বিন্দুর ছেলে-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিন্দুর ছেলে-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

এক

যাদব মুখুয্যে ও মাধব মুখুয্যে যে সহোদর ছিলেন না, সে কথা নিজেরা ত ভুলিয়াই ছিলেন, বাহিরের লোকও ভুলিয়াছিল। দরিদ্র যাদব অনেক কষ্টে ছোটভাই মাধবকে আইন পাশ করাইয়াছিলেন এবং বহু চেষ্টায় ধনাঢ্য জমিদারের একমাএ সন্তান বিন্দুবাসিনীকে ভ্রাতৃবধূরূপে ঘরে আনিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। বিন্দুবাসিনী অসামান্যা রূপসী। প্রথম যেদিন সে এই অতুল রূপ ও দশ সহস্র টাকার কাগজ লইয়া ঘর করিতে আসিয়াছিল, সেদিন বড়বৌ অন্নপূর্ণার চোখে আনন্দাশ্রু বহিয়াছিল। বাড়িতে শাশুড়ী-ননদ ছিল না, তিনিই ছিলেন গৃহিণী। ছোটবধূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া প্রতিবাসিনীদের কাছে সগর্বে বলিয়াছিলেন, ঘরে বৌ আনতে হয় ত এমনি।
একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা। কিন্তু দু’দিনেই তাঁহার এ ভুল ভাঙ্গিল। দু’দিনেই টের পাইলেন, ছোটবৌ যে ওজনে রূপ ও টাকা আনিয়াছে, তাহার চতুর্গুণ অহঙ্কার-অভিমানও সঙ্গে আনিয়াছে।

একদিন বড়বৌ স্বামীকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, হাঁ গা, রূপ আর টাকার পুঁটুলি দেখে ঘরে বৌ আনলে, কিন্তু এ যে কেউটে সাপ!

যাদব কথাটা বিশ্বাস করিলেন না। মাথা চুলকাইয়া বার-দুই ‘তাই ত’, ‘তাই ত’, করিয়া কাছারি চলিয়া গেলেন।

যাদব অতিশয় শান্ত-প্রকৃতির লোক। জমিদারী সেরেস্তায় নায়েবি এবং ঘরে আসিয়া পূজা-অর্চনা করিতেন। মাধব দাদার চেয়ে দশ-বারো বছরের ছোট, উকিল হইয়া সম্প্রতি ব্যবসা শুরু করিয়াছিল।

সে আসিয়া কহিল, বৌঠান, টাকাটাই কি দাদার বেশী হ’ল? দুদিন সবুর করলে আমিও ত রোজগার করে দিতে পারতাম। অন্নপূর্ণা চুপ করিয়া রহিলেন।

এ ছাড়া আরও একটা বিপদ এই হইয়াছিল, ছোটবৌকে শাসন করিবার জো ছিল না। তাহার এমনি ভয়ঙ্কর ফিটের ব্যামো ছিল যে, সেদিকে চাহিয়া দেখিলেও বাড়িসুদ্ধ লোকের মাথা ঝিমঝিম করিতে থাকিত এবং ডাক্তার না ডাকিলে আর উপায় হইত না। সুতরাং সাধের বিবাহটা যে ভুল হইয়া গিয়াছে, এই ধারণাই সকলের মনে বদ্ধমূল হইয়া গেল। শুধু যাদব হাল ছাড়িলেন না। তিনি সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া ক্রমাগত বলিতে লাগিলেন, না গো না, তোমরা পরে দেখো। মায়ের আমার অমন জগদ্ধাত্রীর মত রূপ, সে কি একেবারে নিষ্ফল যাবে? এ হতেই পারে না।

একদিন কি একটা কথার পরে ছোটবৌ মুখ অন্ধকার করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছে দেখিয়া ভয়ে অন্নপূর্ণার প্রাণ উড়িয়া গেল। হঠাৎ তাঁহার কি মনে হইল, ঘরের মধ্যে ছুটিয়া গিয়া তাঁহার দেড়-বছরের ঘুমন্ত ছেলে অমূল্যচরণকে টানিয়া আনিয়া বিন্দুর কোলের উপর নিক্ষেপ করিয়াই তিনি পলাইয়া গেলেন।

অমূল্য কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল।

বিন্দু প্রাণপণ-বলে নিজেকে সংবরণ করিয়া মূর্ছার কবল হইতে আত্মরক্ষা করিয়া ছেলে বুকে করিয়া ঘরে চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণা আড়ালে দাঁড়াইয়া তাহা দেখিলেন এবং ফিটের ব্যামোর এই অমোঘ দৈব-ঔষধ আবিষ্কার করিয়া পুলকিত হইলেন।

সংসারের সমস্ত ভার অন্নপূর্ণার মাথায় ছিল বলিয়া তিনি ছেলে মানুষ করিতে পারিতেন না। বিশেষ, সমস্তদিনের কাজকর্মের পর রাত্রে ঘুমাইতে না পাইলে তাঁহার বড় অসুখ করিত; তাই এই ভারটা ছোটবৌ লইয়াছিল।

মাসখানেক পরে একদিন সকালবেলা সে ছেলে কোলে লইয়া রান্নাঘরে ঢুকিয়া বলিল, দিদি, অমূল্যধনের দুধ কৈ?

অন্নপূর্ণা তাড়াতাড়ি হাতের কাজটা ফেলিয়া রাখিয়া ভয়ে ভয়ে বলিলেন, এক মিনিট সবুর কর বোন, এখনি জ্বাল দিয়ে দিচ্চি।

বিন্দু ঘরে ঢুকিয়াই তাহা দেখিয়া রাগিয়া গিয়াছিল, তীক্ষ্ণকন্ঠে বলিল, কালও তোমাকে বলেছি, আমার আটটার আগে দুধ চাই, তা সে ত নটা বাজে! কাজটা তোমার যদি এতই ভারী ঠেকে দিদি, পষ্ট করে বললেই ত পার, আমি অন্য উপায় দেখি। হাঁ বামুনমেয়ে, তোমারও কি একটু হুঁশ থাকতে নেই গা, বাড়িসুদ্ধ লোকের পিণ্ডি-রান্না না হয় দু’মিনিট পরে হ’ত।

বামুনঠাকরুন চুপ করিয়া রহিলেন।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, তোর মত শুধু ছেলেকে টিপ পরানো আর কাজল দেওয়া নিয়ে থাকলে আমাদেরও হুঁশ থাকত। এক মিনিট আর দেরি সয় না, ছোটবৌ?

ছোটবৌ তাহার উত্তরে বলিল, তোমার অতি বড় দিব্যি রইল, দিদি, যদি কোনদিন আর অমূল্যের দুধে হাত দাও; আমারও দিব্যি রইল, আর কোনদিন যদি তোমাকে বলি।

এই বলিয়া সে মেঝের উপর অমূল্যকে দুম্‌ করিয়া বসাইয়া দিয়া, দুধের কড়া তুলিয়া আনিয়া উনানের উপর চড়াইয়া দিল। এই অভাবনীয় ব্যাপারে অমূল্য চীৎকার করিয়া উঠিতেই, বিন্দু তাহার গাল টিপিয়া বলিল, চুপ কর হারামজাদা, চুপ কর, চেঁচালে একেবারে মেরে ফেলব। বিন্দুর ব্যাপারে বাড়ির দাসী কদম ছুটিয়া আসিয়া খোকাকে কোলে লইতে গেলে বিন্দু তাহাকে ধমকাইয়া উঠিল, দূর হ, সামনে থেকে দূর হ!

সে আর অগ্রসর হইতে পারিল না, ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

বিন্দু আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া রোরুদ্যমান শিশুকে কোলে তুলিয়া লইয়া দুধ জ্বাল দিতে লাগিল।

অন্নপূর্ণা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। খানিক পরে বিন্দু দুধ লইয়া চলিয়া গেলে তিনি পাচিকাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, শুনলে মেয়ে, ওর কথা? সেই যে একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলুম, অমূল্যকে তুই নে। ছোটবৌ সেই জোরে আজ আমাকেও দিব্যি দিয়ে গেল!

যাহা হউক, এমন করিয়া অন্নপূর্ণার ছেলে বিন্দুবাসিনীর কোলে মানুষ হইতে লাগিল এবং তাহার ফল হইল এই যে, অমূল্য খুড়ীকে মা এবং মাকে দিদি বলিতে শিখিল।

.

দুই

ইহার বছর-চারেক পরে যেদিন খুব ঘটা করিয়া অমূল্যের হাতেখড়ি হইয়া গেল, তাহার পরদিন সকালে অন্নপূর্ণা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বাহির হইতে বিন্দুবাসিনী ডাকিয়া কহিল, দিদি, অমূল্যধন প্রণাম করতে এসেচে, একবারটি বাইরে এস।

অন্নপূর্ণা বাহিরে আসিয়া অমূল্যের সাজগোজ দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন। তাহার চোখে কাজল, কপালে টিপ, গলায় সোনার হার, মাথার উপর ঝুঁটি করিয়া চুল বাঁধা, পরনে একখানি হলদে রঙের ছোপান কাপড়, একহাতে দড়ি-বাঁধা মাটির দোয়াত, বগলে ক্ষুদ্র একখানি মাদুর-জড়ানো গুটিকয়েক তালপাতা।

বিন্দু বলিল, দিদিকে প্রণাম কর ত বাবা!

অমূল্য জননীকে প্রণাম করিল।

তাহার পায়ে জুতা নাই, মোজা নাই, পরনে নানাবিধ বিলাতী পোশাক নাই—অন্নপূর্ণা এই অপরূপ সাজ দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, এতও তোর আসে ছোটবৌ! ছেলে বুঝি পড়তে যাচ্চে?

বিন্দু হাসিমুখে বলিল, হাঁ, গঙ্গাপণ্ডিতের পাঠশালে পাঠিয়ে দিচ্চি। আশীর্বাদ কর দিদি, আজকের দিন যেন ওর জীবনে সার্থক হয়।

চাকরের দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, ভৈরব, পণ্ডিতমশাইকে আমার নাম করে বিশেষ করে বলে দিস, ছেলেকে আমার যেন কেউ মারধর না করে।

দিদি, এই পাঁচটা টাকা ধর, বেশ করে একখানি সিদে সাজিয়ে টাকা-ক’টি দিয়ে কদমের হাতে পাঠশালে পাঠিয়ে দাও। বলিয়া সে গভীর স্নেহে চুমা খাইয়া ছেলেকে কোলে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণার দুই চোখে অশ্রু উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল; তিনি বামুনঠাকরুনকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, ছেলে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তবু পেটে ধরেনি—তা হলে না জানি ও কি করত!

পাচিকা কহিল, সেজন্যই ভগবান বোধ করি দিলেন না, আঠার-উনিশ বছর বয়স হ’ল—

কথাটা শেষ হইতে পাইল না। ছোটবৌ একা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, দিদি, বঠ্‌ঠাকুরকে বলে আমাদের বাড়ির সামনে একটা পাঠশালা করে দেওয়া যায় না? আমি সমস্ত খরচ দেব।

অন্নপূর্ণা হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, এখনো সে দু-পা যায়নি ছোটবৌ, এর মধ্যেই তোর মতলব ঘুরে গেল? না হয়, তুইও যা না পাঠশালে গিয়ে বসে থাকবি।

বিন্দু অপ্রতিভ হইয়া হাসিয়া বলিল, মতলব ঘোরেনি, দিদি। কিন্তু ভাবচি আড়ালে থাকা এক, আর চোখের সামনে এক। পোড়োরা সব দুষ্ট ছেলে, ওকে ছোটটি পেয়ে যদি মারধর করে।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, করলেই বা। ছেলেরা মারামারি করেই। তা ছাড়া সকলের ছেলেই সমান ছোটবৌ, তাদের বাপ-মা প্রাণ ধরে যদি পাঠশালে দিতে পেরে থাকে, তুই পারবি নে কেন?

পরের সঙ্গে তুলনা করাটা বিন্দু একেবারে পছন্দ করিত না। তাই বোধ করি মনে মনে অসন্তুষ্ট হইয়া বলিল—তোমার এক কথা দিদি! ধর, কেউ যদি ওর চোখে কলমের খোঁচাই দিয়ে দেয়—তা হলে?

অন্নপূর্ণা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া হাসিয়া বলিলেন, তা হলে ডাক্তার দেখাবি। কিন্তু সত্যি বলচি তোকে, আমি ত সাত দিন সাত রাত বসে ভাবলেও খোঁচাখুঁচির কথা মনে করতে পারতুম না। এত ছেলে পড়ে, কে কার চোখে কলমের খোঁচা দেয় তাও ত শুনিনি।

বিন্দু কহিল, তুমি শোননি বলেই কি এমন কান্ড হতে পারে না? দৈবাতের কথা কে বলতে পারে? আচ্ছা, বেশ ত তুমি একবার বলেই দেখ না, তারপর যা হয় হবে।

অন্নপূর্ণা গম্ভীর হইয়া বলিলেন, যা হবে, তা দেখতেই পাচ্ছি। তুই একবার যখন ধরেচিস তখন কি আর না করে ছাড়বি? কিন্তু আমি অমন অনাছিষ্টি কথা মুখে আনতে পারব না। আর তুইও ত কথা ক’স—নিজেই বল গে না।

এবার বিন্দু রাগ করিল, বলিল, বলবই ত। এত দূরে রোজ রোজ আমি ছেলে পাঠাতে পারব না—এতে কারুর ভাল লাগুক, আর না লাগুক, আর এতে ওর বিদ্যে হোক আর নাই হোক। হাঁ কদম, তোকে না বললুম সিদে দিয়ে আসতে? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে?

তাহার ক্রুদ্ধভাব লক্ষ্য করিয়া অন্নপূর্ণা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, সিদে দিচ্চি। একেবারে এত উতলা হোসনে ছোটবৌ! আচ্ছা, ছেলে কি তোর বড় হবে না? তুই কি চিরকাল তাকে আঁচল-চাপা দিয়ে রাখতে পারবি? এটা ভাবিস না কেন?

ছোটবৌ সে কথার জবাব না দিয়া বলিল, কদম, সিদে দিয়ে গুরুমশায়ের পায়ের ধূলো একটু তার মাথায় দিয়ে, ছেলে ফিরিয়ে আন গে। তাঁকেও একবার বিকেলবেলা আসতে বলিস।—যে বুঝবে না, তাকে আর বোঝাব কি করে? বলচি ছোটটি পেয়ে যদি কেউ মারধর করে,—না, চিরকাল কি তুই আঁচল-চাপা দিয়ে রাখতে পারবি? কি পারব, না পারব, সে পরামর্শ ত নিতে আসিনি।

বলিয়া সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

কদম বলিল, আর দাঁড়িয়ে থেকো না মা, হয়ত এখনি আবার এসে পড়বেন। উনি যা ধরেচেন, বিধাতা-পুরুষেরও সাধ্যি নেই যে তা রদ করেন।

সেইদিন সন্ধ্যার পর বড়কর্তা আফিং খাইয়া শয্যার উপর কাত হইয়া শুইয়া গুড়গুড়ির নল মুখে দিয়া নেশার পৃষ্ঠে চাবুক দিতেছিলেন, এমন সময় দরজার শিকলটা ঝনঝন করিয়া নড়িয়া উঠিল।

যাদব কষ্টে চোখ খুলিয়া বলিলেন, কে ও?

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ছোটবৌ কি বলতে এসেচে, শোন।

যাদব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ছোটমা? কেন মা?

ছোটবৌকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসিতেন। ছোটবৌ কথা কহিল না, তাহার হইয়া অন্নপূর্ণাই বলিয়া দিলেন,—ওর ছেলের চোখে পোড়োরা কলমের খোঁচা মারবে, তাই বাড়ির মধ্যে একটা পাঠশালা করে দিতে হবে।

যাদব হাতের নলটা ফেলিয়া দিয়া শঙ্কিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, কে চোখে খোঁচা মারলে? কৈ দেখি, কি-রকম হ’ল?

অন্নপূর্ণা তাঁহার হাতের নলটা তুলিয়া দিয়া হাসিয়া বলিলেন, এখনো কেউ মারেনি—যদির কথা হচ্ছে।

যাদব সুস্থির হইয়া বলিলেন, ওঃ, যদির কথা! আমি বলি বুঝি—

বিন্দু আড়ালে দাঁড়াইয়া হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গিয়া মৃদুস্বরে বলিল, দিদি, এই না তুমি বললে অনাছিষ্টি কথা মুখে আনতে পারবে না—আবার বলতে এলে কেন?

অন্নপূর্ণা নিজেও বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার কথা বলিবার ধরনটা ভাল হয় নাই এবং ইহার ফলও মধুর হইবে না। এখন এই চাপা গলার নিগূঢ় অর্থ স্পষ্ট অনুভব করিয়া তিনি যথার্থই ভীত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার রাগটা পড়িল নিরীহ স্বামীর উপর; এবং তাঁহাকেই উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আপিং-এর নেশায় মানুষের চোখই বুজে যায়, কানও কি বুজে যায়? বললুম কি, আর ও শুনলে কি! ‘কৈ দেখি কি-রকম হ’ল!’ আমি কি বলেচি তোমাকে, অমূল্যর চোখ কানা করে দিয়েচে? আমার হয়েচে যেন সবদিকে জ্বালা!

নির্বিরোধী যাদবের আফিং-এর মৌজ ছুটিয়া যাইবার উপক্রম হইল; তিনি হতবুদ্ধি হইয়া গিয়া বলিলেন, কেন, কি হ’ল গো?

অন্নপূর্ণা রাগিয়া বলিলেন, যা হ’ল তা ভালই। এমন মানুষের সঙ্গে কথা কইতে যাওয়া ঝকমারি—অধর্মের ভোগ। বলিয়া সক্রোধে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন।

যাদব বলিলেন, কি হয়েচে মা, খুলে বল ত?

বিন্দু দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, বাইরে গোলার ধারে একটি পাঠশালা হলে—

যাদব বলিলেন, এ আর বেশি কথা কি মা! কিন্তু পড়াবে কে?

বিন্দু কহিল, পন্ডিতমশাই এসেছিলেন, তিনি মাসে দশ টাকা করে পেলে পাঠশালা তুলে আনবেন। আমি বলি, আমার সুদের জমা টাকা থেকে যেন সব খরচ দেওয়া হয়।

যাদব সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, বেশ ত মা, কালই আমি লোক লাগিয়ে দেব, গঙ্গারাম এইখানেই যদি তার পাঠশালা তুলে আনে, সে ভাল কথাই।

ভাশুরের হুকুম পাইয়া বিন্দুর রাগ পড়িয়া গেল। সে হাসিমুখে রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখিল, অন্নপূর্ণা মুখ ভার করিয়া বসিয়া আছেন এবং কাছে বসিয়া কদম হাতমুখ নাড়িয়া কি যেন ব্যাখ্যা করিতেছে। বিন্দুকে ঢুকিতে দেখিয়াই সে পাংশুমুখে ‘ওমা এই যে’—বলিয়াই বক্তব্য শেষ করিয়া ফেলিল। বিন্দু বুঝিল তাহার কথাই হইতেছিল, সামনে আসিয়া বলিল, ও মা কি, তাই বল না?

