রিকশা থেকে নেমেই শামা দেখল তাদের বাসার বারান্দার কাঠের চেয়ারে কে যেন বসে আছে। কাঠের চেয়ারের পেছনের একটা পা ভাঙা। চেয়ারটা দেয়ালে হেলান না দিয়ে বসা যায় না। কিন্তু যে বসেছে সে চেয়ারটা বারান্দার মাঝামাঝি এনেই বসেছে। একটু অসাবধান হলেই উল্টে পড়বে। শামার বুক ধুকধুক করতে লাগল।যে–কোনাে সময় একটা একসিডেন্ট ঘটবে এটা মাথায় থাকলেই টেনশন হয়। শামার সমস্যা হচ্ছে সামান্য টেনশনেই তার বুক ধুকধুক করে। গলা শুকিয়ে যায়। এক সময় মনে হয় হাত–পা শক্ত হয়ে আসছে। নিশ্চয়ই হার্টের কোনাে অসুখ। যত দিন যাচ্ছে, তার অসুখটা তত বাড়ছে। আগে এত সামান্যতে বুক ধুকধুক করত না, এখন করে। | গত সপ্তাহেই কলেজ থেকে ফেরার পথে সে দেখল কে যেন ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা ডাব ফেলে রেখেছে। তার বুক ধুকধুক করা শুরু হলাে। এই বুঝি একসিডেন্ট হলাে।
ডাবের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ল রিকশা। রিকশার যাত্রী ছিটকে পড়ল সিট থেকে, আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে তার ওপর দিয়ে চলে গেল। দৃশ্যটা শামা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখল, তার হাত পা হয়ে গেল শক্ত। নড়ার ক্ষমতা নেই। একসিডেন্ট না হওয়া পর্যন্ত সে যেন নড়তে পারবে না। তার উচিত রাস্তায় নেমে ভাবটা সরিয়ে দেয়া। সেটাও সম্ভব না। কুড়ি বছর বয়েসী—রূপবতী একটা তরুণী রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করছে এই দৃশ্য মজাদার। চারদিকে লােক জমে যাবে। সবাই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। তাদের দৃষ্টিতে পরিষ্কার লেখা থাকবে ‘ব্রেইন নষ্ট মেয়ে। ডাবটা সরিয়ে সে যখন বাসার দিকে রওনা হবে তখন তার পেছনে পেছনে কয়েকজন রওনা হবে। মজা দেখার জন্যে যাবে। ব্রেইন নষ্ট মেয়ে নতুন আর কী করে সেটা দেখার কৌতূহলেই পেছনে পেছনে যাওয়া।
পাগল মেয়ের পেছনে হাঁটা যায়। তাতে কেউ দোষ ধরে না। | ভাঙা চেয়ারটায় বসে আছেন শামার বাবা আবদুর রহমান। তিনি মালিবাগ অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সন্ধ্যা সাতটার আগে কোনােদিনই বাসায় ফেরেন । এখন বাজছে তিনটা দশ। অসময়ে বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আছেন বলে শামা দূর থেকে বাবাকে চিনতে পারে নি। তাছাড়া বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন,
খালি গায়ে থাকেন। আজ পরেছেন ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি। শামার বাবার মুখ হাসি হাসি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে আনন্দময় কিছু ঘটবে, তার প্রতীক্ষায় চেয়ারে বসে তিনি পা দোলাচ্ছেন।
শামা বাবার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল, বাবা এই চেয়ারটার পেছনের পা ভাঙা । তুমি উল্টে পড়বে।
আবদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, পায়া ঠিক করেছি। তিনটা পেরেক মেরে দিয়েছি। তাের কলেজ ছুটি ? ঘেমে টেমে কী হয়েছিস! যা ঘরে গিয়ে গােসল কর। আর তাের মাকে বল আমাকে একটা পান দিতে।
শামা ঘরে ঢুকল। শামার মা সুলতানা মেয়েকে দেখেই বললেন, এত দেরি কেন রে ?
শামা বিরক্ত হয়ে বলল, দেরি কোথায় দেখলে ? দু’টার সময় কলেজ ছুটি হয়েছে ? এখন বাজছে দু‘টা পঁচিশ।
যা গােসল করতে যা, বাথরুমে পার্টি, সাবান, ভােয়ালে দেয়া আছে। | ক্ষিধায় মারা যাচ্ছি, আগে ভাত দাও। আর বাবা পান চাচ্ছে। বাবা আজ এত সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরল কেন ?
সুলতানা হাসিমুখে বললেন, তার অফিসের কয়েকজন কলিগ আসবে। বিকালে চা খাবে। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? গােসলে যা।
শামা শীতল গলায় বলল, ঘটনা কী বলতাে মা ? আমাকে গােসল করানাের জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে গেছ কেন?
সুলতানা হড়বড় করে বললেন, কোনাে ঘটনা না । ঘটনা আবার কী ? তাের বাবার কয়েকজন বন্ধু বিকালে চা খেতে আসবে। অফিসের বন্ধু–বান্ধবরা চা খেতে আসতে পারে না?
