ভারতের উদ্ভিদ উদ্যানের প্রথম পরিচালকের নাম উইলিয়াম রবার্গ। তাঁকে আধুনিক ভারতীয় উদ্ভিদবিদ্যার জনক বলা হয়।
অনেক বােটানিক্যান্স নামে রক্সবার্গের নাম আছে, যেমন— Puranjiva roxburghi Wall. বােটানিক্যাল নামের প্রথম অংশটি ভারতীয় পুত্ৰঞ্জীবা’। গাছের বাংলা নাম জিয়নপুত্র কিংবা জিয়াপুত্র।
অদ্ভুত নামকরণের কারণ জনৈক সন্ন্যাসীর দেয়া উপহার এই গাছের বীজ থেকে জনৈকা ভারতীয় তরুণীর মৃতপুত্র জীবন লাভ করেছিল।
এখনাে অনেকে বিশ্বাস করেন, এই গাছের বীজ শিশুদের অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক শিশুকে এই গাছের বীজ গলায় বা কোমরের ঘুনসিতে পরতে দেখা যায়।
সাধু-সন্ন্যাসীরা রুদ্রাক্ষের মালার সঙ্গে পুঞ্জীব বৃক্ষের বীজের মালাও গলায় পরেন। | মাঝারি আকারের বৃক্ষ। গরমের সময় সাদা ফুল ফোটে। গাছের বাকল কালাে। পাতা ছােট রঙ গাঢ় সবুজ। শুনেছি গাছটি দেখতে সুন্দর । শুনেছি এই কারণে বললাম যে, এই গাছ আমি এখনো চোখে দেখি নি। নুহাশ পল্পীর ওষুধি বাগানে এই গাছ নেই।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
ভেষজ গুণ গাছটির ফল ও পাতা এনালাজসিক জ্বর কমায় । বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়। কেরােসিনের আগমনের আগে এই গাছ এবং রেড়ি গাছের বীজের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানাে হতাে। পুত্ৰঞ্জীৰ গাছের বীজের তেলের আলাে অতি নরম এবং অতি স্নিগ্ধ বলে বইপত্রে লেখা। পরীক্ষা করার উপায় পাচ্ছি না ।।
Saite 09110 : Euphorbiaceae. রেড়ি গাছও একই গােত্রের। রাণীর ফুল। জারুল গাছের ইংরেজি নাম Queen‘s Flower. আবার কিছু বইতে লেখা Pride of India
অতি বিনয়ের সঙ্গে বলছি আমি রাজা-রাণী গােত্রের কেউ না— আমজনতার একজন হিসেবে জারুল ফুলের মহাভক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবনে মােহসিন হলে থাকতাম। হেঁটে হেঁটে কার্জন হলে যেতাম এবং মুঃ চোখে দুপাশের বিশাল জারুল গাছগুলির ফুলগুলির দিকে তাকাতাম । মনের অজান্তে কতবার যে বলেছি— ‘আহারে!‘
গাছটির বােটানিক্যাল নামে একজন সুইডিস বিজ্ঞানী আছে–Lagerstron, soft4 AN Lagerstroemia speciosa Pers.
গাছের পরিবার tythraceae.
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
পাতাঝরা টাইপ গাছ, তবে সব পাতা আমি নিজে কখনাে ঝরে যেতে দেখি নি। এপ্রিল–মে মাসে ফুল ফোটে, পৃথিবী নীল রঙে রাঙিয়ে দেয়। ভেষজ গুণ। নলিনিকান্ত চক্রবর্তীর বইতে পড়লাম, এই গাছের ফুল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ক্ষত নিবারণে ব্যবহার করা হয়।
গাছের বীজ ঘুমের ওষুধ হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর। শিকড় জ্বর কমায়। বাকল এবং পাতা কোষ্ঠকাঠিন্যের না–কি মহৌষধ।
লটকন
লটকনের বােটানিক্যাল নাম Bixa orallana L. Bixa শব্দটি দক্ষিণ আমেরিকার, কাজেই ধারণা করা হয় লটকন ছড়িয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। চীন দেশে এই গাছের নাম বগাছ। কারণ চীনে প্রথম লটকনের বীজ শুকিয়ে রঙ তৈরি করা হয়। ইংরেজিতে গাছের নাম বাদরের তেঁতুলবৃক্ষ (Monkey Turmeric}।
বাংলার গ্রামেগঞ্জে ঝােপে–ঝাড়ে অযত্ন-অবহেলায় এই গাছ প্রচুর হয় । ফল হয় গরমে। গ্রামের শিশুদের অতি পছুন্দের ফল । ইদানীং দেখছি শহরের বাজারও এই ফল দখল করেছে। আঙ্গুরের কেজি এবং টকনের কেজি তুল্যমূলা।।
লটকনের রসায়ন বিষয়ে বলা যাক। পাতায় আছে Essential oils. যেমন bixaghanene flavonoids, que OTCE 7-bisulphateo of apigenin, buteolin.
