মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছেন?
মেয়েটির চোখে অপরিচিতের দৃষ্টি। লজ্জায় এবং দুঃখে মনসুরের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। আর তখন মেয়েটি বলল, ‘ও আচ্ছা আপনি গ্রীণ ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেব। জ্বি আমি ভাল।
মনসুর হড়বড় করে বলল, আপনার মায়ের সেই কাটাটা কি সেরেছে?
মেয়েটি এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর আর কোন কথা না বলে রিকশায় উঠে গেল। রাগে এবং লজ্জায় মনসুরের ইচ্ছা করল লাইট পােষ্টে নিজের মাথা সজোরে ঠুকে দেয়। কেন সে বােকার মত তার মা’র হাত কাটার কথা জিজ্ঞেস করল? মেয়েটি নিশ্চয়ই তার বােকামী নিয়ে মনে মনে হাসছে। কে জানে বাড়িতে গিয়ে তার মাকেও হয়ত বলবে। কি লজ্জা! কি লজ্জা।
কুন্দুস সাহেব বললেন, তােমার কি হয়েছে মনসুর বল তাে। ‘কিছু হয়নি। ‘কিছু হয়নি বললে তাে আমি বিশ্বাস করব না। কিছু একটা হয়েছে তাে বটেই–রাতে ঘুম
হয়?
‘ঘুমের একটু অসুবিধা হচ্ছে? ‘বদ হজমও হচ্ছে তাই না? ‘জ্বি।
মনে হচ্ছে পৃথিবীটা খুব খারাপ জায়গ–ঠিক না? ‘জ্বি।
‘সবই খুব পরিচিত লক্ষণ। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন আমার মধ্যে এইসব লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল। এটা একটা জীবাণু ঘটিত অসুখ।
‘মনসুর অবাক হয়ে বলল, জীবাণু ঘটিত অসুখ?
‘হ্যাঁ জীবানূ ঘটিত। এইসব জীবাণুর উৎপত্তি হয় কোন এক সুন্দরী তরুণীর চোখে। জীবাণুর নাম হচ্ছে প্রেম–জীবাণু। ইংরেজীতে বলে Love bus, ঠাট্টা করছি না ভাই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। জীবাণুর প্রথম আক্রমণে নার্ভাস সিস্টেম উইক হয়ে যায়। তারপর লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বহুব্রীহি পর্ব ( ৪)- হুমায়ূন আহমেদ
কি যে বলেন। ‘সত্যি কথা বলছি রে ভাই। খুবই সত্যি কথা–এখন বল মেয়েটা কে? ‘কেউ না।” ‘সােবাহান সাহেবের মেয়ে মিলিনাতাে?
মনসুরের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। কুদ্স সাহেব বললেন, আগেই সন্দেহ হয়েছিল এখন তােমাকে দেখে পুরােপুরি নিশ্চিত হলাম। তােমার অবস্থাতাে দেখি কাহিল।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা না। ‘আমি কিছুই ভাবছি না। ভাবাভাবির ফাঁক তুমি রাখনি। এখন আমার উপদেশ শােন, সহজ পাচ্য খাবার খাবে। বেশী করে ডাবের পানি খাবে। সকাল বিকাল লাইট একসারসাইজ। প্রেম জীবাণু ঘটিত অসুখের কোন চিকিৎসা নেই। জীবাণুগুলি ভাইরাস টাইপ, কোন ওষুধেই কাজ করে না। সময়ে রােগ সারে। টাইম ইজ দ্যা বেস্ট হিলার। সতীনাথের বিরহের গানগুলি শুনতে পার। এতেও অনেক সময় আরাম হয়–ঐ যে আমি এধারে তুমি ওধারে, মাঝে নদী কুলকুল বয়ে যায় টাইপ গান।।
ঠাট্টা করবেন না কুদ্স ভাই। ঠাট্টা তামাশা ভাল লাগে না।
ঠিক বলেছ, এই সময় ঠাট্টাটা অসহ্য লাগে। কেউ ঠাট্টা করলে ইচ্ছা করে টান দিয়ে জিভ ছিড়ে ফেলি। রােগের কঠিন সংক্রমনের সময় এটা হয়। অল্পতেই নার্ভ ইরিটেটেড হয়।
মনসুর ক্ষীণ স্বরে বলল, আমাকে কি করতে বলেন?
‘কিছুই করতে বলি না। মিলি অল্প বয়েসী মেয়ে হলে চিঠি লিখতে বলতাম–এরা সেই স্টেজ পার হয়ে এসেছে। চিঠি লিখলে সবাইকে সেই চিঠি পড়ে শুনাবে এবং হাসাহাসি করবে। তুমি যদি আগবাড়িয়ে কথা বলতে চাও, তােমাকে ভাববে ভ্যাবলা। এক মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া তাে আমি আর কোন পথ দেখি না। যাকে বলে আধ্যাত্মিক চেষ্টা। মাঝে মাঝে এই চেষ্টায় কাজ হয়। দৈব সহায় হয়।
বহুব্রীহি পর্ব ( ৪)- হুমায়ূন আহমেদ
হঠাৎ হয়ত দেখবে মেয়েটা রিকসা এ্যাকসিডেন্ট করেছে। ধরাধরি করে তাকে এইখানে আনা হল। তুমি ফাষ্ট এইড দিলে। দেখা গেল অবস্থা সুবিধার না। তুমিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। মেয়েটাকে ব্লড দিতে হবে। ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। দেখা গেল তােমারও তাই। তুমি ব্লড দিলে। মেয়েটি করুণ গলায় বললে, আপনি আমার জন্যে অনেক করলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তুমি গাঢ় গলায় বললে, ধন্যবাদ পরে হবে আগে সুস্থ হয়ে উঠ।
মনসুর বলল, চুপ করুনতাে কুদুস সাহেব, আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে না।
কুদ্স সাহেব বললেন, সেটা তােমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। করব কি বল, কথা বলা হয়ে গেছে অভ্যাস। তােমার অবস্থা দেখে খারাপও লাগছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। তাতে যদি কিছু হয়।
কিছু হল না। প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বৈব কখনােই সহায় হয় না। গল্পে, সিনেমায় হয়। জীবনটা গল্প সিনেমা নয়। জীবনের নায়িকারা, নায়কদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলেও চিনতে পারে না। স্যাভলনের শিশি কিনতে একবারই ফার্মেসীতে আসে দ্বিতীয়বার আসে না। গল্পে উপন্যাসে নায়িকারা ঘন ঘন অসুখে পড়ে। ডাক্তার নায়ক তখন চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলে। বাস্তবের নায়িকাদের কখনাে কোন অসুখ হয় না, আর হলেও অন্য ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেন।
অবশ্যি মনসুরের বেলায় দ্বৈব সহায় হল। শরৎকালের এক সন্ধ্যায় তার ডাক পড়ল নিরিবিলিতে। সােবাহান সাহেবের প্রেসার মাপতে হবে। তাঁর প্রেসার হাই হয়েছে। মাথা ঘুরছে। ব্লাড প্রেসার নামক ব্যধিটির উপর কৃতজ্ঞতায় মনসুরের মন ভরে গেল। বারান্দায় মিলি দাড়িয়েছিল। এও এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য। বারান্দায় সে নাও থাকতে পারত। মিলির সঙ্গে দেখা না হলেও কিছু করার ছিল না। মিলির জন্যেতাে আর তাকে ডাকা হয়নি। মিলি বলল, স্নামালিকুম।
বহুব্রীহি পর্ব ( ৪)- হুমায়ূন আহমেদ
‘ওয়ালাইকুম সালাম।
‘আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
মনসুর হতভম্ব। বলে কি এই মেয়ে। এই কথাগুলি কি সত্যি সত্যি বলছে না মনসুর কল্পনা করছে? কল্পনা হাওয়াই সম্ভব। নিশ্চয়ই কল্পনা। হেলুসিনেশন।
‘আপনাকে বলেছে বােধ হয় বাবার ব্লাড প্রেসার মাপার জন্যে আপনাকে খবর দেয়া হয়েছে।
*জি বলেছে। ‘আপনার সঙ্গে একটা গােপন ষড়যন্ত্র করবার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ‘জ্বি বলুন। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
‘যদি দেখেন বাবার প্রেসার খুব হাই না তবু বলবেন হাই। বাবার রেষ্টের সরকার। ভয় না দেখালে তিনি রেষ্ট নেবেন না। আপনি মিথ্যা করে বলতে পারবেন না?
‘জ্বি না। মিলির দৃষ্টি তীব্র হল। মনসুর বলল, আমি মিথ্যা বলতে পারি না। ‘মিথ্যা বলতে পারেননা?
জ্বি না। ‘ও আচ্ছা, আমার জানা ছিল না। আপনাকে দেখে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই মনে হয়েছিল, যারা প্রয়ােজনে কিছু মিথ্যা টিথ্যাও বলতে পারে। আপনি যে অসাধারণ তা বুঝতে পারি নি।
‘আপনি কি রাগ করলেন?
কথায় কথায় রাগ করা আমার স্বভাব না। আসুন, দোতলায় যেতে হবে। বাবা দোতলায়। সিড়ি ভেঙ্গে দোতলায় ওঠার পর মনসুর নাভাস ভঙ্গিতে বলল, একটা ভুল হয়ে গেছে।
বহুব্রীহি পর্ব ( ৪)- হুমায়ূন আহমেদ
কি ভুল? ‘প্রেসার মাপার যন্ত্র ফেলে এসেছি।‘
সেকি, প্রেসার মাপার জন্যেইতাে আপনাকে ডাকা হয়েছে–সেই জিনিসই আপনি ফেলে এসেছেন? আপনি মানুষ হিসেবে শুধু যে অসাধারণ তাই না, মনে হচ্ছে খুব ভুলাে মন।”
‘আমি এক দৌড়ে নিয়ে আসব। যাব আর আসব। ‘আপনাকে যেতে হবে না। আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি, ও নিয়ে আসবে।‘
না না আমিই যাই। এক মিনিট। মনসুর অতি দ্রুত সিড়ি টপকাচ্ছে। সেই দ্রুত সিড়ি ভাঙ্গা দেখে মিলির মনে হল–একটা একসিডেন্ট হতে যাচ্ছে, হবেই হবে। না হয়েই যায় না। আর তখনি হুড়মুড় শব্দ হল।