বহুব্রীহি পর্ব (২৩)- হুমায়ূন আহমেদ

মনসুর তাকিয়ে রইলআনিস বলল, যে কথাটা আপনি বলতে পারেন না, লজ্জা বােধ করেন বা সংকোচ বােধ করেন সেটা বলে ফেলবেনপেটে জমিয়ে রাখবেন নাএই হচ্ছে উপদেশ

বহুব্রীহি 

আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। 

ধরুন আপনি কাউকে ভালবাসেনরূপবতী কোন এক তরুণীকেকিন্তু বলার সাহস পাচ্ছেন নাসব সময়ই আপনার মনে এক ধরণের ভয়এক ধরনের শংকাভয়, শংকা দূর করে ফেলুনযখন মেয়েটিকে একা দেখবেন এগিয়ে যাবেন, সহজ স্বাভাবিক গলায় বলবেন, আমি তােমাকে ভালবাসিএতে অতীতে কাজ হয়েছেবর্তমানে হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবেআমার মনে হয় অনেকদিন থেকেই কথাটা আপনি কাউকে বলতে চাচ্ছেনসাহস পাচ্ছেনা। 

আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন

আপনাকে বলছি কারণ আপনি নিতান্তই একজন ভাল মানুষ, আমি আপনার উপকার করতে চাই‘ 

আমার উপকার করা নিয়ে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। 

মনসুর নীচে নেমে এল কিন্তু আনিসের কথা মাথা থেকে দূর করতে পারল নাব্যাপারটা তাে আসলেই তাইকাছে যাওয়া এবং এক পর্যায়ে শান্ত গলায় আসল কথাটা বলে ফেলা 

আমি তােমাকে ভালবাসিI love you

জগতের সবচে পুরাতন কথা আবার সবচে নতুন কথাএই কথা বলতে এত সংকোচ কেন? এত দ্বিধা কেন? সে মিলিকে এই কথা বলার পর মিলি কি করতে পারে? সম্ভাবনা গুলি খতিয়ে দেখা যাক। 

মিলি মাথা নীচু করে ফেললতার ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছেচোখের কোণ আদ্র। 

ক্ষীণ গলায় ছােট্ট করে বললতুমি এসব কি বলছ? যাঃআমার লজ্জা লাগছে(মিলি 

এটা কখনাে করবে নামিলির প্রকৃতি এটা নয়}। মিলি কড়া চোখে তাকাবে তারপর বলবে, মনে হচ্ছে কয়েক রাত আপনার ঘুম 

হয়নিদয়া করে প্রতি রাতে দশ মিলিগ্রাম করে সিডেটিভ খেয়ে ঘুমুবেনআর যে কথাটা এখন বললেন সেই কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না। 

(মিলি এই জাতীয় কিছু বলবে বলেও মনে হয় নাতার হৃদয় এত কঠিন নয়) মিলি হাে হাে করে হেসে উঠবে তারপর যার সঙ্গেই দেখা হবে তাকেই ঘটনাটা 

বলবেএই সম্ভাবনাই সবচে বেশী। 

খাবার ঘর প্রায় ফাঁকারহিমার মা টেবিলে খাবার দিচ্ছেমিলি বসে আছে একা একাঅপেক্ষা করছে ডাক্তারের জন্যেমনসুর খাবার ঘরে ঢােকার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলমিলিকে কি কথাটা বলে ফেলবে? মন্দ কি? মানসিক যাতনা ভােগ করার চেয়ে হুট করে বলে ফেললেই হয়। 

কখন বললে ভাল হবে? খাওয়ার আগে খাওয়ার মাঝখানে নাকি খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর? সবচে ভাল হবে চলে যাবার সময় বললেমিলি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে তখন সে বলবে সেই বিশেষ কথাবলেই অপেক্ষা করবে নালম্বা লম্বা পা ফেলে পগার পাররাতের টেনশান কমানাের জন্যে দশমিলিগ্রাম রিলাক্সেন অবশ্যি খেতে হবেতাতেও টেনশান কমবে বলে মনে হয় না। 

ছােট্র নিঃশ্বাস ফেলে মনসুর খাবার ঘরে এলমিলি টেবিল সাজাতে ব্যস্ততাকে লক্ষ্য করল নাঘরে দ্বিতীয় প্রাণী নেই! রহিমার মা পানির জগ বা অন্য কিছু আনতে গেছেএক্ষণী হয়ত চলে আসবেকথাটা বলে ফেললে কেমন হয়? এইতাে সুযােগ। 

গুছিয়ে কিছু চিন্তা করার আগেই সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মিলি আমি তােমাকে ভালবাসি| মনসুর বুঝতে পারছে মিলি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছেমনসুর তার চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, অনেকদিন থেকেই কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম, বলতে পারছিলাম নাআজ বলে ফেললামমিলি আমি তােমাকে ভালবাসি। 

ডাক্তার সাহেব, আমি বিলুআপনি বসুনআমি আপনার কথা মিলিকে বলে দেব। মিলি এখানে নেই। 

মনসুরের মনে হল খুব বড় একজন সার্জন, ধারাল ছুরি দিয়ে তার শরীর থেকে সেন্ট্রাল নাভাস সিস্টেম কেটে বের করে নিয়ে গেছেতার শরীরে এখন কোন বােধ নেই, চেতনা নেই। 

সে কোন মানুষ নাসে একজন জম্বিবিলু বলল, ডাক্তার সাহেব বসুন। 

মনসুর বসলঘরে খাবার তেমন কিছু নেইমিলি কি যেন রাঁধতে গেছে” 

ডাক্তার মাথা নীচু করে বসে রইলবিলু অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্যে বলল, আপনি এত নাভাস হচ্ছেন কেন? রকম ছােট খাট ভুলতাে মানুষ সব সময় করেকরে না

মনসুর যন্ত্রের মত মাথা নাড়লমিলি ডিম ভেজে এনেছেঘরে ঢুকেই ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি হয়েছে

কিছু হয় নিমিলি বলল, ডাক্তার সাহেব আপনার কি হার্ট এ্যাটাক হচ্ছে? রকম ঘামছেন কেন

মনসুর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে মিস মিলিআজ আমি কিছু খাব না। 

ডাক্তার কাউকে কিছু বলার অবকাশ দিল নাদ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেলমিলি কিছুই বুঝতে পারছে নাহাসতে হাসতে বিলু ভেঙ্গে পড়ছেতার বড় মজা লাগছেমিলি বলল, হচ্ছেটা কি আপা? এত হাসি কিসের

বিলু বলল, ডাক্তার চমৎকার করে প্রেম নিবেদন করল তাই দেখে হাসছি। 

প্রেম নিবেদন করল মানে? তাের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেডুবে মরে যাবার আগে ওকে বিয়ে করে ফেলভাল 

ছেলে। 

দুজনই দেব শিশু। 

দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের ছােট্ট ডানা দুটি ঘরের বাইরে রেখে খেলতে বসেছেএই খেলাও অদ্ভুত খেলাএকজনের হাতে একটা কীচি, অন্যজন বিছানার চাদর ধরে আছেকচ কচ করে চাদর কাটা হচ্ছেবাচ্চা দুজনের কারাে মুখেই কোন বিকার নেই

পুতুল অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছেবাচ্চা দুটিকে সে চেনে তবে এখনাে ভাল পরিচয় হয়নিআজ পরিচয় করার জন্যেই এসেছিলএসে দেখে এই কান্ডতার বাধা দেয়া উচিত কিন্তু বাধা দেয়ার প্যায় পার হয়ে গেছেবাচ্চা দুটি বিছানার চাদর কেটেছে, বালিশ কেটেছে 

একটা লেপ কেটেছেঘরময়তুলা উড়ছেভয়াবহ অবস্থা। 

পুতুল বলল, এইসব কি? নিশা হালকা গলায় বলল, কিছুনাতােমরা এইসব কেন করতা? কাটাকুটি খেলছিবােনের এই কথা টগরের পছন্দ হল না সে বলল, আমরা দরজি দরজি খেলছিদরজি দরজি খেলতাছ?” 

বসেই টগর হাসলঅনেকদিন থেকেই এই খেলাটা তার খুব পছন্দ। 

রাস্তার ওপাশে নতুন দরজির দোকান হয়েছেক্যালকাটা স্যুটিং সেখানে খচ খচ করে রাত দিন কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটা হয়, টগর গভীর আগ্রহে দেখেআজ অনেক দিন পর এই খেলার সুযােগ পাওয়া গেলকীচি অনেক কষ্টে নিশা মিলির কাছ থেকে জোগাড় করেছে। 

পুতুল বলল, তােমাদের আহ্বা তােমাদের মারবে না? টগরবলল, মারবে। 

তারপরেও এই রকম করতাছ

কেন? নিশা ছােট্ট করে হেসে বলল, বেশি মারবে নাঅল্প মারবেঅল্প মারবে কেন? আমাদের মা মারা গেছেতােমা মারা গেলে বাচ্চাদের বেশি মারার নিয়ম থাকে নাকম মারতে হয়। 

পুতুল বলল, অনেক খেলা হইছে এখন হাত থাইক্যা কেচিটা নামাওনা হইলে হাত কাটব। 

টগর বলল, আপনি এখন যানতােআপনি আমাদের বিরক্ত করবেন নাপুতুল নড়ল নাএমন মজার একটি দৃশ্যের আকর্ষণ এড়িয়ে সে যেতে পারছে নাবাচ্চা দুটি টুক টুক করে কথা বলছে। 

নিশা বলল, আপনি আমার জন্যে এক গ্লাস খাওয়ার পানি আনেন তােএমনভাবে বলল যেন কতদিনের পরিচিতকত দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠতাপুতুপানি আনতে গেল| পানি এনে দুই দরজীর কাউকেই পাওয়া গেল নাতারা অদৃশ্যডেকেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে নাকারণ আনিস ঘরে এসেছেতার সাড়া পাওয়ার পরই এই অবস্থা। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *