তাের বাবাকে দেব। বাবা শুয়ে পড়েছে, কিছু খাবে না।
আজ সারাদিন কিছু খায় নি। অফিসে শুধু একটা কলিজার সিঙ্গাড়া খেয়েছিল। টিফিন বক্স খুলেও দেখে নি।
এই বয়সে বাবার কলিজার সিঙ্গাড়া খাওয়া একেবারেই ঠিক না। পচা বাসি কলিজা দিয়ে সিঙ্গাড়া বানায়।...
সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছিস ?
শামা নাসূচক মাথা নাড়ল। তাহলে হাত মুখ ধুয়ে আয়, রুটি খা। না–কি ভাত খাবি ? রুটি খাব। গরম গরম রুটি দেখে লােভ লাগছে। সুলতানা বললেন, তার বান্ধবীর বিয়ের উৎসব কেমন জমেছে ?
খুব জমেছে। নানান ধরনের মজা হচ্ছে। কী হচ্ছে বল, শুনি। বলতে ইচ্ছা করছে না। বড় মানুষদের বড় মজা। ওরা কি খুবই বড়লােক ?
বড়লােক মানে— হুলস্থুল বড়লােক! মীরাদের বাড়ির প্রতিটা ঘরে এসি আছে। আমার ধারণা কাজের মেয়েদের ঘরেও আছে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
বলিস কী ?
কথার কথা বলছি। কাজের মেয়ের ঘরেতাে আর এসি থাকে না। বড়লােকেরা যা করে নিজের জন্যে করে। অন্যের জন্যে করে না।
মীরার বাবা কী করেন ? ইন্ডাস্ট্রি আছে। মাছের ব্যবসা আছে। আরাে কী কী যেন আছে। শামা একটা রুটি নিয়ে খেতে শুরু করলাে ।
সুলতানা বললেন, শুধু শুধু রুটি খাচ্ছিস কেন? তরকারি দিয়ে খা । ডিম একটা ভেজে দেব, ডিম দিয়ে খাবি ?
উঁহু। সবুজ শাড়িতে তােকে যে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এই কথা কেউ বলে নি ?
বলে নি। সুলতানা বললেন, কুমারী মেয়েদের সেজেগুজে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটা ভাল। অনেকের চোখে পড়ে। সম্বন্ধ আসে।
সুলতানা মাথা নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, তাের বয়সে আমি যতবার কোনাে বিয়ে বাড়িতে গিয়েছি ততবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে! এর মধ্যে একটা এসেছিল প্লেনের পাইলট ।
পাইলটের সঙ্গে বিয়ে হলাে না কেন? বিয়ে হলেতাে প্লেনে করে তুমি দেশ বিদেশ ঘুরতে পারতে।
বিয়ে কপালের ব্যাপার । কপালের লেখা ছিল তাের বাবার সাথে বিয়ে হবে। তাই হয়েছে।
আমার কপালে লেখা খাতাউরের সঙ্গে বিয়ে হবে, কাজেই যত সেজেগুজেই বিয়ে বাড়িতে যাই না কেন আমার কপালে খাতাউর তাই না মা ? খাতাউর সাহেব যে দুপুরে বাসায় খেতে এসেছিল এটা কি বাবাকে বলেছ ?
না।
বল নি কেন? আছে একটা সমস্যা। কী সমস্যা ? পরে শুনবি। পরে শুনব কেন ? এখন বল।
সুলতানা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাের বাবার ইচ্ছা না ছেলেটার সঙ্গে তাের বিয়ে হােক। তার যে শরীরটা খারাপ করেছে এইসব ভেবেই করেছে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
তার মানে ?
তাের বাবা আজ দুপুরে ছেলেটার সম্পর্কে খুব একটা খারাপ খবর পেয়েছে। তখনি তার শরীরটা খারাপ করেছে। এত আশা করে ছিল! হঠাৎ একটা ধাক্কার মতাে খেয়েছে। অফিসেই বমি টমি করেছে।
খারাপ খবরটা কী?
আমাকে কিছু বলে নি। তাের বাবাকেতাে তুই চিনিস একবার যদি সে ঠিক করে কিছু বলবে না, পেটে বােমা মারলেও বলবে না।
খারাপ খবর যেটা বাবা শুনেছেন সেটাতাে ভুলও হতে পারে। বিয়ের সময় প্রায়ই মিথ্যা খবর রটানাে হয়।
তাের বাবা বলেছে খবর মিথ্যা না।
শামা তাকিয়ে আছে। সুলতানা মেয়ের দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে পারলেন । তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এশার ঘরে একবার যেতে হবে। মেয়েটা সন্ধ্যা থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। স্বামীকে দেখতে গিয়ে মেয়ের দিকে তাকানাে হয় নি।
প্রথমে তিনি স্বামীর ঘরে উঁকি দিলেন। মানুষটা ঘুমুচ্ছে। মনে হচ্ছে আরাম করেই ঘুমুচ্ছে আরামের ঘুমের সময় মানুষ হাত পা গুটিয়ে ছােট্ট হয়ে যায়। বেআরামের ঘুমের সময় মানুষ সরল রেখার মতো সােজা হয়ে থাকে।
সুলতানা ছেলের ঘরে গেলেন। বেচারার পড়ার আজ অনেক ক্ষতি হয়ে। গেছে। তিনি ঠিক করলেন মন্টু যতক্ষণ পড়বে তিনি পাশে বসে থাকবেন। তার এই ছেলেটা বােকা টাইপ হয়েছে। ছােটবেলায় এত বােকা ছিল না, যতই দিন যাচ্ছে বুদ্ধি মনে হয় ততই কমছে। পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করে। এই ছেলের পড়াশােনা হবে বলে মনে হয় না। পরীক্ষা দিয়ে ফেল করবে। আবার দেবে, কোনাে বছর দেবে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৭)- হুমায়ূন আহমেদ
কোনাে বছর দেবে না। এই করতে করতে বয়স হয়ে চেহারায় লােক লােক ভাব আসবে তখন কোনাে দোকান টোকান দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। মন্টুর মতাে ছেলেরা খুব ভাল দোকানদার হয়।
টেবিলে খােলা বই। মন্টু বইয়ে মাথা রেখে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ঘাড়ের ওপর মশা, রক্ত খেয়ে ফুলে আছে। মন্টুর কোনাে বিকার নেই। সুলতানা ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলেকে ঘুম থেকে তুললেই সে পড়তে শুরু করবে। ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে যেখানে পড়া শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করবে, কিছুক্ষণ ঘুমাক। তিনি এশার ঘরের দিকে রওনা হলেন। খুব সম্ভব এশাও ঘুমুচ্ছে। মাইগ্রেনের ব্যথা প্রবল হলে এশা কয়েকটা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলে। ব্যথা কমে যায় কিন্তু ঘুম থেকে যায়।
এশার ঘরের দরজা ভেজানাে । সুলতানা দরজার পাশে দাঁড়াতেই এশা বলল, ভেতরে এসাে মা।
সুলতানা ঘরে ঢুকলেন। এই গরমে এশা চাদর গায়ে শুয়ে আছে। তার চোখ লাল। সুলতানা বললেন, মাথাব্যথার অবস্থা কী ?
এশা বলল, অবস্থা ভাল। কমেছে ?
তাহলে ভাল বলছিস কেন?
আমার মাথাব্যথা প্রসঙ্গটা এখন একটু বাদ থাকুক। মা আসল ঘটনা আমাকে বল। আপার বিয়ে বাতিল হয়ে গেছে?
–ফু না, পরিষ্কার করে বল— বাবা কি বিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন ?
ছেলেকে বলেছেন ?
সরাসরি ছেলেকে বলে নি। তার চাচাকে আর বড় বােনকে খবর দেয়া হয়েছে।