন কাজ। তবে জীবনের আনন্দতাে কঠিন কাজেই। সহজ কাজ সবাই পারে। কঠিন কাজ পারে কজনে? | ছবি নিয়ে মিলির সঙ্গে ছােটখাট ঝগড়ার মতও হল। মিলি চোখ মুখ লাল করে এসে বলল, একটা মানুষ মরে যাচ্ছে আর তুমি আছ ছবি নিয়ে?
ফরিদ বলেছে, জীবনটাই এরকম মিলি, কারাে জন্যে কোন কিছু আটকে থাকে না। Life goes on.
‘মামা তুমি পাথরের তৈরী একজন মানুষ। ‘তুই নেহায়েৎ ভুল বলিসনি।”
একটা মানুষ না খেয়ে মরে যাচ্ছে আর তুমি কিনা বানাচ্ছ ‘ক্ষুধা–হে। মামা চক্ষু লজ্জারােতে একটা ব্যাপার আছে। আছেনা?
‘শিল্প সাহিত্যের কাছে চক্ষু লজ্জা কিছু না–রে মা, শিল্প সাহিত্য চক্ষু লজ্জার অনেক উপরে।
‘তুমি কিছু মনে করাে না মামা। তােমার বুদ্ধি শুদ্ধিও কম।‘
না আমি কিছুই মনে করছি না। স্বয়ং সক্রেটিসকে লােকে গাধা বলেছে। আর্কিমিডিসকে ছােট বেলায় ডাকা হত সিকি বুদ্ধির মানুষ –বুঝলি?
মিলি জবাব না দিয়ে উঠে পড়েছে। মামার সঙ্গে তর্ক করা অর্থহীন।
এ বাড়ির কান্ডকারখানা দেখে সবচে বেশী হকচকিয়ে গেছে এমদাদ। সে কল্পনাও করতে পারেনি সত্যি সত্যি একটা মানুষ না খেয়ে এতদিন পার করে দেবে। এরকম অবস্থায় কোন কথা বার্তাওতাে বলা যায় না। যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল সেই পরিকল্পনা কোন কাজে আসছে না।
বহুব্রীহি পর্ব (২১)- হুমায়ূন আহমেদ
নাতনীটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। দেখে শুনে একটা বিয়ে দিয়ে দেয়া। গ্রামের বাড়িতে তাকে রাখা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কিছু গুড়া পাড়া ছেলে পেছনে লেগেছে। এদের মতলব ভাল না। গত বষায় বদি শেখের বৌকে ধরে পাটক্ষেতে নিয়ে গেছে। লজ্জায় এই ঘটনা বদি শেখ কাউকে বলেনি। না বললেও কারাের জানতে বাকি নেই।
ঘটনার নায়করাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। এদেরই একজন পুতুলকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে এবং আকারান্তরে জানিয়েছে প্রস্তাবে রাজি না হলে পাটক্ষেতে যেতে হবে। এর পর আর গ্রামে থাকা সম্ভব না। এমদাদ নাতনীকে নিয়ে বলতে গেলে পালিয়েই এসেছে। সে জানে ঘটনা শুনলে সােবাহান সাহেব একটা ব্যবস্থা করবেনই কিন্তু ঘটনা শুনানাের সময়ইতাে হল না। না খেয়ে মর মর
অবস্থা।
সব মন্দ জিনিষের একটা ভাল দিকও আছে। সােবাহান সাহেবের এই অসুখের ফলে মনসুর নামের এই ডাক্তার ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হল। এই ছেলে ঘন ঘন আসছে। পুতুলের সঙ্গে এই ছেলের বিয়ে দেয়া কি একেবারেই অসম্ভব? পুতুল দেখতে তাে খারাপ না।
চোখে কাজল টাজল দিলে মাশাআল্লাহ ভাল লাগে। তবে মেয়েটা হয়েছে বদ। যেটা করতে বলা হবে সেটা করবে না।
একটু সেজেগুজে ডাক্তারের সামনে হাঁটাহাটি করলে কি কোন অসুবিধে আছে? এক কাপ চা এনে দিবে। এক গ্লাস পানি আনবে। যাবার সময় বলবে, ডাক্তার সাব ভাল আছেন। আবার আসবেন! একটু ঢংঢং না করলে হয়? দুনিয়াটাই হচ্ছে ঢং ঢংয়ের।
অবশ্যি এমদাদ চেষ্টার ত্রুটি করছে না। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলেই গল্প গুজব করছে। একটা সম্পর্ক পাতানের চেষ্টায় আছে। কোনমতে একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেললে নিশ্চিন্ত। সেই সম্পর্কও করা যাচ্ছে না। ডাক্তারকেও একটু বােকা কিসিমের বলে মনে হচ্ছে। এটা একদিক দিয়ে ভাল। স্বামী হিসেবে বােকাদের কোন তুলনা নেই।
বহুব্রীহি পর্ব (২১)- হুমায়ূন আহমেদ
যত বােকা তত ভাল স্বামী। ডাক্তারটা কত বােকা সেটাও ঠিক ধরা যাচ্ছে না। তবে এই বাড়ির মিলি মেয়েটির সঙ্গে বড় বেশি খাতির। এটা একটা সন্দেহজনক ব্যাপার। একটু লক্ষ্য রাখতে হবে। গতকাল অবশ্যি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে কিছু কাজ করা হয়েছে। এইসব কাজ ঠান্ডা মাথায় করতে হয়। এখন বয়স হয়ে গেছে। মাথা আগের মত ঠান্ডা না। গতকাল ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তা যা হল তা হচ্ছে
এমদাদঃ এই যে ডাক্তার ভাই, শরীর ভাল? জিনহেন তাে আমারে? আমি এমদাদ।
পাকুন্দিয়ার এমদাদ। আমার নাতনীটার শরীরটা খারাপ। ভাবলাম একটু অষুধ
আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাই। ডাক্তারঃ কি অসুখ?
এমদাদঃ মাথার যন্ত্রণা। আরাে কি সব যেন আছে। আমি নিয়ে আসবনে আপনের কাছে।
দেখে শুনে যাই হােক একটা কিছু দিবেন। আপনের উপরে আবার খুব ভক্তি। আপনাকে খুবই ভাল পায়।। এই কথায় ডাক্তার খানিকক্ষণ খুক খুক করে কাশল। এটা খুব ভাল লক্ষণ। কাজেই কথাবাতা এই লাইনেই চালানাে ভাল। এমদাদ গলার স্বর খানিকটা নীচু করে বলল, মেয়েদের মন বােঝা বড় মুশকিল।