ডাক্তার সাহেব মাঝ সিড়ি থেকে বলের মত গড়িয়ে নীচে নামতে লাগলেন। শব্দ শুনে সােবাহান সাহেব এবং মিনু বেরিয়ে এলেন, ফরিদ বেরিয়ে এল, বাসার কাজের ছেলে কাদের ছুটে এল।
সােবাহান সাহেব বললেন, এ কে? মিলি বলল, ডাক্তার সাহেব। তােমার প্রেসার মাপতে এসেছেন। ‘প্রেসার মাপতে এসে মাটিতে শুয়ে থাকার কারণ কি? ‘পা পিছলে পড়ে গেছেন বাবা। ‘পা পিছলে পড়েছে টেনে তুলবি না? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
মিলিকে টেনে তুলতে হল না, মনসুর নিজেই উঠল। সার্টের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, একদম ব্যথা পাইনি। সত্যি বলছি।
তার চারপাশের লােকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। সােবাহান সাহেব কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না। মনসুর বলল, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাব! সোবাহান সাহেব বললেন,
অবশ্যই খাবে। মিলি একে নিয়ে ফ্যানের নীচে বসা। কাদের এগিয়ে এসে বলল, আমারে ধইরা ধইরা হাঁটেন ডাক্তার সাব। চিন্তার কিছুনাই, উপরে আল্লা নীচে মাড়ি।। | নীচে মাটি এমন কোন লক্ষণ মনসুর পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে চোরাবালির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পা ডেবে ডেবে যাচ্ছে। ঘরটাও মনে হচ্ছে একটু একটু দুলছে। কে যেন বলল, ‘বাবা তুমি এখানে বস।
বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ
কে বলল কথাটা? ঐ মহিলা না? ইনি বােধ হয় মিলির মা। তাকে কি সালাম দেয়া হয়েছে? স্নামালিকুম বলা দরকার না? দেরী হয়ে গেছে বােধ হয়। দেরী হলেও বলা দরকার।
‘নিন পানি নিন।।
মনসুর পানি নিল। নিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলল, স্নামালিকুম। বলেই বুঝল ভুল হয়ে গেছে। কথা এমন জিনিস একবার বলা হয়ে গেলে ফিরিয়ে নেয়া যায় না। মনসুর লক্ষ্য করল তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লােকজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। সে নিশ্চয়ই খুব উল্টা পাল্টা কিছু বলেছে। টেনশনের সময় তার মাথা এলােমেলাে হয়ে যায়। মনসুর অবস্থা স্বাভাবিক করবার জন্যে শব্দ করে হাসল। অবস্থা স্বাভাবিক হল না মনে হল আরাে খারাপ হয়ে গেল।
ফরিদ বলল, ছােকরার মনে হয় ব্রেইণ ডিফেক্ট হয়ে গেছে। কেমন করে হাসছে দেখুন না দুলাভাই। অবিকল পাগলের হাসি। সােবাহান সাহেব বললেন, একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার।
ফরিদ বলল, ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেতাে মনে হচ্ছে না। আমার ধারণা ব্রেইণ হেমারেজ। হােয়াট এ পিটি, এ রকম ইয়াং এজ।
আনিস অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ভয়ংকর একটা রাগের ভঙ্গি করতে। যা দেখে তার আট বছরের ছেলে টগর আঁৎকে উঠবে এবং মুখ কাচুমাচু করে বলবে, আর করব না বাবা। টগর ফা করেছে তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠে না। সে ফায়ার ব্রিগেড খেলা খেলছিল। আগুন ছাড়া এরকম খেলা হয় না, কাজেই অনেক কষ্টে সে বিছানার চাদরে আগুণ ধরাল। তাকে সাহায্য করেছিল তার ছােট বােন নিশা যার বয়স পাঁচ হলেও এই জাতীয় কাজ খুব ভাল পারে।
বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ
খেলার দুটি অংশ, প্রথম অংশে বিছানার চাদর এবং জানালার পর্দায় আগুন লেগে যাবে, নিশা তার খেলনা টেলিফোন কানে নিয়ে বলবে, হলাে, আমাদের বাসায় আগুন লেগে গেছে। তখন শুরু হবে খেলার দ্বিতীয় অংশ–টগর সাজবে ফায়ার ম্যান। বাথরুম থেকে নল দিয়ে সে পানি এনে চারদিকে হিটিয়ে স্যাল নেভাবে। বেশ মজার খেলা।
খেলার প্রথম অংশ ভালমত শুরু হবার আগেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। তিন তলার ভাড়াটে ছুটে এলেন। একতলা থেকে বাড়িওয়ালা এলেন এবং ঘন ঘন বলতে লাগলেন, কি
সর্বনাশ! কি সর্বনাশ!