শামা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, চায়ের ট্রে নিয়ে তাদের সামনে সেজেগুজে আমাকে যেতে হবে তাইতাে ? ঘটনা এরকম কি–না সেটা বল।
সুলতানা চুপ করে রইলেন। শামা বলল, ছেলে কী করে? তাের বাবার অফিসে চাকরি করে। নতুন ঢুকেছে। জুনিয়ার অফিসার।
বাহ ভালতাে। শ্বশুর–জামাই এক অফিসে চাকরি করবে। দুপুরে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার ভাগাভাগি করে খাবে। শ্বশুর জামাইকে সেধে খাওয়াবে। জামাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে শ্বশুরের জন্যে চমন বাহার দেয়া পান নিয়ে আসবে।
সুলতানা ফিক করে হেসে ফেললেন। শামা কঠিন গলায় বলল, হাসবে না। মা। তােমার হাসি অসহ্য লাগছে। আমি মরে গেলেও চা নিয়ে কারাের সামনে
যাব না। এটা আমার শেষ কথা।
আচ্ছা ঠিক আছে। না গেলে না যাবি। যা গােসল করতে যা। গোসল করে যে শাড়িটা পরবি সেটাও বাথরুমে আছে। তাের বাবা কিনে এনেছে। তাের বাবা যে কিনতে পারে তাই জানতাম না।
গােসল করতেও যাব না। গা ঘামা অবস্থায় থাকব। ক্ষিধে বেশি লেগেছে ? আগে ভাত খেয়ে নিবি ?
ভাত খাব না। গেস্ট না আসা পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে থাকব। গায়ে আরাে রােদ লাগাব। রােদে গায়ের চামড়া জ্বালিয়ে ফেলব।
তাের যা ইচ্ছা করিস। একটু ঠাণ্ডা হ। লেবুর সরবত খাবি ? গরম থেকে এসেছিস লেবুর সরবত ভাল লাগবে।
লেবুর সরবত খাব না। বাবা পান চাচ্ছে এখনাে পান দিচ্ছ না কেন? | শামা মা’র সামনে থেকে সরে গেল। ঢুকল বাথরুমে। বাথরুমে গোসলের সরঞ্জাম সুন্দর করে সাজানাে। বালতি ভর্তি পানি। নতুন একটা সাবান, এখনাে মােড়ক খােলা হয় নি। সাবানের পাশে নতুন একটা টুথব্রাশ। বাথরুমের দড়িতে হালকা সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি ঝুলছে। এই শাড়িটা শামার বাবা আজ কিনে এনেছেন। বাবার রুচি খুবই খারাপ। কটকটে রঙ ছাড়া কোনাে রঙ তার চোখে ধরে না। কিন্তু এই শাড়ির রঙটা ভাল।
মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে শামার মনে হলাে লাল কাচের চুড়ি থাকলে খুব ভাল হত। সবুজ শাড়ির সঙ্গে হাত ভর্তি লাল চুড়ি খুব মানায়। শাদা শাড়ির সঙ্গে মানায় নীল চুড়ি।
এ বাড়িতে পানির খুব টানাটানি। সাপ্লাইয়ের পানি ঝিরঝির করে তিন চার ঘণ্টা এসেই বন্ধ। জমা করে রাখা পানি খুব সাবধানে খরচ করতে হয়। কেউ পানি বেশি খরচ করলে তার দিকে সবাই এমনভাবে তাকায় যেন চোখের সামনে মূর্তিমান পানি–খেকো শয়তান। আজ শামার সেই ভয় নেই। পুরাে বালতি শেষ করলেও কেউ কিছু বলবে না। শামা মনের আনন্দে মাথায় পানি ঢালতে লাগল। ঠাণ্ডা পানিতে এত আরাম লাগছে! শামার ধারণা গায়ে প্রচুর পানি ঢাললে শুধু যে শরীরের নােংরা দূর হয় তা–না, মনের ময়লাও খানিকটা হলেও ধুয়ে চলে যায়। এই জন্যেই মন ভাল লাগে।
যে ছেলেটা তাকে দেখতে আসবে তাদের বাড়িতে প্রচুর পানি আছেতাে? সবচে‘ ভাল হয় যদি বাড়িতে বাথটাব থাকে। গরমের সময় বাথটাব ভর্তি করে সে পানি রাখবে। বরফের দোকান থেকে চার পাঁচ কেজি বরফ এনে গুড়াে করে বাথটাবে ছেড়ে দেবে। কয়েকটা টাটকা গােলাপ কিনে গােলাপের পাপড়ি
পানিতে ছেড়ে দিয়ে সে ডুবে থাকবে। হাতের কাছে টি পটে চা থাকবে। মাঝে মাঝে চায়ে চুমুক দেবে। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজতে পারে। নিশ্চয়ই বাথরুমে গান শুনতে ভাল লাগবে। অনেক মানুষই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই গান ধরে । ভাল না লাগলে নিশ্চয়ই ধরত না।
সুলতানা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলেন। অবাক হয়ে বললেন, শামা ভাত। তরকারি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কী করছিস? | শামা হালকা গলায় বলল, বালতির পানি সব শেষ হয়ে গেছে মা। আরাে পানি লাগবে।
আর পানি পাব কোথায় ?
বাড়িওয়ালা চাচার ঘর থেকে আনাও। সারা গায়ে সাবান মেখে বসে আছি। পানি শেষ। আরেকটা কথা মা, যে ছেলেটা আমাকে দেখতে আসছে তার নাম
কী ?