তাের মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি নেই ? এক্ষুণি চলে যেতে বল। ভদ্রলােক দুপুরে খাবেন বলে বসে আছেন। এখন কী করে তাকে চলে যেতে বুলি ? তােমার যদি এতই অসহ্য লাগে তুমি চলে যেতে বল।
আমি বলব কেন? তুই দাওয়াত করে এনেছিস তুই বলবি। আচ্ছা যাও আমিই বলব। গােসল সেরে নেই তারপর বলি।
বলে এসে তারপর বাথরুমে ঢুকবি। তাের সাহস দেখে আমি হতভম্ব। তুই একে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ফন্দি করেছিস। এত ফন্দি ফিকির কার কাছ থেকে শিখেছিস ?
শামা মা‘কে সরিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। সুলতানা বাথরুমের দরজার সামনে থেকে নড়লেন না। ক্রমাগত গজরাতে থাকলেন। শামার খুব মজা লাগছে। হঠাৎ তার মনে হলাে সে তার দীর্ঘ জীবনে এত আনন্দ পায় নি। এ রকম মনে হবার কারণ কী। এই ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় নেই। প্রেম নেই। ঘন্টার পর ঘণ্টা তারা গুজগুজ করে গল্প করে নি। লম্বা লম্বা চিঠি চালাচালি করে নি। অথচ এখন এই মুহূর্তে তার কথা ভাবতে ভাল লাগছে। শুধু যে ভাল লাগছে। তা না— বুকের মধ্যে ব্যথা ব্যথা লাগছে। এটাই কি প্রেম ? হঠাৎ শামার চোখে পানি এসে গেল। চোখে পানি আসার অর্থইবা কী ?
বাথরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ছে। সুলতানা দরজা ধাক্কাচ্ছেন। শামা বলল, কী হলাে মা ? তুমি দেখি দরজা ভেঙে ফেলার জোগাড় করছ!
সুলতানা ফিসফিস করে বললেন, বারান্দায় আতাউর বসে আছে না? হা। ফিসফিস করছ কেন? ফিসফিসানির কোনাে কারণ ঘটে নি। তুই এই নাটকটা কেন করলি ? কেন আমাকে বললি না আতাউর এসেছে ?
মা প্লিজ ফিসফিস করবে না তাে। মনে হচ্ছে তুমি কথা বলছ না। হাঁস কথা বলছে।
ঘরে খাবারের আয়ােজন এত খারাপ। তুই এটা কী করলি বলতাে মা?
আমি কিছুই করি নি। তােমার কি ধারণা আমি দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি ? দ্রলােক নিজেই এসেছেন। মা শােনাে, তুমি কি দয়া করে জমিদার সাহেবকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করবে ? আমার কাছে ঠাণ্ডা পানি চেয়েছেন, আমি ভুলে গেছি।
কী সর্বনাশের কথা, তুই ভুললি কী করে! না জানি কী মনে করছে। | কিছুই মনে করছে না মা। তুমি মুত্তালিব চাচার ফ্রিজ থেকে এক বােতল পানি আনাও তারপর ন’আনির জমিদারকে এক গ্লাস পানি পাঠাও। আর শােন মা, বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমি লক্ষ করেছি আমি বাথরুমে ঢুকলেই তােমার একশ একটা গল্প করার নেশা চাপে।
চট করে একটু পােলাও করে ফেলব ? পােলাও কী দিয়ে খাবে। বেগুন ভাজা দিয়ে ? ঘরে ডিম আছে। ডিমের কোরমা করি ?
তােমার যা ইচ্ছা কর । এখন দয়া করে বাথরুমের সামনে থেকে সর। আমার খুবই বিরক্তি লাগছে।
শামা গায়ে পানি ঢালছে। গরমের সময় শরীরে পানি ঢাললেই ভাল লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও অনেক বেশি ভাল লাগছে কেন ? শামার হঠাৎ মনে হলাে বাথরুমের বন্ধ দরজার ওপাশে যদি মা দাড়িয়ে না থেকে খাতাউর সাহেব দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে চমকার হত। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে খাতাউর সাহেবের সঙ্গে গল্প করা যেত। কী গল্প করা যায়? কোনাে মানে হয় না এমন সব গল্প। ধাধা জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় ? মাকড়সার একটা ধাধা আছে। কেউ এই ধাধার উত্তর পারে না। এটা জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। শামা মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে বলবে, আচ্ছা, আপনি নিশ্চয়ই জানেন মাকড়সা জাল বানায়। বানায় না ?
আতাউর বলবে, হ্যা, জানি।
সেই জালে অন্যান্য পােকা আটকায়, মাকড়সা সেগুলাে খায়। এটা জানেন তাে ?
হা জানি।
আচ্ছা তাহলে বলুন– মাকড়সা তাে পােকাই। সে কেন নিজের জালে আটকায় না ?
বাড়ি দেখে শামা হকচকিয়ে গেল। সে অনেকবার শুনেছে মীরাদের বিরাট বাড়ি। সেই বিরাট বাড়ি যে এই হুলুস্থুল তা বুঝতে পারে নি। এমন বাড়ির একটা মেয়ে ইডেন কলেজে পড়বে কেন ? সে পড়বে দেশের বাইরে ইংল্যান্ড আমেরিকায়। তা না হলে দার্জিলিং–টার্জিলিং। এমন বাড়ির মেয়ে ফুটপাতে দাড়িয়ে ফুচকা খায় ভাবাই যায় না।
শামা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির নাম্বার ঠিক আছে নামও ঠিক আছে হ্যাপি কটেজ। সব ঠিক থাকার পরেও তাে ভুল হতে পারে। হয়ত এটা মীরাদের বাড়ি না। অন্য কারাের বাড়ি। একই নামের দু’টো বাড়িতে থাকতেই পারে।
আতাউর বলল, এই বাড়ি ? শামা বলল, তাইতাে মনে হয়। তুমি আগে আস নি ?
কী বিশাল ব্যাপার! শামা বলল, আপনি চলে যান।
আতাউর দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। শামা বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলে যান। আতাউর বলল, যেতে ইচ্ছা করছে না। তােমার সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকলামতাে, অভ্যাস হয়ে গেছে।
মানুষটা চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শামার তীব্র ইচ্ছা হলাে মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেয়। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে। মানুষটাকে ছুঁয়ে না দিলে সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। একটা অজুহাত তৈরি করে কি মানুষটাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না! সে কি বলতে পারে না— এই যে শুনুন, আপনার কপালে এটা কী লেগে আছে ? খুব স্বাভাবিকভাবে এই কথাটা বলে সে কপালে হাত দিতে পারে। কপালে হাত দিয়ে অদৃশ্য ময়লা সরিয়ে ফেলা। মানুষটার নিশ্চয়ই এত বুদ্ধি নেই যে কপালে ময়লার আসল রহস্য ধরে
ফেলবে। এই জাতীয় ব্যাপারগুলােতে পুরুষদের বুদ্ধি থাকে কম।
হ্যাপি কটেজের বারান্দায় তৃণা দাঁড়িয়ে আছে। সে শামাকে দেখে হাত নাড়ছে। শামা বাড়ির ভেতর ঢুকল। তৃণা অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে শামার কাছে এসে বলল, মারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যায় ? মীরাকে আজ নিচ্ছে না। এই বাড়িতেই বাসর হবে। মারাত্মক না ?
শামা বলল, মারাত্মক কেন ? বুঝতে পারছিস না কেন মারাত্মক ?
তৃণা বিরক্ত গলায় বলল, তাের কি মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই নাকি ? এই বাড়িতে বাসর হচ্ছে তার মানে কী? আমরা বাসর ঘর সাজানাের সুযােগ পাচ্ছি। অলরেডি সাজানাে শুরু হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই আছে, তার কলাবাগানে ভিডিওর দোকান। তাকে খবর দেয়া হয়েছে। সে বাসর ঘরে গােপন ভিডিও ক্যামেরা সেট করে রাখবে। একটা সাউন্ড রেকর্ডারও থাকবে। মীরার যাবতীয় অডিও ভিস্যুয়াল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের অবস্থায় থাকবে। এখন বুঝতে পারছিস কেন মারাত্মক ?
পারছি। মীরা কিছু বুঝতে পারছে না ? | সে তার বিয়ের টেনশনে বাচে না, সে কী বুঝবে! তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।
বাসর হচ্ছে কোথায় ?