Ribu wa Cartenoid, bixin 4 fatty oils. f alcoholo dice, PIET bixol.
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
T e ft Triterpenes, tomentosis acid. ভেষজ ব্যবহার গাছের মূল পানিতে সেদ্ধ করে হুঁকার পর যা পাওয়া যায় (water extract) খিচুনিতে উপকারী। জখিলেও অত্যন্ত কার্যকর।
প্রাচীনকালে এই গাছের বাকল এবং বিচি গনােরিয়া রােগে ব্যবহার করা হতাে।
বিচি ডিসেনট্রিতে উপকারী, ফল প্রস্রাবকারক এবং রেচক। এপেলেন্সি ব্লেগে লটকনের ফল ও বিচি খুব কাজ করে। ভারতীয় ভেষজবিদ না, আধুনিক ইউরােপের গবেষকদের গবেষণায় এই তথ্য বের হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির একটি বই Medicinal Plants of Bangladesh (Abdul Ghani} থেকে আমি ভেষজ রেফারেন্স নিয়েছি।
এখন শুনি আয়ুর্বেদশাস্ত্রীরা কী বলেন— এই গাছের পাতা, বীজ ও শিকড় জ্বর উপশমের ক্ষমতা রাখে। কফ, বাত, মাথা ধরা, কুঠ, বমি এবং পিরে সকল পীড়ার উপকারী।
অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশে বৃক্ষমেলা হচ্ছে । বাণিজ্য মেলা, বইমেলার পাশাপাশি বৃক্ষমেলা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। ইট–কংক্রিটের শহর ঢাকার মানুষরা যে হারে গাছ কেনেন তা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, এ গাছ তারা কোথায় লাগাবেন? জায়গা কই?
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
বৃক্ষমেলা থেকে গাছ কেনার কিছু বিপদ আছে। আমি একটির উল্লেখ করছি। একবার বৃক্ষমেলা থেকে আগ্রহ করে আমি একটা হিং গাছ কিনলাম। হিং অতি দুর্লভ গাছ। আফগানিস্তানের পাহাড়ে অযতে বড় হয়। আফগানিরা হিং-এর আটা জমা করেন। একসময় সেই হি নিয়ে ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েন। চাই হিং চাই হিং’ ধ্বনি শােনা যায়।
হিং–এ বিশেষ ধরনের ক্ষুধা উদ্রেকারী) গন্ধ আছে। এই কারণেই নানা খাদ্যদ্রব্যে হিং–এর ব্যবহার হয়। যারা প্রায়ই কোলকাতা যাতায়াত করেন, তাদের অনেকেই নিশ্চয় হিং–এর কচুরি খেয়েছেন।
যাই হােক আমি হিং–এর দুর্লভ চারা অতি যাতে নুহাশপল্পীতে লাগালাম। যত্ন-আত্তি চলতে থাকল। জৈব–অজৈব নানান সার দেয়া হলাে। হল্যান্ড থেকে আনা Slow realising nutrients–এর ট্যাবলেট দেয়া হল। আমাদের পরিশ্রম বৃথা গেল না। পাহাড়–পর্বতের এই গাহু বাংলার মাটিতে দ্রুত বড় হলো এবং এক সময় ফুল ফুটুল। ফুল দেখে আমি হতভ। এ তাে গন্ধরাজ ফুল! হিং গাছে গন্ধরাজের ফুল ফুটবে কেন ? হিং–এর ফুল হবে ছোট ছােট হলুদ রঙের। ফুলগুলি পুষ্প মঞ্জুরির মতাে সাজানাে থাকবে। বইপত্রে তাই বলে। হিং গাছে গন্ধরাজ ফুল ফোটার কারণ নেই।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
যাদের কাছ থেকে এই গাছ কিনেছিলাম, কয়েক বছর পর কাকতালীয়ভাবে তাদের সঙ্গে দো । আমি হিং গাছে গন্ধরাজ্জ ফুলের কারণ জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন, হিং গাছ বাংলাদেশের মাটিতে হয় না। গন্ধরাজ গাছের সঙ্গে গ্রাফটিং করতে হয়। আপনি কোনাে কারণে মূল হিং গাছ কেটে ফেলেছেন। বলেই এই সমস্যা হয়েছে।
এখন অবশ্যি নুহাশ পল্লীতে হিং গাছ আছে। গাছ থেকে আঠা সংগ্রহ এখনাে করা হয় নি। কখনাে হবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ আঠা সংগ্রহ করতে
হলে গাছটা গোড়া থেকে কেটে ফেলতে হয়। কাটা গাছে মাটির হাঁড়ি উপুড় করে রাখতে হয়। সেখানে আঠা জমে। তিন মাস আঠা সংগ্রহ করা হয়। সেই আঠা রােদে শুকিয়ে বিক্রিযােগ্য হিং বের হয়, যার রঙ গাঢ় হলুদ। আমার যেহেতু হিং–এর আঠা বিক্রির বাসনা নেই, আমি গাছ কাটতে যাচ্ছি না।
হিং–এর বােটানিক্যালি নাম Ferula foetida Regil, হিং–এর পরিবার UJmbellifereae. এশিয়াটিক সােসাইটি প্রকাশিত বিপুল আয়ােজনের গ্রন্থ Medicinal Parts of Bangladesh–এ হিং–এর উল্লেখ নেই। সম্ভবত এই গাছ বাংলাদেশের নয় বলেই। তবে ড, তপন কুমার দের লেখা বাংলাদেশের প্রয়ােজনীয় গাছ গাছড়ায় হিং-এর উল্লেখ আছে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে এই উদ্ভিদের চাষ হচ্ছে। উনার কথা ফেলে দেয়া যাবে না। কারণ তিনি বন বিভাগের বড় একজন কর্মকর্তা। বনের রাজার কাছাকাছি পদের মানুষ।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
তার লেখা বইটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। ঔষধি ব্যবহার ড. তপন কুমার দে বলছেন’হিং হিস্টোরিয়া রােগ নিবারক, স্নায়ুবিক উত্তেজক। আমার প্রশ্ন, হিস্টোরিয়া স্নায়ুবিক উত্তেজনাতেই হয়। যে ওষুধ স্নায়ুবিক উত্তেজক সেই ওষুধ হিস্টোরিয়া আরাে বাড়াবে। কমাবে কেন ? না-কি বিষে বিষয়ের ব্যাপার? | হিং পেট ফাপায় খিচুনিতে খুবই কার্যকর। শিশুদের ব্রংকাইটিস এবং নিউমােনিয়া উপকারী এপিলেস্থিতেও ব্যবহার করা যায়। শ্বাসযন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্রে হিং উত্তেজক ওষুধ।
শিবকালী তাঁর বইতে লিখছেন, ‘হিং কাঁচা খেলে মহিলাদের গর্ভপাতের সম্ভাবনা। কাজেই মহিলারা সাবধান।
গাছপালা-বিষয়ক শুকনা {} বিষয় নিয়ে আমার লেখাগুলি পাঠক–পাঠিকারা পড়ছেন বলে মনে হয় না। যারা পড়েছেন তাদের হয়তাে ইতােমধ্যে ধারণা হয়েছে, ভেষজ বৃক্ষের ঔষধি গুণের উপর আমার অসম্ভব আস্থা। তা কিন্তু না । বর্তমান বিজ্ঞান কঠিন পরীক্ষা–নিরীক্ষার বিজ্ঞান। প্রাচীন ভেষজবিদরা কী ধরনের পরীক্ষা করেছেন তা জানা নেই।