এম, এ পড়া মানে শুধু শুধু সময় নষ্ট। বর্তমানে তার দিন কাটছে ঘুমিয়ে। অল্প যে কিছু সময় সে জেগে থাকে সেই সময়টায় সে ছবি দেখে। অধিকাংশই আর্ট ফ্লিম। কোন কোন ছবি ছ‘সাতবার করেও দেখা হয়।
বাকি জীবনটা সে এই ভাবেই কাটিয়ে দিতে চায় কিনা জিজ্ঞেস করলে অত্যন্ত উচ্চ মার্গের একটা হাসি দেয়। সেই হাসি অতি মধুর, তবু কেন জানি সােবাহান সাহেবের গা জ্বলে যায়। ইদানীং ফরিদকে দেখা মাত্র তীর ব্রহ্মতালু গরম হয়ে উঠে, ঘাম হয়। আজও হল। তিনি তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আগেকার আমলের মুনি ঋষিরা হয়ত এই দৃষ্টি দিয়েই দুষ্টদের ভস্ম করে দিতেন। ফরিদ তার দুলাভাইয়ের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
What a lovely day.
ফরিদের খালি গা। কাঁধে একটা টাওয়েল। মুখ ভর্তি টুথপেষ্ট্রের ফেনা। কথা বলতে গিয়ে ফেনা তার গায়ে পড়ে গেল এতে তার মুগ্ধ বিস্ময়ের হের ফের হল না। সে আনন্দিত স্বরে বলল, দুলাভাই শরৎকালের এই শােভার কোন তুলনা হয় না। অপূর্ব! অপূর্ব! আমার মনটা দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে দুলাভাই। I am dissolving in the nature.
সােবাহান সাহেব মেঘ গর্জন করলেন, ফরিদ এসব কি হচ্ছে আমি কি জানতে পারি?
‘নেচারকে এপ্রিসিয়েট করছি দুলাভাই। নেচারকে এপ্রিসিয়েট করায় নিশ্চয়ই কোন বাধা নেই।
টুথপেষ্টের ফেনায় সারা গা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল আছে?” ‘তাতে কিছু যায় আসে না দুলাভাই। ‘যায় আসে না?”
‘খালি গায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ, রাস্তায় লােকজন চলাচল করছে তাতেও তােমার অসুবিধা হচ্ছে না?
‘জ্বি না। পােষাক হচ্ছে একটা বাহুল্য।
পােষাক একটা বাহুল্য। ‘জ্বি। আমি যখন খালি গা থাকি তখন প্রকৃতির কাছাকাছি থাকি। কারণ প্রকৃতি যখন আমাদের পাঠান তখন খালি গায়েই পাঠায়। এই যে আপনি জাৰ্ব জোৱা পরে বসে আছেন এইসব খুলে পুরো দিগম্বর হয়ে যান দেখবেন অন্য রকম ফিলিংস আসবে।‘
স্তম্ভিত সােবাহান সাহেব বললেন, তুমি আমাকে সব কাপড় খুলে ফেলতে বলছ? ‘জ্বি বলছি।”
সােবাহান সাহেব লক্ষ্য করলেন তাঁর ব্রহ্মতালুতে জ্বলুনী শুরু হয়েছে, গা ঘামছে। এসব হার্ট এ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ কিনা কে জানে। তার মৃত্যু হার্ট এটাকে হবে এটা তিনি বুঝতে পারছেন, ফরিদের কারণেই হবে। কত অবলীলায় কথাগুলি বলে কেমন হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে।
ফরিদ বলল, আপনি চোখ মুখ এমন শক্ত করে বসে আছেন কেন দুলাভাই ? আনন্দ করুন। ‘আনন্দ করব?‘
‘হাঁ করবেন। জীবনের মূল জিনিসই হচ্ছে আনন্দ। এমন চমৎকার একটা সকাল। আচ্ছা দুলাভাই রবি ঠাকুরের ঐ গানটার কথাগুলি আপনার মনে আছে–আজি এ শারদ প্রভাতে মনে আছে? প্রথম লাইনটা কি–আজি এ শারদ প্রভাতে, না–কি হেরিনু শারদ প্রভাতে?
