আজ দেখবে না তা করা যাবে ।
ফজরের আজান হতেই মা–বাবা দুজনই উঠে পড়বেন। তারা অজু করতে এসে দেখবেন তাদের বড় মেয়ে একা একা বারান্দায় বসে আছে। মনের কষ্টে মেয়ে সারা রাত ঘুমুতে পারে নি। তারা দুজনই খুবই দুঃখিত হবেন ।সেটা হতে দেয়া যায় না। শামা মনের কষ্টে ঘুমুতে পারছে না, এটা ঠিক না। তার মনে কষ্ট নেই। তবে তার খারাপ লাগছে।
খারাপ লাগলেই সেই খারাপ লাগাটা অন্যকে দেখাতে হবে কেন ? আজ তার জন্যে খারাপ একটা রাত যাচ্ছে। রাতটা কোনাে মতে পার করতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একজন লােকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যে কোনাে কারণে বিয়েটা ভেঙে গেছে। এটা এমন কোনাে বড় ঘটনা না । এই
লােকের সঙ্গে বিয়ে হলে তার এক ধরনের ছেলেমেয়ে হত। অন্য আরেক জনের সঙ্গে বিয়ে হলে অন্য ধরনের ছেলেমেয়ে হবে। ব্যাস এইতাে! এর বেশি আর কী ?
তিনটা কুড়ি বাজে। এই শেষবার ঘড়ি দেখা। শামা ঠিক করে ফেলল সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আতাউর নামের মানুষটার ব্যাপারে সে কিছু ভাববে না। আংটিটা ফেরত পাঠাতে হবে। ভাগ্যিস সে আংটি আঙুলে আর পরে নি। আতাউরের সঙ্গে শেষবার কি শামা কথা বলবে ? হ্যা বলবে, শামা হিসেবে বলবে না। এশা হয়ে বলবে। এই একটা ভাল সুবিধা হয়েছে। এশা সেজে সে অনেক কিছু বলতে পারছে। যাকে বলা হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
শামা ভেবেছিল বাসর রাতে পুরাে ঘটনাটা আতাউরকে হাসতে হাসতে বলবে এবং মানুষটার হতভম্ব মুখ দেখবে। মানুষটা নিশ্চয়ই খুব লজ্জা পাবে। বিড়বিড় করে বলবে, তুমি এমন মেয়ে! আশ্চর্য! তখন শামা হঠাৎ শুরু করবে একটা ভূতের গল্প। সে খুব ভাল ভূতের গল্প বলতে পারে। তার নানিজানদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বার তের বছর বয়েসী একটা মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটা কে ? কোথেকে এখানে এসেছে, কেউ কিছু জানে না। ফুটফুটে চেহারা, মাথাভর্তি চুল। ঠোটের কোণায় হাসির রেখা। পুলিশ এল তদন্ত হলাে।
কিছুই বের হলাে না। মেয়েটার কবর হলাে গ্রামের মসজিদের পেছনের কবরস্থানে। তারপর শুরু হলাে যন্ত্রণা। গভীর রাতে মেয়েটার কান্না শােনা যায়। লােকজনদের ফিসফিস করে বলে– এই তােমরা আমাকে কবর দিলে কেন ? আমি হিন্দু। আমার নাম লীলাবতী। গ্রামের লােকজন অস্থির হয়ে পড়ল। শেষে সবাই মিলে সালিস করে ঠিক করল কবর খুঁড়ে মেয়েটার ডেডবডি বের করে শ্মশানে নিয়ে পােড়ানাে হবে। কবর খােড়া হলাে, দেখা গেল কবরে কিছুই নেই। কাফনের কাপড়টা শুধু পড়ে আছে।
ভূতের গল্প শেষ করে শামা ভয় কাটানাের জন্যে একটা মজার গল্প বলবে । যে গল্প বলবে সেটাও ঠিক করা। গল্পটা সবচে’ সুন্দর বলতে পারে তৃণা। তবে সে নিজেও খারাপ বলে । এক পথচারী অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই শুনুন, এই রাস্তাটা কি হাসপাতালের দিকে গিয়েছে ? উত্তরে সেই লােক বলল, রাস্তার কি অসুখ হয়েছে যে রাস্তা হাসপাতালের দিকে যাবে ?
গল্পগুজব শেষ হবার পর মানুষটাকে পুরােপুরি চমকে দেবার জন্যে সে বলবে, আচ্ছা শুনুন, অনেক গল্প করা হয়েছে। এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতেও ঘুমুই নি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘুমাব।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
ঘুমের মধ্যে আপনি কিন্তু আমার গায়ে হাত দেবেন না। ঘুমের সময় কেউ আমার গায়ে হাত দিলে আমার খুব খারাপ লাগে। এই বলেই সে পাশ ফিরে শুয়ে গভীর ঘুমের ভান করবে। লােকটা কী করবে? বাধ্য ছেলের মতাে চুপচাপ পাশে বসে থাকবে ?
আজান হচ্ছে। সুলতানা উঠেছেন। রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে ডেকে তুলবেন। দু’জনে ফজরের নামাজ পড়ে এক সঙ্গে চা খাবেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘণ্টা খানিক ঘুমিয়ে আবার উঠবেন। এই ওঠা ফাইনাল ওঠা। আগেরটা সেমিফাইনাল। এই রুটিনের কোনাে ব্যতিক্রম শামা তার জীবনে দেখে নি। শামা এবং তার বাবা রুটিনের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। মানুষ অতি দ্রুত রুটিনে আটকা পড়ে যায়। ভালবাসাবাসিও কি এক সময় রুটিনের মধ্যে চলে আসে? রুটিন করে একজন আরেক জনকে ভালবাসে ?
শামা বিছানায় উঠে বসল। সে ঠিক করল এক কাপ চা নিয়ে ছাদে চলে যাবে। ছাদে হাটতে হাটতে চা খাবে। চা খেতে খেতে গুছিয়ে নেবে— এশা সেজে আজ কী কী কথা আতাউর নামের মানুষটাকে বলবে । কথা বলবে কি না সেটাও ভাবার ব্যাপার আছে। এখন আর কথা বলে কী হবে! তবু সে হয়ত বলবে। কারণ তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলতে হবে নটার আগে। ন‘টার সময় মানুষটা নিশ্চয়ই অফিসে চলে যাবে। শামা কলেজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে। মানুষটা পারবে না। তাকে বেঁচে থাকতে হলে অফিস করতে হবে। বেতন তুলতে হবে। সে নিশ্চয়ই রুটিনে ঢুকে পড়া মানুষ।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১৯)- হুমায়ূন আহমেদ
এখন বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বাবার অসুখটা তাহলে সেরে গেছে। তিনি রােজদিনের মতাে নামাজ পড়বেন। কোরান তেলাওয়াত করবেন। তারপর ছােট্ট ঘুম ঘুমাতে যাবেন। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে অফিসের দিকে রওনা হবেন। তার জীবন আগের মতােই চলবে। শামার জীবনও হয়ত আগের মতােই চলবে। এক সময় আতাউর নামের লােকটার কথা মনেও থাকবে না। অনেক অনেক দিন পর তার নিজের মেয়ে বড় হবে। সে তার বান্ধবীর বিয়ে দেখে বাসায় ফিরে মা‘র সঙ্গে গল্প করতে বসবে তখন হয়ত শামা হঠাৎ করে বলবে, জানিস আমার একজনের সঙ্গে বিয়ে প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। লােকটার নাম আতাউর। আমি ঠাট্টা করে বলতাম খাতাউর ।
তার মেয়ে বলবে, ছিঃ মানুষের নাম নিয়ে ঠাট্টা করা ঠিক না। নামটাতাে সে রাখে নি। বাবা মা রেখেছে।
শামা বলবে, তা ঠিক। তখন আমার বয়স কম ছিল। ঠাট্টা তামাশা করতে খুব ভাল লাগত।
উনার সঙ্গে বিয়ে হলাে না কেন?
আমার বাবা কোনাে খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাে । শেষে তিনি জানতে পারলেন, কিছু সমস্যা আছে।