শিবের প্রিয় বস্তু গাঁজা এবং ভাং। বর্তমানের অনেক তরুণ–তরুণী শিবের। পথ ধরেছেন, গাঁজা খাচ্ছেন। তবে তাদের আদর্শ শিব না— পশ্চিমা দেশগুলির তরুণ–তরুণী। যেহেতু তারা Grass খাচ্ছে, কাজেই আমাদেরও খেতে হবে।
বছর পনেরাে আগে আমি সুসং দুর্গাপুর গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা মেলাবার বেশ অনেকক্ষণ পর শাখের আওয়াজ হতে লাগল। থেমে থেমে শাঁখের আওয়াজ। আমাকে বলা হলাে, গাঁজা খাওয়ার জন্যে ডাকছে। গঞ্জিকাসেবীরা এই আওয়াজ শুনে একত্রিত হবেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আনন্দময় ভুবনে (!) প্রবেশ করবেন। কাছে গিয়ে দৃশ্যটা দেখার শখ ছিল। আমাকে বলা হলাে, কাছে গেলেই খেতে হবে ।
গাছটির বােটানিক্যাল নাম Canabis sativa Linn. গােত্র Urticaceae. শুভ সংবাদ হচ্ছে, এই গােত্রের আর কোনাে গাছেরই মাদক গুণ নেই।
গাঁজা গাছের স্ত্রী-পুরুষ আছে। দুই ধরনের গাছেই ফুল হয়। তবে শুধু স্ত্রী গাছই গাঁজা, ভাং এবং চরস দেয়। পুরুষ গাছের মাদক ক্ষমতা নেই। ধিক পুরুষ গাঁজা বৃক্ষ?
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
স্ত্রী গাছের শুকানাে পাতাকে বলে সিদ্ধি বা ভাং। কালীপূজায় ভাং-এর শরবত অতি আবশ্যকীয় বস্তু। ভাং–এর শরবত কী করে বানাতে হয় সেই রেসিপি জোগাড় করেছি। সংগত কারণেই দিচ্ছি না । এই শরবত ভয়ঙ্কর হেলুসিনেটিং ড্রাগ । ট্রাকের পেছনে যেমন লেখা থাকে ১০১ হাত দূরে থাকুন, ভাং–এর শরবত
থেকে ১০১ মাইল দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।
স্ত্রী গাজা গাছের পুষ্পমঞ্জুরী থেকে তৈরি হয় গাঁজা। খুব কঠিন প্রস্তুতিপর্ব না।
রোদে শুকিয়ে নিলেই হলাে। স্ত্রী গাছের কাণ্ড, পাতা এবং ফুল থেকে আঠালো যে নির্যাস বের হয় তা জুমিয়ে তৈরি হয় চরস। শুনেছি চরস খেতে হয় ময়দা দুর্গন্ধময় কঁখিী বা কম্বল গায়ে জড়িয়ে। কাঁথা কম্বল যত নােংরা হবে, নেশা না কি তুতই জমবে।
রসায়ন— গাজা গাছের ফুল, ফল, পাতা এবং এর গা থেকে বের হওয়া। নির্যাসে আছে সঙ্কুরেরও বেশি ক্যানাবিনয়েস। এদের মধ্যে প্রধান ক্যালাবিনল, কানিবিড়িওল, কানাবিনি। এছাড়াও আছে নানান ধরনের Alhaloids (নাইট্রজেন ঘটিত যৌগ) এবং কোলিম ট্রাইনেলিন। এইসব জটিল যৌগের কারণেই শাজা, ভাং এবং চরলসেবীদের ভেতর তৈরি হয় অবসাদ, নেশা এবং বিভ্রম। দীর্ঘ ব্যবহারে ব্রেইনের বাবােটা বেজে যায়। নানান ধনের স্নায়ুবিক রোগ দেখা দেয়। যে বস্তু শিব এবং নন্দি সৃঙ্গি হজম করে, সেই বস্তু আমরা হজম করব কীভাবে?
