ঐ দিন আপনারে নিয়া
বিরাট ঝগড়া মিলির সঙ্গে। ডাক্তারঃ (খানিকটা উৎসাহী) মিলির সঙ্গে ঝগড়া?
এমদাদঃ জি। ডাক্তারঃ কি জন্যে বলুন তাে? এমদাদঃ মেয়েছেলের কারবারতাে। মিলি একদিন বলল–ডাক্তার সাহেব বেকুব
কিসিমের লােক এই শুইন্যা পুতুল রাগ করল। ডাক্তারঃ (হতভম্ব) আমাকে বেকুব কিসিমের লােক বলল? এমদাদঃ বাদ দেন। বাদ দেন। মেয়েছেলের কারবার, তামশা কইরা বলছে।
মেয়েছেলেরা তামশা কইরা অনেক কথা কয়। হে হে হে।। এমদাদ চেষ্টার চুড়ান্ত করছে, কিন্তু একা একা কত করবে? পুতুলের নিজেরও তাে সাহায্য দরকার। সে যদি কাঠের টুকরার মত থাকে তাহলে হবে কিভাবে? শাড়িটা বদলাতে বললে বদলায় না। চুলটা আঁচড়িয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ক্ষতিতাে কিছু নাই ?
তাছাড়া অবস্থা এমন কিছু করারও সময় না। একজন ঝিম ধরে পড়ে আছে। এখন যায় তখন যায় অবস্থা। ক্ষুধা কি জিনিষ বুঝতে চায়। আরে বাবা আল্লাহতালার ইচ্ছা না ক্ষুধা কি
জিনিষ তুমি বােঝ। যদি আল্লাহতালার সেই রকম ইচ্ছা থাকত তােমারে গরীব বানিয়ে পাঠাত। খামাখা ভাড়ং।
বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ
এ বাড়িতে এমদাদের সব সময় মুখ শুকনা করে থাকতে হয়। ভাব দেখাতে হয় যে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। এইসব কি ভাল লাগে? আর বুড়া যদি সত্যি সত্যি মরে যায় তাহলে তাে সাড়ে
সর্বনাশ। সে যাবে কোথায়?
সন্ধ্যাবেলা আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করল। কালবৈশাখীর প্রথম ঝাপ্টা। হাওয়ায় ঘরের দরজা জানালা উড়িয়ে নিয়ে যাবার মত অবস্থা। টগর এবং নিশীর আনন্দের সীমা নেই। বৃষ্টির মধ্যে খুব লাফাচ্ছে। বৃষ্টির জল অসম্ভব ঠান্ডা। শীতে একেকজন থর থর করে কাঁপছে তাতেও আনন্দ বাঁধ মানছে না। আনিস ঘর থেকে এই দৃশ্য দেখছে তবে চুপচাপই আছে। তার মুখের মৃদু হাসি দেখে মনে হচ্ছে সেও বেশ মজাই পাচ্ছে হয়ত সে পানিতে নামবে। টগর বলল, বাবা পানিতে নামবে?
আনিস হাসি মুখে বলল, ঠান্ডা কেমন তার উপর নির্ভর করছে। নিশা শীতে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একদম ঠান্ডা না বাবা। গরম পানি!
খুব গরম? ‘হ্যা খুব গরম।
আনিসও নেমে পড়ল। শীতে জমে যাবার মত অবস্থা। তবু বাচ্চাদের সঙ্গে হৈ চৈ করে ভিজতে ভাল লাগছে। সবার ঠান্ডা লেগে যাবে বলাই বাহুল্য। নিশা এখনই হাঁচি দিচ্ছে।
আর বােধ হয় মেয়েটাকে পানিতে থাকতে দেয়া উচিত হবে না কিন্তু ওঠে যেতে বলতেও খারাপ লাগছে। করুক, একটু আনন্দ–করুক।
নিশা শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল, বাবা আজ সারা রাত আমরা পানিতে ভিজব–কেমন? ‘আমার আপত্তি নেই।
বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ
পানিতে বেশীক্ষণ ভেজা গেল না। শীলা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দৌড়ে বাইকে ঘরে ঢুকতে হল। তিনজনেই শীতে থর থর করে কাঁপছে। নিশার গায়ে সম্ভবত জ্বর উঠেই গেছে। সে একটু পর পরই হাঁচি দিচ্ছে। বিলুর কাছ থেকে অষুধ এনে খাইয়ে দেয়া দরকার। আনিনকে বিলুর কাছে যেতে হল না। বিলুনিজেই এসে উপস্থিত। | বিলু মুখ শুকনাে করে বলল, আপনারা মনে হচ্ছে খুব মজা করলেন! আনিস বলল, হ্যাঁ করলাম। অনেকদিন পর পানিতে ভিজলাম। যাকে বলে শৈশবে ফিরে যাওয়া।
‘আপনার সঙ্গে একটা কথা বলার জন্যে এসেছিলাম আনিস সাহেব। ‘বলুন। ‘আপনার বাচ্চাগুলির গা মুছিয়ে শুকনাে কাপড় পরিয়ে দিন তারপর আমার সঙ্গে নিচে আসুনবলছি।
‘মনে হচ্ছে খারাপ খবর।
‘আমাদের জন্যে খারাপ খবর আপনার জন্যে কেমন তা জানি না। বাবার ব্লাড প্রেসার খুব ফল করেছে।
বলেন কি? ‘বাড়ির একটা মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে পড়ে আছে এবং তা পড়ে আছে আপনার উল্টা পাল্টা কথা শুনে অথচ আপনি একদিনও তাঁকে দেখতে যান নি।
আনিস বলল “চলুন যাই দেখে আসি।
‘ঠাট্টা করছেন? ‘আমি ঠাট্টা করি না। একজন মানুষ ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চাচ্ছে এটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে বলেই আমি চুপ করে আছি।
একজন মানুষ মরে যাবে তারপরও আপনি চুপ করে থাকবেন?