সােবাহান সাহেব বললেন, তুমি দয়া করে আমার সামনে আসবে না। ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কেন? ‘আবার কথা বলে, যাও বলছি আমার সামনে থেকে বহিষ্কার, বহিস্কার। ‘কি যন্ত্রণা আবার সাধু ভাষা ধরলেন কেন? বহিস্কার বার কি? বলুন বেড়িয়ে যাও। মুখের ভাষাকে আমাদের সহজ করতে হবে। দুলাভাই, তৎসম শব্দ যত কম ব্যবহার করা যায়। ততই ভাল।
যাও বলছি আমার সামনে থেকে। যাও বলছি। ‘যাচ্ছি। যাচ্ছি। বিনা কারণে আপনি এ রকম রেগে যান কেন এই ব্যাপারটাই আমি বুঝি না।
ফরিদ চিন্তিত মুখে ঘরের ভেতর ঢুকল। সােবাহান সাহেবের স্ত্রী তার কিছুক্ষণ পর বারান্দায় এসে বললেন, তুমি কি মিলিকে কিছু বলেছ? ও কাঁদছে কেন?
সােবাহান সাহেবের মনটা আরাে খারাপ হয়ে গেল, একুশ বছর বয়েসী একটা মেয়ে যদি কথায় কথায় কেঁদে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে দেশের নারী সমাজের চরম দুর্দিন যাচ্ছে।
‘কথা বলছ না কেন, কিছু বলেই মিলিকে? মেয়ে বড় হয়েছে এখন যদি রাগারাগি কর।––
সােবাহান সাহেব শীতল গলায় বললেন, মিনু তােমাকে এখন একটা কঠিন কথা বলব, মন দিয়ে শােন—আমি তােমাদের সংসারে আর থাকব না।
‘তার মানে, কোথায় যাবে তুমি?
সেটা এখনাে ঠিক করিনি। আজ দিনের মধ্যে ঠিক করব। মিনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। সােবাহান সাহেব বললেন, একটা অপ্রিয় ডিসিসান নিলাম। বাধ্য হয়েই নিলাম।
বনে জঙ্গলে গিয়ে সাধু সন্ন্যাসী হবে? এই বিষয়ে তােমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না।‘ সােবাহান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। মিন বললেন যাচ্ছ কোথায়?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অতি দ্রুত গেট খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার ওপাশেই এখন একটা মাইক ভাড়ার দোকান হয়েছে। সারাক্ষণ সেখান থেকে “হ্যালাে মাইক্রোফোন টেস্টিং–ওয়ান–টু–খ্রী। হলাে মাইক্রোফোন টেস্টিং–ওয়ান টু–খ্রী হয়। এখন হচ্ছে না। এখন তারা একটা রেকর্ড বাজাচ্ছে–“হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল।” এই লক্ষ কোটি বার শােনা গান শুনে মেজাজ আরাে খারাপ হবার কথা, তা হল না। সােবাহান সাহেব লক্ষ্য করলেন–গানটা শুনতে তাঁর ভাল লাগছে। তিনি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, আকাশ ঘন নীল, নীল আকাশে সাদা মেঘের স্তুপ। আকাশ এবং মেঘ দেখতেও তাঁর ভাল লাগল। তাঁর মনে হল–মানব জীবন বড়ই মধুর। এই জীবনের আনন্দ হেলা ফেলার বিষয় নয়।
‘মানব জীবন বড়ই মধুর এই কথা সবার জন্যে সম্ভবত প্রযােজ্য নয়। গ্রীন ফার্মেসীর নতুন ডাক্তার মনসুর আহমেদের জন্যে তাে অবশ্যই নয়। তার কাছে মনে হচ্ছে—মানব জীবন অর্থহীন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রকম মনে করার আপাত দৃষ্টিতে তেমন কোন কারণ নেই। সে মাত্র ছ‘মাস আগে ইন্টানীশীপ শেষ করে বের হয়েছে। এর মধ্যেই ভােলা উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটা চাকরিও পেয়েছে। ঢাকা ছেড়ে যাবার ইচ্ছা নেই বলে ঐ চাকরি সে নেয়নি। আপাতত সে গ্রীণ ফার্মেসীতে বসছে। গ্রীণ ফার্মেসীর মালিক কুন্দুস সাহেব তাকে ফার্মেসীর উপরে দু’টি ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। মনসুর ঐ ঘর দু’টিতে সংসার পেতে বসেছে। প্রতিদিন কিছু রুগী টুগীও পাচ্ছে। বড় কিছু না–সর্দি জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া। একদিন অল্পবয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে মেয়ের মা এসেছিলেন, চেংড়া ডাক্তার দেখে মেয়ের অসুখ প্রসঙ্গে কিছু বললেন
গম্ভীর গলায় বললেন, না থাক আপনাকে দেখতে হবে না। আমার দরকার একজন বয়স্ক ডাক্তার। আপনি তাে নিতান্তই বাচ্চা ছেলে।
কুদ্স সাহেব বললেন, ডাক্তারদের কোন বয়স নেই আপা। ডাক্তার হচ্ছে ডাক্তার। আর এর বয়স কম হলে কি হবে জাত–সাপ। | জাত সাপের প্রতি রুগী বা রুগীনির মা কারােরই কোন আগ্রহ দেখা গেল না। রুগীনি বলল, আমি উনাকে কিছু বলব না মা।
এ রকম দু একটা কেইস বাদ দিলে রুগী যে খুব খারাপ হচ্ছে তাও না। ভিজিটের টাকা চাইতে মনসুরের লজ্জা করে। ঐ দায়িত্ব কুদ্দস সাহেব খুব ভাল ভাবেই পালন করছেন।
দশ টাকা কি দিচ্ছেন ভাই? উনার ভিজিট কুড়ি টাকা। বয়স কম বলে অশ্রদ্ধা করবেন। –গােল্ড মেডালিষ্ট।
মনসুর বিব্রত গলায় বলেছে, কুদুস ভাই, সব সময় গােল্ড মেডেলের কথা বলেন। কোন মেডেল ফেডেল তাে আমি পাই নি। | কুদ্স সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছেন, পাওয়ার দরকার নেই। মানুষের মুখেই জয়। মানুষের মুখেই ক্ষয়। মুখে মুখে মেডেলের কথাটা রটে যাক। সুটকেস খুলে কেউতাে আর মেডেল দেখতে আসবে না।
এইসব মিথ্যা কথা বলে লাভ কি?
নাম ফাটবেরে ভাই নাম ফাটবে। তােমার নাম ফাটা মানে ফার্মেসীর উন্নতি। ফার্মেসীর উপর বেঁচে আছি। ফার্মেসীর উন্নতি দেখতে হবে না?
কুদুস সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফার্মেসীতে বসে থাকেন। সারাক্ষণ কথা বলেন। মানুষটাকে মনসুরের বেশ ভাল লাগে। তাঁর বকবকানি এবং উপদেশ শুনতেও মনসুরের খারাপ লাগে না।
‘তােমার সবই ভাল বুঝলে ডাক্তার, তবে তােমার একটা বড় সমস্যা কি জান? তােমার কোন উচ্চাশা নেই।
‘সেটা সমস্যা হবে কেন?
এইটাই সবচে বড় সমস্যা। দু‘ ধরনের মানুষের উচ্চাশা থাকে না, মহাপুরুষদের এবং বেকুবদের। তুমি এই দু’দলের কোন দলে সেটা বুঝতে পারছি না। সম্ভবত দ্বিতীয় দলে!‘
‘আমাকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই।
দরকার থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। এ রকম ইয়াং একজন ছেলে–গােল্ড মেড়ালি, অথচ তার কোন উচ্চাশা নেই।
গােল্ড মেডেলের কথা আবার বলছেন।‘ ঐ একই হল। পেতেও তো পারতে। আমি যা বলছি তার সারমর্ম হচ্ছে–সুযোগ খুঁজতে হবে। বিলেত আমেরিকা যেতে হবে, এফ আর সি এস, এম আর সি পি হয়ে এসে রুগীদের গলা কেটে পয়সা করতে হবে।