
যাই হােক, নিসিন্দার দু’টি প্রজাতি দেখা যায়। একটি নীল ফুল ফোটায় । তার নাম নির্মুন্ডি । অন্য প্রজাতিটি ফোটায় সাদা ফুল । এই প্রজাতি সিন্দুবার নামে পরিচিত।
নিসিন্দার রসায়ন এলকালয়েড তাে (নাইট্রোজেনঘটিত যৌগ) থাকবেই। যার একটির নাম Nishindine, অলা এলকালয়েডগুলিকে আলাদা করা যায় নি। নিসিন্দায় Sterol আছে এবং farpengid জাতীয় যৌগ আছে।
আমি নিজে কেমিস্ট্রির ছাত্র। কাজেই বৃক্ষ–রসায়ন সম্পর্কে আরাে ভালােভাবে কথা বলা উচিত ছিল।
ব্যবহার। বাংলাদেশে দাত মাজতে নিমের মাজল ব্যবহার কা হয়। নিমের পরেই নিসিন্দার ব্যবহার। নবিজি (দ.) মেছওয়াক করতেন, কাজেই বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিম-নিসিন্দার ডাল দিয়ে নবিজির (দ.) সুন্নত পালন করেন ।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
ধান, চাল, ডাল জাতীয় শস্যকে পােকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে নিসিন্দার পাতার ব্যাপক ব্যবহার আছে। গােলার শস্যের ওপর নির্সিার পাতা ছড়িয়ে দিলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ হবে না।
নিসিন্দার পাতা মেশানাে পানিতে রােগগ্রস্তু মানুষকে স্নান করানাের প্রাচীন রেওয়াজ আছে। আমি নিশ্চিত এই গাছের পাতার জীবাণু বিধ্বংসী ক্ষমতা আছে। ভেষজ গবেষকরা কি এগিয়ে আসবেন।
ভেষজ চিকিৎসার জনক চরক বলেছেন— ‘ফুণা আছে এমন সাপে যদি কাউকে দংশন করে, তাহলে তাকে শ্বেত নিসিন্দার মূলক পিষে পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াবে।’
ভেষজ চিকিৎসার আরেক গ্রান্ডমাস্টার চক্রদত্ত বলম্বুেন– ‘নীল নির্মির মূলের ছাল পিষে লসের মতাে নাক দিয়ে টেনে নিলে গলগণ্ড রােগ সারবে। সাধারণ ভেষজ ব্যবহার
অবুদ (টিউমার}; শরীরের কোনাে জায়গায় টিউমার হলে নিসিন্দার পাতা বেটে গরম করে কয়েকদিন লাগালেই টিউমার সারবে । সূতিকা রােগ : সূতিকা সারবে নিসিন্দা পাতা সেদ্ধ পানিতে গােসল করলে । ফেরেনজাইটিস, টনসিলাইটিস ; পাতা সেদ্ধ পানি দিয়ে সেই পানি মুখে রাখতে হবে এবং গার্গল করতে হবে। বেডসাের (Bedsar} : শুকনা নিসিন্দার পাতা গুড়া করে ক্ষতে ছড়িয়ে দিলে দ্রুত ৰােগ সারে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
জিভে বা মুখে ঘা : কিছু জিও বা মুখের ঘা আছে যা কিছুতেই সারতে চায় লা। নিসিন্দা পাতার রস ঘি দিয়ে জ্বাল দিয়ে পেস্টের মতাে বানিয়ে প্রায় দিলে নাকি ঘা সারবেই। প্রাচীন ভারতের কিংবদন্তি চিকিৎসক সুক্ৰতের একটা কথা এই ফাকে বলে নেই, প্রাণ রক্ষা পেতে পারে প্রাণ দিয়েই।
–সুত উদ্ভিদ প্রাণ । সিনথেটিক ওষুধ কি প্রাণ ? আধুনিক পৃথিবী সিনথেটিক ওষুধনির্ভর হয়ে পড়েছে। সুকতের জন্যে দুঃসংবাদ।IF ALLE= বিলম্বীর বােটানিক্যাল নাম Averlos bilim&ft. বােটানিক্যাল নামের শুরুটা গণসূচক, পরের অংশ প্রজাতিসূচক।
বিলম্বীর বােটানিক্যাল নামের গণসূচক শব্দটা এসেছে আরবের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী Averrhoa–র কাছ থেকে। বিলম্বী গাছ আরবে জন্মায় না, অথচ তার নামকরণে আরবের চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর নাম চলে এল। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? বিলম্বীর গোত্র নাম Averrhaacea.
বিলখী সহজলভ্য গাছ না। বাংলাদেশে নার্সারির কল্যাণে এই গাছ প্রচুর পাওয়া যায়। গাছের ফুল লাল কিংবা বেগুনি। গরমের সময় ফুল ফোটে। ফুল পাওয়া যায় শীতকালে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
ফলের স্বাদ কামরাঙ্গার মতো। ভালাে টক। আচার বানানাে ছাড়া এই ফলের আর কোনাে ব্যবহার আছে বলে ‘আমি জানি না। ত্রিপুরায় এই ফল দিয়ে টক রান্না করা হয়। বিলম্বীর পাকা ফল থেকে স্ট্রবেরীর গন্ধ বের হয়। ভেষজ ব্যবহার t বিলম্বী ফলের সিরাপ আন্ত্রিক রক্তক্ষরণ রােগে খুব উপকারী। জ্বর কমানােয়
এই ফলের ভূমিকা আছে। বিলম্বী স্কার্ভি রােগ প্রতিরােধ করে। বিলম্বির পুষ্টিগুণ ভালাে। এতে প্রচুর ক্যারােটিন আছে। সেই সঙ্গে শর্করা, প্রােটিন, স্নেহজাতীয় পদার্থ এবং খনিজ লবণ | একের ভেতর অনেক।
নিমের বোটানিক্যাল নাম Azadirachta indica A, Tuss, নামের প্রথম অংশ পারসিক শব্দ থেকে এসেছে, আর Indica যে India তা বুঝতে না পারার কারণ নেই। নিম পুরােপুরি এ দেশীয় গাছ, যদিও কিছু বইপত্রে পড়েছি এর আদি নিবাস বার্মা।
এখন সারা পৃথিবীতেই নিমের চাষ হচ্ছে। এর ভেষণ নিয়ে রীতিমধ্যে হৈচৈ। শুনেছি আমেরিকানরা এই গাছের Patent নিয়ে নিতে চাচ্ছে। এ নিয়েও নানান আন্দোলন। বাংলাদেশেও নিম গাছ নিয়ে একটা ফাউন্ডেশন আছে, নাম বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশন। জনাব এম, এ হাকিম বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘােষণা দিয়েছে। বলা হচ্ছে প্রাণীকুল এবং উল্লিদকুলের মধ্যে এমন উপকারী গাছ এখনাে আবিত হয় নি। বাতাসে অক্সিজেন ছেড়ে বাতাস বিশুদ্ধ করার ক্ষমতা নিমের মতাে অন্য কোনো বৃক্ষেরই নেই, এই সত্য আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একবার হজ্বে যাবার সময় সৌদি রাজার ভ্রুন্যে উপহার হিসেবে পঞ্চাশটা নিম গাছের চারা নিয়ে গিয়েছিলেন। আরবের উষর মরুভূমিকে এই নিম ছায়াময় করে তুলেছে। আরবের একটি অংশ আজ নিমময়। আরবে এই গাছকে এখন আদর করে কলা হচ্ছে জিয়া গাছ।
জিয়া পরিবারের নানান কর্মকাণ্ড পত্রিকায় পড়ে আমি যখন হতাশ, তখন এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতার প্রশংসাযােগ্য একটি কুকারে কথা বললাম ।
ভারতে নিম পবিত্র গাছ হিসেবে পরিচিত। ঠাকুর দেবতার মূর্তি নিম কাঠ ছাড়া তৈরি হতাে না। জগন্নাথ দেবের দারুমূর্তি বিশেষ লক্ষণযুক্ত নিমগাছের কাঠ ছাড়া কখনােই তৈরি হয় না ।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বাংলাদেশের গ্রামে নিমের লােক প্রধান ব্যবহার দত্তানে। নবিজি (দ.} দান করতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। কাজেই ধর্মপ্রাণ মানুষ নবির সুন্নত হিসেবে টুথপেস্ট এবং ব্রাশ ব্যবহার না করে নিমের দাত্তম ব্যবহার করে।
যখন বসন্তের টিকা বা ওষুধ কিছুই ছিল না, তখন বসন্তরােগীকে নিমপাঝে দুয়ায় শুইয়ে রেখে নিমের ডাল দিয়ে বাতাস করা হতাে।
প্রাচীন ভারতে বাড়ির দলিশ অবশ্যই নিমগাছ থাকত। যাতে বছরের বেশিরভাগ সময় যেন নিমের পবিত্র বিদ্ধ বাতাস ঘরে ঢোকে। প্রাচীন বাংলার আঁতুড় ঘরের দরজায় একগাদা নিমের ডলি ঝুলিয়ে রাখা ছিল অতি আবশাব্দীর কর্মকাণ্ড। তখন ধারণা করা হতাে নিমপাতা শিশুদের অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করে।
লিম অতি তিক্ত গাছ, কিন্তু তার ফল পাখিদের প্রিয় খাদ্য। ফলের বীজ থেকে সুগন্ধি তেল হয়। এই তেলের কড় অংশই সাবান তৈরিতে ব্যবহার হয়। বাংলাদেশের একন লেখক যার নামের আদ্যক্ষর ‘হ‘, নিম সাবান ছাড়া অন্য কোনাে সাবান ব্যবহার করেন না। তার কাছে না–কি এই সাবানের গন্ধ অত গৈ।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
নিমের ভেক্ষণ নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যায় । লিখতে ইচ্ছা করছে না। আমেরিকান বৈজ্ঞানিকরা ১৯৭৯ সন থেকে নিম নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণার ফলাফলে জার্নাল ভর্তি । Internet–এর বােতাম চাপলেই সব তথ্য বের হয়ে আসবে।
নিম বিষয়ে ব্যক্তিগত দুঃখের কাঁদুনি দিয়ে লেখা শেষ করি। নুহাশ পল্পীঃ ত্রিশ–চল্লিশটার মতো নিমগাছ আছে। গাছগুলি কেমন যেন মরা মরা। অন্যসব গাহু স্বাস্থ্য-সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। নিম গাছগুলিই শুধু চিমসি মেরে আছে। এরা মনে হয় আমাকে পছন্দ করে না।
নিমের গােত্র : Maliaceae
মেহগনি এবং তুন বৃক্ষও একই গােত্রের । ভালাে কথা, আমাদের পবিত্র গ্রন্থে তুল’ বৃক্ষের উল্লেখ আছে। তুল গাছ আমার সহে নেই বলে এই গাছ বিষয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে না।