মীরার ঘরে হচ্ছে না। ছাদে এদের প্রকাও একটা কামরা আছে। সেখানে হচ্ছে।তুই এ বাড়িতে আগে এসেছিস?
হা এসেছি। মাত্র একবার এসেছি। এত প্রকাণ্ড বড়লােকের বাড়িতে বারবার আসা যায় না। এত বড় বাড়িতে নিজেকে সব সময় পর পর লাগে। তবে আমরা সবাই এক সঙ্গে আছিতাে আমাদের লাগছে না।
সবাই এসে গেছে ?
তুই আর টুনি তােরা দু‘জন বাদ ছিলি। এখন বাকি শুধু টুনি। মনে হয় সে আসবে না। বাসা থেকে ওকে ছাড়বে না। টুনি খুবই ভুল করল। বাসর ঘরে ভিডিও ফিট করাতেই আমাদের শেষ না। আরাে অনেক ফান হবে। আমাদের সােসিওলজির শাহানা ম্যাডামও এসেছেন। উনি প্রথম আলগা আলগা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এখন আমাদের দলে ভিড়ে গেছেন । ভিডিও ক্যামেরা ফিট করার
তদারকি তিনিই করছেন।
সে–কী! বিয়ে বাড়িতে গেলে সব মেয়ের মাথাই খানিকটা হলেও আউলা হয়। উনার সবচে‘ বেশি আউলা হয়েছে।
ভিডিও ক্যামেরা বসানাের লােক চলে এসেছে। তার নাম তাহের। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না। এতগুলাে মেয়ের পাশে সে খুবই অস্বস্তিবােধ করছে। কেউ কিছু বললেই চমকে উঠছে। একবারতাে হাত থেকে ক্যামেরাও ফেলে দিল।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, তাহের ক্যামেরাটা ফিট করছ কোথায় ? খাটের মাথায় ? তাহের হা–সূচক মাথা নাড়ল। ম্যাডাম বললেন, ফিল্ড অব ভিশন কি রেখেছ ? শুধু খাটটা কভার করলেই হবে। যা ঘটনা সব খাটেই ঘটবে। অডিও রেকর্ডারের কী করেছ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
ভিডিওর সঙ্গেই অডিও আছে।
ক্যামেরাটা গাদাফুল দিয়ে খুব ভালােমতাে ঢেকে দাও যেননা বােঝা না যায় ক্যামেরা। সব ঠিকঠাক হলে একটা টেস্টরান করবে।
তাহের আবারাে হা–সূচক মাথা নাড়ল।
তৃণা বলল, এখন আমাদের দরকার নকল দাড়ি গোঁফ। ফর এভরি বডিস ইনফরমেশন— মীরাকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। সে বাসর ঘরে ঢােকার আগে নকল দাড়ি গোঁফ পরে ঘােমটা দিয়ে থাকবে। তার স্বামী ঘােমটা খুলে দাড়ি গোঁফওয়ালা স্ত্রী দেখে যে কাণ্ডটা করবে আমাদের ভিডিওতে তা ধরা থাকবে। | যূথী বলল, মীরা কি জানে তার বাসর ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বসানাে হয়েছে ?
তৃণা বলল, আমরা এই ক’জন ছাড়া কেউ জানে না। বাইরের মানুষের মধ্যে শুধু মীরার মা জানেন।
শামা বিস্মিত হয়ে বলল, উনি কিছু বলেন নি ?
খালা কিছুই বলেন নি। উনি বরং সবচে‘ বেশি মজা পাচ্ছেন। প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবচে‘ বেশি ফান পায় মেয়ের মা। এক লাখ টাকা বাজি উনি
মেয়ের বাসর ঘরের ভিডিও দেখতে চাইবেন।
শাহানা ম্যাডাম বললেন, মেয়েরা তােমরা খেয়াল রেখাে কোনাে ছেলে যেন এদিকে না আসে। তিন তলার ছাদ আউট অব বাউন্ড ফর এভরিবডি ।
তৃণা বলল, মিঃ হুক্কা কি আসতে পারবেন ? না হুক্কাও আসতে পারবেন না। শামা বলল, হুক্কা কে?
তৃণা বলল, মীরার দূর সম্পর্কের ভাই। আমরা নাম দিয়েছি হুক্কা। সে তার চশমা খুঁজে পাচ্ছে না। তার ধারণা আমরা চশমা লুকিয়ে রেখেছি। বারবার আসছে আমাদের কাছে।
হুক্কা নাম কেন ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
ফানি টাইপ ক্যারেক্টর, এই জন্যে হুক্কা নাম দেয়া হয়েছে। একসময় মীরা হুক্কার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। কিন্তু হুক্কা সাহেব পাত্তাই দেন নি। আমরা ঠিক করেছি হুক্কা সাহেবকেও একটু টাইট দেব।
শামা এক কোণায় বসে বাসর ঘরের ফুল সাজানাে দেখছে। গাদাফুল আর বেলিফুল এই দু‘রকমের ফুল মশারি স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। বিছানায় থাকছে শুধু গােলাপ। শাহানা ম্যাডাম এখন গােলাপের কাটা বাছছেন। টুনিও চলে এসেছে। জবরজং সাজে সেজেছে। টুনিকে দেখে সবাই হৈহৈ করে উঠল। যূথী বলল, এই তােকেতাে একেবারে বিহারিদের মত লাগছে। মনে হচ্ছে তুই মােহাম্মদপুরের পাকিস্তান কলােনিতে থাকিস। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা শাড়ি তুই পরলি কী মনে
সবাই হাে হাে করে হেসে উঠল। শামা লক্ষ করল তার কিছুই ভাল লাগছে । নিজেকে আলাদা এবং একলা লাগছে। মনে হচ্ছে এদের কারাে সঙ্গেই তার কোনাে যােগ নেই। তার যােগ অন্য কোথাও। অন্য কোনােখানে। তার চোখ কেন জানি জ্বালা করছে। মাথাও ভার ভার লাগছে। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিলে হয়ত ভাল লাগবে। তিনতলায় নিশ্চয়ই বাথরুম আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে বাথরুমটা কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় চলে যেতে।
আতাউরকে টেলিফোন করে বললে কেমন হয়, ফিসফিস করে বলা— এই শােন আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। তুমি একটা বেবীটেক্সি নিয়ে চলে এসতাে। আমাকে বাসায় নিয়ে যাও।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
মানুষটাকে তুমি করে সে কি কখনাে বলতে পারবে ? মনে হয় না। বিয়ের পরেও হয়ত আপনি আপনি করেই বলবে।
তৃণা শামার কাছে এগিয়ে এসে বলল, তাের কী হয়েছে ? শামা বলল, কিছু হয় নি।
কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তােকে দেখে মনে হচ্ছে তাের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় একশ কিলােমিটার বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেমন জবুথবু হয়ে বসে আছিস। সমস্যা কী ?
কোনাে সমস্যা নেই।
সমস্যা অবশ্যই আছে। বলতে চাইলে বলতে পারিস। উড়া উড়া শুনছি তাের বিয়ে ঠিক হয়েছে ?
তুই নিজের মুখে আমাদের বলছিস না কেন ? কেন আমরা উড়া উড়া শুনব ? ছেলে পছন্দ হয় নি। তাইতাে ? বল হা বা না ?
শামা চুপ করে রইল। তৃণা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এরেঞ্জড ম্যারেজে এ রকম হবে। বাবা মা ধরে বেঁধে এক বান্দর নিয়ে আসবে। হাসি মুখে সেই বান্দরকে বিয়ে করতে হবে। বাকি জীবন সেই বান্দর গলায় ঝুলে থাকবে। তাকে আর গলা থেকে নামানাে যাবে না।
এখানে শামা কে ? শামা চমকে তাকাল। এ বাড়ির কোনাে বুয়াই হবে। তাকে খুঁজছে। শামা কে ? শামা ? শামা কাঁপা গলায় বলল, আমি শামা। কী হয়েছে ? দোতলায় যান আফা। আপনের টেলিফোন।
শামা ভেবেই পেল না, কে তাকে এ বাড়িতে টেলিফোন করবে। এই বাড়ির টেলিফোন নাম্বার সে নিজেই জানে না। টেলিফোনে কি কোনাে খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে ? আজ কি শনিবার ? শনিবারটা শামার জন্যে খুব খারাপ। শনিবার মানেই কোনাে না কোনাে খারাপ সংবাদ আসবেই।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৪)- হুমায়ূন আহমেদ
শামা বলল, টেলিফোন কোন ঘরে ?
বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, টেলিফোন সব ঘরে আছে। আপনে দোতলায় ‘চলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শামা দেখল হলুদ ব্লেজার পরা এক ভদ্রলােক সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন। বেঁটে খাট মানুষ, মাথাভর্তি চুল। বিরক্তিতে তাঁর চোখ কুঁচকে আছে, তবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার মধ্যে ছেলেমানুষি আছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। যেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠাও একটা খেলা। ভদ্রলােকের চেহারাতেও ছেলেমানুষি আছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পৃথিবীতে জন্মায় যাদের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছা করে না। এই ভদ্রলােক সেরকম। বাসে এই ভদ্রলােকের পাশে বসলে কোনাে মেয়েই অস্বস্তি বােধ করবে
ভদ্রলােক শামাকে দেখে চট করে দাড়িয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন, এক্সকিউজ মি। আপনি কি মীরার বান্ধবীদের একজন ?
জি।
আমি আমার চশমা তিনতলার খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে হাত মুখ ধুতে গিয়েছিলাম। হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি চশমাটা নেই। আমার মাইওপিয়া আছে। চশমার পাওয়ার থ্রি ডাইওপটার। আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে সিঁড়িতে দু’বার হোঁচট খেয়েছি। আমার ধারণা মীরার বান্ধবীরা মজা করার জন্যে চশমা লুকিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক না। আপনি মীরার বান্ধবীদের একজন। আপনি কি চশমাটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন ? আপনি কি জানেন চশমাটা কার কাছে ?
জি না।
প্রথম ভুলটা আমিই করেছি।