নুহাশ পল্লীতে একটা খয়ের গাছ আছে। গাছটা সংগ্রহ করা হমােছে বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে। তেঁতুল গাছের মতাে পাতা। কাটায় ভর্তি। ভারতবর্ষে ১৮ প্রজাতির খয়ের। গাছ আছে। কিছু প্রজাতির পাই না–কি সত্তর–আশি ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। নুহাশ পরীর খয়ের গাছটিও দ্রুত বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত কত বড় হবে কে জানে!
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে খয়েরের কথা বারবার এসেছে। পানের সঙ্গে খয়ের বেলে ঠোট লাল হবে। কন্যার ঠোট লাল না হলে সৌন্দর্যই তাে ফুটবে না। ভাগ্যিস লিপস্টিক বাজারে এসেছে। এই বন্ধু না থাকলে তো খয়েরের পর প্রকা চাপ পড়ত। আজকাল অবশি বাজারে কালাে লিপষ্টিকও পাওয়া যাচ্ছে। কালাে ঠোটের সৌন্দর্য আমাকে এখনাে টানছে না। ভবিষ্যতে হয়তাে টানবে।
যাই হােক, খয়ের গাছের বােটানিকালি নাম Acaca catechu willd পরিবারের নাম Leguminosae.
I TGC , B 09 Y catechin, 1–epicatechin catechotannic অ্যাসিড় । খয়েরে laprin–ও আছে। Tannin নামের এই যৌগটি অবশি। বেশিরভাগ গাছেই আছে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
ব্যবহার মহিলাদের জন্যে সুসংবাদ, খয়ের মহিলাদের যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করে। যারা দীর্থ যৌন চান, তারা এখন থেকে পান খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানে খয়ের ব্যবহার শুরু করতে পারেন।
প্রতিটি সুসংবাদের সঙ্গে একটি দুঃসংবাদও থাকে।গায়ের চামড়া কালাে করে। এবং এটি গম্রাৰ কারক।
কোনাে মহিলাই পত্রবর্ণ কালো হােক তা চাইবেন না, তবে এর একটি ভালাে দিক আছে। যাদের শ্বেতীরোগ আছে, খয়ের ব্যবহারে সেই রােগের প্রকোপ কমবে। কারণ চামড়ার Pigmentaticx বাড়িয়ে দেখে।
গায়ক-গায়িকাদের পানি খেতে দেখা যায়। পানের বস গলার স্বরকে মিষ্টি করে এমন কথা প্রচলি আছে। পানের সঙ্গে মেষ খেলে সেই বয়ে করল দু করে।
যখন সিলিন্স এবং গনােরিয়ার কোনাে চিকিৎসা ছিল না, তখন প্রাচীন ভারতীয় ভেষবিদরা ক্ষতস্থানে খয়ের সূর্ণ ব্যবহার করে বিশেষ ফল পেতেল যতে দাবি করেছেন।
বলা হয়েছে অল্পমাত্রায় স্বয়ের যৌন সঙ্গম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ভায়াগ্রার বিকল্প হিসেবে এটা ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। তবে যা করবেন নিজ দায়িত্বে করবেন। আমি বইপত্রে যা পড়েছি তাই লিখছি।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মটুদের জন্য সুসংবাদ বয়ের মেদ কমায়। প্রাচীন ভেষজ শ্ৰছু গুরুত্বের সঙ্গে মেদ কমানাের কথা বলা হয়েছে। মূল ব্যক্তির প্রতিদিনই ১০/১৫ এম খয়ের কাঠের ঝুখি থাবেন। গায়ের রঙ সামান্য কালাে হয়ে যাবে। সেটা তেমন কোনাে বড় ক্ষতি না। মেদ ভূড়ি কী করি‘র হাত থেকে তাে বাঁচা যাবে। শেষ কথা ঋয়ের নামের অর্থ হিংসুক। সে সকল রােগ–ব্যাধিকে হিংসা করে বলেই এই নাম।
বেঁচে থাকুক এই হিংসুক বৃক্ষ। হিংসা সবসময়ই যে খারাপ তা কিছু না।
কৃষ্ণবট শ্রীকৃষ্ণ ননী চুরি করতেন। চুরি করা ননী লুকিয়ে রাখা বিরাট সমস্যা। বালক কৃষ্ণ এই সমস্যার সমাধান করলেন। তিনি একটা গাছ খুঁজে বের করলেন, যার পাতাগুলি ঠোঙ্গার মতাে। বালক কৃষ্ণ এই পাতার ঠোঙ্গায় ননী লুকিয়ে রাখতেন। বলেই গাছের নাম কৃষ্ণবট।
এই হচ্ছে নামকরণের পৌরাণিক শানে নজুল । উদ্ভিদ বিজ্ঞানী c D E Candolfe কৃষ্ণকটকে উল্লিদের এক নতুন প্রজাতি হিসেবে ঘােষণা দেন। যদিও তার ঘােষণা টিকে নি। বর্তমানে কৃষ্ণকটকে বটগাছের এক প্রজাতি হিসেবে ধরা হয় । বৈজ্ঞানিক নাম Ficus berigarsis var. Krishnea. বােটানিক্যাল নামে অবশ্যি শ্রীকৃষ্ণ স্থান পেয়েছেন। এই গাছের গােত্র Moraceae. আরেকটি কথা, বােটানিক্যাল নামে bengalensis বঙ্গদেশ বুঝায়।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নলিনীকান্ত চক্রবর্তী তার বই ত্রিপুরার গাছপালায় লিখেছেন
“পঞ্চাশের দশকে কলিকাতা হতে চারা এনে একটি কৃষ্ণকট কলেজটিলায় মহারাজা বীরবিক্রম কলেজের ছেলেদের কমন রুমের পেছনে লাগানাে হয়। যা কালক্রমে বিশাল কৃক্ষে পরিণত হয়। আমি কলেজে থাকাকালীন ছাত্রদেরকে এই বৃক্ষটি প্রতি বছর দেখাতাম। বছরখানিক আগে জানতে পারি কে বা কারা গাছটি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমার জানামতে ত্রিপুরায় বর্তমানে আর এই জাতের গাছ নেই।
নলিনীকান্ত বাবুর মনের কষ্ট বুঝতে পারছি। তবে আমার মনে আনন্দ হচ্ছে একটি কারণে যে, নুহাশ পল্লীতে কৃষ্ণবটের একটা গাছ আছে। পাতাগুলি ঠোঙ্গার মতো। প্রকৃতি তার বৃক্ষ জগৎ নিয়ে কত মজাই না করে।
বিভূতিভূষণ যারা পড়েছেন তারা ঘেটু ফুল চেনেন। তাঁর বইয়ে ঘেটু ফুলকে তিনি ভাট ফুল বলেছেন। ভাট ফুলের সৌন্দর্যে বারবার অভিভূত হয়েছেন। ভাট গাছ কিংবা যেটু গাছ গ্রামবাংলার ঝোপঝাড়ে অযত্ন–অবহেলায় বড় হয়। কেউ ফিরেও তাকায় না। বিভূতিভূষণের কারণে আমি ফিরে তাকালাম। অতি যত্নে একটা ভাট গাছ এনে নুহাশ পল্লীতে লাগালাম। গােবর দেয়া হলাে, সার দেয়া হলাে। হল্যান্ডের এক কোম্পানির slow reloax nutrients–এর একটা ট্যাবলেটও দেয়া হলাে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
ভাট ফুল গাছ অপ্রত্যাশিত এই আদর–যত্নে হলাে অভিভূত।ঝাকড়া গাহু পাতায় পুশে ঝলমল করতে লাগল।
যেটু গাছের আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। ঘণ্টাকর্ণ পৌরাণিক নাম। মা শীতলার (গুটি বসন্তু যার কল্যাণে [!] ছড়ায়। স্বামীর নাম ঘণ্টাকর্ণ ।
যাই হােক, গাছটার বােটানিক্যাল নাম Clerodendru fragrans পরিবার Verbenaceae. রসায়ন GU CV Clerodin, Sterol, Xanthophyll 4 Carotene. 4. ut VICE Protein 21.2%, Fibre 14.8%, Reducing sugar 3.0%, Total sugar 17.০%। ‘ভাটের পাতায় কয়েক ধরনের অ্যাসিডও আছে, যেমন Linolenic acid, Obic acid, Stearic acid, Lignoceric acid.
ভাটের রসায়নে প্রচুর চিনি আছে বলে বলা হচ্ছে। আমি পাতা চিবিয়ে দেখেছি, মহা তিতা, প্রায় নিসিন্দার তিতার মতাে। ভেষজ ব্যবহার
চর্ম রােগ ; যে–কোনাে ধরনের চর্মরােগে আটগাছের রস দু‘তিন দিন লাগালেই রােগ সারবে। পেট ফাপা : বিয়ে বাড়িতে প্রচুর খাওয়া–দাওয়ায় পেট ফেপেছে। টক ঢেকুর উঠছে, প্রাণ যায় অবস্থা। সহজ চিকিৎসা। ঘেটু মূলের ছাল তিন-চার গ্রাম বেটে খেয়ে নিতে হবে।
বৃক্ষকথা-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
কৃমিতে : প্রতিদিন খালি পেটে যেটু পাতার রস দু‘চামচ খেলে কোনাে কৃমিই থাকবে না। ম্যালেরিয়ায় ; দেশে কুইনাইন আসার আগে ম্যালেরিয়াতে ঘেটু পাতার রস খাওয়ানাে হতাে। টিউমারে : সাধারণ টিউমারের (ক্যান্সার না, এমন ভালাে চিকিত্সার কথা উল্লেখ করছি ঘেটু পাতা এবং তার মূলের ছাল বেটে টিউমারে কয়েকবার লাগালে টিউমার মিলিয়ে যাবে। উকুনে : মাথার উকুনের নানান ওষুধপত্র এবং শ্যাম্পু পাওয়া যায় । ভেষজ চিকিৎসা করে দেখলে কেমন হয় ? ঘেটু পাতার রস মাথায় মেখে গােসল সেরে নিলে উকুনের ভূষ্টিনাশ হবার কথা।
ঘণ্টাকর্ণের একটা পৌরাণিক রূপ আছে। সেই রূপটা বলে নেই । ঘণ্টাকর্ণ একজন অপদেবতা। তার দুই কানে ঝুলন্ত দুটা ঘন্টা। সে যখন চলাফেরা করে, তখন বিকট শব্দে কানে ঘণ্টা বাজে। সাধারূণ মানুষ এই ঘণ্টাধ্বনি সহ্য করতে পারে না। অনেকেই মৃত্যুবরণ করে।