ভয়ে কদমের গলা কাঠ হইয়া গিয়াছিল; সে ঢোক গিলিয়া বলিল, না দিদি, এই কি না—বড়মা বললেন কি না—এই ধর না, কেন—

বিন্দু রুক্ষস্বরে বলিল, ধরেচি—তুই কাজ কর গে যা।

কদম দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিয়া গিয়া বাঁচিল।

তখন বিন্দু অন্নপূর্ণাকে কহিল, বড়গিন্নীর পরামর্শদাতাগুলি বেশ! বঠ্‌ঠাকুরকে বলে ওদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

বিন্দু খুশী থাকিলে অন্নপূর্ণাকে দিদি বলিত, রাগিলে বড়গিন্নী বলিত।

অন্নপূর্ণা জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, যা না বল গে না—বঠ্‌ঠাকুর আমার মাথাটা কেটে নেবে। আর বঠ্‌ঠাকুরও তেমনি! সে তক্ষুণি শুরু করবে, কি মা! কি বলচ মা, ঠিক কথা মা! ঢের ঢের বরাত দেখেচি ছোটবৌ, কিন্তু তোর মত দেখিনি। কি কপাল নিয়েই জন্মেছিলি, মাইরি, বাড়িসুদ্ধ সবাই যেন ভয়ে জড়সড়।

বিন্দুর রাগ হইয়াছিল বটে, অন্নপূর্ণার কথার ভঙ্গীতে সে হাসিয়া ফেলিল। বলিল, কৈ, তুমি ত ভয় কর না!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, করিনে আবার! তোমার রণচণ্ডী মূর্তি দেখলে যার বুকের রক্ত জল হয়ে না যায় সে এখনো মায়ের পেটে আছে! কিন্তু অত রাগ ভাল নয় ছোটবৌ! এখনো কি ছোটটি আছিস? ছেলে হলে যে এতদিন চার-পাঁচ ছেলের মা হতিস। আর তোকেই বা দোষ দেব কি, ঐ বুড়ো মিনসেই আদর দিয়ে তোর মাথাটা খেলে।

বিন্দু বলিল, কপাল নিয়ে যে জন্মেছিলুম দিদি, সে কথা তোমার মানি; ধন-দৌলত, আদর-আহ্লাদ অনেকেই পায়, সেটা বেশী কথা নয়, কিন্তু এমন দেবতার মত ভাশুর পেতে অনেক জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যার ফল থাকা চাই। আমার অদৃষ্ট দিদি, তুমি হিংসে করে কি করবে? কিন্তু আদর দিয়ে তিনি ত মাথা খাননি, আদর দিয়ে যদি কেউ মাথা খেয়ে থাকে ত, সে তুমি।

অন্নপূর্ণা হাত নাড়িয়া বলিলেন, আমি? সে কথা কারো বলবার জো নেই। আমার শাসন বড় কড়া শাসন—কিন্তু কি করব, আমার কপাল মন্দ, কেউ আমাকে ভয় করে না—দাসী-চাকরগুলো পর্যন্ত মুখের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে ঝগড়া করে, যেন তারাই মনিব, আর আমি দাসী-বাঁদী! আমি তাই সয়ে থাকি, অন্য কেউ হলে—

তাঁহার এই উলটা-পালটা কথায় বিন্দু খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। বলিল, দিদি, তুমি সত্যযুগের মানুষ। কেন মরতে একালে এসে জন্মেছিলে? কৈ, আমার সঙ্গে ত কেউ ঝগড়া করে না? বলিয়া সহসা সুমুখে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই বাহু দিয়া অন্নপূর্ণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, একটা গল্প বল না, দিদি!

অন্নপূর্ণা রাগিয়া বলিলেন, যা, সরে যা।

কদম ছুটিয়া আসিয়া বলিল, দিদি, অমূল্যধন জাঁতিতে হাত কেটে ফেলে কাঁদচে।

বিন্দু তৎক্ষণাৎ গলা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জাঁতি পেলে কোথায়? তোরা কি কচ্ছিলি?

আমি ও-ঘরে বিছানা করছিলুম দিদি, জানিও নে কখন ও বড়মার ঘরে ঢুকে—

আচ্ছা হয়েচে—হয়েচে—যা, বলিয়া বিন্দু ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে অমূল্যের আঙুলের ডগায় ভিজা ন্যাকড়ার পটি বাঁধিয়া কোলে করিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা দিদি, কতদিন বলেচি তোমাকে, ছেলেপুলের ঘরে জাঁতি-টাঁতিগুলো একটু সাবধান করে রেখো—তা—

অন্নপূর্ণা আরো রাগিয়া গিয়া বলিলেন, কি কথা যে তুই বলিস ছোটবৌ, তার মাথা-মুণ্ডু নেই। কখন তোর ছেলে ঘরে ঢুকে হাত কাটবে বলে কি জাঁতি নোয়ার সিন্দুকে বন্ধ করে রাখবো?

বিন্দু বলিল, না, কাল থেকে ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো, তা হলে আর ঢুকবে না, বলিয়া বাহির হইয়া গেল।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, শুনলি কদম, ওর জবরদস্তির কথাগুলো! জাঁতি কি মানুষ সিন্দুকে তুলে রাখে!

কদম কি একটা বলিতে গিয়া হাঁ করিয়া থামিয়া গেল।

বিন্দু ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ফের যদি তুমি দাসী-চাকরকে মধ্যস্থ মানবে ত, সত্যি বলচি তোমাকে, ছেলে নিয়ে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, যা না যা। কিন্তু মাথা খুঁড়ে মলেও আর ফিরিয়ে আনবার নামটি করবো না। সে কথা মনে রাখিস।

আমি আসতেও চাইনে, বলিয়া বিন্দু মুখ ভার করিয়া চলিয়া গেল।

ঘন্টা-দুই পরে অন্নপূর্ণা দুমদুম করিয়া পা ফেলিয়া ছোটবৌয়ের ঘরে আসিয়া ঢুকিলেন। ঘরের একধারে একটি ছোট টেবিলের উপর মাধবচন্দ্র মকদ্দমার কাগজপত্র দেখিতেছিলেন এবং বিন্দু অমূল্যকে লইয়া খাটের উপর শুইয়া আস্তে আস্তে গল্প বলিতেছিল। অন্নপূর্ণা বলিলেন, খাবি আয়।

বিন্দু বলিল, আমার খিদে নেই।

অমূল্য তাড়াতাড়ি খুড়ীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ছোটমা খাবে না, তুমি যাও।

অন্নপূর্ণা ধমক দিয়া বলিলেন, তুই চুপ কর। এই ছেলেটিই হচ্ছে সকল নষ্টের গোড়া। কি আদুরে ছেলেই কচ্চিস ছৌটবৌ! শেষে টের পাবি। তখন কাঁদবি আর বলবি, হ্যাঁ, দিদি বলেছিল বটে!

বিন্দু ফিসফিস করিয়া অমূল্যকে শিখাইয়া দিল, অমূল্য চেঁচাইয়া বলিল, তুমি যাও না দিদি—ছোটমা রূপকথা বলচে।

অন্নপূর্ণা ধমকাইয়া বলিলেন, ভাল চাস ত উঠে আয়, ছোটবৌ! না হলে কাল তোদের দুজনকে না বিদেয় করি ত আমার নামই অন্নপূর্ণা নয়, বলিয়া যেমন করিয়া আসিয়াছিলেন, তেমনি করিয়া পা ফেলিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

মাধব জিজ্ঞাসা করিল, আজ আবার তোমাদের হ’ল কি?

বিন্দু বলিল, দিদি রাগলে যা হয় তাই। আজ অপরাধের মধ্যে বলেছিলুম, ছেলেপুলের ঘর, জাঁতি-টাঁতিগুলো একটু সাবধান করে রেখো—তাই এত কান্ড হচ্ছে।

মাধব বলিল, আর গোলমাল ক’রো না, যাও। বৌঠান যেমন করে পা ফেলে বেড়াচ্ছেন, দাদা এখনি উঠে পড়বেন।

বিন্দু অমূল্যকে কোলে তুলিয়া লইয়া হাসিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

.

তিন

এক মায়ের দুই ছেলে জননীকে আশ্রয় করিয়া যেমন করিয়া বাড়িয়া উঠিতে থাকে, এই দুইটি মাতা তেমনি একটিমাত্র সন্তানকে আশ্রয় করিয়া আরো ছয় বৎসর কাটাইয়া দিলেন। অমূল্য এখন বড় হইয়াছে, সে এন্ট্রাস স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ঘরে মাস্টার নিযুক্ত আছেন, তিনি সকালবেলা পড়াইয়া যাইবার পর অমূল্য খেলা করিতে বাহির হইয়াছিল। আজ রবিবার, স্কুল ছিল না।

অণ্ণপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন ছোটবৌ, কি করি বল ত?

বিন্দু তাহার ঘরের মেঝের উপর আলমারি উজাড় করিয়া অমূল্যর পোশাক বাছিতেছিল, সে কাকার সহিত কোন বড়লোক মক্কেলের বাড়ি নিমন্ত্রণ-রক্ষা করিতে যাইবে। বিন্দু মুখ না তুলিয়াই বলিল, কিসের দিদি?

তাহার মেজাজটা কিছু অপ্রসন্ন। অন্নপূর্ণা রকমারি পোশাকের বাহার দেখিয়া অবাক হইয়া গিয়াছেলেন, তাই তাহার মুখের ভাবটা লক্ষ্য করিলেন না; কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কি সমস্তই অমূল্যর পোশাক নাকি?

বিন্দু বলিল, হাঁ।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, কত টাকাই না তুই অপব্যয় করিস। এর একটার দামে গরীবের ছেলের সারা বছরের কাপড়-চোপড় হতে পারে।

বিন্দু বিরক্ত হইল, কিন্তু সহজভাবে বলিল, তা পারে। কিন্তু গরীবে বড়লোকে একটু তফাত থাকেই; সেজন্য দুঃখ করে কি হবে দিদি!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, তা হোক বড়লোক, কিন্তু তোর সব কাজেই একটু বাড়াবাড়ি আছে।

বিন্দু মুখ তুলিয়া বলিল, কি বলতে এসেছ তাই বল না দিদি, এখন আমার সময় নেই।

তোমার সময় আর কখন থাকে ছোটবৌ! বলিয়া তিনি রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

ভৈরব অমূল্যকে ডাকিয়া আনিতে গিয়াছিল। সে ঘন্টা-খানেক পরে খুঁজিয়া আনিল।

বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, কোথা ছিলি এতক্ষণ?

অমূল্য চুপ করিয়া রহিল।

ভৈরব বলিল, ও-পাড়ায় চাষাদের ছেলেদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলছিল।

এই খেলাটায় বিন্দুর বড় ভয় ছিল, তাই নিষেধ করিয়া দিয়াছিল; বলিল, ডাংগুলি খেলতে তোকে মানা করিচি না?

অমূল্য ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া বলিল, আমি দাঁড়িয়েছিলুম, তারা জোর করে আমাকে—

জোর করে তোমাকে? আচ্ছা, এখন যাচ্চ যাও, তার পর হবে। বলিয়া তাহাকে পোশাক পরাইতে লাগিল।

মাস-দুই পূর্বে অমূল্যর পৈতা হইয়াছিল; সে নেড়া মাথায় জরির টুপি পরিতে ভয়ঙ্কর আপত্তি করিল। কিন্তু বিন্দু ছাড়িবার লোক নয়, সে জোর করিয়া পরাইয়া দিল। অমূল্য নেড়া-মাথায় জরির টুপি পরিয়া দাঁড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল।

মাধব ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিলেন, আর ওর কত দেরি হবে গো?

পরক্ষণেই অমূল্যর দিকে দৃষ্টি পড়িলে হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, বাঃ—এই যে মথুরার কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হয়েছেন।

অমূল্য লজ্জায় টুপিটা ফেলিয়া দিয়া খাটের উপর গিয়া উপুড় হইয়া পড়িল।

বিন্দু রাগিয়া উঠিল। বলিল, একে ছেলেমানুষ কাঁদচে, তার উপর তুমি—

মাধব গম্ভীর হইয়া বলিলেন, কাঁদিস নে অমূল্য, ওঠ্, লোকে পাগল বলে ত আমাকেই বলবে, তুই আয়।

ঠিক এই কথাটাই ইতিপূর্বে আর একদিন হইয়া গিয়াছিল এবং বিন্দু তাহাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিল। সেই কথাটার পুনরাবৃত্তিতে সে হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গিয়া বলিল, আমি সব কাজ পাগলের মত করি, না? বলিয়া উঠিয়া গিয়া অমূল্যকে তুলিয়া আনিয়া পাখার বাঁটের বাড়ি ঘা-কতক দিয়া দামী মখমলের পোশাক টানিয়া টানিয়া খুলিয়া ফেলিতে লাগিল।

মাধব ভয়ে ভয়ে বাহির হইয়া গিয়া অন্নপূর্ণাকে সংবাদ দিলেন, মাথায় ভূত চেপেচে বৌঠান, একবার যাও।

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া দেখেলেন, বিন্দু সমস্ত পোশাক খুলিয়া লইয়া একটা সাধারণ বস্ত্র পরাইয়া দিতেছে, অমূল্য ভয়ে বিবর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, বেশ ত হয়েছিল ছোটবৌ, খুললি কেন?

বিন্দু অমূল্যকে ছাড়িয়া দিয়া হঠাৎ গলায় আঁচল দিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, তোমাদের পায়ে পড়ি বড়গিন্নী, সামনে থেকে একটু যাও। তোমাদের পাঁচজনের মধ্যস্থতার জ্বালায় ওর প্রাণটাই মার খেয়ে যাবে।

অন্নপূর্ণা বাক্‌শূন্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

বিন্দু অমূল্যর একটা কান ধরিয়া টানিয়া আনিয়া ঘরের এক কোণে দাঁড় করাইয়া দিয়া বলিল, যেমন বজ্জাত ছেলে তুমি, তেমনি তোমার শাস্তি হওয়া চাই। সমস্তদিন ঘরে বন্ধ থাক। দিদি, বাইরে এস। আমি দোর বন্ধ করব। বলিয়া বাহিরে আসিয়া শিকল তুলিয়া দিল।

বেলা তখন প্রায় একটা বাজে, অন্নপূর্ণা আর থাকিতে না পারিয়া বলিলেন, হাঁ ছোটবৌ, সত্যি আজ তুই অমূল্যকে খেতে দিবিনে? তার জন্য কি বাড়িসুদ্ধ লোক উপোস করে থাকবে?

বিন্দু জবাব দিল, বাড়িসুদ্ধ লোকের ইচ্ছে!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, এ তোর কি-রকম কথা ছোটবৌ! বাড়ির মধ্যে ঐ একটি ছেলে, সে উপোস করে থাকলে, তোর আমার কথা ছেড়ে দে, দাসী-চাকরেই বা মুখে ভাত তোলে কি করে বল দেখি!

বিন্দু জিদ করিয়া বলিল, তা আমি জানিনে।

অন্নপূর্ণা বুঝিলেন, তর্ক করিয়া আর লাভ হইবে না, বলিলেন, আমি বলচি, বড়বোনের কথাটা রাখ। আজ তাকে মাপ কর। তা ছাড়া পিত্তি পড়ে অসুখ হলে তোকেই ভুগতে হবে।

বেলার দিকে চাহিয়া বিন্দু নিজেই নরম হইয়া আসিয়াছিল, কদমকে ডাকিয়া বলিল, যা নিয়ে আয় তাকে। কিন্তু তোমাদেরও বলে রাখচি দিদি, ভবিষ্যতে আমার কথায় কথা কইলে ভাল হবে না।

গোলযোগটা এইখানেই সেদিনের মত থামিয়া গেল।

ছোটভাইয়ের ওকালতিতে পসার হওয়ার পর হইতে যাদব চাকরি ছাড়িয়া দিয়া নিজেদের বিষয়-আশয় দেখিতেছিলেন। ছোটবধূর দরুন হাতে যে দশ হাজার টাকা ছিল, তাহাও সুদে খাটাইয়া প্রায় দ্বিগুণ করিয়াছিলেন। সেই টাকার কিয়দংশ লইয়া এবং মাধবের উপার্জনের উপর নির্ভর করিয়া তিনি গত বৎসর হইতে প্রায় পোয়াটাক পথ দূরে একখানি বড় রকমের বাড়ি ফাঁদিয়াছিলেন। দিন-দশেক হইল তাহা সম্পূর্ণ হইয়াছিল। কথা ছিল, দুর্গাপূজার পরে ভাল দিন দেখিয়া সকলেই তথায় উঠিয়া যাইবেন, তাই একদিন যাদব
৯০৮

আহারে বসিয়া ছোটবৌকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, তোমার বাড়ি ত তৈরি হ’ল মা, এখন একদিন গিয়ে দেখে এস, আর কিছু বাকি রয়ে গেল কিনা।

বিন্দুর একটা অভ্যাস ছিল, সে সহস্র কাজ ফেলিয়া রাখিয়া ভাশুরের খাবার সময় দরজার আড়ালে বসিয়া থাকিত।ভাশুরকে সে দেবতার মতই ভক্তি করিত—সকলেই করিত। বলিল, আর কিছু বাকি নেই।

যাদব হাসিয়া বলিলেন, না দেখেই রায় দিলে মা! আচ্ছা, ভাল কথা। তবে আরো একটি কথা আছে। আমার ইচ্ছে হয়, আত্মীয়-স্বজন আমাদের যে যেখানে আছেন, সকলকেই এক করে একটি সুদিন দেখে উঠে যাই, গিয়ে গৃহদেবতার পূজা দিই, কি বল মা?

বিন্দু আস্তে আস্তে বলিল, দিদিকে বলি, তিনি যা বলবেন তাই হবে।

যাদব বলিলেন, তা বল। কিন্তু তুমিই আমার সংসারের লক্ষ্মী, মা! তোমার ইচ্ছাতেই কাজ হবে।

অন্নপূর্ণা অদূরেই বসিয়াছিলেন, হাসিয়া বলিলেন, তবু তোমার মা লক্ষ্মীটি যদি একটু শান্ত হতেন!

যাদব বলিলেন, শান্ত আবার কি বড়বৌ? মা আমার জগদ্ধাত্রী! বরও দেন, আবশ্যক হলে খাঁড়াও ধরেন। ওই ত আমি চাই। মাকে এনে অবধি সংসারে আমার এতটুকু দুঃখ-কষ্ট নেই।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, সে কথা তোমার সত্যি। ও আসবার আগের দিনগুলো এখন মনে করলেও ভয় হয়।

বিন্দু লজ্জা পাইয়া সে কথা চাপা দিয়া বলিল, আপনি সক্কলকে আনান। আমাদের ও- বাড়ি বেশ বড়, কারো কোন কষ্ট হবে না। ইচ্ছে করলে তাঁরা দু’মাস ছ’মাস থাকতেও পারবেন।

যাদব বলিলেন, তাই হবে মা, কালই আমি আনবার বন্দোবস্ত করব।

.

