বহুব্রীহি পর্ব (৭)- হুমায়ূন আহমেদ

আনিস তার পিঠে চুলকে দিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, তাতেও কিছু হলাে নাউপর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেএকটু পর পর বলছেঘুম আসছে না বাবা

বহুব্রীহিএকেবারেই আসছে না

তাহলে আস নতুন ধরনের একটা খেলা দু’জনে মিলে খেলিকি খেলা

এই খেলাটার নাম হচ্ছে সত্যিমিথ্যা খেলাআমি তােমাকে প্রশ্ন করব তুমি মিথ্যা জবাব দেবেদশটা প্রশ্ন করবপ্রতি বারই যদি মিথ্যা জবাব দিতে পার তাহলে তুমি জিতে যাবেযেমন ধর আমি যদি জিজ্ঞেস করি, তােমার নাম কি? তুমি যদি বল টগরতাহলে তুমি হেরে যাবেসব জবাব হতে হবে মিথ্যা। 

এটাতাে খুব সহজ খেলা বাবামােটই সহজ নাখুব কঠিন খেলাকারণ মানুষ বেশিক্ষণ মিথ্যা কথা বলতে পারে নাপর পর দশটা মিথ্যা বলা মানুষের জন্যে খুব কঠিনবেশির ভাগ মানুষই পারে না। 

আমি পারব? না তুমিও পারবে নাএসাে শুরু করা যাকরেডিওয়ান টু থ্রীআচ্ছা থােকা তােমার নাম কি টগর

জ্বিনাআমার নাম টগর না। 

তােমার ছােট একটা বােন আছেনা ? জ্বি নাআমার একটা ভাই আছেতুমি কি ক্লাস থ্রিতে পড়? জ্বি না আমি ক্লাস টেনে পড়ি। 

তােমার কি তিনটা হাত আছে?হ্যা আমার তিনটা হাত আছে

তুমি কি তােমার মাকে খুব ভালবাস? হা বাসি। 

আনিস হেসে ফেললটগর মাথা নীচু করে ফেলেছেআনিস বলল, দেখলে তাে টগর, মাত্র পাঁচটা প্রশ্নেই তুমি সত্যি কথা বলে ফেললেকিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলা খুবই কঠিন। 

টগর চাপা গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলা কঠিন কেন বাবা? কঠিন, কারণ মানুষকে মিথ্যা কথা বলার জন্য তৈরী করা হয়নিতবু আমরা মিথ্যা কথাবলিযখন বলি তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়। 

আমার তাে কষ্ট হয় না বাবাতুমি কি মিথ্যা কথা বল? হা বলিস্কুলে বলি। 

আনিস উপদেশ মূলক কিছু বলবে কি বলবে না এই নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলশৈশবে নীতিকথার আসলে কি কোন গুরুত্ব আছে? একই পরিবারের চারটি ছেলেমেয়ে শৈশবে একই ধরনের নীতিকথা এবং উপদেশ শশানে কিন্তু বড় হয়ে চারজন চার রকমের হয়আনিসের ধারণা শিশুরা বইয়ের উপদেশ গ্রহণ করে নাএকটি শিশু অন্য একটি শিশুর কথা শুনে কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের কথা শুনে নাতাদের জগৎ ভিন্ন, তারা নিজেদের জগৎ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। 

টগরটগর জবাব দিল নাআনিস দেখল, টগর ঘুমিয়ে পড়েছেতার নিজের চোখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে কিন্তু সে জানে বিছানায় শােয়া মাত্র ঘুম চলে যাবেনানান উদ্ভট চিন্তা মাথায় ভর করবেতারপর আসবে সুখময় কিছু কল্পনাসেই কল্পনায় চব্বিশ বছর বয়েসী একজন তরুণী এসে ঘরে ঢুকবেপান খাওয়ায় সেই তরুণীর ঠেটি লাল হয়ে আছেতরুণীটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টলমলে চোখে স্নিগ্ধ ছায়া। 

আনিস বিরক্ত হবার মত ভঙ্গি করে বলবে, আবার পান খেয়েছ? তরুণীটি বলবে, হা খেয়েছিদাঁতগুলি নষ্ট করবে। 

করলে করবসারা দিনে একবার পান খাই তাতেই আচ্ছা যাও আর কিছু বলবনাতােমার কি চা লাগবে? ‘া 

ঘুমুতে যাবার আগে কেউ চা খায় এই প্রথম দেখলামঘুমুতে যাব তােমাকে কে বলল?ঘুমুবে না?নাে ম্যাডাম। সারা রাত জাগব। 

লেখালেখি? হ্যালেখালেখিনতুনউপন্যাস শুরুকরছিতুমি না বললে সােমবার থেকে শুরু করবেদুদিন আগেই শুরু করছি। 

উপন্যাসের নাম কি? ময়ুরাক্ষীনামটা কেমন? সত্যি জানতে চাও। 

বললে রাগ করবে নাতাে? নাএর মধ্যে রাগ করার কি আছে? নিউ এলিফেন্ট রােডের একটা জুতার দোকানের নাম ময়ুরাক্ষী। 

আনিস তাকিয়ে আছেতরুণী খিল খিল করে হাসছেহাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেলতবু সে হাসছেকি অসাধারণ একটি দৃশ্যএমন চমৎকার দৃশ্য তার জীবনে অভিনীত হয়েছে এই কথাটা আজ আর কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় নাআজ মনে হয় রাত্রি নামে কোন তরুণীর সঙ্গে তার কোনদিন পরিচয় ছিল নাসবই কল্পনা সবই মায়া। 

সােবাহান সাহেবের সামনে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে সােবাহান সাহেব তাকে চিনতে পারলেন 

মাঝারি গড়নের একজন যুবকগায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী, চোখে মােটা কাচের চশমামুখ ভর্তি দাড়ি গোফএই দাড়িশখের দাড়িযুবকটির চোখে মুখে কোন রকম জড়তা নেইমুখ হাসি হাসিগেট খুলে তরতর করে এগিয়ে এসেছেযেন বাড়ি ঘর খুব পরিচিতঅনেকবার এসেছে। 

স্লমালিকুমওয়ালাইকুম সালামআমার নাম আনিসআমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি? আমি কি আপনাকে চিনি?” 

জ্বি নাঅচেনা লােকের সঙ্গে কি আপনি কথা বলেন না

সােবাহান সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলএই যুবকের মতলব ঠিক বােঝা যাচ্ছে নাদেশ ভর্তি হয়ে গেছে মতলববাজ যুবকেএদের কোন রকম প্রশ্রয় দেয়া উচিত না। 

স্যার, আমি কি বসব? দীর্ঘ আলাপ থাকলে বসুনআর সংক্ষিপ্ত কোন কিছু বলার থাকলে বলে চলে যান। 

আনিস বসলতার কাঁধে একটা ভারী হ্যান্ড ব্যাগ ঝুলছিল, সেই হ্যান্ডব্যাগ খুলে কোলের উপর রাখলসােবাহান সাহেব অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে হ্যান্ডব্যাগের দিকে তাকাতে লাগলেনতাঁর মন বলছে ছােকরার আসার উদ্দেশ্য এই হ্যান্ডব্যাগেই আছেকিছু একটা গছাতে এসেছেসম্ভবত ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর লােকপটিয়ে পটিয়ে ইনস্যুরেন্স করিয়ে ফেলবে। 

সােবাহান সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, বলুন কি ব্যাপারসংক্ষেপে বলবেনলম্বা কথা শােনার সময় বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই। 

আপনার বাড়ির দোতলার ছাদে দুটা ঘর আছেঘর দুটা কি আপনি ভাড়া দেবেন? ছাদের ঘর ভাড়া দেয়া হবে এই রকম কোন বিজ্ঞাপন কি আপনার চোখে পড়েছে? জ্বি নাতাহলে

আমি এই এলাকায় বাড়ি খুঁজছিলামতখন একজন বলল, এক সময় তেতলার দুটি ঘর আপনি ভাড়া দিতেন। 

এক সময় দিতাম বলে সারা জীবন দিতে হবে?তানাআপনি রাগহেন কেন? জোর করে নিশ্চয়ই আমি আপনার বাড়িতে উঠব নাআপনি কি করেন? কিছু করি নাকিছু করি না মানে? কিছু না করলে সংসার চলে কি ভাবে? আমি একজন লেখকলেখালেখি করি” 

কি নাম? আগে একবার বলেছিলামদ্বিতীয়বার বলতে অসুবিধা আছে? না নেইআমার নাম আনিস। 

এই নামে কোন লেখক আছে বলেতাে জানি নাআমি ছদ্মনামে লিখিছদ্মনামটা কি

আপনাকে বলতে চাচ্ছি নাছদ্মনাম গ্রহণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে নিজেকে আড়াল করাযদি বলেই ফেলি তাহলে শুধু শুধু আর ছদ্মনাম নিলাম কেন?‘ 

তুমি কি লেখ ? আনিস লক্ষ্য করল এই ভদ্রলােক হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন এবং নিজে তা বুঝতে পারছেন না। 

এইটি ভাল লক্ষণআনিস বলল, গল্প, উপন্যাস এইসব লিখি

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *