তাের কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তা করব না ?
করবে না। বড় খালা বা ছােট খালা এদের কারাের সঙ্গে কি মা’র যােগ আছে? যযাগ নেই। হঠাৎ হঠাৎ বিয়ে জন্মদিন এইসব উৎসবে তাদের দেখা হয় । এই পর্যন্তই।
আমাদের অবস্থাও তাই হবে। তুমি তােমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আমি আমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হব । কাজেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে নিজের জীবনটা কেমন যাবে তা নিয়ে চিন্তা কর।
ইদানীং তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবছিস। ভাবাভাবির কিছু নেই আপা, আমি বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিমতী কোনাে মেয়ে চাঁদাবাজ ছেলের প্রেমে পড়ে ?
হ্যা, পড়ে। অতি চালাকের গলায় দড়ি’ এই প্রবচনটা জান না? আমি অতি চালাক বলেই আমার গলায় দড়ি।
পুরাে ঘটনাটা কি আমাকে বলবি ? । ঘটনা বলে বেড়াতে লাগে না।
আবদুর রহমান সাহেব খেতে বসেছেন। এশা খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, মাছের তরকারিটা অপূর্ব হয়েছে রে মা! এশা শীতল গলায় বলল, মাছের তরকারি তুমি এখনাে মুখে দাও নি বাবা। আবদুর রহমান ব্ৰিত গলায় বললেন, মুখে দিতে হবে না। আমি চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি। চেহারা দেখেই ষােলআনার বারােআনা বােঝা যায়। এশা বলল, চেহারা দেখে কিছুই বােঝা যায় না।
শামা এক প্যাকেট বাবলগাম, একটা ইরেজার কিনল। পছন্দের ইরেজার বেছে বের করতে তার সময় লাগল। বাজারে নানান ধরনের ইরেজার এসেছে। পেনসিলের দাগ মুছতে পারুক আর না পারুক দেখতে সুন্দর। শামার বুক সামান্য ধকধক করছে। দোকানিকে দাম দেয়ার পর তাকে অভিনয় করতে হবে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
অভিনয়টা ভাল হতে হবে।
আতাউরকে দোকানের এক মাথায় দেখা যাচ্ছে। আতাউরকে দেখে চমকে ওঠার ভান করতে হবে। চমকে উঠে বলতে হবে, আপনি এখানে কী করছেন? কথা বলারও বিপদ আছে, গলার স্বর চিনে ফেলবে না তাে ? ভুরু কুঁচকে ভাববে নাতাে— টেলিফোনে যে কথা বলছিল তার সঙ্গে এই মেয়েটার গলার স্বরের এত মিল কেন ? না, তা ভাববে না। টেলিফোনে মানুষের গলার স্বর অন্যরকম শােনায়।
তাছাড়া দু‘বােনের গলার স্বরে মিল থাকতেই পারে। শামার বান্ধবী তৃণী এবং তার মা’র গলার স্বর অবিকল এক রকম। এই নিয়ে কত ঝামেলা হয়েছে। সাগর ভাই তৃণাদের বাসায় টেলিফোন করেছেন। টেলিফোন ধরেছেন তৃণার মা। তিনি হ্যালাে বলতেই সাগর ভাই বললেন, জানগাে তুমি কেমন আছাে? তােমার রাগ কি কমেছে ? তৃণার মা শান্ত গলায় বললেন, তুমি কাকে চাচ্ছ ? তৃণাকে ? ও টয়লেটে আছে। আমি তৃণার মা।
বাবলগাম এবং ইরেজারের দাম দেয়া হয়েছে, এখন শামা চলে যেতে পারে। একটা ব্যাপারে সে মন ঠিক করতে পারছে না। আতাউরকে দেখতে পায় নি এমন ভান করে সেকি বের হয়ে যাবে? না–কি হঠাৎ দেখতে পেয়ে অবাক হবে ? দেখতে
পাওয়ার অভিনয়টাই সহজ হবে। মাথা নিচু করে দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়া— এর একটা সমস্যা আছে। আতাউর যেমন লাজুক সে হয়ত চোখই তুলবে না। নিজ থেকে এগিয়ে এসে কিছু বলবে না। চিন্তা করার জন্যে আরেকটু সময় দরকার। আরাে কিছু কিনলে হয়। দাম কুড়ি টাকার মধ্যে হতে হবে। তার সঙ্গে ত্রিশ টাকা আছে। এই ত্রিশ টাকা থেকে রিকশা ভাড়া দিতে হবে। শামা। একটা নেইল পলিশ রিমুভার কিনল। বােতলের মুখ খুলে নিজের নখে খানিকটা লাগাল। এই কাজগুলি করতে গিয়ে সময় পাওয়া যাচ্ছে। মিস্টার খাতাউরকে লক্ষ করতে পারছে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতি। দুজন দুজনকে আড়চোখে লক্ষ ।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
করতে করতে এক সময় চোখাচোখি হয়ে যাবে। তখন শামাকে কিছু বলতেই হবে। শামার প্রথম কথাটা কী হবে– আরে আপনি ? না–কি সে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেবে ? সালামটাতাে মনে হয় দেয়া উচিত।
শামা তুমি এখানে?
শামা এতই চমকে গেল যে তার হাত লেগে নেইল পলিশ রিমুভারের বােতল টেবিলে কাত হয়ে পড়ে গেল। শামা বােতল তুলতে তুলতে বলল, স্লামালিকুম।
তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ ? জি। এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে দোকানে ঢুকেছিলাম। হঠাৎ দেখি তুমি!
শামা মনে মনে বলল, খাতাউর সাহেব আপনিতাে মিথ্যা খুব ভালই বলছেন। বেছে বেছে শার্টটাও সুন্দর পরেছেন। কেউ নিশ্চয়ই বলেছে এই শার্টে আপনাকে ভাল মানায়। ঐ দিন আপনার চেহারা ভালমতাে দেখতে পাই নি। আজ দেখতে পাচ্ছি। চেহারা খারাপ না। থুতনিতে কাটা দাগ কেন ? ছােটবেলায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন? কীভাবে ব্যথা পেলেন সেই গল্পটা এক সময় শুনব।
কী জন্যে শুনব জানতে চান ? শুনব কারণ আপনি গল্প কেমন বলতে পারেন সেটা জানার জন্যে। বেশির ভাগ মানুষই গল্প বলতে পারে না। যেমন আমার বাবা। বাবা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেন কাজেই ধরে নিতে পারি আপনিও বাবার মতাে গল্প বলতে পারেন না। | শামা দোকান থেকে বের হলাে। তার পেছনে পেছনে বের হলাে আতাউর। শামা বলল, আজ আপনার অফিস নেই ?
আতাউর বলল, অফিস আছে। আমি ছুটি নিয়েছি। ছুটি নিয়েছেন কেন ? শরীরটা ভাল না। ভাবলাম ঘরে শুয়ে থেকে বিশ্রাম করব। কই আপনিতাে ঘরে শুয়ে নেই। দোকানে দোকানে ঘুরছেন।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
আতাউর বিব্রত ভঙ্গিতে কাশল। শামা বলল, আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন নাতাে। সিগারেট ধরান।
আতাউর বলল, আমি সিগারেট খাই না। একটু আগে যে বললেন, সিগারেট কেনার জন্যে দোকানে ঢুকেছেন ?
আমার জন্যে না। আমার বােনের হ্যাসবেন্ডের জন্যে। দুলাভাই খুব সিগারেট খান। কেউ তাকে সিগারেট উপহার দিলে তিনি খুব খুশি হন। আমি মাঝে মাঝে তাকে সিগারেট দেই।
ও আচ্ছা।
শামা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। রিকশা ঠিক করে বাসার দিকে রওনা হবে ? নাকি ফুটপাতে দাড়িয়ে আরাে কিছুক্ষণ গল্প করবে ?
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করা যায় না। গল্প করতে হয় হাঁটতে হাঁটতে। কিংবা কোথাও বসতে হয়। ন’আনির জমিদার মিস্টার আতাউর কি এই সহজ সত্যটা জানে ? মনে হয় জানে না।
আতাউর বলল, এশা কেমন আছে ? শামা বলল, ভাল আছে। হঠাৎ এশার কথা জানতে চাইছেন কেন ? এম্নি। কোনাে কারণ নেই। ওকেতাে আপনি দেখেনও নি।
দেখেছি। একবার জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল। তুমি কি এখন বাসায় চলে যাবে ?
জি। দাঁড়াও রিকশা ঠিক করে দেই। রিকশা ঠিক করতে হবে না। আমিই রিকশা ঠিক করতে পারব।
আতাউর খুবই অস্বস্তির সঙ্গে বলল, শামা তুমি কি আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবে?
কোথায় চা খাবেন ?
কোনাে রেস্টুরেন্টে বসে বা ধর...
শামা তাকিয়ে আছে। আতাউর তার কথা শেষ করতে পারল না। অসহায় ভঙ্গিতে তাকাল। শামা বলল, দুপুরবেলা কি চা খাবার সময় ?
তা না। মানে... আচ্ছা ঠিক আছে, রিকশা করে দেই। শামা বলল, আপনার যদি খুব চা খেতে ইচ্ছা করে তাহলে আমার সঙ্গে বাসায় চলুন। আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ
আতাউর এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন প্রস্তাবটা তার মনে ধরেছে। শামা ভেবেই পাচ্ছে না জমিদার খাতাউর সাহেব বােকা না–কি! যদি সত্যি সত্যি মানুষটা বলে, ‘চল যাই তাহলে বুঝতে হবে মানুষটা বােকা । মেয়েদের সবচে‘ বড় অভিশাপ হলাে— বােকা স্বামীর সঙ্গে সংসার যাপন। বােকা স্বামীরা স্ত্রীকে টেবিল ভাবে। ঘরের এক কোণায় টেবিলটা পড়ে থাকবে। চেয়ারের তাও নড়াচড়ার সুযােগ আছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া হয়। টেবিলের সে সুযােগও নেই।
শামা বলল, আপনার চিন্তা শেষ হয়েছে ? কী ঠিক করলেন ?
তােমাদের বাসায় কেউ কিছু মনে করবে নাতাে? মনেতাে করবেই। কী মনে করে সেটা হলাে কথা।
(চলবে)