তােমার আই কিউ বুঝি আইনস্টাইনের মত? ‘আমি কারাে সঙ্গে তুলনায় যেতে চাচ্ছি না তবে বুদ্ধি বৃত্তির ক্ষেত্রে ১০০র ভেতর আমাকে ৯৩ থেকে ৯৫ দিতে পারিস।
তাই নাকি? ‘হ্যাঁ। আর তাের বুদ্ধি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬২র মধ্যে। আর একই স্কেলে দুলাভাইয়ের বুদ্ধি ১৮ থেকে ২২র মধ্যে উঠানামা করে।
তােমার তাই ধারণা?
‘হ্যাঁ এবং আমি আমার ধারণার কথা বলতে কোন রকম দ্বিধা বোধ করি না। কারণ সত্য হচ্ছে আগুণের মত। আগুণ চাপা দেবার কোন উপায় নেই। আমি বুঝতে পারছি দুলাভাইয়ের বুদ্ধি কম বলায় তুই আহত হয়েছিল, কিন্তু উপায় কি যা সত্যি তা বলতেই হবে। আমার মুখ হয়তবা তুই বন্ধ করতে পারবি, কিন্তু পাবলিকের মুখ তুই কি করে বন্ধ করবি? পাবলিক এক সময় সত্যি কথা বলবেই।
বকবকানি থামাও তাে মামা। “থামাচ্ছি। কিন্তু প্রসঙ্গটা যখন উঠলই তখন এই বাড়িতে আমার পরই কার আই কিউ বেশি সেটা জানা থাকা ভাল। আমার পরই আছে কাদের। অসাধারণ ব্রেইন।
চুপ করতাে মামা। অসাধারণ ব্রেইন হল কাদেরের! ‘প্রপার এডুকেশন পেলে এই ছেলে ফাটাফাটি করে ফেলত। ‘তুমিতাে প্রপার এডুকেশন পেয়েছ। তুমি কি করেছ?
করব। সময়তাে পার হয়ে যায় নি। দেখবি দেশ জুড়ে একটা হুলুস্থুল পড়ে যাবে। তােদের এই বাড়ি বিখ্যাত হয়ে যাবে। লােকজন এসে বলবে– এটা একটা বিখ্যাত বাড়ি। তােদের বই লিখতে হবে–মামাকে যেমন দেখেছি কিংবা কাছের মানুষ ফরিদ মামা––।
বহুব্রীহি পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ
‘কিছু মনে করাে না, আমার ধারণা তোমার আই কিউ খুবই কম।
ফরিদ উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল। তার সম্পর্কে অন্যদের ধারণা তাকে খুব মজা দেয়। এটা হচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিভাবান ব্যক্তিদের সাধারণট্র্যাজেডি। প্রিয়জনরা তাদের বুঝতে পারে
। আড়ালে হয়তবা হাসাহাসিও করে। করুক। তাদের হাসাহাসিতে কিছু যায় আসে না। | কাদের এসে ঢুকল। গভীর মুখে ঘােষণা করল, নতুন ভাড়াটে চলে এসেছে। সে মুখ কুঁচকে বলল, এক মালগাড়িতে বেবাক জিনিস উপস্থিত। ফকিরী পার্টি।
বলেই সে আবার বারান্দায় চলে গেল। নতুন ভাড়াটের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা দরকার। ফুলের গাছ টাছ না ভেঙ্গে ফেলে। এই বাড়িতে তার অবস্থান সম্পর্কেও জানিয়ে দেয়া দরকার। ভাড়াটে যদি তাকে সামান্য একজন কাজের মানুষ মনে করে তাহলে মুশকিল। প্রথম দর্শনে মনে করে ফেললে সারাজীবনই মনে রাখবে। যখন তখন ডেকে বলবে, এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাওতাে, চিঠিটা পােষ্ট করে দাওতাে, এক দৌড়ে খবরের কাগজটা এনে দাও।
আনিস রিক্সা করে এসেছে। টগর এবং নিশা দুজনেই গভীর ঘুমে। মিলিদের বসার ঘরের দরজা খােলা। আনিস বাচ্চা দুটিকে বসার ঘরের সােফায় শুইয়ে আবার বাইরে এসে দাঁড়াল। কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল, কাদের তুমি স্যুটকেস দু’টা উপরে দিয়ে আসতাে।
কাদের তৎক্ষণাৎ বলল, কুলীর কাম আমি করি না ভাইজান। সৈয়দ বংশ। ‘বখশীস পাবে। ‘এই বংশের লােক বখশীসের লােভে কিছু করে না ভাইজান। আমরা হইলাম আসল সৈয়দ। বােগদাদী সৈয়দ।
বহুব্রীহি পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিস নিজেই জিনিষপত্র টানাটানি করে তুলতে লাগল। ঠেলাগাড়ির লােক দুটি উপরে। কিছু তুলবে না। দোতলার ছাদে তােলা হবে এই কথা তাদের বলা হয়নি। এখন যদি তুলতে হয় পঞ্চাশ টাকা বাড়তি দিতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আনিসের হাতে এই মুহূর্তে পঞ্চাশটা টাকাও নেই। এ বাড়িতে সে কপর্দকশূন্য অবস্থাতেই এসে উঠেছে। | মিলি কি করতে জানি বসার ঘরে ঢুকেছিল। সােফাতে দু’টি শিশুকে শুয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এল। আহ্ কি মায়া কাড়া চেহারা। দুটি দেবশিশু যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। মেয়েটির মাথাভর্তি রেশমী চুল। চোখের তুরুগুলি যেন কোন চৈনিক শিল্পী সূক্ষ তুলী দিয়ে এঁকেছে। কমলার কোয়ার মত পাতলা ঠোঁট বার বার কেপে উঠছে। বাচ্চাটিকে কোলে নেবার এমন ইচ্ছা হচ্ছে যে মিলির রীতিমত লজ্জা লাগছে। মিলি দোতলার ছাদে উঠে গেল। আনিস খাটের ভারী একটা অংশ টেনে টেনে তুলছে।
মিলি বলল, আপনি এত কষ্ট করছেন কেন? আপনার ঠেলাগাড়ির লােকজন কোথায় ? ‘ওরা চলে গেছে। ‘দাঁড়ান আমি কাদেরকে পাঠাচ্ছি।
না থাক। বেচারা সৈয়দ বংশের মানুষ কুলীর কাজ করবে না। আমার অসুবিধা হচ্ছে না। তুলে ফেলেছি। তাইতাে দেখছি। আপনার স্ত্রী কোথায়? ও আসে নি। ‘আসে নি মানে?” মা‘কে ছাড়াই বাচ্চা দু’টি চলে এসেছে? উনাকে কবে আনবেন ? ‘তাকে আনা সম্ভব হবে না। সে আসবে না। আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।” ‘ও মারা গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় মিলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এত বড় একটা খবর তার হজম করতে সময় লাগল। মিলি বলল, বাচ্চা দুটির মা নেই শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। এটা নিয়ে আপনি রহস্য করবেন তা ভাবিনি। আপনি হয়ত খুব রসিক মানুষ, সব কিছু নিয়ে রসিকতা করা হয়ত আপনার অভ্যাস কিন্তু এটা অন্যায়।
বহুব্রীহি পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ
আনিস বলল, ঠিক এই ভাবে কিছু বলিনি। ওর মৃত্যুর কথা সরাসরি বলতে খারাপ লাগে বলেই অন্য পথে বলতে চেষ্টা করি।
‘আর করবেন না। “আচ্ছা আর করব না।
আনিস মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করল মিলি নামের এই মেয়েটি তার ঘর গুছিয়ে দিল। মশারি খাটিয়ে দিল, টগর এবং নিশাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেয়েরা প্রাকৃতিক নিয়মেই মমতাময়ী, কিন্তু এই মেয়েটির মধ্যে মমতার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি।
আনিস বলল, আপনাকে অনেক যন্ত্রণার মধ্যে ফেললাম। তা ঠিক। কাল সকালেই আমার টিউটোরিয়াল। কিছুই করা হয় নি।
আপনি আমার জন্যে অনেক কষ্ট করেছেন কাজেই আমি আপনার ক্ষুদ্র একটা উপকার করতে চাই। এ গুড টার্ণ ফর এ গুড টার্ণ), মিলি বিস্মিত হয়ে বলল, কি উপকার করতে চান?
একটা উপদেশ দিতে চাই যা আপনার খুব কাজে আসবে। উপদেশটা হচ্ছে আমার বাচ্চা দু’টিকে একেবারেই পাত্তা দেবেন না।
সে কি! | ‘ওদের একজনই আপনাকে পাগল করে দেবার জন্যে যথেষ্ট। দুজন মিলে কি করবে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও আপনার নেই। কাজেই সাবধান। | মিলি হাসল। আনিস বলল, আপনার হাসি দেখেই বুঝতে পারছি আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা। সাবধান করে দেবার দরকার ছিল করে দিয়েছি।
বহুব্রীহি পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ
| সােবাহান সাহেবকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন রাত ঠিক দশটায় বিছানায় চলে যেতে। রাত জাগা পুরােপুরি বারণ। ডাক্তারের উপদেশ মত কিছুদিন তাই করলেন। দেখা গেল রাত দশটার দিকে ঘুমুতে গেলে ঘুম আসে দেড়টা দু‘টার দিকে অথচ বারটার দিকে ঘুমুতে গেলে দশ পনেরাে মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসে। কিছুদিন হল তিনি তার নিজস্ব নিয়ম চালু করেছেন রাত বারােটায় ঘুমুতে যান। তবে তিনি জানেন না যে শােবার ঘরের ঘড়ি এক ফাঁকে মিলি
এসে এক ঘন্টা আগিয়ে রাখে। | শােবার ঘরের ঘড়িতে এখন বারােটা বাজছে। যদিও আসল সময় রাত এগারােটা। মিনু ঘরে ঢুকলেন। হাতে বরফ শীতল এক গ্লাস পানি। বিছানায় যাবার আগে সােবাহান সাহেব ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খান। মিনু পানির গ্লাস টেবিলের পাশে রাখতে রাখতে বললেন, ঘুমুবে না ?
সােবাহান সাহেব বললেন, একটু দেরী হবে মিনু। তুমি শুয়ে পড়।
দেরী হবে কেন? একটা বিষয় নিয়ে ভাবছি।