মনসুর তাকিয়ে রইল। আনিস বলল, যে কথাটা আপনি বলতে পারেন না, লজ্জা বােধ করেন বা সংকোচ বােধ করেন সেটা বলে ফেলবেন। পেটে জমিয়ে রাখবেন না। এই হচ্ছে উপদেশ।
‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।
ধরুন আপনি কাউকে ভালবাসেন। রূপবতী কোন এক তরুণীকে। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছেন না। সব সময়ই আপনার মনে এক ধরণের ভয়। এক ধরনের শংকা। ঐ ভয়, ঐ শংকা দূর করে ফেলুন। যখন মেয়েটিকে একা দেখবেন এগিয়ে যাবেন, সহজ স্বাভাবিক গলায় বলবেন, আমি তােমাকে ভালবাসি। এতে অতীতে কাজ হয়েছে। বর্তমানে হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। আমার মনে হয় অনেকদিন থেকেই এ কথাটা আপনি কাউকে বলতে চাচ্ছেন। সাহস পাচ্ছেনা।
‘আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন?
‘আপনাকে বলছি কারণ আপনি নিতান্তই একজন ভাল মানুষ, আমি আপনার উপকার করতে চাই।‘
‘আমার উপকার করা নিয়ে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
মনসুর নীচে নেমে এল কিন্তু আনিসের কথা মাথা থেকে দূর করতে পারল না। ব্যাপারটা তাে আসলেই তাই। কাছে যাওয়া এবং এক পর্যায়ে শান্ত গলায় আসল কথাটা বলে ফেলা
আমি তােমাকে ভালবাসি। I love you.
জগতের সবচে পুরাতন কথা আবার সবচে নতুন কথা। এই কথা বলতে এত সংকোচ কেন? এত দ্বিধা কেন? সে মিলিকে এই কথা বলার পর মিলি কি করতে পারে? সম্ভাবনা গুলি খতিয়ে দেখা যাক।
ক। মিলি মাথা নীচু করে ফেলল। তার ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে। চোখের কোণ আদ্র।
ক্ষীণ গলায় ছােট্ট করে বলল–তুমি এসব কি বলছ? যাঃ। আমার লজ্জা লাগছে। (মিলি
এটা কখনাে করবে না। মিলির প্রকৃতি এটা নয়।}। খ। মিলি কড়া চোখে তাকাবে তারপর বলবে, মনে হচ্ছে কয়েক রাত আপনার ঘুম
হয়নি। দয়া করে প্রতি রাতে দশ মিলিগ্রাম করে সিডেটিভ খেয়ে ঘুমুবেন। আর যে কথাটা এখন বললেন সেই কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না।
(মিলি এই জাতীয় কিছু বলবে বলেও মনে হয় না। তার হৃদয় এত কঠিন নয়।) গ। মিলি হাে হাে করে হেসে উঠবে তারপর যার সঙ্গেই দেখা হবে তাকেই ঘটনাটা
বলবে। এই সম্ভাবনাই সবচে বেশী।
খাবার ঘর প্রায় ফাঁকা। রহিমার মা টেবিলে খাবার দিচ্ছে। মিলি বসে আছে একা একা।। অপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্যে। মনসুর খাবার ঘরে ঢােকার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। মিলিকে কি কথাটা বলে ফেলবে? মন্দ কি? মানসিক যাতনা ভােগ করার চেয়ে হুট করে বলে ফেললেই হয়।
কখন বললে ভাল হবে? খাওয়ার আগে খাওয়ার মাঝখানে নাকি খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর? সবচে ভাল হবে চলে যাবার সময় বললে। মিলি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে তখন সে বলবে সেই বিশেষ কথা। বলেই অপেক্ষা করবে না। লম্বা লম্বা পা ফেলে পগার পার। রাতের টেনশান কমানাের জন্যে দশ–মিলিগ্রাম রিলাক্সেন অবশ্যি খেতে হবে। তাতেও টেনশান কমবে বলে মনে হয় না।
ছােট্র নিঃশ্বাস ফেলে মনসুর খাবার ঘরে এল। মিলি টেবিল সাজাতে ব্যস্ত। তাকে লক্ষ্য করল না। ঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই! রহিমার মা পানির জগ বা অন্য কিছু আনতে গেছে। এক্ষণী হয়ত চলে আসবে। কথাটা বলে ফেললে কেমন হয়? এইতাে সুযােগ।
গুছিয়ে কিছু চিন্তা করার আগেই সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মিলি আমি তােমাকে ভালবাসি। | মনসুর বুঝতে পারছে মিলি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছে। মনসুর তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, অনেকদিন থেকেই কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম, বলতে পারছিলাম না। আজ বলে ফেললাম। মিলি আমি তােমাকে ভালবাসি।
‘ডাক্তার সাহেব, আমি বিলু। আপনি বসুন। আমি আপনার কথা মিলিকে বলে দেব। মিলি এখানে নেই।
মনসুরের মনে হল খুব বড় একজন সার্জন, ধারাল ছুরি দিয়ে তার শরীর থেকে সেন্ট্রাল নাভাস সিস্টেম কেটে বের করে নিয়ে গেছে। তার শরীরে এখন কোন বােধ নেই, চেতনা নেই।
সে কোন মানুষ না–সে একজন ‘জম্বি‘। বিলু বলল, ‘ডাক্তার সাহেব বসুন।
মনসুর বসল। ‘ঘরে খাবার তেমন কিছু নেই। মিলি কি যেন রাঁধতে গেছে।”
ডাক্তার মাথা নীচু করে বসে রইল। বিলু অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে বলল, আপনি এত নাভাস হচ্ছেন কেন? এ রকম ছােট খাট ভুলতাে মানুষ সব সময় করে। করে না?
মনসুর যন্ত্রের মত মাথা নাড়ল। মিলি ডিম ভেজে এনেছে। ঘরে ঢুকেই ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি হয়েছে?
‘কিছু হয় নি। মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব আপনার কি হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে? এ রকম ঘামছেন কেন?
মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে মিস মিলি। আজ আমি কিছু খাব না।
ডাক্তার কাউকে কিছু বলার অবকাশ দিল না। দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেল। মিলি কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসতে হাসতে বিলু ভেঙ্গে পড়ছে। তার বড় মজা লাগছে। মিলি বলল, হচ্ছেটা কি আপা? এত হাসি কিসের?
বিলু বলল, ডাক্তার চমৎকার করে প্রেম নিবেদন করল তাই দেখে হাসছি।
প্রেম নিবেদন করল মানে? ‘ও তাের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডুবে মরে যাবার আগে ওকে বিয়ে করে ফেল। ও ভাল
ছেলে।
দু’জনই দেব শিশু।
দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের ছােট্ট ডানা দু’টি ঘরের বাইরে রেখে খেলতে বসেছে। এই খেলাও অদ্ভুত খেলা। একজনের হাতে একটা কীচি, অন্যজন বিছানার চাদর ধরে আছে। কচ কচ করে চাদর কাটা হচ্ছে। বাচ্চা দু‘জনের কারাে মুখেই কোন বিকার নেই!
পুতুল অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। বাচ্চা দু’টিকে সে চেনে তবে এখনাে ভাল পরিচয় হয়নি। আজ পরিচয় করার জন্যেই এসেছিল। এসে দেখে এই কান্ড। তার বাধা দেয়া উচিত কিন্তু বাধা দেয়ার প্যায় পার হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটি বিছানার চাদর কেটেছে, বালিশ কেটেছে
একটা লেপ কেটেছে। ঘরময়তুলা উড়ছে। ভয়াবহ অবস্থা।
পুতুল বলল, এইসব কি? নিশা হালকা গলায় বলল, কিছুনা। তােমরা এইসব কেন করতা? ‘কাটাকুটি খেলছি।‘ বােনের এই কথা টগরের পছন্দ হল না সে বলল, আমরা দরজি দরজি খেলছি। ‘দরজি দরজি খেলতাছ?”
বসেই টগর হাসল। অনেকদিন থেকেই এই খেলাটা তার খুব পছন্দ।
রাস্তার ওপাশে নতুন দরজির দোকান হয়েছে–‘ক্যালকাটা স্যুটিং সেখানে খচ খচ করে রাত দিন কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হয়, টগর গভীর আগ্রহে দেখে। আজ অনেক দিন পর এই খেলার সুযােগ পাওয়া গেল। কীচি অনেক কষ্টে নিশা মিলির কাছ থেকে জোগাড় করেছে।
পুতুল বলল, তােমাদের আহ্বা তােমাদের মারবে না? টগরবলল, মারবে।
তারপরেও এই রকম করতাছ?
কেন? নিশা ছােট্ট করে হেসে বলল, বেশি মারবে না। অল্প মারবে। ‘অল্প মারবে কেন? ‘আমাদের মা মারা গেছেতাে। মা মারা গেলে বাচ্চাদের বেশি মারার নিয়ম থাকে না। কম মারতে হয়।
পুতুল বলল, অনেক খেলা হইছে এখন হাত থাইক্যা কেচিটা নামাও। না হইলে হাত কাটব।।
টগর বলল, আপনি এখন যানতাে। আপনি আমাদের বিরক্ত করবেন না। পুতুল নড়ল না। এমন মজার একটি দৃশ্যের আকর্ষণ এড়িয়ে সে যেতে পারছে না। বাচ্চা দু’টি টুক টুক করে কথা বলছে।
নিশা বলল, আপনি আমার জন্যে এক গ্লাস খাওয়ার পানি আনেন তাে। এমনভাবে বলল যেন কতদিনের পরিচিত। কত দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠতা। পুতুল পানি আনতে গেল। | পানি এনে দুই দরজীর কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা অদৃশ্য। ডেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আনিস ঘরে এসেছে। তার সাড়া পাওয়ার পরই এই অবস্থা।