আনিস গিয়েছিল বাড়ির খোঁজে। বাড়িওয়ালা নােটিশ দিয়েছে। গত মাসেই বাড়ি ছাড়ার কথা। এখনাে কিছু পাওয়া যায়নি বলে বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না। বাড়িওয়ালার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এবার তিনি আর মুখের কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। পাড়ার ছেলেপুলে দিয়ে তুলে দেবেন। গত সপ্তাহে খুব ভদ্র ভাষায় এ জাতীয় ইংগীত দেয়া হয়েছে।
সারাদিন বাড়ি খুঁজে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে টগর এবং নিশার নতুন কীর্তি শােনার পর মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। আনিসের মেজাজ যথেষ্টই খারাপ, কিন্তু তা সে ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। টগরের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়া খুবই প্রয়ােজন, হাত উঠছে না। বাচ্চা দুটির মা এক বছর আগে মারা গেছে। মা নেই দু’টি শিশুর উপর রাগ করা কিংবা তাদের শাসন করা বেশ কঠিন ব্যাপার। আনিসের বেলায় তা আরাে কঠিন কারণ রাগ তার স্বভাবে নেই। সে এক দৃষ্টিতে টগরের দিকে তাকিয়ে আছে। টগর খানিকটা অস্বস্তি বােধ করছে তবে খুব ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে না।
বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ
টগর। জি বাবা। টগর যা করে নিশার ঠিক সেই জিনিসটিই করা চাই, কাজেই সেও বলল, জ্বি বাবা।
আনিস বলল, নিশা মা, তুমি এখন কোন কথা বলবে না। টগরের সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছে। ওকে আমি যা বলব তা খুব মন দিয়ে শুনবে।
টগর। ‘জি বাবা। ‘ঘরে আগুন লাগিয়েছিলে?” ‘নাতাে–বিছানার চাদরে লাগিয়েছিলাম। আর নিশাকে বলেছিলাম জানালার পর্দায় লাগাতে। ‘কি জন্যে? ‘আমরা ফায়ার সার্ভিস ফায়ার সার্ভিস খেলছিলাম! “খেলতে আগুন লাগে? ‘অন্য খেলায় লাগে না। ফায়ার সার্ভিস খেলায় লাগে। আগুন না লাগলে নেভাব কি করে? ‘আমি খুব রাগ করেছি টগর। এত রাগ করেছি যে আমার গা কাপছে রাগে। ‘কই বাবা, গা তে কাঁপছে না।
“তােমরা দু‘জন খুবই অবাধ্য হয়েছ। আমার কোন কথা তোমরা শােন না। রােজ অন্তত ‘অদ্ভুত সব খেলা খেল। দু‘দিন আগে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়লে।
‘দোতলার ছাদ থেকে তাে লাফ দেই নি। গ্যারাজের উপর থেকে লাফ দিয়েছি। নীচে বালি ছিল। একটুও ব্যথা পাইনি। বালি না থাকলে লাফ দিল্লাম না।
‘তােমাদের কখনাে আমি কোন শাস্তি দেই না বলে এই অবস্থা হয়েছে। আজ তােমাদের শাস্তি দেব।‘
‘তুমি নিজেই ঠিক কর কি শাস্তি। আমি কিছু বলব না।
এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকব বাবা? ‘বেশ দাঁড়াও।
টগর এবং নিশা দু‘জনই উঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। দেখা গেল শাস্তি গ্রহণে দু’জনেরই সমান আগ্রহ। এই শাস্তিতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে বলেও মনে হল। মিটিমিটি হাসছে
‘টগর! ‘জ্বি বাবা!
একটা কথা তােমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে–কথাটা হচ্ছে–––
আনিস তার দীর্ঘ বাক্য শেষ করতে পারল না, বাড়িওয়ালার ভাগ্নে এসে বলল, আপনাকে মামা ডাকে। আনিস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বকবক করতে তার মােটেই ইচ্ছা করছে না। উপায় নেই, ইচ্ছা না করলেও বকবক করতে হবে।
বহুব্রীহি পর্ব (৫)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিসের বাড়িওয়ালার নাম মীজা সুলায়মান। ভাড়াটেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল। শুধু ভাল না, বেশ ভাল। সুলায়মান সাহেবের ব্যবহার অতি মধুর। হাসি হাসি মূখ না করে তিনি কোন কথা বলেন না। ভাড়াটেদের যখন ডেকে পাঠান তখন বসার ঘরের টেবিলে নানান ধরনের খাবার দাবার তৈরী থাকে। | আনিস বাড়িওয়ালার বসার ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলে ঠান্ডা পেপসির গ্লাস, প্লেটে ফুট কেক। সুলায়মান সাহেবের বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও তিনি তার সব ভাড়াটেদের ডাকেন–বড় ভাই। কেউ এই নিয়ে কিছু বললে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে আমার দস্তুর। আমার পিতাজীর কাছ থেকে শিখেছি। পিতাজী সবাইকেই বড় ভাই ডাকতেন।
সুলায়মান সাহেব তার দস্তুর মত আনিসকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বড় ভাই সাহেব আছেন কেমন?
‘জ্বি ভাল।‘