চার

ইঁহাদের পিসতুতো বোন এলোকেশীর অবস্থা ভাল ছিল না। যাদব তাঁহাকে প্রায়ই অর্থসাহায্য করিয়া পাঠাইতেন। কিছুদিন হইতে তিনি তাঁহার পুত্র নরেনকে এইখানে রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইবার ইচ্ছা জানাইয়া চিঠিপত্র লিখিতেছিলেন, এই সময়ে তিনি ছেলে লইয়া উত্তরপাড়া হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার স্বামী প্রিয়নাথ সেখানে কি করিতেন, তাহা ঠিক করিয়া কেহই বলিতে পারে না, দিন-দুয়ের মধ্যে তিনিও আসিয়া পড়িলেন। নরেনের বয়স ষোল-সতের। সে চওড়া পাড়ের কাপড় ফের দিয়া পরিত এবং দিনের মধ্যে আট-দশবার চুল আঁচড়াইত। টেরিটা তাহার বাস্তবিকই একটা দেখিবার বস্তু ছিল।

আজ সন্ধ্যার পর রান্নাঘরের বারান্দায় সকলে একত্রে বসিয়াছেলেন এবং এলোকেশী তাঁহার পুত্রের অসাধারণ রূপ-গুণের পরিচয় দিতেছেলেন।

বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, নরেন, কোন্ ক্লাসে পড় তুমি?

নরেন বলিল, ফোর্থ ক্লাস। রয়েল রিডার, গ্রামার, জিয়োগ্রাফি, এরিথ্‌মেটিক, আরো কত কি ডেসিমেল্‌-টেসিমেল্‌—ও-সব তুমি বুঝবে না মামী।

এলোকেশী সগর্বে পুত্রের মুখের দিকে একবার চাহিয়া বিন্দুকে বলিলেন, সেকি এক-আধখানা বই, ছোটবৌ? বইয়ের পাহাড়; কাল বইগুলো বাক্স থেকে বার করে তোমার মামীদের একবার দেখিও ত বাবা!

নরেন ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা দেখাব।

বিন্দু বলিল, পাস করতে এখনো ত দেরি আছে।

এলাকেশী বলিলেন, দেরি কি থাকত ছোটবৌ, দেরি থাকত না। এতদিনে একটা কেন, চারটে পাস করে ফেলতো। শুধু মুখপোড়া মাস্টারের জন্যই হচ্ছে না। তার সর্বনাশ হোক, বাছাকে সে যে কি বিষ-নজরেই দেখেচে, তা সেই জানে। ওকে কি তুলে দিচ্চে? দিচ্চে না। হিংসে করে বছরের পর বছর একটা কেলাসেই ফেলে রেখেচে।

বিন্দু বিস্মিত হইয়া কহিল, কৈ, এ-রকম ত হয় না!

এলোকেশী বলিলেন, হচ্চে, আবার হয় না! মাস্টারগুলো সব একজোট হয়ে ঘুষ চায়; আমি গরীব মানুষ, ঘুষের টাকা কোথা থেকে যোগাই বল ত?

বিন্দু চুপ করিয়া রহিল। অন্নপূর্ণা আন্তরিক দুঃখিত হইয়া বলিলেন, এমন করে কি কখন মানুষের পিছনে লাগতে আছে? সেটা কি ভাল কাজ? কিন্তু আমাদের এখানে ও-সব নেই। আমাদের অমূল্য ত ফি বছর ভাল ভাল বই প্রাইজ ঘরে আনে, কিন্তু কখ্খন ঘুষটুষ দিতে হয় না।

এই সময় অমূল্য কোথা হইতে আসিয়া আস্তে আস্তে তাহার ছোটমার কোলে গিয়া বসিল। বসিয়াই গলা ধরিয়া কানে কানে বলিল, কাল রবিবার, ছোটমা, আজ মাস্টারমশায়কে যেতে বলে দাও না।

বিন্দু হাসিয়া বলিল, এই যে ছেলেটি দেখচ ঠাকুরঝি, এটি গল্প পেলে আর উঠবে না—কদম, মাস্টারমশায়কে যেতে বলে দে, অমূল্য আজ আর পড়বে না।

নরেন আশ্চর্য হইয়া বলিল, ও কি রে অমূল্য, অত বড় ছেলে, এখনও মেয়েমানুষের কোলে গিয়ে বসিস!

বিন্দু হাসিয়া বলিল, শুধু এই বুঝি? এখনও রাত্তিরে—

অমূল্য ব্যাকুল হইয়া তাহার মুখে হাত-চাপা দিয়া বলিল, ব’লো না ছোটমা, ব’লো না।

বিন্দু বলিল না, কিন্তু অন্নপূর্ণা বলিয়া দিলেন। বলিলেন, এখনো ও রাত্তিরে ছোটমার কাছে শোয়।

বিন্দু বলিল, শুধু শোয়া দিদি, এখনো সমস্ত রাত্তির বাদুড়ের মত আঁকড়ে ধরে ঘুমোয়।

অমূল্য লজ্জায় তাহার ছোটমার বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া রহিল।

নরেন কহিল, ছি ছি, তুই কি রে! তুই ইংরাজী পড়িস?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, পড়ে বৈ কি। ইস্কুলে ও ত ইংরাজীই পড়ে।

নরেন বলিল, ইস, ইংরাজী পড়ে! কৈ, ইন্‌জিন্‌ বানান করুক ত দেখি? তা আর পারতে হয় না।

এলোকেশী বলিলেন, ও-সব শক্ত শক্ত কথা, ও কি ছেলেমানুষে পারে?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, কৈ অমূল্য বানান কর না?

অমূল্য কিন্তু কিছুতেই মুখ তুলিল না।

বিন্দু তাহার মাথাটা একবার বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিল, তোমরা সবাই মিলে ওকে লজ্জা দিলে ও আর কি করে বানান করে?

তারপর এলোকেশীর দিকে চাহিয়া বলিল, ও আমার আসচে বছর পাস দেবে। আমাদের মাস্টারমশাই বলেচেন, ও কুড়ি টাকা জলপানি পাবে। ও সেই টাকা দিয়ে ওর কাকার মত এক জোড়া ঘোড়া কিনবে।

কথাটা সত্য হইলেও পরিহাস-ছলে সবাই হাসতে লাগিলেন।

এলোকেশী বিন্দুকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আমার নরেন্দ্রনাথ শুধু কি লেখা-পড়াতেই ভাল, ও এমনি থিয়েটারে অ্যাক্টো করে যে, লোকে শুনে আর চোখে জল রাখতে পারে না। সেই সীতা সেজে কি-রকমটি করে বলেছিলে, একবার মামীদের শুনিয়ে দাও ত বাবা!

নরেন তৎক্ষণাৎ হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাতজোড় করিয়া, উচ্চ নাকিসুরে সুর করিয়া আরম্ভ করিয়া দিল, প্রাণেশ্বর! কি কুক্ষণে দাসী তব—

বিন্দু ব্যাকুল হইয়া উঠিল,—ওরে থাম থাম, চুপ কর, বঠ্‌‌ঠাকুর ওপরে আছেন। নরেন চমকিয়া চুপ করিল।

অন্নপূর্ণা ঐটুকু শুনিয়াই মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন, বলিলেন, শুনলেই বা ঠাকুর-দেবতার কথা, এ ত ভাল কথা ছোটবৌ।

বিন্দু বিরক্ত হইয়া বলিল, তবে শোন তুমি ঠাকুর-দেবতার কথা, আমরা উঠে যাই।

নরেন বলিল, আচ্ছা, তবে থাক, আমি সাবিত্রীর পার্ট করি।

বিন্দু বলিল, না।

এই কণ্ঠস্বর শুনিয়া এতক্ষণে অন্নপূর্ণার চৈতন্য হইল যে, ব্যাপারটা অনেক দূরে গিয়াছে এবং এইখানেই তাহার শেষ হইবে না। এলোকেশী নূতন লোক, তিনি ভিতরের কথা বুঝিলেন না, বলিলেন, আচ্ছা এখন থাক। পুরুষেরা বেরিয়ে গেলে সে একদিন দুপুরবেলা হতে পারবে। আহা গান-বাজনাই কি ও কম শিখেচে? দময়ন্তীর সেই কেঁদে কেঁদে গানটি একবার বলিস ত বাবা, তোর মামীরা শুনলে আর ছাড়তে চাইবে না।

নরেন বলিল, এখনি বলব?

রাগে বিন্দুর সর্বাঙ্গ জ্বালা করিতেছিল, সে কথা কহিল না।

অন্নপূর্ণা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, না না, গান-টান এখন কাজ নেই।

নরেন বলিল, আচ্ছা, গানটা আমি অমূল্যকে শিখিয়ে দেব। আমি বাজাতেও জানি। ত্রেকেটে তাক্‌ বাজনা বড় শক্ত মামী, আচ্ছা, ঐ পেতলের হাঁড়িটা একবার দাও ত দেখিয়ে দিই।

বিন্দু অমূল্যকে উঠিবার ইঙ্গিত করিয়া বলিল, যা অমূল্য ঘরে গিয়ে পড় গে।

অমূল্য মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল, তাহার উঠিবার ইচ্ছা ছিল না, চুপি চুপি বলিল, আরো একটু বোস না ছোটমা।

বিন্দু কোন কথা না বলিয়া তাহাকে তুলিয়া দিয়া সঙ্গে করিয়া ঘরে চলিয়া গেল। সহসা সে কেন যে অমন করিয়া গেল, অন্নপূর্ণা তাহা বুঝিলেন এবং পাছে সঙ্গদোষে অমূল্য বিগড়াইয়া যায়, এই ভয়ে নরেনের এইখানে থাকিয়া লেখাপড়াও যে সে পছন্দ করিবে না, ইহা সুস্পষ্ট বুঝিয়া তিনি উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, বাবা নরেন, তোমার ছোটমামীর সামনে ঐ অ্যাক্টো-ট্যাক্টোগুলো আর ক’রো না। ও রাগী মানুষ, ও-সব ভালবাসে না।

এলোকেশী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ছোটবৌ ও-সব ভালবাসে না বুঝি? তাই অমন করে উঠে গেল বটে।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, হতেও পারে। আরো একটা কথা বাবা, তুমি নিজের খাবে-দাবে পড়াশুনা করবে—যাতে মায়ের দুঃখ ঘোচে, সেই চেষ্টা করবে, তুমি অমূল্যর সঙ্গে বেশী মিশো না বাবা। ও ছেলেমানুষ, তোমার চেয়ে অনেক ছোট।

কথাটা এলোকেশীর ভাল লাগিল না। বলিলেন, সে ত ঠিক কথা, ও গরীবের ছেলে, ওর গরীবের মত থাকাই উচিত। তবে যদি বললে ত বলি, বড়বৌ, অমূল্যটিই তোমার কচি খোকা, আর আমার নরেনই কি বুড়ো? এক-আধ বছরের ছোট-বড়োকে আর বড় বলে না। আর ও-কি কখনও বড়োলোকের ছেলে চোখে দেখেনি গা, এইখানে এসে দেখচে? ওদের থিয়েটারের দলে কত রাজা-রাজড়ার ছেলে রয়েচে যে!

অন্নপূর্ণা অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, না ঠাকুরঝি, সে কথা বলিনি, আমি বলচি—

আবার কি করে বলবে বড়বৌ? আমরা বোকা বলে কি এতই বোকা, যে এ কথাটাও বুঝিনে! তবে দাদা নাকি বললেন, নরেন এইখানেই লেখাপড়া করবে, তাই আসা, নইলে আমাদেরও কি দিন চলছিল না!

অন্নপূর্ণা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিলেন, ভগবান জানেন ঠাকুরঝি, আমি সে কথা বলিনি, আমি বলচি কি, এই যাতে মায়ের দুঃখ-কষ্ট ঘোচে, যাতে—

এলোকেশী বলিলেন, আচ্ছা, তাই, তাই। যা নরেন, তুই বাইরে গিয়ে বস গে, বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশিস নে। বলিয়া ছেলেকে ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া নিজেও চলিয়া গেলেন।

অন্নপূর্ণা ঝড়ের মত বিন্দুর ঘরে ঢুকিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হাঁ লা, তোর জন্যে কি কুটুম-কুটম্বিতেও বন্ধ করতে হবে? কি করে চলে এলি বল ত?

বিন্দু অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, কেন বন্ধ করতে হবে দিদি, আত্মীয়-কুটুম্ব নিয়ে তুমি মনের সুখে ঘর কর, আমি ছেলে নিয়ে পালাই, এই!

পালাবি কোথায় শুনি?

বিন্দু কহিল, যাবার দিন তোমায় ঠিকানা বলে যাব, ভেবো না।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, সে আমি জানি। যাতে পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না, সে কি তুই না করেই ছাড়বি? চিরকালটা এই বৌ নিয়ে আমার হাড়মাস জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল। বলিয়া বাহির হইয়া যাইতেছিলেন, মাধবকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া আবার জ্বলিয়া উঠিলেন, না ঠাকুরপো, তোমরা আর কোথাও গিয়ে থাক গে, না হয়, ঐ বৌটিকে বিদেয় কর, আমি আর রাখতে পারব না, আজ তা পষ্ট বলে গেলুম, বলিয়া চলিয়া গেলেন।

মাধব আশ্চর্য হইয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, ব্যাপার কি?

বিন্দু বলিল, জানিনে, বড়গিন্নী বলেচে, দাও আমাদের বিদেয় করে।

মাধব আর কিছু বলিল না। টেবিলের উপর হইতে খবরের কাগজটা তুলিয়া লইয়া বহিরের ঘরে চলিয়া গেল।

.

পাঁচ

ঠাকুরঝি দেখিতে বোকার মতন ছিলেন, কিন্তু সেটা ভুল। তিনি যেই দেখিলেন, নিঃসন্তান ছোটবৌর অনেক টাকা, তিনি তখ্‌খনি সেই দিকে ঢলিলেন, এবং প্রতি রাত্রে স্বামী প্রিয়নাথকে একবার করিয়া ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন, তোমার জন্যই আমার সব গেল। তোমার কাছে মিছিমিছি পড়ে না থেকে এখানে থাকলে আজ আমি রাজার মা। আমার এমন সোনার চাঁদ ফেলে কি আর ঐ কাল ভূতের মত ছেলেটাকে ছোটবৌ—, বলিয়া একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসের দ্বারা ঐ কাল ভূতের সমস্ত পরমায়ুটা নিঃশেষে উড়াইয়া দিয়া ‘গরীবের ভগবান আছেন’ বলিয়া উপসংহার করিয়া চুপ করিয়া শুইতেন। প্রিয়নাথও মনে মনে নিজের বোকামির জন্য অনুতাপ করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িতেন। এমনি করিয়া এই দম্পতিটির দিন কাটিতেছিল এবং ছোটবৌর প্রতি ঠাকুরঝির স্নেহ-প্রীতি বন্যার মত ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল।

আজ দুপুরবেলা তিনি বলিতেছিলেন, অমন মেঘের মত চুল ছোটবৌ, কিন্তু কোনদিন বাঁধতে দেখলুম না। আজ জমিদারের বাড়ির মেয়েরা বেড়াতে আসবে, এস, মাথাটা বেঁধে দিই।

বিন্দু বলিল, না ঠাকুরঝি, আমি মাথায় কাপড় রাখতে পারিনে, ছেলে বড় হয়েচে—দেখতে পাবে।

ঠাকুরঝি অবাক হইয়া বলিলেন, ও আবার কি কথা ছোটবৌ? ছেলে বড় বলে এ”স্ত্রী মানুষ চুল বাঁধবে না? আমার নরেন্দরনাথ ত শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আরো ছ’মাস বছরেকের বড়, তাই বলে কি আমি মাথা-বাঁধা ছেড়ে দেব!

বিন্দু বলিল, তুমি ছাড়বে কেন ঠাকুরঝি, নরেন বরাবর দেখে আসচে, ওর কথা আলাদা। কিন্তু অমূল্য হঠাৎ আজ আমার মাথায় খোঁপা দেখলে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। হয়ত চেঁচামেচি করবে, না কি করবে—ছি ছি, সে ভারি লজ্জার কথা হবে!

অন্নপূর্ণা হঠাৎ সেইদিক দিয়া যাইতেছিলেন, বিন্দুর দিকে চাহিয়া সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিলেন, তোর চোখ ছলছল করচে কেন রে ছোটবৌ? আয় ত, গা দেখি!

বিন্দু এলোকেশীর সামনে ভারি লজ্জা পাইয়া বলিল, কি রোজ রোজ গা দেখবে! আমি কি কচি খুকি, অসুখ করলে টের পাব না?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, না, তুই বুড়ি। কাছে আয়, ভাদ্দর আশ্বিন মাস, দিনকাল বড় খারাপ।

বিন্দু বলিল, কক্ষণ যাব না। বলচি কিছু হয়নি, বেশ আছি তবু কাছে আয়!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, দেখিস, ভাঁড়াস নে যেন! বলিয়া সন্দিগ্ধ-দৃষ্টিতে চাহিতে চাহিতে চলিয়া গেলেন।

এলোকেশী বলিল, বড়বৌর যেন একটু বায়ের ছিট্‌ আছে, না?

বিন্দু একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, ঐ-রকম ছিট্‌ যেন সকলের থাকে ঠাকুরঝি!

এলোকেশী চুপ করিয়া রহিল।

অন্নপূর্ণা কি একটা হাতে লইয়া সে পথেই ফিরিয়া যাইতেছিলেন, বিন্দু ডাকিয়া বলিল, দিদি, শোন শোন, খোঁপা বাঁধবে?

অন্নপূর্ণা ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া এলোকেশীকে বলিলেন, আমি কত বলেচি ঠাকুরঝি, ওকে বলা মিছে। অত চুল তা বাঁধবে না, অত কাপড় গয়না তা পরবে না, অত রূপ তা একবার চেয়ে দেখবে না। ওর সব ছিষ্টিছাড়া মতিবুদ্ধি । ছেলেও হচ্চে তেমনি। সেদিন অমূল্য আমাকে কি বললে জানিস ছোটবৌ! বলে, কাপড় জামা পরে কি হয়? ছোটমারও অত আছে, পরে কি?

বিন্দু সগর্বে মুখ তুলিয়া হাসিয়া বলিল, তবে দেখ দিদি, ছেলেকে দশের একজন করে তুলতে হলে মায়ের এইরকম ছিষ্টিছাড়া মতিবুদ্ধির দরকার কি না! যদি ততদিন বেঁচে থাক দিদি, তা হলে দেখতে পাবে, দেশের লোকে দেখিয়ে বলবে, ঐ অমূল্যর মা। বলিতে বলিতেই তাহার চোখদুটি সজল হইয়া উঠিল।

অন্নপূর্ণা তাহা দেখিতে পাইয়া সস্নেহে বলিলেন, সেইজন্যই ত তোর ছেলের সম্বন্ধে কোন কথা আমরা কইনে । ভগবান তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন, কিন্তু ঐ ছেলে বড় হবে, দশের একজন হবে, অত আশা আমরা মনে ঠাঁই দিইনে।

বিন্দু আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া বলিল, কিন্তু ঐ একটি আশা নিয়ে আমি বেঁচে আছি দিদি। বাপ্‌রে! সহসা তাহার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়া উঠিল। সে লজ্জিত হইয়া জ়োর করিয়া হাসিয়া বলিল, না দিদি, ও আশায় যদি কোনদিন ঘা পড়ে ত আমি পাগল হয়ে যাব।

অন্নপূর্ণা নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তিনি ছোটজায়ের মনের কথাটা যে জানিতেন না, তাহা নহে, কিন্তু তাহার আশা-আকাঙ্ক্ষার এমন উগ্র প্রতিচ্ছবি কোনদিন নিজের মধ্যে এমন স্পষ্ট করিয়া উপলব্ধি করেন নাই। আজ তাঁহার চৈতন্য হইল, কেন বিন্দু অমূল্য সম্বন্ধে এমন যক্ষের মত সজাগ, এমন প্রেতের মত সতর্ক! নিজের পুত্রের এই সর্বমঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণীর মুখের দিকে চাহিয়া অনির্বচনীয় শ্রদ্ধার মাধুর্যে তাঁহার মাতৃহৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তিনি উদ্গত অশ্রু গোপন করিবার জন্য মুখ ফিরাইলেন।

ঠাকুরঝি বলিলেন, তা হোক ছোটবৌ, আজকে তোমার—

বিন্দু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিল, হাঁ ঠাকুরঝি, আজ দিদির মাথাটা বেঁধে দাও—এ-বাড়িতে ঢুকে পর্যন্ত কখন দেখিনি। বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া চলিয়া গেল।

দিন পাঁচ-ছয় পরে একদিন সকালবেলা বাটীর পুরাতন নাপিত যাদবের ক্ষৌরকর্ম করিয়া উপর হইতে নামিয়া যাইতেছিল, অমূল্য আসিয়া তাহার পথরোধ করিয়া বলিল, কৈলাসদা, নরেনদার মত চুল ছাঁটতে পার?

নাপিত আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে কি-রকম দাদাবাবু!

অমূল্য নিজের মাথার নানাস্থানে নির্দেশ করিয়া বলিল, দেখ, এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা, এইখানে দু আনা, আর এই ঘাড়ের কাছে এক্কেবারে ছোট ছোট। পারবে ছাঁটতে?

নাপিত হাসিয়া বলিল, না দাদা, ও আমার বাবা এলেও পারবে না।

অমূল্য ছাড়িল না। সাহস দিয়া কহিল, ও শক্ত নয় কৈলাসদা, এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা—

নাপিত নিষ্কৃতি-লাভের উপায় করিয়া বলিল, কিন্তু আজ কি বার? তোমার ছোটমা হুকুম না দিলে ত ছাঁটতে পারিনে দাদা!

অমূল্য বলিল, আচ্ছা দাঁড়াও, আমি জেনে আসি। বলিয়া এক পা গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা, তোমার ছাতিটা একবার দাও, না হলে তুমি পালিয়ে যাবে। বলিয়া জোর করিয়া সে ছাতিটা টানিয়া লইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। ঝড়ের মত ঘরে ঢুকিয়া বলিল, ছোটমা, শিগগির একবার এস ত?

ছোটমা সবেমাত্র স্নান সারিয়া আহ্নিকে বসিতেছিল, ব্যস্ত হইয়া বলিল, ওরে ছুঁসনে, ছুঁসনে, আহ্নিক কচ্চি।

আহ্নিক পরে ক’রো ছোটমা, একবারটি বাইরে এসে হুকুম দিয়ে যাও, নইলে চুল ছেঁটে দেয় না, সে দাঁড়িয়ে আছে।

বিন্দু কিছু আশ্চর্য হইল, তাহার চুল ছাঁটাইবার জন্য চিরদিন মারামারি করিতে হয়, আজ সে কেন স্বেচ্ছায় চুল ছাঁটিতে চাহিতেছে, বুঝিতে না পারিয়া সে বাহিরে আসিতেই নাপিত কহিল, বড় শক্ত ফরমাস হয়েচে মা, নরেনবাবুর মত বারো আনা, ছ আনা, তিন আনা, দু আনা, এক আনা, এমনি করে ছাঁটতে হবে, ও কি আমি পারব!

অমূল্য বলিল, খুব পারবে। আচ্ছা দাঁড়াও, আমি নরেনদাকে ডেকে আনি, বলিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। নরেন বাড়ি ছিল না, খানিক খোঁজাখুঁজি করিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, সে নেই, আচ্ছা নাই থাকল, ছোটমা, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দাও—বেশ করে দেখো—এইখানে বারো আনা, এইখানে ছ আনা, এইখানে দু’আনা আর এইখানে খুব ছোট।

তাহার ব্যগ্রতা দেখিয়া বিন্দু হাসিয়া বলিল, আমি এখন আহ্নিক করব যে রে!

আহ্নিক পরে করো, নইলে ছুঁয়ে দেব।

বিন্দুকে অগত্যা দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।

নাপিত চুল কাটিতে লাগিল। বিন্দু চোখ পিটিয়া দিল। সে সমস্ত চুল সমান করিয়া কাটিয়া দিল। অমূল্য মাথায় হাত বুলাইয়া খুশি হইয়া বলিল, এই ঠিক হয়েচে। বলিয়া লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল।

নাপিত ছাতি বগলে করিয়া বলিল, কিন্তু মা, কাল এ-বাড়ি ঢোকা আমার শক্ত হবে।

বামুনঠাকরুন ভাত দিয়া ডাকাডাকি করিতেছিল; বিন্দু রান্নাঘরের একধারে বসিয়া বাটিতে দুধ সাজাইতে সাজাইতে শুনিতে পাইল, অমূল্য বাড়িময় কাকার চুল আঁচড়াইবার বুরুশ খুঁজিয়া ফিরিতেছে। খানিক পরেই সে কাঁদিয়া আসিয়া বিন্দুর পিঠের উপর ঝুঁকিয়া পড়িল—কিচ্ছু হয়নি ছোটমা। সব খারাপ করে দিয়েছে—কাল তাকে আমি মেরে ফেলব।

বিন্দু আর হাসি চাপিতে পারিল না। অমূল্য পিঠ ছাড়িয়া দিয়া রাগে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, তুমি কি কানা? চোখে দেখতে পাও না?

অন্নপূর্ণা কান্নাকাটি শুনিয়া ঘরে ঢুকিয়া সমস্ত শুনিয়া বলিলেন, তার আর কি, কাল ঠিক করে কেটে দিতে বলব।

অমূল্য আরো রাগিয়া গিয়া বলিল, কাল কি করে বারো আনা হবে? এখানে চুল কৈ?

অন্নপূর্ণা শান্ত করিবার জন্য বলিলেন, বারো আনা না হোক, আট আনা দশ আনা হতে পারবে।

ছাই হবে। আট আনা দশ আনা কি ফ্যাশন? নরেনদাকে জিজ্ঞেস কর, বারো আনা চাই।

সেদিন অমূল্য ভাল করিয়া ভাত খাইল না, ফেলিয়া ছড়াইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, তোর ছেলের টেরি বাগাবার শখ হ’ল কবে থেকে রে?

বিন্দু হাসিল, কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হইয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, দিদি, তুচ্ছ কথা, তাই হাসচি বটে, কিন্তু ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে—সব জিনিসের শুরু এমনি করেই হয়।

অন্নপূর্ণা আর কথা কহিতে পারিলেন না।

দুর্গাপূজা আসিয়া পড়িল। ও-পাড়ার জমিদারদের বাড়ি আমোদ-আহ্লাদের প্রচুর আয়োজন হইয়াছিল। দুইদিন পূর্ব হইতেই নরেন তাহার মধ্যে মগ্ন হইয়া গেল। সপ্তমীর রাত্রে অমূল্য আসিয়া ধরিল, ছোটমা, যাত্রা হচ্ছে দেখতে যাব?

ছোটোমা বলিলেন, হচ্চে, না হবে রে?

অমূল্য বলিল, নরেনদা বলেচে, তিনটে থেকে শুরু হবে।

এখন থেকে সমস্ত রাত্তির হিমে পড়ে থাকবি? সে হবে না। কাল সকালে তোর কাকার সঙ্গে যাস, খুব ভাল জায়গা পাবি।

অমূল্য কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, না পাঠিয়ে দাও। কাকা হয়ত যাবেন না, নয়ত কত বেলায় যাবেন।

বিন্দু বলিল, তিনটে-চারটের সময় যাত্রা শুরু হলে চাকর দিয়ে পাঠিয়ে দেব, এখন শো।

অমূল্য রাগ করিয়া শয্যার এক প্রান্তে গিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইয়া রহিল।

বিন্দু টানিতে গেল, সে হাত সরাইয়া দিয়া শক্ত হইয়া পড়িয়া রহিল। তার পর কিছুক্ষণের নিমিত্ত সকলেই বোধ করি একটু ঘূমাইয়া পড়িয়াছিল। বাহিরের বড় ঘড়ির শব্দে অমূল্যর উদ্বিগ্ন-নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল, সে উৎকর্ণ হইয়া গণিতে লাগিল, একটা—দুটো—তিনটে—চারটে—ধড়ফড় করিয়া সে উঠিয়া বসিয়া বিন্দুকে সজোরে নাড়া দিয়া তুলিয়া দিয়া বলিল, ওঠ ওঠ ছোটমা, তিনটে চারটে বেজে গেলো—বাহিরের ঘড়িতে বাজিতে লাগিল—পাঁচটা—ছটা—সাতটা—আটটা—অমূল্য কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, সাতটা আটটা বেজে গেল, কখন যাব? বাহিরের ঘড়িতে তখনও বাজিতে লাগিল—নটা—দশটা—এগারটা—বারটা; বাজিয়া থামিল। অমূল্য নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিয়া শুইল। ঘরের ও-ধারের খাটের উপর মাধব শয়ন করিতেন, চেঁচামেচিতে তাঁহারও ঘুম ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।

উচ্চাহাস্য করিয়া তিনি বলিলেন, অমূল্য, কি হ’ল রে!

অমূল্য লজ্জায় সাড়া দিল না। বিন্দু হাসিয়া বলিল, ও যে করে আমাকে তুলেচে, ঘরে-দোরে আগুন ধরে গেলেও মানুষ অমন করে তোলে না। অমূল্য নিস্তব্ধ হইয়া আছে দেখিয়া তাহার দয়া হইল; সে বলিল, আচ্ছা যা, কিন্তু কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করিস নে।

তার পর ভৈরবকে ডাকিয়া আলো দিয়া পাঠাইয়া দিল। পরদিন বেলা দশটার সময় যাত্রা শুনিয়া হৃষ্টচিত্তে অমূল্য ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কাকাকে দেখিয়াই বলিল, কৈ, গেলেন না আপনি?

বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, কেমন দেখলি রে?

বেশ যাত্রা, ছোটমা। কাকা, আজ সন্ধ্যার সময় আবার চমৎকার খেমটার নাচ হবে।

কলকাতা থেকে দু’জন এসেচে, নরেনদা তাদের দেখেচে, ঠিক ছোটমার মত—খুব ভাল দেখতে—তারা নাচবে, বাবাকেও বলেচি।

বেশ করেচ, বলিয়া মাধব হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।

রাগে বিন্দুর সমস্ত মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল—তোমার গুণধর ভাগ্নের কথা শোন।

অমূল্যকে কহিল, তুই একবারও আর ওখানে যাবি না—হারামজাদা বজ্জাত! কে বললে আমার মত, নরেন?

অমূল্য ভয়ে ভয়ে বলিল, হাঁ সে দেখেচে যে।

কৈ নরেন? আচ্ছা, আসুক সে।

মাধব হাসি দমন করিয়া বলিলেন, পাগল তুমি! দাদা শুনেছেন, আর গোলমাল করো না। কাজেই বিন্দু কথাটা নিজের মধ্যে পরিপাক করিয়া রাগে পুড়িতে লাগিল।

সন্ধ্যার প্রাক্কালে অমূল্য আসিয়া অন্নপূর্ণাকে ধরিয়া বসিল, দিদি, পূজা-বাড়িতে নাচ দেখতে যাব। দেখে, এখনি ফিরে আসব।

অন্নপূর্ণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বলিলেন, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর গে!

অমূল্য জিদ করিতে লাগিল, না দিদি, এখ্‌খনি ফিরে আসব, তুমি বল, যাই।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, না রে না, সে রাগী মানুষ, তাকে বলে যা।

অমূল্য কাঁদিতে লাগিল, কাপড় ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল—তুমি ছোটমাকে বলো না।।আমি নরেনদার সঙ্গে যাই—এখনি ফিরে আসব।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, নরেনের সঙ্গে যদি যাস ত—

অমূল্য কথাটা শেষ করিবারও সময় দিল না, এক দৌড়ে বাহির হইয়া গেল।

ঘণ্টা-খানেক পরে অন্নপূর্ণার কানে গেল, বিন্দু খোঁজ করিতেছে। তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।খোঁজাখুঁজি ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। তখন তিনি বাহিরে আসিয়া বলিলেন, কি নাচ হবে, নরেনের সঙ্গে তাই দেখতে গেছে,—এখনি ফিরে আসবে, তোর কোন ভয় নেই।

বিন্দু কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে যেতে বলেছে, তুমি?

অমূল্য যে সম্মতি না লইয়াই গিয়াছে, এ কথা অন্নপূর্ণা ভয়ে স্বীকার করিতে পারিলেন না, বলিলেন, এখনি আসবে।

বিন্দু মুখ অন্ধকার করিয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে অমূল্য বাড়ি ঢুকিয়া যাই শুনিল ছোটমা ডাকিতেছে, সে গিয়া তাহার পিতার শয্যার একধারে শুইয়া পড়িল।

প্রদীপের আলোকে বসিয়া চোখে চশমা আঁটিয়া যাদব ভাগবত পড়িতেছিলেন, মুখ তুলিয়া বলিলেন, কি রে অমূল্য?

অমূল্য সাড়া দিল না।

কদম আসিয়া বলিল, ছোটমা ডাকছেন, এস।

অমূল্য তাহার পিতার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, বাবা, তুমি দিয়ে আসবে চল না।

যাদব বিস্মিত হইয়া বলিলেন, আমি দিয়ে আসব? কি হয়েছে কদম?

কদম বুঝাইয়া বলিল।

যাদব বুঝিলেন, এই লইয়া একটা কলহ অবশ্যম্ভাবী। একজন নিষেধ করিয়াছে, একজন হুকুম দিয়াছে। তাই অমূল্যকে সঙ্গে করিয়া ছোটবধূর ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া ডাকিয়া বলিলেন, এইবারটি মাপ কর মা, ও বলচে আর করবে না।

সেই রাত্রে দুই জায়ে আহারে বসিলে বিন্দু বলিল, আমি তোমার উপর রাগ কচ্চিনে দিদি, কিন্তু এখানে আমার আর থাকা চলবে না—অমূল্য তা হলে একেবারে বিগড়ে যাবে। আমি যদি মানা না করতুম, তা হলেও একটা কথা ছিল; কিন্তু নিষেধ করা সত্ত্বেও, এত বড় সাহস ওর হল কি করে, তখন থেকে আমি শুধু এই কথাই ভাবচি। তার ওপর বজ্জাতি বুদ্ধি দেখ! আমার কাছে যায়নি, এসেছে তোমার কাছে; বাড়ি ফিরে যাই শুনেচে আমি ডাকচি, অমনি গিয়ে বঠ্‌ঠাকুরকে সঙ্গে করে এনেচে। না দিদি, এতদিন এ-সব ছিল না—আমি বরং কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকব সেও ভাল, কিন্তু এক ছেলে—ব’য়ে যাবে, তাকে নিয়ে সারা জীবন আমি চোখের জলে ভাসতে পারব না।

অন্নপূর্ণা উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, তোরা চলে গেলে আমিই বা কি করে একলা থাকি বল্‌!

বিন্দু ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সে তুমি জান। আমি যা করব, তোমাকে বলে দিলুম। বড় মন্দ ছেলে ঐ নরেন।

কেন, কি করলে নরেন? আর মনে কর, ওরা যদি দুটি ভাই হ’ত, তা হলে কি কত্তিস?

বিন্দু বলিল, আজ তা হলে চাকর দিয়ে হাত-পা বেঁধে জলবিছুটি দিয়ে বাড়ি থেকে দূর করে দিতুম। তা ছাড়া, ‘যদি’ নিয়ে কাজ হয় না, দিদি—ওদের তুমি ছাড়।

অন্নপূর্ণা মনে মনে বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, ছাড়া না ছাড়া কি আমার হাতে ছোটবৌ? যে ওদের এনেচে, তাকে বল গে। আমাকে মিথ্যে গঞ্জনা দিসনে।

এ-সব কথা বঠ্‌ঠাকুরকে বলব কি করে?

যেমন করে সব কথা বলিস—তেমনি করে বল গে।

বিন্দু ভাতের থালাটা ঠেলিয়া দিয়া বলিল, ন্যাকা বুঝিয়ো না দিদি, আমারো সাতাশ-আটাশ বছর বয়স হতে চলল। এ বাড়ির দাসী-চাকর নিয়ে কথা নয়, কথা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে—তুমি বেচেঁ থাকতে এ-সব কথায় কথা বলতে গেলে বঠ্‌ঠাকুর রাগ করবেন না?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, রাগ নিশ্চয়ই করবেন, কিন্তু আমি বললে আমার আর মুখ দেখবেন না। হাজার হই আমরা পর, ওরা ভাই-বোন—সেটা দেখিস না কেন? তা ছাড়া আমি বুড়ো মাগী, এই তুচ্ছ কথা নিয়ে নেচে বেড়ালে লোকে পাগল বলবে না?

বিন্দু ভাতের থালাটা হাত দিয়া আরো খানিকটা ঠেলিয়া দিয়া গুম হইয়া বসিয়া রহিল।

অন্নপূর্ণা বুঝিলেন, সে কেবল ভাশুরের ভয়ে চুপ করিয়া গেল। বলিলেন, হাত তুলে বসে রইলি—ভাতের থালাটা কি অপরাধ করলে?

বিন্দু হঠাৎ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।

অন্নপূর্ণা তাহার ভাব দেখিয়া আর জিদ করিতে সাহস করিলেন না।

শুইতে গিয়া বিন্দু বিছানায় অমূল্যকে দেখিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, সে গেল কোথায়?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, আজ দেখচি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্চে—যাই, তুলে দিই গে।

না না, থাক, বলিয়া বিন্দু মুখ অন্ধকার করিয়া চলিয়া গেল।

অর্ধেক রাত্রে, বিন্দুর সতর্ক নিদ্রা অন্নপূর্ণার ডাকে ভাঙ্গিয়া গেল।

কি দিদি?

অন্নপূর্ণা বাহির হইতে বলিলেন, দোর খুলে তোর ছেলে নে। এত বজ্জাতি আমার বাবা এলেও সইতে পারবে না।

বিন্দু দোর খুলিয়া দিতেই তিনি অমূল্যকে সঙ্গে করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই বলিলেন, ঢের হারামজাদা ছেলে দেখেচি ছোটবৌ, এমনটি দেখিনি। রাত্তির দুটো বাজে, একবার চোখে পাতায় কত্তে দিলে না। এই বলে খিদে পেয়েচে, এই বলে মশা কামড়াচ্চে, এই বলে জল খাব, এই বলে বাতাস কর—না ছোটবৌ, আমি সমস্তদিন খাটিখুটি, রাত্রিতে একটু ঘুমোতে না পেলে ত বাঁচিনে।

বিন্দু হাসিয়া হাত বাড়াইতেই অমূল্য তাহার ক্রোড়ের ভিতর গিয়া ঢুকিল এবং বুকের উপর মুখ রাখিয়া এক মিনিটের মধ্যে ঘুমাইয়া পড়িল।

মাধব ওদিকে বিছানা হইতে পরিহাস করিয়া কহিলেন, শখ মিটল বৌঠান?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, আমি শখ করিনি ভাই, উনিই নিজ়ে মারের ভয়ে ওখানে গিয়ে ঢুকেছিলেন। তবে আমারও শিক্ষা হ’ল বটে। আর কি ঘেন্নার কথা ঠাকুরপো, আমাকে বলে কিনা তোমার কাছে শুতে লজ্জা করে।

তিনজনেই হাসিয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা বলিলেন, আর না, যাই একটু ঘুমোই গে, বলিয়া চলিয়া গেলেন।

দিন-দশেক পরে বিন্দুর বাপ-মা তীর্থযাত্রার সঙ্কল্প করিয়া মেয়েকে একবার দেখিবার জন্য পালকি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। বিন্দু বড় জায়ের অনুমতি লইয়া দু-তিন দিনের জন্য অমূল্যকে লুকাইয়া বাপের বাড়ি যাইবার জন্য উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময় বই বগলে করিয়া ইস্কুলের জন্য প্রস্তুত হইয়া অমূল্য আসিয়া উপস্থিত হইল।

অনতিপূর্বে সে বাহিরে পথের ধারে একটা পালকি দেখিয়া আসিয়াছিল; এখন হঠাৎ পায়ের দিকে নজর পড়িতেই সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, পায়ে আলতা পরেচ কেন ছোটমা?

অন্নপূর্ণা উপস্থিত ছিলেন, হাসিয়া ফেলিলেন।

বিন্দু বলিল, আজ পরতে হয়।

অমূল্য বার বার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, গায়ে এত গয়না কেন?

অন্নপূর্ণা মুখে আঁচল দিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

বিন্দু হাসি চাপিয়া বলিল, কবে তোর বৌ এসে পরবে বলে আমাদের কাউকে কিছু পরতে নেই রে! যা, ইস্কুলে যা।

অমূল্য সে কথা কানে না তুলিয়া বলিল, দিদি অত হাসচে কেন? আমি ত আর ইস্কুলে যাব না—তুমি কোথায় যাবে

বিন্দু বলিল, তাই যদি যাই, তোর হুকুম নিতে হবে নাকি?

আমিও যাব, বলিয়া সে বই লইয়া বাহিরে চলিয়া গেল।

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ও যে অত সহজে ইস্কুলে যাবে, মনে করিনি। কিন্তু কি সেয়ানা দেখেছিস, বলে আলতা পরেচ কেন? গায়ে অত গয়না কেন? কিন্তু আমি বলি নিয়ে যা—নইলে ফিরে এসে তোকে দেখতে না পেলে ভারি হাঙ্গামা করবে।

বিন্দু বলিল, তুমি কি মনে করেচ দিদি, সে ইস্কুলে গেছে? কক্ষণো না। কোথায় লুকিয়ে বসে আছে, দেখো, ঠিক সময়ে হাজির হবে।

ঠিক তাহাই হইল। সে লুকাইয়া ছিল, বিন্দু অন্নর্পূণার পায়ের ধূলা লইয়া পালকিতে উঠিবার সময় কোথা হইতে বাহির হইয়া তাহার আঁচল ধরিয়া দাঁড়াইল। দুই জায়েই হাসিয়া উঠিলেন।

অন্নর্পূণা বলিলেন, যাবার সময় আর মারধর করিস্‌ নে, নিয়ে যা।

বিন্দু বলিল, তা যেন গেলুম দিদি, কিন্তু কোথাও যে আমার এক-পা নড়বার জো নাই, এ ত বড় বিপদের কথা!

অন্নর্পূণা বলিলেন, যেমন করেচিস, তেমনি হবে তো! অমূল্য, থাক না তুই দু’দিন আমার কাছে।

অমূল্য মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, তোমার কাছে থাকতে পারব না। বলিয়া আগেই সে পালকিতে গিয়া বসিল।

.

ছয়

বিন্দু বাপের বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিবার দিন-দশেক পরে একদিন মধ্যাহ্নে অন্নর্পূণা তাহার ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিলেন, ছোটবৌ?

ছোটবৌ একরাশ ময়লা কাপড়-জামার সুমুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল।

অন্নর্পূণা বলিলেন, ধোপা এসেছে?

ছোটবৌ কথা কহিল না। অন্নর্পূণা এইবার তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া ভয় পাইলেন। উদ্বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হয়েছে রে?

বিন্দু আঙুল দিয়া ছোট ছোট দুই টুকরো পোড়া সিগারেট দেখাইয়া দিয়া বলিল, অমূল্যর জামার পকেট থেকে বেরুল।

অন্নর্পূণা নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

বিন্দু সহসা কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, তোমার দুটি পায়ে পড়ি দিদি, ওদের বিদেয় কর, না হয়, আমাদের কোথায় পাঠিয়ে দাও।

অন্নর্পূণা জবাব দিতে পারিলেন না। আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চলিয়া গেলেন।

অপরাহ্নে অমূল্য ইস্কুল হইতে ফিরিয়া খাবার খাইয়া খেলা করিতে গেল। বিন্দু একটি কথাও বলিল না। ভৈরব চাকর নালিশ করিতে আসিল, নরেনবাবু বিনা দোষে তাহাকে চপেটাঘাত করিয়াছে।

বিন্দু বিরক্ত হইয়া বলিল, দিদিকে বল গে।

আদালত হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাধব কাপড় ছাড়িতে ছাড়িতে কি একটা ক্ষুদ্র পরিহাস করিতে গিয়া ধমক খাইয়া চুপ করিল। অদৃশ্যে যে কতবড় ঝড় ঘনাইয়া উঠিতেছে, বাড়ির মধ্যে তাহা কেবল অন্নপূর্ণাই টের পাইলেন। উৎকন্ঠায় সমস্ত সন্ধ্যাটা ছটফট করিয়া, এক সময়ে নির্জনে পাইয়া তিনি ছোটবৌয়ের হাতখানি ধরিয়া ফেলিয়া মিনতির স্বরে বলিলেন, হাজার হোক, সে তোরই ছেলে, এইবারটি মাপ কর।বরং আড়ালে ডেকে ধমক দে।

বিন্দু বলিল, আমার ছেলে নয়, সে কথা আমিও জানি, তুমিও জান। মিছামিছি কতকগুলো কথা বাড়িয়ে দরকার কি, দিদি?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, আমি নয়, তুই তার মা—আমি তোকেই ত দিয়েচি!

যখন ছোট ছিল, খাইয়েছি পরিয়েছি। এখন বড় হয়েচে, তোমাদের ছেলে তোমরা নাও—আমাকে রেহাই দাও, বলিয়া বিন্দু চলিয়া গেল।

রাত্রে কাঁদ-কাঁদ মুখে অমূল্য অন্নপূর্ণার কাছে শুইতে আসিল।

অন্নপূর্ণা ব্যাপার বুঝিয়া বিরক্ত হইয়া বলিলেন, এখানে কেন? যা এখান থেকে—যা বলচি।

অমূল্য ফিরিয়া দেখিল, তাহার পিতা ঘুমাইতেছেন, সে কোন কথাটি না বলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল।

সকালবেলা কদম রান্নাঘরে এঁটো বাসন তুলিতে আসিয়া দেখিল, বারান্দার এক কোণে কতগুলো কাঠ-ঘুঁটের উপর অমূল্য পড়িয়া ঘুমাইতেছে। সে ছুটিয়া গিয়া বিন্দুকে তুলিয়া আনিল। অন্নপূর্ণাও ঘুম ভাঙ্গিয়া বাহিরে আসিয়াছিলেন, কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

বিন্দু তীক্ষ্ণভাবে বলিল, রাত্রে বড়গিণ্ণী বুঝি তাড়িয়ে দিয়েছিলে? ও থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত হয়, না?

ছেলের অবস্থা দেখিয়া ক্ষোভে দুঃখে তাঁহার নিজের চোখেও জল আসিতেছিল, কিন্তু বিন্দুর নিষ্ঠুর তিরস্কারে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন, নিজের দোষ তুই পরের ঘাড়ে তুলে দিতে পারলেই বাঁচিস।

বিন্দু ছেলেকে তুলিতে গিয়া দেখিল, তাহার গা গরম—জ্বর হইয়াছে। কহিল, সারারাত, কার্তিক মাসের হিমে-জ্বর হবেই ত। এখন ভাল হলে বাঁচি।

অন্নপূর্ণা ব্যগ্র হইয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিলেন, জ্বর হয়েচে—কৈ দেখি!

বিন্দু সজোরে তাঁহার হাত ঠেলিয়া দিয়া বলিল, থাক, আর দেখে কাজ নেই। বলিয়া ঘুমন্ত ছেলেকে স্বচ্ছন্দে কোলে তুলিয়া লইয়া অন্নপূর্ণার প্রতি একবার বিষ-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল।

পাঁচ-ছয় দিনেই অমূল্য আরোগ্য হইয়া উঠিল বটে, কিন্তু বড়জায়েব অপরাধটা বিন্দু মার্জনা করিল না। সেইদিন হইতে সে ভাল করিয়া কথা পর্যন্ত বলিত না।

অন্নপূর্ণা মনে মনে সমস্তই বুঝিলেন, অথচ তিনিও মৌন হইয়া রহিলেন। সকলের সম্মুখে সমস্ত অপরাধ বিন্দু যে তাহারি উপর তুলিয়া দিয়াছে, এ অন্যায় তিনিও ভুলিতে পারিলেন না। এইটিই একদিন কি একটা কথার পর তিনি এলোকেশীর কাছে বলিয়া ফেলিলেন, ওর জ্বর ত ছোটবৌয়ের জন্যেই। ও যে মরেনি, এই ওর ভাগ্যি।

কথাটা এলোকেশী বিন্দুর গোচর করিতে লেশমাত্র বিলম্ব করিলেন না। বিন্দু মন দিয়া শুনিল, কিন্তু কথা কহিল না। সে যে শুনিয়াছে, তাহাও এলোকেশী ভিন্ন আর কেহ জানিল না। বিন্দু বড়জায়ের সহিত একেবারে কথাবার্তা বন্ধ করিয়া দিল।

কয়েকদিন হইতে নূতন বাটীতে জিনিস-পত্র সরানো হইতেছিল, কাল সকালেই উঠিয়া যাইতে হইবে। যাদব ছেলেদের লইয়া সে বাড়িতে ছিলেন, মাধব মকদ্দমা উপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন; তিনিও ছিলেন না। ইতিমধ্যে এ-বাড়িতে এক বিষম কান্ড ঘটিল। সন্ধ্যার সময় মাষ্টার পড়াইতে আসিয়াছিল, কি মনে করিয়া বিন্দু তাহাকে ডাকাইয়া পাঠাইল। বলিল, কাল থেকে ও-বাড়িতে গিয়ে পড়াবেন।

মাস্টার যে আজ্ঞা বলিয়া চলিয়া যাইতেছিল, বিন্দু প্রশ্ন করিল, আপনার ছাত্রটি আজকাল পড়ে কেমন?

মাস্টার বলিল, লেখাপড়ায় সে বরাবরই ভাল, প্রতিবারেই ত প্রথম হয়।

বিন্দু কহিল, তা হয়। কিন্তু আজকাল চুরুট খেতে শিখেচে যে!

মাস্টার বিস্মিত হইয়া বলিল, চুরুট খেতে শিখেচে?

পরক্ষণে নিজেই বলিল, আশ্চর্য নয়, ছেলেরা সমস্তই দেখাদেখি শেখে।

কার দেখে শিখেচে?

মাস্টার চুপ করিয়া রহিল। বিন্দু বলিল, ওর বাবাকে ও-কথা জানাবেন।

মাস্টার মাথা নাড়িয়া বলিল, এই দেখুন না, আজ পাঁচ-সাতদিনের কথা, ইস্কুলের পথে এক উড়ে মালীর বাগানে ঢুকে তার অসময়ের আম পেড়ে, গাছ ভেঙ্গে, তাকে মারধর করে এক কান্ড করেছে।

বিন্দু রুদ্ধ-নিশ্বাসে বলিল, তারপর?

উড়ে হেডমাস্টারকে বলে দেয়, তিনি দশ টাকা জরিমানা করিয়া তাকে তা দিয়ে শান্ত করেচেন।

বিন্দু বিশ্বাস করিতে পারিল না। বলিল, আমার অমূল্য ছিল? সে টাকা পাবে কোথায়?

মাস্টার কহিল, তা জানি না, কিন্তু সেও ছিল। এ-বাড়ির নরেনবাবুও ছিল, আরও তিন-চারজন ইস্কুলের বদমাস ছেলে ছিল। এই কথা আমি হেডমাস্টার মশায়ের কাছে শুনেচি।

বিন্দু বলিল, টাকাও আদায় হয়ে গেছে?

আজ্ঞে হাঁ, তাও শুনেচি।

আচ্ছা—আপনি যান। বলিয়া বিন্দু সেইখানেই বসিয়া রহিল। তার মুখ দিয়া শুধু অস্ফুটে বাহির হইল, আমাকে না জানিয়ে টাকা দিলে, এত সাহস এ বাড়িতে কার? একে তাহার মন খারাপ, তাহাতে দিদির সহিত কথাবার্তা বন্ধ, তাহার উপর এই সংবাদ বিন্দুকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য করিয়া তুলিল।

সে উঠিয়া গিয়া রান্নাঘরে ঢুকিল। অন্নপূর্ণা রাত্রির জন্য তরকারি কুটিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া ছোটবৌয়ের মেঘাচ্ছন্ন মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন।

বিন্দু কহিল, দিদি, এর মধ্যে অমূল্যকে টাকা দিয়েচ?

অন্নপূর্ণা ঠিক এই আশঙ্কাই করিতেছিলেন, ভয়ে তাঁহার গলা কাঠ হইয়া গেল; মৃদুস্বরে বলিলেন, কে বললে?

বিন্দু বলিল, সেটা দরকারী কথা নয়—দরকারী কথা, সেই বা কি বলে নিলে, আর তুমিই বা কি বলে দিলে?

অন্নপূর্ণা নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

বিন্দু বলিল, তুমি চাও না যে, আমি তাকে শাসন করি, সেইজন্যই আমাকে লুকিয়েচ। অমূল্য আর যাই করুক, মিথ্যে কথা গুরুজনের কাছে বলবে না, তুমি জেনেশুনে দিয়েচ, সত্যি কি না?

অন্নপূর্ণা আস্তে আস্তে বলিলেন, সত্যি, কিন্তু এইবারটি তাকে মাপ কর বোন, আমি মাপ চাচ্ছি।

বিন্দুর বুকের ভিতর পুড়িয়া যাইতেছিল, বলিল, একটিবার! আজ থেকে চিরকালের জন্যই মাপ করলুম। আর বলব না। আর কথা ক’ব না। সে যে এমনি করে চোখের সামনে একটু একটু করে উচ্ছন্ন যাবে, তা সইতে পারব না—তার চেয়ে একেবারে যাক। কিন্তু তোমার কি আস্পর্ধা!

শেষ-কথাটা অন্নপূর্ণাকে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধিল, তথাপি তিনি নিরুত্তরে বসিয়া রহিলেন। কিন্তু বিন্দু যত বকিতেছিল, তাঁহার ক্রোধ উত্তরোত্তর ততই বাড়িতেছিল। সে পুনরায় চেঁচাইয়া বলিল, সব কথায় তুমি ন্যাকা সেজে বল, এইবারটি মাপ কর, কিন্তু দোষ তার তত নয়, যত তোমার। তোমাকে আমি মাপ করব না।

পাটীর দাসী-চাকরেরাও আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল।

অন্নপূর্ণার আর সহ্য হইল না, তিনি বলিলেন, কি করবি—ফাঁসি দিবি?

বহ্নিতে আহুতি পড়িল, বিন্দু বারুদের মত জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, সেই তোমার উপযুক্ত শাস্তি।

নিজের ছেলেকে দুটো টাকা দিয়েছি, এই ত অপরাধ?

কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়িল, বিন্দু আসল কথা ভুলিয়া বলিয়া বসিল, তাই বা দেবে কেন? নষ্ট করবার টাকা আসে কোথা থেকে?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, টাকা তুই নষ্ট করিস নে?

আমি করি আমার টাকা, তুমি নষ্ট কর কার টাকা শুনি?

অন্নপূর্ণা এবার ভয়ঙ্কর ক্রদ্ধ হইয়া উঠিলেন। তিনি নিঃস্ব ঘরের মেয়ে ছিলেন। মনে করিলেন, বিন্দু সেই ইঙ্গিতই করিয়াছে। দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, তুই না হয় মস্ত বড় লোকের মেয়ে, কিন্তু তাই বলে আর কেউ যে দুটো টাকাও দিতে পারে না, সে অহঙ্কার করিস নে।

বিন্দু বলিল, সে অহঙ্কার আমি করিনে, কিন্তু তুমিও ভেবে দেখো একটা পয়সাও দিতে গেলে তুমি কার পয়সা দাও।

অন্নপূর্ণা চেঁচাইয়া উঠিলেন, কার পয়সা দিই? তোর যা মুখে আসে তাই বলিস? যা, দূর হয়ে যা সামনে থেকে।

বিন্দু বলিল, দূর—আমি রাত পোহালেই হব, কিন্তু কার পয়সা খরচ কর, সেটা দেখতে পাও না? কার রোজগারে খাচ্চ-পরচ, সেটা জান না?

হঠাৎ কথাটা বলিয়া ফেলিয়া বিন্দু স্তব্ধ হইয়া থামিল।

অন্নপূর্ণার মুখ সাদা হইয়া গিয়াছিল। তিনি ক্ষণকাল নির্নিমেষ-চোখে ছোটবৌয়ের মুখের প্রতি চাহিয়া বলিলেন, তোমার স্বামীর রোজগারে খাচ্চি-পরচি। আমি তোমার দাসী-বাঁদী, উনি তোমার চাকর-বাকর। এই না তোর মনের কথা? তা এতদিন বলিস নি কেন?