আনিস হাসি মুখে বলল, মানুষ এত সহজে মরে না। চলুন যাই অনশন ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আসি। বিলু বিশিত গলায় বলল, ‘আমরা সবাই মিলে যা পারলাম না আপনি তাই করবেন। অনশন ভাঙ্গাবেন?
আনিস সোবাহান সাহেবের সঙ্গে কি কথা বলল কেউ জানল না কারণ ঘরে তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না। কিন্তু দেখা গেল আনিস ঘর থেকে বেরুবার পর পরই সােবাহান সাহেব বললেন, ‘আমাকে এক গ্লাস দুধ দাও।
বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ
খবর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ফরিদ। এটা কি কথা? চিত্রনাট্য এখন কমপ্লিট আর এখনি কি–না অনশন ভঙ্গ। আর দুদিন পর ভাঙ্গলে অসুবিধাটা কি হত? এই দু’দিনে ইম্পর্টেন্ট কিছু সট নিয়ে নেয়া যেত! মহৎ কাজে পদে পদে বাধা আসে এটাই হচ্ছে খাটি কথা। মহাপুরুষদের যে বাণী–তােমার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় এটাই হচ্ছে আদি সত্য। – রাগ করে রাতে ফরিদ ভাত খেল না। এই রাগ তার নিজের উপর না, দুলাভাইয়ের উপরও।
এই রাগ হচ্ছে প্রকৃতির উপর। যে প্রকৃতি পদে পদে মানুষকে আশাহত করে। সােবাহান সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মিলি বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ডাক্তার পাশেই আছে। ডাক্তারের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে কারণ এই অনশনের কারণে খুব ঘন ঘন সে এ বাড়িতে আসতে পেরেছে। এখন অনশন ভাঙ্গায় একটু সমস্যা হয়েছে আর হয়ত ঘন ঘন আসা সম্ভব হবে না।
তবে ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলে হয়ত তৃষ্ণার্ত মানুষের কষ্ট বােঝার জন্যে এই লােক পানি খাওয়া বন্ধ করবেন। সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে। মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব আপনি এখনাে বসে আছেন কেন চলে যান। মনসুর বলল, না আমার কোন অসুবিধা নেই। এগারােটার দিকে প্রেসারটা মেপে তারপর যাব।
বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ
তাহলে আসুন আমাদের সঙ্গে চারটা ভাত খান। ‘জ্বি আচ্ছা। | ‘মিলি হাসতে হাসতে বলল, কেউ ভাত খেতে বলতেই আপনি বুঝি রাজি হয়ে যান? এ রকম চট করে রাজী হওয়াটা কি ভাল? আমাদের হয়ত ভাত খাওয়াবার ইচ্ছা নেই ভদ্রতা করে বলেছি।
মিলি কেমন হাসতে হাসতে কথাগুলি বলছে। শুনতে কি ভালই না লাগছে। আচ্ছা এই মেয়ের সঙ্গে তার যদি কোনদিন বিয়ে হয় তাহলে সেকি কোনদিন তার সঙ্গে কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবে? না করবে না। কোনদিন না। এই মেয়েকে সে কোনদিন কোন কড়া কথা বলতে পারবে না। এই মেয়ের খুব কঠিন কথায়ও সে রাগ করতে পারবে না।
‘ডাক্তার সাহেব।
‘আপনি আনিস সাহেবের ছােট মেয়েটাকে একবার দেখে যাবেন। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে। আপনি বরংউপর থেকে রুগী দেখে আসুন–আমি ভাত দিতে বলি।
‘জি আচ্ছা।‘
নিশার জ্বর তেমন কিছু না। একশ’র কিছু বেশী। তবে লাংস পরিস্কার না। কেমন যেন ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। আনিস বলল, কেমন দেখলেন?
মনসুর বলল, ভাল। ‘সত্যি ভাল তাে? আপনার গলায় তেমন জোর পেলাম না।
সাংসে কেমন ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে বুকে বােধ হয় কফ জমে গেছে। সকাল পর্যন্ত দেখবতারপরএন্টিবায়ােটিক দেব।”
‘আপনার ভিজিট কত ডাক্তার সাহেব?‘
মনসুর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আনিস সাহেব। আমি বাচ্চাদের সঙ্গে খুব ভাল মিশতে পারি না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে না। আমি সেই রকম। আমি আপনার বাচ্চা দুটাকে যে কি পরিমাণ পছন্দ করি তা ওরা জানে না কিন্তু আমি জানি, আমার হৃদয় জানে। আপনি ভিজিটের কথাটা তুলে খুব কষ্ট দিলেন।
বহুব্রীহি পর্ব (২২)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিস লজ্জিত স্বরে বলল, ভাই কিছু মনে করবেন না। “না আমি কিছু মনে করিনি।
আনিস হাসতে হাসতে বলল, আমিও আপনাকে খুব পছন্দ করি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনাকে খানিক সাহায্য করতে পারি।
মনসুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে সাহায্য করতে পারেন? ‘হাঁ পারি। আমার মনে হয় আপনার কিছু উপদেশের প্রয়ােজন আছে।