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
এখন দেখা যাক গাঁজা গাছের ভেষজ দিক। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে চীন সম্রাট সেন নুং গাজা গাছের ঔষধি গুণ প্রথম আবিষ্কার করেন (সূত্র Internet, নওয়াজেশ আহমেদ, বাংলার বনফুল) । প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এর ওষধি গুণ নিয়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় নি। শিবকালী অট্টাচার্য লিখছেন— “রসের চিকিৎসা স্থানের প্রথম অধ্যায়ে এবং মুতের চিকিৎসাস্থানের ২৯ অধ্যায়ে সোমবন্ধুরীর উল্লেখ থাকলেও এটা যে সিদ্ধি বা ভাং এটাকে উপস্থাপিত করা যায় না।”
তথ্যকথা বাদ থাকুক। আমরা বরং এই নিষিদ্ধ গাছের ভেষজ প্রয়োগ দেখি। গাঁজার ভেষজগুণ কোনাে শ্রুতিতে নেই, তবে ভারতবর্ষে এর ভেষস্ত্র ব্যবহার
মিলিত রূপ।
পাঠক যদি প্রশ্ন করে বসেন— সত্ত্ব, রজঃ, তমাের ব্যাখ্যা কী ? আমি নাফার।
ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনাদের যেতে হবে বেদাচার্যের কাছে। গাজার ঔষধি ব্যবহার । অর্শরােগের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হলে দুধের সঙ্গে বেটে প্রলেপ দিতে হবে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
লাগানাে হতাে।
অতি আধুনিক কালে ইউরােপের হাসপাতালে ক্যান্সারের প্রচণ্ড ব্যথা
কমানোয় গাজায় ধোয়া পান করতে দেয়া হয়। সিদ্ধির ঔষধি ব্যবহার। গাঁজার পাতারই আরেক নাম সিদ্ধি কিংবা ডাং। মহাপুরুষরা সিদ্ধি লাভের জন্যে এই বস্তু ব্যবহার করতেন। মহাপুরুষ হবার সহজ পথ (!) বাধা থাকুক । সিদ্ধির পাতা শােধনের নিয়ম বলি । দুধের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। দুধ যখন হালকা সবুজ বর্ণ ধারণ করবে, তখন দুধ ফেলে দিয়ে সিদ্ধি পাতা সংগ্রহ করতে হবে। সেই পাতা ভালােমতাে পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে সামান্য ঘিতে ভেজে বােতলে ভরে রেখে দিতে হবে। তৈরি হয়ে গেল ভেষজ গুণসম্পন্ন সিদ্ধি।
শিদের ‘তড়কা রােগে খিচুনিতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্রিয়া করে। দুঃখিত, যাত্রা জানি না। | হাঁপানিতে, Hay fever–এ দারুণ কার্যকর। হৃদযন্ত্রের সমস্যায়ও এর ব্যবহার আছে।
কামউত্তেজক হিসেবে সিদ্ধির ভালাে লামড়া কাছে। রাজা–মহারাজাদের বই নারীর কাছে সান্ত্বনা পাবার জন্যে যেতে হতাে। তাদের জন্যে বিশেষভাবে ঘিয়ে ভাজা সিদ্ধি তৈরি করে দিতে হতে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আমরা যেহেতু আমজনতা, রাজাবাদশা নই, সিদ্ধির এই অপূর্ব (৫) ভেষজগুণের বিষয়ে আমাদের না জানলেও চলবে। আমাদের
জন্যে রবীন্দ্রনাথই ভালাে ।
দেখব শুধু মুখখানি শুনব যদি নাও বাণী । না হয় যা অনাদরে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেলগাছে ভূত থাকে এই তথ্য নিশ্চয় জানেন? সব ধরনের ভূত না। ভূত সমাজের শ্রেষ্ঠরা। ব্রাহ্মণ ভূত, যার আরেক নাম ব্ৰহ্মদত্যি। উচ্চশ্রেণীর ভূতরা বেলগাছে থাকবেন এটাই তাে স্বাভাবিক। কারণ বেল হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র বৃক্ষ। বেলের তিন পাতা হচ্ছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রতীক। শিবের ত্রিনয়নের প্রতীক। সত্ত্ব, রজ এবং তম গুণের প্রতীক । জাগ্রত, সুষুপ্তি এবং স্বপ্নের প্রতীক। বেলপাতা ছাড়া শিবপূজা হবে না। দুর্গাপূজারু আদিবাস এবং বােধন দুইই হয় বেলগাছে। বচনই তাে আছে–—
“আসছে দুর্গাপূজা
বেলপাত্রী চাই বােঝ বােঝ। হিন্দু ছাত্রদের বই খুললেই পাওয়া যাবে বেলপাতা। কারণ এই পাতা দেবী সরস্বতীরও পছন্দ। সরস্বতী পূজায় বইয়ের ভেতর বেলপাতা দিয়ে সেই বই দেবীর পায়ের কাছে রাখলে দেবী বিদ্যা দেন।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
বেল Rutaceae পরিবারের গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Aegle marmelos.
বেলের রসায়ন— বেলে আছে জটিল কিছু Alraloids (নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগ) যেমন Haplopine, Aegeline, Tambanide, ditamine ইত্যাদি। আরাে WCE Coumarins (4.– 6. 7– dimethoxy coumarin, scopoletin, Kanthotoxin, Marimin, Marmasin ইত্যাদি। Sterol আছে দুই ধরনের, Betasitosterol এবং Garasitosterol, এইখানেই শেষ না, আরাে কিছু জটিল যৌগ আছে যার একটি হলাে lupeo,
বেল অতি পরিচিত ফল। প্রধান ব্যবহার শরবত তৈরিতে। পাকা বেলের শরবতের রেসিপি সবার জানা। আমি কঁাচা বেলের শরবতের একটা রেসিপি দিচ্ছি । কারণ প্রাচীন ভেষজবিদরা পাকা বেলকে বিষবৎ পরিত্যাগ করে কঁচাবেলকে মৃত্নসম গ্রহণ করতে বলেছেন।
সংহিতায় বলা হচ্ছে— ‘পক্কং বিষ্মং বিষোপমম, আমং তুং অমৃতােপমম’
এখানে কাঁচাবেলের শরবতের রেসিপি রেসিপি দিয়েছেন হেকিম মাওলানা মােঃ মােস্তফা (তিব্বিয়া হাবিবিয়া ইউনানী কলেজ, ঢাকা)।