তাঁহার ওষ্ঠাধর বারংবার কাঁপিয়া উঠিল। তিনি দাঁত দিয়া অধর চাপিয়া ধরিয়া এক-মুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিলেন, কোথা ছিলি ছোটোবৌ যখন ছোটভাইকে পড়াবার জন্যে ও দু’খানি কাপড় একসঙ্গে কিনে পরেনি। কোথা ছিলি তুই, যখন ঘড় পুড়ে গেলে গাছতলায় একবেলা রেঁধে খেয়ে এই পৈতৃক ভিটেটুকু খাড়া করেছিল?

বলিতে বলিতেই তাঁহার দুই চোখ দিয়া দরদর করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল। আঁচল দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ও যদি জানত তোদের মনের কথা, কখনো এমন আফিং খেয়ে চোখ বুজে হুঁকোর নল মুখে দিয়ে আরামে দিন কাটাতে পারত না—সে লোক ও নয়। ওকে জানে তোর স্বামী, ওকে জানে স্বর্গের দেবতারা। আজ আমার ছুতো করে তুই তাঁকে অপমান করলি?

স্বামী-অভিমানে অন্নপূর্ণার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। বলিলেন, ভালই হল, জানিয়ে দিলি। সতী আত্মহত্যা করেছিল, আমিও দিব্যি কচ্চি, বরং পরের বাড়ি রেঁধে খাব, তবুও তোদের ভাত আর খাব না। তুই কি করলি—ওঁকে অপমান করলি!

ঠিক এই সময়ে যাদব প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, বড়বৌ!

স্বামীর কণ্ঠস্বরে তাঁহার অভিমান ঝটিকা-ক্ষুব্ধ সাগরের মত উত্তাল হইয়া উঠিল, ছুটিয়া বাহিরে আসিয়া বলিলেন, ছি ছি, যে লোক নিজের মাগ-ছেলেকে খেতে দিতে পারে না—তার গলায় দেবার দড়ি জোটে না কেন?

যাদব হতবুদ্ধি হইয়া গিয়া বলিলেন, কি হ’ল গো?

কি হ’ল? কিচ্ছু না। ছোটবৌ আজ স্পষ্ট করে বলে দিলে, আমি তার দাসী, তুমি তার চাকর।

ঘরের ভিতর বিন্দু জিভ কাটিয়া কানে আঙুল দিল।

অন্নপূর্ণা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, আমার একটা পয়সা কাউকে হাত তুলে দেবার অধিকার নেই—তুমি বেঁচে থাকতেও আজ আমাকে এ কথা শুনতে হল। আজ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে এই শপথ কচ্চি, ওদের ভাত খাবার আগে যেন আমাকে ব্যাটার মাথা খেতে হয়।

বিন্দুর অবরুদ্ধ কর্ণরন্ধ্রে এ কথা অস্পষ্ট হইয়া প্রবেশ করিল; সে অস্ফুটে ‘কি করলে দিদি’ বলিয়া সেইখানেই ঘাড় গুঁজিয়া আজ দ্বাদশ বর্ষ পরে অকস্মাৎ মূর্ছিত হইয়া পড়িল।

.

সাত

নূতন বাড়িতে যাদব, অন্নপূর্ণা ও অমুল্য ব্যতীত আর সকলেই আসিয়াছিল। বাহির হইতে বিন্দুর পিসি, পিসির মেয়ে, নাতি-নাতনি, বাপের বাড়ি হইতে তাহার বাপ-মা, তাঁহাদের দাস-দাসী প্রভৃতিতে সমস্ত গৃহ পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এখানে আসিবার দিনটাতেই শুধু বিন্দুকে কিছু বিমনা দেখাইয়াছিল, কিন্তু পরদিন হইতেই সে ভাব কাটিয়া গেল। রাগ পড়িলেই অন্নপূর্ণা আসিবেন, ইহাতে বিন্দুর লেশমাত্র সংশয় ছিল না। এখানে পূজা দিয়া লোকজন খাওয়াইতে হইবে, সে তাহারই উদ্যোগ-আয়োজনে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

বিন্দুর বাপ জিজ্ঞাসা করিলেন, মা, তোর ছেলেকে দেখছি নে যে?

বিন্দু সংক্ষেপে কহিল, সে ও-বাড়িতে আছে।

মা প্রশ্ন করিলেন, তোর জা বুঝি আসতে পারলেন না?

বিন্দু কহিল, না।

তিনি নিজেই তখন বলিলেন, সবাই এলে ও-বাড়িতেই বা থাকে কে? পৈতৃক ভিটে বন্ধ করেও ত রাখা চলে না।

বিন্দু চুপ করিয়া কাজে চলিয়া গেল।

যাদব এ-কয়দিন প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় একবার করিয়া বাহিরে আসিয়া বসিতেন, কথাবার্তা বলিয়া সংবাদ লইয়া ফিরিয়া যাইতেন, কিন্তু ভিতরে ঢুকিতেন না। গৃহপূজার পূর্বের রাত্রে তিনি ভিতরে ঢুকিয়া এলোকেশীকে ডাকিয়া তত্ত্ব লইতেছিলেন, বিন্দু জানিতে পারিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল। পিতার অধিক এই ভাশুরের কাছে ছেলেবেলা হইতে সেদিন পর্যন্ত সে কত আদর পাইয়াছে, কত স্নেহের ডাক শুনিয়াছে, যাদব ‘মা’ বলিয়া ডাকিতেন, কোনদিন ‘বৌমা’ পর্যন্ত বলেন নাই, এই ভাশুরের কাছে জায়ের সহিত কলহ করিয়া কত নালিশ করিয়াছে, কোনটি তাহার কোনদিন উপেক্ষিত হয় নাই, আজ তাঁহার কাছে অপরিসীম লজ্জায় বিন্দুর কণ্ঠরোধ হইয়া গেছে। যাদব চলিয়া গেলেন। সে নিভৃতে ঘরের মধ্যে মুখে আঁচল গুঁজিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল—চারিদিকে লোক, পাছে কেহ শুনিতে পায়।

পরদিন সকালবেলা বিন্দু স্বামীকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিল, বেলা হচ্চে, পুরুত বসে আছেন—বঠ্‌ঠাকুর এখনো ত এলেন না!

মাধব বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কেন?

বিন্দু ততোধিক বিস্মিত হইয়া বলিল, তিনি কেন? তিনি ছাড়া এ-সব করবে কে?

মাধব বলিল, হয় আমি, না হয় ভগ্নীপতি প্রিয়বাবু করবেন। দাদা আসতে পারবেন না।

বিন্দু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, আসতে পারবেন না বললেই হ’ল? তিনি থাকতে কি কারো অধিকার আছে? না না, সে হবে না—তিনি ছাড়া আমি কাউকে কিছু করতে দেব না।

মাধব বলিল, তবে বন্ধ থাক। তিনি বাড়ি নেই, কাজে গেছেন।

এ-সমস্ত বড়গিন্নীর মতলব! তা হলে সেও আসবে না দেখচি। বলিয়া বিন্দু কাঁদ-কাঁদ হইয়া চলিয়া গেল। তাহার কাছে পূজা-অর্চনা, উৎসব-আয়োজন, খাওয়ান-দাওয়ান, সমস্তই একমুহূর্তে একেবারে মিথ্যা হইয়া গেল। তিনদিন ধরিয়া অনুক্ষণ সে এই চিন্তাই করিয়াছে, আজ বঠ্‌ঠাকুর আসিবেন, দিদি আসিবেন, অমূল্য আসিবে। আজিকার সমস্তদিনব্যাপী কাজকর্মের উপর সে যে মনে মনে তাহার কতখানি নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া ছিল, সে কথা সে ছাড়া আর কেহই জানিত না। স্বামীর একটা কথায় সে-সমস্ত মরীচিকার মত অন্তর্ধান হইয়া যাইবামাত্রই উৎসবের বিরাট পণ্ডশ্রম পাষাণের মত তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিল।

এলোকেশী আসিয়া বলিলেন, ভাঁড়ারের চাবিটা একবার দাও ছোটবৌ, ময়রা সন্দেশ নিয়ে এসেচে।

বিন্দু ক্লান্তভাবে বলিল, ঐখানে কোথাও এখন রাখ ঠাকুরঝি, পরে হবে।

কোথায় রাখব বৌ, কাকে-টাকে মুখ দেবে যে!

তবে ফেলে দাও গে, বলিয়া বিন্দু অন্যত্র চলিয়া গেল।

পিসিমা আসিয়া বলিলেন, হাঁ বিন্দু, এ-বেলা কতখানি ময়দা মাখবে, একবার যদি দেখিয়ে দিতিস।

বিন্দু মুখ ভার করিয়া বলিল, কতখানি মাখবে তার আমি কি জানি? তোমরা গিন্নী-বান্নী, তোমরা জান না?

পিসিমা অবাক হইয়া বলিলেন, শোন কথা! কত লোক তোদের এ-বেলা খাবে, আমি তার কি জানি?

বিন্দু রাগিয়া বলিল, তবে বল গে ওঁকে। সে ছিল দিদি; অমূল্যধনের পৈত্যের সময় তিনদিন ধরে শহরের সমস্ত লোক খেলে, তা একবার বলেনি, ছোটবৌ ওটা কর্‌ গে, সেটা দেখ্‌ গে! তার একটা হাড়ের যা যোগ্যতা, এ বাড়ির সমস্ত লোকের তা নেই। বলিয়া আর একটা ঘরে চলিয়া গেল।

কদম আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, দিদি, জামাইবাবু বলচেন পূজোর কাপড়-চোপড়গুলো—

তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই বিন্দু চেঁচাইয়া উঠিল, খেয়ে ফ্যাল্‌ আমাকে, তোরা খেয়ে ফ্যাল্‌! যা দূর হ সামনে থেকে।

কদম শশব্যস্তে পলায়ন করিল।

খানিক পরে মাধব আসিয়া কয়েকবার ডাকাডাকি করিয়া বলিল, ওগো শুনতে পাচ্ছ?

বিন্দু কাছে সরিয়া আসিয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিয়া উঠিল, পাচ্ছি না। আমি পারব না। পারব না। পারব না! হ’ল?

মাধব অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।

বিন্দু বলিল, কি করবে? আমার গলায় ফাঁসি দেবে? না হয় তাই দাও, বলিয়া কাঁদিয়া দ্রুতপদে সরিয়া গেল।

বেলা বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।

বিন্দু বিনা কাজে ছটফট করিয়া এ-ঘর ও-ঘর করিয়া কেবলি লোকের দোষ ধরিয়া বেড়াইতে লগিল। কে তাড়াতাড়ি পথের উপর কতকগুলো বাসন রাখিয়া গিয়াছিল, বিন্দু টান মারিয়া সেগুলো উঠানের উপর ফেলিয়া দিয়া, কি করিয়া কাজ করিতে হয় শিখাইয়া দিল; কার ভিজা কাপড় শুকাইতেছিল, উড়িয়া তাহার গায়ে লাগিবামাত্র টানিয়া খন্ড খন্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া, কি করিয়া কাপড় শুকাইতে হয়, বুঝাইয়া দিল। যে কেহ তাহার সামনে পড়িল, সে-ই সভয়ে পাশ কাটাইয়া দাঁড়াইল।

পুরোহিত-বেচারা নিজে ভিতরে আসিয়া বলিলেন, তাই ত! বেলা বাড়তে লাগল—কোন বিলি-ব্যবস্থাই দেখিনে।—

বিন্দু আড়ালে দাঁড়াইয়া কড়া করিয়া জবাব দিল, কাজকর্মের বাড়িতে বেলা একটু হয়ই।বলিয়া আর একটা বাসন পা দিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া আর একটা ঘরের মেঝের উপর নির্জীবের মত বসিয়া রহিল। মিনিট-দশেক পরে হঠাৎ তাহার কানে একটা পরিচিত কণ্ঠের শব্দ যাইবামাত্রই সে ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া দরজা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল, অন্নপূর্ণা আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইলেন।

বিন্দু দুঃখে অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া সশব্দে সুমুখে আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, বেলা দশটা-এগারটা বাজে,আর কত শত্রুতা করবে দিদি? আমি বিষ খেলে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় ত তাই না হয় বাড়ি গিয়ে এক বাটি পাঠিয়ে দাও। বলিয়া চাবিব গোছাটা ঝনাৎ করিয়া তাঁহার পায়ের নীচে ফেলিয়া দিয়া নিজের ঘরে গিয়া দোর দিয়া মাটির উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।

অন্নর্পূণা নিঃশব্দে চাবির গোছা তুলিয়া লইয়া দোর খুলিয়া ভাঁড়ারে গিয়া ঢুকিলেন।

অপরাহ্নে লোকজনের যাতায়াত, খাওয়ানো-দাওয়ানো ভিড় কমিয়া গিয়াছিল; তবুও বিন্দু কিসের জন্য কেবলি অস্থির হইয়া ঘর-বার করিতে লাগিল।

ভৈরব আসিয়া বলিল, অমূল্যবাবু ইস্কুলে নেই।

বিন্দু তাহার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, হতভাগা! ছেলেরা রাত্রি পর্যন্ত ইস্কুলে থাকে? নূতন লোক তুমি? ও-বাড়িতে গিয়ে একবার দেখতে পারনি?

ভৈরব বলিল, সে-বাড়িতেও তিনি নেই।

বিন্দু চেঁচাইয়া বলিল, কোথায় কোন্‌ ছোটলোকদের ছেলের সঙ্গে ডাংগুলি খেলচে। আর কি তার প্রাণে ভয়-ডর আছে, এইবার একটা চোখ কানা হলেই বড়গিন্নীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়! তা হলে দশ হাত বার করে খায়—যা, যেখানে পাস খুঁজে আন।

অন্নপূর্ণা ভাঁড়ারের দোরে বসিয়া আর পাঁচজন বর্ষীয়সীর সহিত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। ছোটবৌর তীক্ষকন্ঠ শুনিতে পাইলেন।

ঘন্টা-খানেক পরে ভৈরব আসিয়া জানাইল, অমূল্যবাবু ঘরে আছে, এল না। বিন্দু বিশ্বাস করিতে পারিল না।

এল না কি রে? আমি ডাকচি বলেছিলি?

ভৈরব মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ, তবু এল না।

বিন্দু এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তার দোষ কি? যেমন মা, তেমনি ছেলে হবে ত! আমারো কটু দিব্যি রইল যে, অমন মা-ব্যাটার মুখ দর্শন করব না।

অনেক রাত্রে অন্নপূর্ণা বাটী ফিরিতে উদ্যত হইলে, পৌঁছাইয়া দিবার জন্য মাধব নিজে আসিয়া উপস্থিত হইল। বিন্দু দ্রুতপদে অদূরে আসিয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া ভীষণ-কন্ঠে বলিল, পৌঁছে দিতে ত যাচ্ছ, উনি জলস্পর্শ করেন নি, তা জান?

মাধব বলিল, সে তোমার জানবার কথা—আমার নয়। সমস্ত নষ্ট হয় দেখে, নিজে গিয়ে ডেকে এনেছিলাম, এখন নিজে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।

বিন্দু বলিল, বেশ ভাল কথা। তা হলে দেখচি তুমিও ঐদিকে।

মাধব জবাব না দিয়া বলিল, চল বৌঠান, আর দেরি ক’রো না।

চল ঠাকুরপো; বলিয়া অন্নপূর্ণা পা বাড়াইতেই বিন্দু গর্জন করিয়া বলিল, লোকে কথায় বলে দেইজী শত্রু। নিজের যা মুখে এলো, দশটা মিথ্যে সাজিয়ে বললে—কটকট করে দিব্যি করলে, চার দিন চার রাত ছেলের মুখ দেখতে দিলে না—ভগবান এর বিচার করবেন।

বলিয়া মুখে আঁচল গুঁজিয়া কান্না রোধ করিয়া রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়াই উপুড় হইয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িল। একটা গোলমাল উঠিল; মাধব অন্নপূর্ণা দুইজনেই শুনিতে পাইলেন। অন্নপূর্ণা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, কি হ’ল দেখি!

মাধব কহিল, দেখতে হবে না, চল।

কলহের কথাটা এ-কয়দিন গোপন ছিল, আর রহিল না। পরদিন বাড়ির মেয়েরা এক জায়গায় বসিলে, এলোকেশী বলিয়া উঠিলেন, জায়ে জায়ে ঝগড়া হয়েচে, ছেলের কি হ’ল, সে একবার আসতে পারলে না? ছোটবৌ বড় মিথ্যে বলেনি—যেমন মা, তেমনি ছেলে হবে ত! ঢের ঢের ছেলে দেখেছি বাবা, এমন নেমকহারাম কখন দেখিনি।

বিন্দু ক্লান্তদৃষ্টিতে একটিবার তাহার দিকে চাহিয়া লজ্জায় ঘৃণায় চোখ নিচু করিল।

এলোকেশী পুনরায় কহিলেন, তুমি ছেলে ভালবাস ছোটবৌ, আমার নরেন্দ্রনাথকে নাও—ওকে তোমায় দিলুম। মেরে ফেল, কেটে ফেল, কোনদিন কথাটি বলবার ছেলে ও নয়—তেমন সন্তান আমরা পেটে ধরিনে।

বিন্দু নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। বিন্দুর মা জবাব দিলেন। তাঁহার বয়স হইয়াছে, জমিদারের মেয়ে, জমিদারের গৃহিণী, তিনি পাকা লোক। হাসিয়া বলিলেন, ও কি একটা কথা গা! অমূল্য ওর হাড়েমাসে জড়িয়ে আছে—না না, ওকে তোমরা অমন করে উতলা করে দিও না। বিন্দু, তোদের ঝগড়া দু’দিনের মা, তাই বলে ছেলে কি তোর পর হয়ে যাবে?

বিন্দু ছলছল চোখে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। সন্ধ্যার সময় সে কদমকে ডাকিয়া বলিল, আচ্ছা কদম, তুই ত ছিলি, তুই বল্‌, আমার এত কি দোষ হয়েছিল যে, উনি অতবড় দিব্যি করে ফেললেন?

বিন্দু তাহাকে এ আলোচনা করিতে আহ্বান করিয়াছে, সহসা কদম তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। সে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া মৌন হইয়া রহিল।

তথাপি বিন্দু বলিল, না না, হাজার হোক তোরা বয়সে বড়, তোদের দুটো কথা আমাকে শুনতেই হয়, তুই বল্‌ না, এত দোষ আমার কি হয়েছিল?

কদম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না দিদি, দোষ আর কি?

বিন্দু কহিল, তবে যা না একবার ও-বাড়িতে। দু’কথা বেশ করে শুনিয়ে দিয়ে আয় না—তোর আর ভয় কি?

কদম সাহস পাইয়া বলিল, ভয় কিছুই নয় দিদি, কিন্তু, কাজ কি আর ঝগড়া-বিবাদ করে? যা হবার তা হয়ে গেছে।

বিন্দু কহিল, না না, কদম, তুই বুঝিস নে—সত্যি কথা বলা ভাল। না হলে, ও মনে করবে, আমারি যেন সব দোষ, তার কিছুই নেই। বার করে দেব, দূর করে দেব, এসব কথা বলেনি ও? আমি কোনদিন তাতে রাগ করেচি? কেন ও লুকিয়ে টাকা দিলে? কেন একবার জানালে না?

