বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

পানের শিকড়ের একটা ব্যবহারের কথা বলে পান-বিষয়ক আলােচনা শেষ করি । পানের শিকড় মেয়েদের বেটে খাওয়ালে না-কি আর গর্ভ সঞ্চার হয় না। বইপত্রে দেখেছি এটা না-কি পরীক্ষিত ।

বৃক্ষকথা

ভয়াবহ এই পরীক্ষা কীভাবে করা হলাে, কেন করা হলাে, কে জানে! Glossary of Indian Mediciral Plants-এ এই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। 

“চারিদিকে বাংলার ধানি শাড়ি-শাদা শাখা বাংলার মাস 

আকন্দ বসল ঘেরা এক নীলময় আপনার মনে ভঙিতেছে ধীরে ধীরে : চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস|

জীবনানন্দ দাশ 

কবি কি ভুল করে বাসকলতা লিখলেন ? না-কি ছন্দ মেলানাের জন্যে লতা” যুক্ত করেছেন ? আকন্দ লতানাে গাছ হলেও বাসক না। বাসক বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। একসময় গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে বাসক এবং তুলসি গাছ দেখা যেত । এখনাে হিন্দুবাড়িতে তুলসি গাছ দেখা যায়, তবে বাসক না। 

বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

অর্শ্ববেদের ব্যাখ্যাকার মহীধর বাসককে বলেছেন অট রূষক। অট রূষক হলাে, শরীরের দোষকে (রােগ) হিংসা করে। চরকের টীকায় চক্রদত্ত বলেছেন— 

বাসায়াং বিদ্যমানায়া মাশায়ং জীবিতস্য চ। 

রক্তপিক্ট ক্ষয়ি কাশি কিমর্থমবকসদৃতি।। অর্থ হচ্ছে, বাসক যদি থাকে তাহলে ক্ষয়রােগ ও কাশরােগে মৃত্যুচিন্তায় অস্থির হবে কেন ? 

বাসকের বােটানিক্যাল নাম Adhatoda vasica Nees. এর ইংরেজি নাম Malabur Nut, আরবি নাম ইশীশতু সুল, ফরাসি মাম রব্বাজা (সূত্র : ওষুধি উল্লিদ, ড. সামসুদ্দিন আহমেদ)। বাসকের আরবি, ফরাসি এবং ইংরেজি নাম প্রমাণ করে বাংলার এই অভিদের পরিচিতি ব্যাপক। 

এদেশে বাসকের প্রধান ব্যবহার কাশিতে । প্রচণ্ড কাশি হয়েছে, বুকে কফ জমেছে, মনে হচ্ছে অ্যান্টিবায়ােটিক খেতে হবে, তখন বাসক পাতার রস খেয়ে দেখা যেতে পারে। বাসক পাতার রস যে অতি কাশি দূর করে তার প্রমাণ আমি নিজে। যতবার কাশি হয়েছে পাতার রস খেয়ে সুস্থ। সমস্যা একটাই, ডোজের সমস্যা।

বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ কতটুকু রস খাবেন? একটা শিইবা কতটা যাবে? আয়ুর্বেদে ডােজের’ বিষয়টা অনুপস্থিত বলেই হয়। ব্যাপক গবেষণা করে ডােজের বিষয়টা ঠিক করা উচিত না ? দু’হাজার বছর আগের পুরনাে পুঁখি দেখে 

চলাটা কি এই যুগে যুক্তিযুক্ত? বাসকের অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টও তো খুঁজে বের করা প্রয়ােজ্জন। 

বাসকের রসায়নে দেখি asicine, I-Pegaoine এবং কিছু essential oil, এর কোনটা অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট। 

বাসক পাতার প্রচণ্ড জীবাণু বিধ্বংসী ক্ষমতা আছে। এটা পরীক্ষিত । কয়েকটা পাতা ছিড়ে কলসির পানিতে ছিটিয়ে দিলে কলসির পানি জীবাণুমুক্ত হবে। 

এখানেই বা অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট কী ? 

তিন ধরনের বাসক গাছের উল্লেখ দেখা যায়। সাদা বাসক, আম্রপুষ্পি বাস এবং রক্তপুষ্পি বাসক। আমপুলিশ বাসক এবং পুষ্পি বাসক অতি দুর্লভ বলেই হয়তাে এদের ভেষজ গুণ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।

বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

নুহাশ পল্লীতে সাদা বাসক ছাড়াও আছে কালাে বাসক। ফুল গাঢ় নীল, প্রায় কালচে। এই বাসকের উল্লেখ কোথাও পাই নি। বাসক ফুল যে শীল হয় আমি জানল্লাম না। 

এখন আসুন ঔষধি ব্যবহারে । 

গাত্রবর্ণ ফর্সা করা প্রয়ােজন। শখ অমর সঙ্গে বাসক পাতার রস মিশিয়ে গােসলের তিনঘণ্টা আগে গায়ে মাখুন। এক সপ্তাহেই কাজ হবে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। 

খােসপাচড়া : গরুর প্রস্রাবের সঙ্গে বাসক পাতা বেটে লাগালে নিশ্চিত নিরাময়। (সূত্র : চিরঞ্জীব বনৌষধি, শিবকালী}। 

হাঁপানিতে ; বাসকের পাতা শুকিয়ে সিগারেট বানিয়ে টানলে হাঁপানির আরাম। 

অর্শরােগে : বাসক পাতা থেঁতাে করে (অল্প গরম করে) ন্যাকরায় পুঁটলি বেঁধে মলদ্বারে সেঁক দিলে যন্ত্রণা ও ফোলা দুইই কমবে। 

বেঁচে থাকুক আমাদের চিরচেনা বাসক। 

অরু। অগর 

নুহাশ পল্লীতে গােটা বিশেক অগুরু গাছ আছে। সিলেট চা-বাগানে আমার এক প্রিয়জন অারজু থাকে। তার কাজ হচ্ছে খুঁজে খুঁজে দুর্লভ গাছ জোগাড় করে পাঠাননা। অগুরু সেই অর্থে দুর্লভ না। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর জন্মায়। অগুরু কাঠ পাতন করে সিলেট অঞ্চলে সুগন্ধি বের করা হয়।

বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

আরজু অগুরু গাছ পাঠিয়েছে ঔষধি গাছ হিসেবে না। অর্থনৈতিক বিবেচনায় । সে অতি উৎসাহে বলেছে, এক একটা গাছ আপনে লাখ টেকায় বেচবেন। | লক্ষ টাকায় গাছ বিক্রির আমার কোনাে শখ নেই। ঔষধি গাছ সংরক্ষণের শ। সর্ব অর্ধেই অগুরু ঔষধি গাছ। অগুরু শাব্দিক অর্থ যার ধক্ষ নেই।

সংহিতায় বলা হয়েছে, বনভূমিতে তুমি সব বিচারেই গুরু, তাই তুমি অপরু।’ | অপুরু হচ্ছে সেই গাছ যার বাকলে লেখা হলাে। বাকল পাতলা কিন্তু শক্ত। আরবে এই বৃক্ষ জানে কিনা জানি না, কিন্তু তাদের কাছে এই বৃক্ষের কদর আছে। আরবিতে অগুরু গাছকে বলে উদ। বােটানিক নাম Aquilana Talaccensis Lamk. Thymeleaceae 6699 || 

পাতন প্রক্রিয়ায় অগুরু থেকে যে তেল পাওয়া যায় তাতে আছে সেলিনিন, এগারুন এবং বেশকিছু কিটোন । গাছের ভেতরে তেল তৈরির জন্যে গাছকে কিন্তু নানানভাবে কষ্ট দেয়া হয়। গােড়া থেকে গাছের কাণ্ডে প্রচুর পেরেক পুঁতে দেয়া হয় । গাছু কষ্টের ভেতর দিয়ে যায়, ছত্রাকের আক্রমণে পর্যদুস্ত হয়। তখনই নাকি গাছ সুগন্ধি তৈরি করে। নুহাশ পল্লীর কোনাে অগুরু গাছে আমি পেরেক পুঁততে দেই নি। সুগন্ধি তেলের আমার প্রয়ােজন নেই। ভালাে কথা, একটা তথ্য দিতে ভুলে গেছি। সব কাঠ পানিতে ভাসে। অগুরু কাঠ ভাসে মা। পানিতে ডুবে যায়। ঔষধি ব্যবহার

বৃক্ষকথা-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ

মেদ ভুড়ি কী করিওয়ালাদের জন্যে সুসংবাদ। অগুরু কাচন্দনের মতাে 

ঘষে ১ চা-চামচ করে খেলে মেদ রােগ সারে। গরম পানিতে এক কাপে এক চামচ অগুরুর পাউডার খেলে হাঁপানি রোগ সার। গুধু হাঁপানি না, পাপুরােগেও (রক্তশূন্যতা) এটি মহৌষধ। অগুরু পাউডার গায়ে মাখলে চুলকানি এবং ছুলি ৰােগের আরাম হয়। 

বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদ ফর্মুলারি ১৯৯২-তে যেসব অসুখে অগুরুর ব্যবহার দেখানাে হয়েছে তা হলাে, মেদরোগ, মুখে দুর্গন্ধ, হৃদরােগ, পাপু, প্রমেহ, কুষ্ঠ, কত, ধ্বজভঙ্গ, শুক্ৰদোষ ইত্যাদি সূত্র : ঔষধি উদ্ভিদ; ডি, সামসুদ্দিন আহমদ। চীনা ভেষজে অগুরু কাঠকে বিবেচনা করা হয় কামউত্তেজক হিসেবে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *