ছেলের অপরাধটা ? আমি জানি না। তাের বাবা কিছু বলে নি।
কাজটা ঠিক করলে না মা। হুট করে বিয়ে ঠিক করা, আবার হুট করে বাতিল। বিয়ে তাে Play and dust না।
প্লে এন্ড ডাস্ট কী ?
প্লে হচ্ছে খেলা আর ডাস্ট হচ্ছে ধুলা। প্লে এন্ড ডাস্ট হলাে– খেলাধুলা। মা এখন আমার ঘর থেকে যাও। তােমার পাথরের মতাে মুখ দেখে আমার মাথা ধরা ছেড়ে যাচ্ছে।
শামা,
তুই কি আমার ওপর খুব বেশি রেগে আছিস, তিন দিন হয়ে গেল এখনাে টেলিফোন করলি না। আমি তাের নিষেধ সত্ত্বেও তােদের বাড়িওয়ালার টেলিফোনে টেলিফোন করেছিলাম। দু’বার করেছি। প্রথমবার তিনি বলেন, রং নাম্বার । দ্বিতীয়বারে বললেন, শামারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মালিবাগের দিকে বাসা নিয়েছে। রেল ক্রসিং–এর কাছে। বয়স্ক একজন মানুষ মিথ্যা কথা বললে কেমন লাগে বলতাে। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। এই দ্রলােককে। আমি একটা শিক্ষা দেব। শামা আমাদের পিকনিকে তুই এই ভদ্রলােককে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আয় না। তারপর দেখ আমি কী করি ।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
শামা শােন, ঐ দিনের ঘটনায় আমি খুব দুঃখিত। সামান্য ফান করলাম। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর সঙ্গে ফান করতে পারবে না ? দ্রলােকের চশমা তাের ব্যাগে পাওয়া গেল। তাতে ক্ষতি কিছু হয় নি। বরং লাভ হয়েছে। কী লাভ হয়েছে সেটা বলি। মন দিয়ে শােন। ভদ্রলােকতাে মােটামুটি অন্ধের মতােই হাঁটাহাঁটি করছিলেন, চশমা ফেরত পেয়ে প্রথম তােকে দেখলেন।
তুই সবুজ শাড়ি পরে দাড়িয়েছিলি, তােকে দেখাচ্ছিল ইন্দ্রাণীর মতাে (ইন্দ্রাণী জিনিসটা কী আমি জানি না। প্রায়ই গল্পের বইয়ে পড়ি ইন্দ্রাণীর মতাে সুন্দর । কাজেই ধরে নিচ্ছি ইন্দ্রাণী খুবই রূপবতী কেউ)। দ্রলােক তােকে দেখে ধাক্কার মতাে খেলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
বাজিল বুকে সুখের মতাে ব্যথা তুই রাগে দুঃখে কেঁদে ফেললি, তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলি। তখন আমি হুক্কা বাবাজিকে আসল ঘটনা
বললাম। বললাম যে তুই চশমার ব্যাপারটা কিছুই জানিস
আমি তাের ব্যাগে চশমা লুকিয়ে রেখেছিলাম। ঘটনা শুনে হুক্কা বাবাজি (বাবাজির আসল নাম আশফাকুর রহমান) খুবই মন খারাপ করলেন। তিনি ঠিক করেছেন তাদের বাসায় গিয়ে তাের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।
আমার ধারণা ইতিমধ্যে তিনি এই কাজটা সেরে ফেলেছেন এবং তাের সঙ্গে হুক্কা বাবাজির কথাবার্তা হয়েছে। আমার এই ধারণার পেছনে কারণ আছে। হুক্কা বাবাজির মা আজ সকালেই আমাকে টেলিফোন করে তাের সম্পর্কে খোঁজ খবর করছিলেন। জানতে চাচ্ছিলেন তুই মেয়ে কেমন, তাের কারাে সঙ্গে এফেয়ার আছে কি–না।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
কাজেই বুঝতেই পারছিস ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে। এখন শুধু গড়াতেই থাকবে। হুক্কা বাবাজিকে যদি বড়শিতে গেঁথে তুলতে পারিস তাহলে বিরাট কাজ হবে। ওদের গুলশানের তিনতলা বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল আছে। আমি দেখি নি। মীরার কাছে শুনেছি। পয়সাওয়ালা স্বামী হলাে— সােনার চামচ। কথায় আছে না— সােনার চামচ বাকাও ভাল। হুক্কা বাবাজি বাঁকা না, সােজা। দ্রলােকের ফাইবার অপটিক্সের ওপর পিএইচ.ডি. ডিগ্রি আছে। মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন।
তার বাবা খুবই অসুস্থ, নিজে ব্যবসাপাতি দেখতে পারছেন না বলে ছেলে এসেছে। বাবাকে সাহায্য করতে। | শামা শােন, ঐ ভদ্রলােকের সঙ্গে যদি তাের কিছু হয়ে যায় (সম্ভাবনা ৯০ পারসেন্ট), তাহলে তুই কিন্তু প্রতি মাসে একবার তােদের গুলশানের বাড়ির ছাদে পুল সাইড পার্টি দিবি। আমরা সবাই সুইমিং পুলে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করব আর পার্টি করব।
মীরার বিয়ের ঘটনা বলে চিঠি শেষ করি। এত ঝামেলা করে ভিডিওর ব্যবস্থা করা হলাে, সেই ভিডিও শেষ পর্যন্ত হয় নি। বর এসেছে রাত তিনটায়। বিয়ে শেষ হতে হতে বেজেছে পাচটা। দিনের বেলাতে কি বাসর হয় ? ভদ্রলােক তিনতলা পর্যন্ত উঠলেনই না। আমরা খুবই মন খারাপ
করেছি। সবচে‘ বেশি মন খারাপ করেছেন শাহানা ম্যাডাম। শেষে ম্যাডামকে বললাম, ম্যাডাম মন খারাপ করবেন না। আমরাতাে অনেকেই আছি বিয়ের বাকি। আমাদের যে কোনাে একজনের বাসর রাত ভিডিওর ব্যবস্থা হবে ।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৮)- হুমায়ূন আহমেদ
কে জানে হয়ত তােরটাই হবে। কাজেই সাবধান!
ভাল থাকিস এবং আমার ওপর থেকে রাগটা দূর করার চেষ্টা করিস। তাের নাম রাগ–কুমারী বলেই সারাক্ষণ রেগে থাকতে হবে না–কি? রাগ মিঃ হুক্কার জন্যে জমা করে রাখ।
তাের দুষ্টু বন্ধু>ণা
শামা জেগে আছে। একটু আগে ঘড়ি দেখেছে তিনটা দশ। চোখ জ্বালা করছে। যদিও চোখ জ্বালা করার কোনাে কারণ নেই। সে চোখ বন্ধ করে আছে। রােদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করার প্রশ্ন আসত। ঘর অন্ধকার। যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছিল। এখন শীত শীত লাগছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। রাত যতই বাড়ছে ফ্যানের গতি মনে হয় ততই বাড়ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে কী ? আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি না হলে এতটা ঠাণ্ডা লাগার কথা না।
শামা আবারাে ঘড়ি দেখল। রেডিয়ামের ডায়াল দেয়া ঘড়ি। অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মতাে জ্বলে।
এখন বাজছে তিনটা বার। মাত্র দু’মিনিট পার হয়েছে, শামার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। অনিদ্রা রােগ মানুষকে এতটা কষ্ট দেয় তা তার জানা ছিল না। তার ছিল বালিশ ঘুম। বালিশে মাথা লাগানাে মাত্র ঘুম। আজ এ–কী যন্ত্রণা হলাে ? আগে চোখ জ্বালা করছিল, এখন মুখ জ্বালা করছে। এই জ্বলুনি কি শেষ পর্যন্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে ? বিছানায় শুয়ে
থেকে ভেতরের বারান্দায় চলে গেলে কেমন হয়! ভেতরের বারান্দায় কাঠের চেয়ারটা আছে। চেয়ারের পায়াটা আবার ভেঙেছে। আবদুর রহমান সাহেব আবার ঠিক করেছেন। এই নিয়ে তিনবার হলাে। চেয়ারে বসে সকাল হওয়া দেখা। অনেক দিন সকাল হওয়া দেখা হয় না।