কদম বলিল, আচ্ছা কাল যাব, আজ সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

বিন্দু অপ্রসন্ন হইয়া বলিল, সন্ধ্যা আবার কোথায় কদম,—তুই বড় কথা কাটিস্‌। শীতকালের বেলা বলেই অমন দেখাচ্চে, না হয় কাউকে সঙ্গে নে না—ওরে, ও ভৈরব শোন, হেবোকে ডেকে দে ত, কদমের সঙ্গে যাক।

ভৈরব বলিল, হেবোকে দিয়ে বাবু বাতি পরিষ্কার করাচ্চেন।

বিন্দু চোখ তুলিয়া বলিল, ফের মুখের সামনে জবাব করে!

ভৈরব সে চাহনির সুমুখ হইতে ছুটিয়া পলাইল। কদমকে পাঠাইয়া দিয়া বিন্দু বার-দুই এ-ঘর ও-ঘর করিয়া রান্নাঘরে আসিয়া ঢুকিল। বামুনঠাকরুন একা বসিয়া রাঁধিতেছিল। বিন্দু একপাশে বসিয়া পড়িয়া বলিল, আচ্ছা মেয়ে, তোমাকেই সাক্ষী মানচি—সত্যি কথা বল মেয়ে, কার দোষ বেশি?

পাচিকা বুঝিতে পারিল না, বলিল, কিসের মা?

বিন্দু বলিল, সেদিনের কথা গো! কি বলেছিলুম আমি? শুধু বলেছিলুম, দিদি, অমূল্যকে এর মধ্যে টাকা দিয়েচ? কে না জানে ছেলেদের হাতে টাকাকড়ি দিতে নেই। বললেই ত হ’ত, অমূল্য কান্নাকাটি করেছিল, দিয়েচি, চুকে যেত। এতে, এত কথাই বা ওঠে কেন, আর এমন দিব্যি-দিলেসাই বা হয় কেন? পাঁচটা ঘটিবাটি একসঙ্গে থাকলে ঠোকাঠুকি লাগে, এ ত মানুষ! তাই বলে এত বড় দিব্যি! ঐ একটি বংশধর—তার নাম করে দিব্যি? আমি বলচি মেয়ে তোমাকে, ইহজন্মে আমি আর ওর মুখ দেখব না। শত্রুর দিকে ফিরে চাইব, ত, ওর দিকে চোখ ফেরাব না।

বামুনমেয়ে স্বভাবত অল্পভাষিণী, সে কি বলিবে বুঝিতে না পারিয়া মৌন হইয়া রহিল।

বিন্দুর দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মুছিয়া ফেলিয়া ভাঙ্গা গলায় পুনরায় বলিল, রাগের মাথায় কে দিব্যি না করে মেয়ে? তাই বলে জলস্পর্শ করলে না! ছেলেটাকে পর্যন্ত আসতে দিলে না! এইগুলো কি বড়র মত কাজ? হাজার হোক, আমি ছোট, বুদ্ধি কম, যদি তার পেটের মেয়েই হতুম, কি করত তা হলে? আমিও তেমনি ওর নাম কখন মুখে আনব না, তা তোমরা দেখো।

বামুনঠাকরুন তথাপি চুপ করিয়া রহিল।

বিন্দু বলিয়া উঠিল, আর ও-ই দিব্যি দিতে জানে, আমি জানিনে? কাল যদি ও-বাড়িতে গিয়ে বলে আসি, একবাটি বিষ পাঠিয়ে না দাও ত তোমারো ওই দিব্যি রইল, কি হয় তা হলে? আমি দু’দিন চুপ করে আছি, তার পরে হয় গিয়ে ঐ দিব্যি দিয়ে আসবো, না হয়, নিজেই একবাটি বিষ খেয়ে বলে যাব, দিদি পাঠিয়ে দিয়েচে। দেখি, পাঁচজনে ওকে ছি ছি করে কি না! ও জব্দ হয় কি না!

বামুনঠাকরুন ভয় পাইয়া মৃদুস্বরে বলিল, ছি মা, ও-সব মতলব করতে নেই—ঝগড়া-বিবাদ চিরস্থায়ী হয় না—উনিও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না, অমূল্যধনও পারবে না। এ ক’দিন সে যে কেমন করে আছে, আমরা তাই কেবল ভাবি!

বিন্দু ব্যগ্র হইয়া বলিল, তাই বল মেয়ে। নিশ্চয় তাকেও মারধর করে ভয় দেখিয়ে রেখেচে। যে একটা রাত আমাকে না হলে ঘুমুতে পারে না, আজ পাঁচ দিন চার রাত কেটে গেল! ও-মাগীর কি আর মুখ দেখতে আছে! ঐ যে বললুম, শত্রুর দিকে ফিরে চাইব ত ওর দিকে ইহজন্মে আর না।

বামুনঠাকরুন নিজের কবজির কাছে একটা কাল দাগ দেখাইয়া কহিল, এই দেখ মা, এখনো কালশিরে পড়ে আছে। সে রাত্রে তোমার মূর্ছা হয়েছিল, এ-সব কথা জান না। অমূল্যধন কোথা থেকে ছুটে এসে তোমার বুকের উপর পড়ে সে কি কান্না! সে ত আর কখন দেখেনি, বলে, ছোটমা মরে গেল। না দেয় তোমার চোখেমুখে জল দিতে, না দেয় বাতাস করতে—আমি টানতে গেলুম, আমাকে কামড়ে দিলে; বড়মা টানতে গেলেন, তাঁকে আঁচড়ে-কামড়ে কাপড় ছিঁড়ে এক করে দিলে। লোকে রুগীর সেবা করবে কি মা, তাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। শেষে চার-পাঁচজন মিলে টেনে নিয়ে যায়।

বিন্দু নির্নিমেষ-চোখে তাহার মুখের পানে চাহিয়া কথাগুলো যেন গিলিতে লাগিল; তারপর অতি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া ঘরে গিয়া দোর দিয়া শুইল।

দিন-চারেক পরে বিন্দুর পিতা, মাতা, পিসি প্রভৃতির ফিরিবার পূর্বের দিন মূর্ছার পরে বিন্দু চুপ করিয়া বিছানায় পড়িয়া ছিল। কদম বাতাস করিতেছিল, আর কেহ ছিল না। বিন্দু ইঙ্গিতে তাহাকে আরও কাছে ডাকিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, কদম, দিদি এসেছেন রে?

কদম বলিল, না দিদি, আমরা এত লোক আছি, তাঁকে আর কষ্ট দেওয়া কেন?

বিন্দু ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিল, এই তোদের দোষ কদম। সব কাজেই নিজেদের বুদ্ধি খাটাতে যাস। এমনি করেই একদিন আমাকে মেরে ফেলবি দেখছি। পূজোর দিনেও ত তোরা একবাড়ি লোক ছিলি, কি করতে পেরেছিলি, যতক্ষণ না সেই একফোঁটা লোকটি এসে বাড়িতে পা দিলে?—ওরে, তোরা আর সে? তার কড়ে আঙুলের ক্ষমতাও তোদের বাড়িসুদ্ধ লোকের নেই।

বিন্দুর মা ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, জামাইয়ের মত আছে বিন্দু, তুইও দিন-কতক আমাদের সঙ্গে ঘুরে আসবি চল্‌।

বিন্দু মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আমার যাওয়া না-যাওয়া কি তাঁর মতামতের উপর নির্ভর করে মা, যে তিনি বললেই যাব? আমার শত্রুর হুকুম না পেলে যাই কি করে?

মা কথাটা বুঝিয়া বলিলেন, তোর জায়ের কথা বলচিস? তাঁর আর হুকুম নিতে হবে না। যখন আলাদা হয়ে তোরা চলে এসেছিস, তখন উনি বললেই হ’ল।

বিন্দু মাথা নাড়িয়া বলিল, না, মা, তা হয় না। যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণ যেখানেই থাক, সেই সব। আর যাই করি মা, তাকে না বলে বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না—বঠ্‌ঠাকুর তা হলে রাগ করবেন।

এলোকেশী এইমাত্র উপস্থিত হইয়া শুনিতেছিলেন, বলিলেন, আচ্ছা, আমি বলচি, তুমি যাও।

বিন্দু সে কথার জবাবও দিল না।

মা বলিলেন, বেশ ত, না হয়, লোক পাঠিয়ে তাঁর মত নে না বিন্দু!

বিন্দু আশ্চর্য হইয়া বলিল, লোক পাঠিয়ে? সে ত আরও মন্দ হবে মা! আমি তার মন জানি, মুখে বলবে ‘যাক’, কিন্তু ভেতরে রেগে থাকবে, হয়ত বঠ্‌ঠাকুরকে পাঁচটা বানিয়ে বলবে—না মা, তোমরা যাও, আমার যাওয়া হবে না।

মা আর জিদ করিলেন না, চলিয়া গেলেন। এইবার ফাঁকা বাড়ি প্রতি মুহূর্তে তাহাকে গিলিবার জন্য হাঁ করিতে লাগিল। নীচের একটি ঘরে এলোকেশীরা থাকেন, দোতলার একটি ঘর তাহার নিজের, আর সমস্তই খালি খাঁখাঁ করিতে লাগিল। সে শূন্যমনে ঘুরিতে ঘুরিতে তেতলার একটি ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল। কোন্‌ সুদূর ভবিষ্যতে পুত্র-পুত্রবধুর নাম করিয়া এই ঘরখানি সে তৈরি করাইয়াছিল। এইখানে ঢুকিয়া সে কিছুতেই চোখের জল রাখিতে পারিল না। নীচে নামিয়া আসিতেছিল, পথে স্বামীর সহিত দেখা হইবামাত্রই সে বলিয়া উঠিল, হাঁ গা, কি-রকম হবে তবে?

মাধব বুঝিতে না পারিয়া বলিলেন, কিসের?

বিন্দু আর জবাব দিতে পারিল না। হঠাৎ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, না না, তুমি যাও—ও কিছু না।

পরদিন সকালবেলা মাধব বাহিরের ঘরে বসিয়া কাজ করিতেছিলেন, অকস্মাৎ বিন্দু ঘরে ঢুকিয়াই কান্না চাপিয়া বলিল, উনি চাকরি করচেন নাকি?

মাধব চোখ না তুলিয়াই বলিলেন, হুঁ।

হুঁ কি? এই কি তাঁর চাকরির বয়স?

মাধব পূর্বের মত কাগজে চোখ রাখিয়া বলিলেন, চাকরি কি মানুষ বয়সের জন্য করে, চাকরি করে অভাবে!

তাঁর অভাবই বা হবে কেন? আমরা পর, ঝগড়া করেচি, কিন্তু তুমি ত তাঁর ভাই?

মাধব বলিলেন, বৈমাত্রেয় ভাই—জ্ঞাতি।

বিন্দু স্তম্ভিত হইয়া গিয়া ধীরে ধীরে বলিল, তুমি বেঁচে থেকে তাঁকে কাজ করতে দেবে?

মাধব এবার মুখ তুলিয়া স্ত্রীর দিকে চাহিলেন, তার পর সহজ শান্তকণ্ঠে বলিলেন, কেন দেব না? সংসারে যে যার অদৃষ্ট নিয়ে আসে, তেমনি ভোগ করে, তার জীবন্ত সাক্ষী আমি নিজে। কবে বাপ-মা মরেচেন, জানিও নে; বড়বৌঠানের মুখে শুনি আমরা বড় গরীব, কিন্তু কোনোদিন দুঃখ-কষ্টের বাষ্পও টের পেলাম না। কোথা থেকে চিরকাল পরিষ্কার ধপধপে কাপড়জামা এসেচে, কোথা থেকে ইস্কুল-কলেজের মাইনে, বইয়ের দাম, বাসাখরচ এসেচে, তা আজও বলতে পারিনে। তার পরে উকিল হয়ে মন্দ টাকা পাইনে। ইতিমধ্যে কোথা থেকে কেমন করে তুমি একরাশ টাকা নিয়ে ঘরে এলে,—এমন অট্টালিকাও তৈরি হ’ল—অথচ, দাদাকে দেখ, চিরকালটা নিঃশব্দে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেছেন, ছেঁড়া সেলাই-করা কাপড় পরেচেন—শীতের দিনেও তাঁর গায়ে কখন জামা দেখিনি—একবেলা একমুঠো খেয়ে কেবল আমাদের জন্যে—সব কথা আমার মনেও পড়ে না, পড়বার দরকারও দেখিনে—শুধু দিন-কতক আরাম করছিলেন, তা ভগবান সুদসুদ্ধ আদায় করে নিচ্চেন। বলিয়া সহসা সে মুখ ফিরাইয়া একটা দরকারী কাগজ খুঁজিতে লাগিল।

বিন্দু নির্বাক, স্তব্ধ। স্বামীর কত বড় তিরস্কার যে এই অতীত দিনের সহজ কাহিনীর মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল, সে কথা বিন্দুর প্রতি রক্তবিন্দুটি পর্যন্ত অনুভব করিতে লাগিল, সে মাথা হেঁট করিয়া রহিল।

মাধব কাগজ খুঁজিতে খুঁজিতে কতকটা যেন নিজের মনেই বলিলেন, চাকরি বলে চাকরি! রাধাপুরের কাছারিতে যেতে আসতে প্রায় পাঁচ ক্রোশ—ভোর চারটেয় বেরিয়ে সমস্তদিন অনাহারে থেকে রাত্রে ফিরে এসে দুটি খাওয়া, মাইনে বারো টাকা।

বিন্দু শিহরিয়া উঠিল—সমস্ত দিন অনাহারে! মোটে বারো টাকা!

হাঁ, বারো টাকা! বয়স হয়েছে, তাতে আফিংখোর মানুষ, একটু-আধটু দুধটুকুও পান না; ভগবান দেখচি, এতদিন পরে দয়া করে দাদার ভবযন্ত্রণা মোচন করে দেবার উপায় করে দিয়েছেন।

বিন্দুর চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল এবং যাহা কোনদিন করে নাই, আজ তাহাও করিল। হেঁট হইয়া স্বামীর দুই পা চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, একটি উপায় করে দাও, রোগা মানুষ এমন করে দুটো দিনও বাঁচবেন না।

মাধব নিজের চোখের জল কোন গতিকে মুছিয়া লইয়া কহিল, আমি কি উপায় করব? বৌঠান আমাদের এক কণা চাল পর্যন্ত নেবেন না; কিছু না করলে তাঁদের সংসারই বা চলবে কি করে?

বিন্দু রুদ্ধস্বরে বলিল, তা আমি জানিনে। ওগো, তুমি আমার দেবতা, তিনি তোমার চেয়েও বড় যে! ছি ছি, যে কথা মনে আনাও যায় না, সেই কথা কিনা—বিন্দু আর বলিতে পারিল না।

মাধব বলিল, বেশ ত, অন্তত যাও বৌঠানের কাছে। যাতে তাঁর রাগ পড়ে, তিনি প্রসন্ন হন, তাই কর। আমার পা ধরে সমস্ত দিন বসে থাকলেও উপায় হবে না।

বিন্দু তৎক্ষণাৎ পা ছাড়িয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, পায়ে-ধরা অভ্যাস আমার নয়। এখন দেখচি, কেন সে-রাত্রে তিনি জলস্পর্শ করেন নি, অথচ তুমি সমস্ত জেনেশুনে শত্রুর মত চুপ করে রইলে! আমার অপরাধ বেড়ে গেল, তুমি কথা কইলে না!

মাধব কাগজপত্রে মনোনিবেশ করিয়া কহিল, না। ও বিদ্যে আমার দাদার কাছে শেখা। ঈশ্বর করুন, যেন অমনি চুপ করে থেকেই একদিন যেতে পারি।

বিন্দু আর কথা কহিল না। উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরে দোর দিয়া পড়িয়া রহিল।

মাধব তখন উঠিবার উপক্রম করিতেছিল, বিন্দু আবার আসিয়া ঘরে ঢুকিল। তাহার দুই চোখ রাঙ্গা। মাধবের দয়া হইল, বলিল, যাও একবার তাঁর কাছে। জান ত তাঁকে, একটি বার গিয়ে শুধু দাঁড়াও, তাহলেই সব হবে।

বিন্দু অত্যন্ত করুণ-কণ্ঠে বলিল, তুমি যাও—ওগো, আমি ছেলের দিব্যি কচ্চি—

মাধব তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কিছু উষ্ণ হইয়াই জবাব দিল, হাজার দিব্যি করলেও আমি দাদাকে বলতে পারব না। তিনি নিজে জিজ্ঞাসা না করলে গিয়ে বলব, এত সাহস আমার গলা কেটে ফেললেও হবে না।

বিন্দু তথাপি নড়িল না।

মাধব কহিল, পারবে না যেতে?

বিন্দু জবাব দিল না, হেঁট মুখে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

.

আট

বাড়ির সুমুখ দিয়া ইস্কুল যাইবার পথ। প্রথম কয়েকদিন অমূল্য ছাতি আড়াল দিয়া এই পথেই গিয়াছিল, আর দু’দিন ধরিয়া সেই লাল রঙের ছাতাটি আর পথের একধার বাহিয়া গেল না। চাহিয়া চাহিয়া বিন্দুর চোখ ফাটিয়া জল পড়িতে লাগিল, তবুও সে চিলের ছাদের আড়ালে বসিয়া তেমনি একদৃষ্টে পথের পানে চাহিয়া বসিয়া রহিল। সকালে নটা-দশটার সময় কত রকমের ছাতি মাথায় দিয়া কত ছেলে হাঁটিয়া গেল; ইস্কুলে ছুটির পর কত ছেলে সেই পথে আবার ফিরিয়া আসিল; কিন্তু সেই চলন, সেই ছাতি, বিন্দুর চোখে পড়িল না। সে সন্ধ্যার সময় চোখ মুছিতে মুছিতে নামিয়া আসিয়া নরেনকে আড়ালে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, হাঁ নরেন, এই ত ইস্কুলে যাবার সোজা পথ, তবে কেন সে এদিক দিয়ে আর যায় না?

নরেন চুপ করিয়া রহিল।

বিন্দু বলিল, বেশ ত রে, তোরা দুটি ভাই গল্প করতে করতে যাবি-আসবি—সেই ত ভাল।

নরেন তাহার নিজের ধরনে অমূল্যকে ভালবাসিয়াছিল, চুপি চুপি বলিল, সে লজ্জায় আর যায় না মামী, ঐ হোথা দিয়ে ঘুরে যায়।

বিন্দু কষ্টে হাসিয়া বলিল, তার আবার লজ্জা কিসের রে? না না, তুই বলিস তাকে, সে যেন এই পথেই যায়।

নরেন মাথা নাড়িয়া বলিল, কক্ষণ যাবে না মামী! কেন যাবে না জান?

বিন্দু উৎসুক হইয়া বলিল, কেন?

নরেন বলিল, তুমি রাগ করবে না?

না।

তাদের বাড়িতে বলে পাঠাবে না?

না।

আমার মাকেও বলে দেবে না?

বিন্দু অধীর হইয়া বলিল, না রে না, বল্‌—আমি কাউকে কিছু বলব না।

নরেন ফিসফিস করিয়া বলিল,—থার্ডমাস্টার অমূল্যর আচ্ছা করে কান মলে দিয়েছিল।

একমুহূর্তে বিন্দু আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, কেন দিলে? গায়ে হাত তুলতে আমি মানা করে দিয়েচি না?

নরেন হাত নাড়িয়া বলিল, তার দোষ কি মামী, সে নূতন লোক। আমাদের চাকর এই হেবো শালাই বজ্জাত, সে এসে মাকে বলেচে। আমার মা-টিও কম বজ্জাত নয়, মামী, সে মাস্টারকে বলে দিতে বলে দিয়েচে, থার্ডমাস্টার অমনি আচ্ছাসে কান মলেচে,—
কি রকম করে জান মামী,—এই রকম করে ধরে বিন্দু তাহাকে তাড়াতাড়ি থামাইয়া দিয়া বলিল, হেবো কি বলে দিয়েচে?

নরেন বলিল, কি জান মামী, হেবো টিফিনের সময় আমার খাবার নিয়ে যায় ত, সে ছুটে এসে বলে, কি খাবার দেখি নরেনদা? মা শুনে বলে, অমূল্য নজর দেয়।

অমূল্যর কেউ খাবার নিয়ে যায় না?

নরেন কপালে একবার হাত ঠেকাইয়া বলিল, কোথা পাবে মামী, তারা গরীব মানুষ, সে পকেটে করে দুটি ছোলা-ভাজা নিয়ে যায়, তাই টিফিনের সময় ওদিকের গাছতলায় নুকিয়ে বসে খায়।

বিন্দুর চোখের উপর ঘরবাড়ি সমস্ত সংসার দুলিতে লাগিল; সে সেইখানে বসিয়া পড়িয়া বলিল, নরেন তুই যা।

সেরাত্রে অনেক ডাকাডাকির পর বিন্দু খাইতে বসিয়া কোনমতেই হাত মুখে তুলিতে পারিল না, শেষে অসুখ করিতেছে বলিয়া উঠিয়া গেল। পরদিনও প্রায় উপবাস করিয়া পড়িয়া রহিল, অথচ কাহাকেও কোন কথা বলিতেও পারিল না, একটা উপায়ও খুঁজিয়া পাইল না। তাহার কেবলি ভয় করিতে লাগিল, পাছে কথা কহিলেই তাহার নিজের অপরাধ আরও বাড়িয়া যায়। অপরাহ্নে স্বামীর আহারের সময় অভ্যাসমত কাছে গিয়া বসিয়া অন্যদিকে চাহিয়া রহিল। কোনরূপ ভোজ্য পদার্থের দিকে কাল হইতে সে চাহিয়া দেখিতেও পারিল না।

ঘরে বাতি জ্বলিতেছে, মাধব নিমীলিত চোখে চুপ করিয়া পড়িয়া ছিলেন, বিন্দু আসিয়া পায়ের কাছে বসিল। মাধব চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, কি?

বিন্দু নতমুখে স্বামীর পায়ের একটা আঙুলের নখ খুঁটিতে লাগিল।

মাধব স্ত্রীর মনের কথাটা অনুমান করিয়া লইয়া আর্দ্র হইয়া বলিলেন,—আমি সমস্তই বুঝি বিন্দু, কিন্তু আমার কাছে কাঁদলে কি হবে? তাঁর কাছে যাও।

বিন্দু সত্যই কাঁদিতেছিল—বলিল, তুমি যাও।

আমি গিয়ে তোমার কথা বলব, দাদা শুনতে পাবেন না?

বিন্দু সে কথার জবাব না দিয়া বলিল—আমি ত বলচি, আমার দোষ হয়েচে—আমি ঘাট মানচি, তুমি তাঁদের বল গে।

আমি পারব না, বলিয়া মাধব পাশ ফিরিয়া শুইলেন।

বিন্দু আরও কতক্ষণ আশা করিয়া বসিয়া রহিল, কিন্তু মাধব কোন কথাই আর যখন বলিলেন না, তখন সে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল; স্বামীর ব্যবহারে তাহার বুকের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একটা প্রস্তর-কঠিন ধিক্কার যোজন-ব্যাপী পর্বতের মত একনিমেষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল। আজ সে নিঃসংশয়ে বুঝিল, তাহাকে সবাই ত্যাগ করিয়াছে।

পরদিন প্রাতঃকালেই যাদব ছোটবধুর যাইবার অনুমতি দিয়া একখানি পত্র পাঠাইয়া দিলেন। বিন্দুর পিতা পীড়িত, সে যেন অবিলম্বে যাত্রা করে। বিন্দু সজল-চোখে গাড়িতে গিয়া উঠিল।

বামুনঠাকরুন গাড়ির কাছে আসিয়া বলিলেন, বাপকে ভালো দেখে শিগগির ফিরে এসো মা।

বিন্দু নামিয়া আসিয়া তাঁহার পদধূলি লইতেই তিনি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া পড়িলেন।

বিন্দুকে এমন নত, এমন নম্র হইতে কেহ কোনদিন দেখে নাই। পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইয়া বিন্দু কহিল,—না মেয়ে, যাই হোক, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে, বয়সে বড়—আশীর্বাদ কর, যেন আর ফিরতে না হয়, এই যাওয়াই যেন আমার শেষ যাওয়া হয়।

বামুনমেয়ে তদুত্তরে কিছুই বলিতে পারিলেন না—বিন্দুর শীর্ণ ক্লিষ্ট মুখখানির পানে চাহিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।

এলোকেশী উপস্থিত ছিলেন, খনখন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ও কি কথা ছোটবৌ? আর কারো বাপ-মায়ের কি অসুখ হয় না?

বিন্দু জবাব দিল না, মুখ ফিরাইয়া চোখ মুছিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল,—তোমাকেও নমস্কার করি ঠাকুরঝি—চললুম আমি।

ঠাকুরঝি বলিলেন, যাও দিদি, যাও। আমি ঘরে রইলুম, সমস্তই দেখতে শুনতে পারব।

বিন্দু আর কথা কহিল না, কোচম্যান গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

অন্নপূর্ণা বামুনঠাকরুনের মুখে এ কথা শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, ইতিপূর্বে কোন দিন বিন্দু অমূল্যকে ছাড়িয়া বাপের বাড়ি যায় নাই—আজ এক মাসের উপর হইল, সে একবার তাহাকে চোখের দেখা দেখিতে পায় নাই—তাহার দুঃখ অন্নপূর্ণা বুঝিলেন।

রাত্রে অমূল্য বাপের কাছে শুইয়া আস্তে আস্তে গল্প করিতেছিল।

নীচে প্রদীপের আলোকে কাঁথা সেলাই করিতে করিতে অন্নপূর্ণা সহসা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন, ষাট! ষাট! যাবার সময় বলে গেল কিনা এই যাওয়াই যেন শেষ যাওয়া হয়! মা দুর্গা করুন, বাছা আমার ভালয় ভালয় ফিরে আসুক।

কথাটা শুনিতে পাইয়া যাদব উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, আগাগোড়াই কাজটা ভাল করনি বড়বৌ! আমার মাকে তোমরা কেউ চিনলে না!

অন্নপূর্ণা বলিলেন, সেও ত একবার দিদি বলে এল না! তার ছেলেকেও ত সে জোর করে নিয়ে যেতে পারত, তাও ত করলে না! সেদিন সমস্তদিন খাটুনির পর ঘরে ফিরে এলুম—উলটে কতকগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দিলে!

যাদব বলিলেন, আমার মায়ের কথা শুধু আমি বুঝি! কিন্তু বড়বৌ, এই যদি না মাপ করতে পারবে, বড় হয়েছিলে কেন? তুমিও যেমন, মাধুও তেমনি, তোমরা ধরে-বেঁধে বুঝি আমার মায়ের প্রাণটা বধ করলে!

অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

অমূল্য বলিল, বাবা, ছোটমা কেন আসবে না বলেচে?

অন্নপূর্ণা চোখ মুছিয়া বলিলেন, যাবি তোর ছোটমার কাছে?

অমূল্য ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

না কেন রে? ছোটমা তোর দাদামশায়ের বাড়ি গেছে, তুইও কাল যা!

অমূল্য চুপ করিয়া রহিল। যাদব বলিলেন, যাবি অমূল্য?

অমূল্য বালিশে মুখ লুকাইয়া পূর্বের মত মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, না।

কতকটা রাত্রি থাকিতেই যাদব কর্মস্থানে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেন। দিন পাঁচ-ছয় পরে এমনি এক শেষরাত্রে তিনি প্রস্তুত হইয়া অন্যমনস্কের মত তামাক টানিতেছিলেন।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, বেলা হয়ে যাচ্ছে।

যাদব ব্যস্ত হইয়া হুঁকাটা রাখিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন,—আজ মনটা বড় খারাপ বড়বৌ, কাল রাত্রে আমার মা যেন ঐ দোরের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছিলেন! দুর্গা! দুর্গা! বলিয়া তিনি বাহির হইয়া পড়িলেন।

সকালবেলা অন্নপূর্ণা ক্লান্তভাবে রান্নাঘরে কাজ করিতেছিলেন, ও-বাড়ির চাকর আসিয়া সংবাদ দিল, বাবু কাল রাতে ফরাসডাঙ্গায় চলে গেছেন—মা’র নাকি বড় ব্যামো। স্বামীর কথাটা স্মরণ করিয়া অন্নপূর্ণার বুক কাঁদিয়া উঠিলে—কি ব্যামো রে?

চাকর বলিল, তা জানিনে মা, শুনলুম কি-রকম অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে কি-রকম শক্ত অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েচে।

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া যাদব খবর শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, কত সাধ করে সোনার প্রতিমা ঘরে আনলুম বড়বৌ, জলে ভাসিয়ে দিলে? আমি এখনি যাব।

দুঃখে আত্মগ্লানিতে অন্নপূর্ণার বুক ফাটিতেছিল; অমূল্যর চেয়েও বোধ করি তিনি ছোটবৌকে ভালবাসিতেন। নিজের চোখ মুছিয়া, তিনি স্বামীর পা ধুইয়া দিয়া জোর করিয়া সন্ধ্যা করিতে বসাইয়া দিয়া, অন্ধকার বারান্দায় আসিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিক পরেই বাহিরে মাধবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অন্নপূর্ণা প্রাণপণে বুক চাপিয়া ধরিয়া, দুই কানে আঙুল দিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলেন।

মাধব রান্নাঘরে অন্ধকার দেখিয়া, এ ঘরে ফিরিয়া আসিয়া অন্ধকারে অন্নপূর্ণাকে দেখিয়া শুষ্কস্বরে বলিল, বৌঠান, শুনেচ বোধ হয়?

অন্নপূর্ণা মুখ তুলিতে পারিলেন না।

মাধব কহিল, অমূল্যর যাওয়া একবার দরকার, বোধ করি শেষ সময় উপস্থিত হয়েচে।

অন্নপূর্ণা উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুকারিয়া উঠিলেন। যাদব ও-ঘর হইতে পাগলের মত ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন,—এমন হয় না মাধু! আমি বলছি হয় না! আমি জ্ঞানে-অজ্ঞানে কাউকে দুঃখ দিইনি, ভগবান আমাকে এ-বয়সে কখনো এমন শাস্তি দেবেন না।

মাধব চুপ করিয়া রহিল।

যাদব বলিলেন, আমাকে সব কথা খুলে বল্‌—আমি গিয়ে মাকে ফিরিয়া আনবো—তুই উতলা হস্‌নে মাধু—গাড়ি সঙ্গে আছে?

মাধব বলিল, আমি উতলা হইনি দাদা, আপনি নিজে কি-রকম কচ্চেন?

কিছুই করিনি। ওঠ বড়বৌ, আয় অমূল্য—

মাধব বাধা দিয়া বলিল, রাত্রিটা যাক না দাদা।

না না, সে হবে না—তুই অস্থির হ’সনে মাধু—গাড়ি ডাক্‌, নইলে আমি হেঁটে যাব।

মাধব আর কিছু না বলিয়া গাড়ি আনিলে চারজনেই উঠিয়া বসিলেন। যাদব বলিলেন, তার পরে?

মাধব কহিল, আমি ত ছিলুম না—ঠিক জানিনে। শুনলুম, দিন-চারেক আগে খুব জ্বরের ওপর ঘন ঘন মূর্ছা হয়, তার পরে এখন পর্যন্ত কেউ ওষুধ কি এক ফোঁটা দুধ অবধি খাওয়াতে পারেনি। ঠিক বলতে পারিনে কি হয়েচে, কিন্তু আশা আর নেই।

যাদব জোর দিয়া বলিয়া উঠিলেন, খুব আছে, একশ’বার আছে। মা আমার বেঁচে আছেন। মাধু, ভগবান আমার মুখ দিয়ে এই শেষ বয়সে মিথ্যে কথা বার করবেন না—আমি আজ পর্যন্ত মিথ্যে বলিনি।

মাধব তৎক্ষণাৎ অবনত হইয়া অগ্রজের পদধূলি মাথায় লইয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিল।

.

নয়

কতদিন হইতে যে বিন্দু অনাহারে নিজেকে ক্ষয় করিয়া আনিতেছিল, তাহা কেহই জানিতে পারে নাই। বাপের বাড়ি আসিয়া জ্বর হইল। দ্বিতীয় দিন দুই-তিনবার মূর্ছা হইল—তাহার শেষ মূর্ছা আর ভাঙ্গিতে চাহিল না। অনেক চেষ্টায় অনেক পরে যখন তাহার চৈতন্য ফিরিয়া আসিল, তখন দুর্বল নাড়ী একেবারে বসিয়া গিয়াছে। সংবাদ পাইয়া মাধব আসিলেন। সে স্বামীর পায়ের ধূলা মাথায় লইল, কিন্তু দাঁতে দাঁত চাপিয়া রহিল, শত অনুনয়েও একফোঁটা দুধ পর্যন্ত গিলিল না।

মাধব হতাশ হইয়া বলিলেন, আত্মহত্যা ক’চ্চ কেন?

বিন্দুর নিমীলিত চোখের কোণ বাহিয়া জল পড়িতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে বলিল, আমার সমস্ত অমূল্যর। শুধু হাজার-দুই টাকা নরেনকে দিয়ো, আর তাকে পড়িয়ো, সে আমার অমূল্যকে ভালবাসে।

মাধব দাঁত দিয়া জোর করিয়া নিজের ঠোঁট চাপিয়া কান্না থামাইলেন।

বিন্দু ইঙ্গিত করিয়া তাঁহাকে আরও কাছে আনিয়া চুপি চুপি বলিল, সে ছাড়া আর কেউ যেন আমাকে আগুন না দেয়।

মাধব সে ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া কানে কানে বলিলেন, দেখবে কাউকে?

বিন্দু ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না থাক।

বিন্দুর মা আর একবার ঔষধ খাওয়াইবার চেষ্টা করিলেন, বিন্দু তেমনি দৃঢ়ভাবে দাঁত চাপিয়া রহিল।

মাধব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, সে হবে না বিন্দু। আমাদের কথা শুনলে না, কিন্তু যাঁর কথা ঠেলতে পারবে না, আমি তাঁকে আনতে চললুম। শুধু এই কথাটি আমার রেখো, যেন ফিরে এসে দেখেতে পাই, বলিয়া মাধব বাহিরে আসিয়া চোখ মুছিলেন। সে-রাত্রে বিন্দু শান্ত হইয়া ঘুমাইল।

তখন সবেমাত্র সূর্যোদয় হইতেছিল; মাধব ঘরে ঢুকিয়া দীপ নিবাইয়া জানালা খুলিয়া দিতেই বিন্দু চোখ চাহিয়া সুমুখেই প্রভাতের স্নিগ্ধ আলোকে স্বামীর মুখ দেখিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, কখন এলে?

এই আসচি। দাদা পাগলের মত ভয়ানক কান্নাকাটি কচ্চেন।

বিন্দু আস্তে বলিল, তা জানি। তাঁর একটু পায়ের ধুলো এনেচ?

মাধব বলিলেন, তিনি বাইরে বসে তামাক খাচ্চেন। বৌঠান হাত-পা ধুচ্চেন, অমূল্য গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওপরে শুইয়ে দিয়েচি, তুলে আনব?

বিন্দু কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিয়া ‘না, ঘুমোক’ বলিয়া ধীরে ধীরে পাশ ফিরিয়া অন্যদিকে মুখ করিয়া শুইল।

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া তাহার শিয়রের কাছে বসিয়া মাথায় হাত দিতেই সে চমকিয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা মিনিট-খানেক নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া বলিলেন, ওষুধ খাসনি কেন রে ছোটো, মরবি বলে?

বিন্দু জবাব দিল না। অন্নপূর্ণা তাহার কানের উপর মুখ রাখিয়া চুপি চুপি বলিলেন, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, তুই বুঝতে পাচ্চিস?

বিন্দু তেমনি চুপি চুপি উত্তর দিল, পাচ্চি দিদি।

তবে মুখ ফেরা। তোর বঠ্‌ঠাকুর বাড়ি নিয়ে যাবার জন্যে নিজে এসেচেন। তোর ছেলে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েচে। কথা শোন, মুখ ফেরা।

বিন্দু তথাপি মুখ ফিরাইল না। মাথা নাড়িয়া বলিল, না দিদি, আগে বল—

অন্নপূর্ণা বলিলেন, বলচি রে ছোটো, বলচি, শুধু তুই একবার বাড়ি ফিরে আয়।

এই সময় যাদব দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইতে অন্নপূর্ণা বিন্দুর মাথার উপর চাদর টানিয়া দিলেন। যাদব একমুহূর্ত আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃতা তাঁহার অশেষ স্নেহের পাত্রী ছোটবধূর পানে চাহিয়া থাকিয়া অশ্রু নিরোধ করিয়া বলিলেন, বাড়ি চল মা, আমি নিতে এসেছি।

তাঁহার শুষ্ক শীর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া উপস্থিত সকলের চক্ষুই সজল হইয়া উঠিল। যাদব আর একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া বলিলেন, আর একদিন যখন এতটুকুটি ছিলে মা, তখন আমিই এসে আমার সংসারের মা-লক্ষ্মীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আবার আসতে হবে ভাবিনি; তা মা শোন, যখন এসেচি, তখন হয় সঙ্গে করে নিয়ে যাব, না হয়, ও-মুখো আর হব না। জান ত মা, আমি মিথ্যে কথা বলিনে!

যাদব বাহিরে চলিয়া গেলেন।

বিন্দু মুখ ফিরাইয়া বলিল, দাও দিদি কি খেতে দেবে। আর অমূল্যকে আমার কাছে শুইয়ে দিয়ে তোমরা সবাই বাইরে গিয়ে বিশ্রাম কর গে। আর ভয় নেই—আমি মরব না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *