বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ

তাের কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে আমি চিন্তা করব না

করবে নাবড় খালা বা ছােট খালা এদের কারাের সঙ্গে কি মাযােগ আছে? যযাগ নেইহঠাৎ হঠাৎ বিয়ে জন্মদিন এইসব উৎসবে তাদের দেখা হয় এই পর্যন্তই

বৃষ্টি বিলাসআমাদের অবস্থাও তাই হবেতুমি তােমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেআমি আমার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হব কাজেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে নিজের জীবনটা কেমন যাবে তা নিয়ে চিন্তা কর। 

ইদানীং তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবছিসভাবাভাবির কিছু নেই আপা, আমি বুদ্ধিমতীবুদ্ধিমতী কোনাে মেয়ে চাঁদাবাজ ছেলের প্রেমে পড়ে

হ্যা, পড়েঅতি চালাকের গলায় দড়িএই প্রবচনটা জান না? আমি অতি চালাক বলেই আমার গলায় দড়ি। 

পুরাে ঘটনাটা কি আমাকে বলবি ? ঘটনা বলে বেড়াতে লাগে না। 

আবদুর রহমান সাহেব খেতে বসেছেনএশা খাবার এগিয়ে দিচ্ছেতিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, মাছের তরকারিটা অপূর্ব হয়েছে রে মা! এশা শীতল গলায় বলল, মাছের তরকারি তুমি এখনাে মুখে দাও নি বাবাআবদুর রহমান ব্ৰিত গলায় বললেন, মুখে দিতে হবে না। আমি চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিচেহারা দেখেই ষােলআনার বারােআনা বােঝা যায়এশা বলল, চেহারা দেখে কিছুই বােঝা যায় না। 

শামা এক প্যাকেট বাবলগাম, একটা ইরেজার কিনলপছন্দের ইরেজার বেছে বের করতে তার সময় লাগলবাজারে নানান ধরনের ইরেজার এসেছেপেনসিলের দাগ মুছতে পারুক আর না পারুক দেখতে সুন্দরশামার বুক সামান্য ধকধক করছেদোকানিকে দাম দেয়ার পর তাকে অভিনয় করতে হবে। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ

অভিনয়টা ভাল হতে হবে। 

আতাউরকে দোকানের এক মাথায় দেখা যাচ্ছে। আতাউরকে দেখে চমকে ওঠার ভান করতে হবেচমকে উঠে বলতে হবে, আপনি এখানে কী করছেন? কথা বলারও বিপদ আছে, গলার স্বর চিনে ফেলবে না তাে ? ভুরু কুঁচকে ভাববে নাতােটেলিফোনে যে কথা বলছিল তার সঙ্গে এই মেয়েটার গলার স্বরের এত মিল কেন ? না, তা ভাববে নাটেলিফোনে মানুষের গলার স্বর অন্যরকম শােনায়

তাছাড়া দুবােনের গলার স্বরে মিল থাকতেই পারেশামার বান্ধবী তৃণী এবং তার মাগলার স্বর অবিকল এক রকমএই নিয়ে কত ঝামেলা হয়েছেসাগর ভাই তৃণাদের বাসায় টেলিফোন করেছেনটেলিফোন ধরেছেন তৃণার মা। তিনি হ্যালাে বলতেই সাগর ভাই বললেন, জানগাে তুমি কেমন আছাে? তােমার রাগ কি কমেছে ? তৃণার মা শান্ত গলায় বললেন, তুমি কাকে চাচ্ছ ? তৃণাকে ? টয়লেটে আছেআমি তৃণার মা। 

বাবলগাম এবং ইরেজারের দাম দেয়া হয়েছে, এখন শামা চলে যেতে পারেএকটা ব্যাপারে সে মন ঠিক করতে পারছে নাআতাউরকে দেখতে পায় নি এমন ভান করে সেকি বের হয়ে যাবে? নাকি হঠাৎ দেখতে পেয়ে অবাক হবে ? দেখতে 

পাওয়ার অভিনয়টাই সহজ হবেমাথা নিচু করে দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়াএর একটা সমস্যা আছেআতাউর যেমন লাজুক সে হয়ত চোখই তুলবে নানিজ থেকে এগিয়ে এসে কিছু বলবে না। চিন্তা করার জন্যে আরেকটু সময় দরকারআরাে কিছু কিনলে হয়দাম কুড়ি টাকার মধ্যে হতে হবে। তার সঙ্গে ত্রিশ টাকা আছেএই ত্রিশ টাকা থেকে রিকশা ভাড়া দিতে হবেশামাএকটা নেইল পলিশ রিমুভার কিনলবােতলের মুখ খুলে নিজের নখে খানিকটা লাগালএই কাজগুলি করতে গিয়ে সময় পাওয়া যাচ্ছেমিস্টার খাতাউরকে লক্ষ করতে পারছে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিদুজন দুজনকে আড়চোখে লক্ষ ।

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ

করতে করতে এক সময় চোখাচোখি হয়ে যাবেতখন শামাকে কিছু বলতেই হবেশামার প্রথম কথাটা কী হবেআরে আপনি ? নাকি সে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেবে ? সালামটাতাে মনে হয় দেয়া উচিত। 

শামা তুমি এখানে

শামা এতই চমকে গেল যে তার হাত লেগে নেইল পলিশ রিমুভারের বােতল টেবিলে কাত হয়ে পড়ে গেলশামা বােতল তুলতে তুলতে বলল, স্লামালিকুম। 

তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ ? জিএক প্যাকেট সিগারেট কিনতে দোকানে ঢুকেছিলামহঠাৎ দেখি তুমি

শামা মনে মনে বলল, খাতাউর সাহেব আপনিতাে মিথ্যা খুব ভালই বলছেনবেছে বেছে শার্টটাও সুন্দর পরেছেনকেউ নিশ্চয়ই বলেছে এই শার্টে আপনাকে ভাল মানায়দিন আপনার চেহারা ভালমতাে দেখতে পাই নিআজ দেখতে পাচ্ছিচেহারা খারাপ নাথুতনিতে কাটা দাগ কেন ? ছােটবেলায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন? কীভাবে ব্যথা পেলেন সেই গল্পটা এক সময় শুনব

কী জন্যে শুনব জানতে চান ? শুনব কারণ আপনি গল্প কেমন বলতে পারেন সেটা জানার জন্যেবেশির ভাগ মানুষই গল্প বলতে পারে নাযেমন আমার বাবাবাবা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেন কাজেই ধরে নিতে পারি আপনিও বাবার মতাে গল্প বলতে পারেন না| শামা দোকান থেকে বের হলােতার পেছনে পেছনে বের হলাে আতাউরশামা বলল, আজ আপনার অফিস নেই

আতাউর বলল, অফিস আছেআমি ছুটি নিয়েছিছুটি নিয়েছেন কেন ? শরীরটা ভাল নাভাবলাম ঘরে শুয়ে থেকে বিশ্রাম করবকই আপনিতাে ঘরে শুয়ে নেইদোকানে দোকানে ঘুরছেন। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ

আতাউর বিব্রত ভঙ্গিতে কাশলশামা বলল, আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন নাতােসিগারেট ধরান। 

আতাউর বলল, আমি সিগারেট খাই নাএকটু আগে যে বললেন, সিগারেট কেনার জন্যে দোকানে ঢুকেছেন

আমার জন্যে নাআমার বােনের হ্যাসবেন্ডের জন্যেদুলাভাই খুব সিগারেট খানকেউ তাকে সিগারেট উপহার দিলে তিনি খুব খুশি হনআমি মাঝে মাঝে তাকে সিগারেট দেই। 

আচ্ছা। 

শামা এখন কী করবে বুঝতে পারছে নারিকশা ঠিক করে বাসার দিকে রওনা হবে ? নাকি ফুটপাতে দাড়িয়ে আরাে কিছুক্ষণ গল্প করবে

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করা যায় নাগল্প করতে হয় হাঁটতে হাঁটতেকিংবা কোথাও বসতে হয়আনির জমিদার মিস্টার আতাউর কি এই সহজ সত্যটা জানে ? মনে হয় জানে না। 

আতাউর বলল, এশা কেমন আছে ? শামা বলল, ভাল আছেহঠাৎ এশার কথা জানতে চাইছেন কেন ? এম্নিকোনাে কারণ নেইওকেতাে আপনি দেখেনও নি। 

দেখেছিএকবার জানালা দিয়ে তাকিয়েছিলতুমি কি এখন বাসায় চলে যাবে

জিদাঁড়াও রিকশা ঠিক করে দেইরিকশা ঠিক করতে হবে নাআমিই রিকশা ঠিক করতে পারব। 

আতাউর খুবই অস্বস্তির সঙ্গে বলল, শামা তুমি কি আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবে

কোথায় চা খাবেন

কোনাে রেস্টুরেন্টে বসে বা ধর..

শামা তাকিয়ে আছেআতাউর তার কথা শেষ করতে পারল নাঅসহায় ভঙ্গিতে তাকালশামা বলল, দুপুরবেলা কি চা খাবার সময়

তা নামানে... আচ্ছা ঠিক আছে, রিকশা করে দেইশামা বলল, আপনার যদি খুব চা খেতে ইচ্ছা করে তাহলে আমার সঙ্গে বাসায় চলুনআপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১১)- হুমায়ূন আহমেদ

আতাউর এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন প্রস্তাবটা তার মনে ধরেছেশামা ভেবেই পাচ্ছে না জমিদার খাতাউর সাহেব বােকা নাকি! যদি সত্যি সত্যি মানুষটা বলে, চল যাই তাহলে বুঝতে হবে মানুষটা বােকা মেয়েদের সবচেবড় অভিশাপ হলােবােকা স্বামীর সঙ্গে সংসার যাপনবােকা স্বামীরা স্ত্রীকে টেবিল ভাবেঘরের এক কোণায় টেবিলটা পড়ে থাকবেচেয়ারের তাও নড়াচড়ার সুযােগ আছেএক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া হয়টেবিলের সে সুযােগও নেই। 

শামা বলল, আপনার চিন্তা শেষ হয়েছে ? কী ঠিক করলেন

তােমাদের বাসায় কেউ কিছু মনে করবে নাতাে? মনেতাে করবেইকী মনে করে সেটা হলাে কথা

(চলবে)

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১০)- হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *