বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-১)- হুমায়ূন আহমেদ

রিকশা থেকে নেমেই শামা দেখল তাদের বাসার বারান্দার কাঠের চেয়ারে কে যেন বসে আছেকাঠের চেয়ারের পেছনের একটা পা ভাঙাচেয়ারটা দেয়ালে হেলান না দিয়ে বসা যায় নাকিন্তু যে বসেছে সে চেয়ারটা বারান্দার মাঝামাঝি এনেই বসেছেএকটু অসাবধান হলেই উল্টে পড়বেশামার বুক ধুকধুক করতে লাগলবৃষ্টি বিলাসযেকোনাে সময় একটা একসিডেন্ট ঘটবে এটা মাথায় থাকলেই টেনশন হয়শামার সমস্যা হচ্ছে সামান্য টেনশনেই তার বুক ধুকধুক করেগলা শুকিয়ে যায়এক সময় মনে হয় হাতপা শক্ত হয়ে আসছেনিশ্চয়ই হার্টের কোনাে অসুখযত দিন যাচ্ছে, তার অসুখটা তত বাড়ছেআগে এত সামান্যতে বুক ধুকধুক করত না, এখন করে| গত সপ্তাহেই কলেজ থেকে ফেরার পথে সে দেখল কে যেন ঠিক রাস্তার মাঝখানে একটা ডাব ফেলে রেখেছেতার বুক ধুকধুক করা শুরু হলােএই বুঝি একসিডেন্ট হলাে

ডাবের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ল রিকশারিকশার যাত্রী ছিটকে পড়ল সিট থেকে, আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে তার ওপর দিয়ে চলে গেলদৃশ্যটা শামা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখল, তার হাত পা হয়ে গেল শক্তনড়ার ক্ষমতা নেইএকসিডেন্ট না হওয়া পর্যন্ত সে যেন নড়তে পারবে নাতার উচিত রাস্তায় নেমে ভাবটা সরিয়ে দেয়াসেটাও সম্ভব নাকুড়ি বছর বয়েসীরূপবতী একটা তরুণী রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করছে এই দৃশ্য মজাদারচারদিকে লােক জমে যাবেসবাই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবেতাদের দৃষ্টিতে পরিষ্কার লেখা থাকবে ব্রেইন নষ্ট মেয়েডাবটা সরিয়ে সে যখন বাসার দিকে রওনা হবে তখন তার পেছনে পেছনে কয়েকজন রওনা হবেমজা দেখার জন্যে যাবেব্রেইন নষ্ট মেয়ে নতুন আর কী করে সেটা দেখার কৌতূহলেই পেছনে পেছনে যাওয়া

পাগল মেয়ের পেছনে হাঁটা যায়তাতে কেউ দোষ ধরে না| ভাঙা চেয়ারটায় বসে আছেন শামার বাবা আবদুর রহমানতিনি মালিবাগ অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশিয়ারসন্ধ্যা সাতটার আগে কোনােদিনই বাসায় ফেরেন এখন বাজছে তিনটা দশঅসময়ে বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আছেন বলে শামা দূর থেকে বাবাকে চিনতে পারে নিতাছাড়া বাসায় তিনি যতক্ষণ থাকেন

খালি গায়ে থাকেনআজ পরেছেন ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবিশামার বাবার মুখ হাসি হাসিতাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে আনন্দময় কিছু ঘটবে, তার প্রতীক্ষায় চেয়ারে বসে তিনি পা দোলাচ্ছেন। 

শামা বাবার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল, বাবা এই চেয়ারটার পেছনের পা ভাঙা তুমি উল্টে পড়বে। 

আবদুর রহমান আনন্দিত গলায় বললেন, পায়া ঠিক করেছিতিনটা পেরেক মেরে দিয়েছিতাের কলেজ ছুটি ? ঘেমে টেমে কী হয়েছিস! যা ঘরে গিয়ে গােসল করআর তাের মাকে বল আমাকে একটা পান দিতে। 

শামা ঘরে ঢুকলশামার মা সুলতানা মেয়েকে দেখেই বললেন, এত দেরি কেন রে

শামা বিরক্ত হয়ে বলল, দেরি কোথায় দেখলে ? দুটার সময় কলেজ ছুটি হয়েছে ? এখন বাজছে দুটা পঁচিশ। 

যা গােসল করতে যা, বাথরুমে পার্টি, সাবান, ভােয়ালে দেয়া আছে| ক্ষিধায় মারা যাচ্ছি, আগে ভাত দাওআর বাবা পান চাচ্ছেবাবা আজ এত সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরল কেন

সুলতানা হাসিমুখে বললেন, তার অফিসের কয়েকজন কলিগ আসবেবিকালে চা খাবেতুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? গােসলে যা। 

শামা শীতল গলায় বলল, ঘটনা কী বলতাে মা ? আমাকে গােসল করানাের জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে গেছ কেন

সুলতানা হড়বড় করে বললেন, কোনাে ঘটনা না । ঘটনা আবার কী ? তাের বাবার কয়েকজন বন্ধু বিকালে চা খেতে আসবেঅফিসের বন্ধুবান্ধবরা চা খেতে আসতে পারে না

শামা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, চায়ের ট্রে নিয়ে তাদের সামনে সেজেগুজে আমাকে যেতে হবে তাইতাে ? ঘটনা এরকম কিনা সেটা বল। 

সুলতানা চুপ করে রইলেনশামা বলল, ছেলে কী করে? তাের বাবার অফিসে চাকরি করেনতুন ঢুকেছেজুনিয়ার অফিসার। 

বাহ ভালতােশ্বশুরজামাই এক অফিসে চাকরি করবেদুপুরে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার ভাগাভাগি করে খাবেশ্বশুর জামাইকে সেধে খাওয়াবেজামাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে শ্বশুরের জন্যে চমন বাহার দেয়া পান নিয়ে আসবে। 

 সুলতানা ফিক করে হেসে ফেললেনশামা কঠিন গলায় বলল, হাসবে নামাতােমার হাসি অসহ্য লাগছেআমি মরে গেলেও চা নিয়ে কারাের সামনে 

যাব নাএটা আমার শেষ কথা। 

আচ্ছা ঠিক আছেনা গেলে না যাবিযা গােসল করতে যাগোসল করে যে শাড়িটা পরবি সেটাও বাথরুমে আছেতাের বাবা কিনে এনেছেতাের বাবা যে কিনতে পারে তাই জানতাম না। 

গােসল করতেও যাব নাগা ঘামা অবস্থায় থাকবক্ষিধে বেশি লেগেছে ? আগে ভাত খেয়ে নিবি

ভাত খাব নাগেস্ট না আসা পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবগায়ে আরাে রােদ লাগাবরােদে গায়ের চামড়া জ্বালিয়ে ফেলব। 

তাের যা ইচ্ছা করিসএকটু ঠাণ্ডা লেবুর সরবত খাবি ? গরম থেকে এসেছিস লেবুর সরবত ভাল লাগবে। 

লেবুর সরবত খাব নাবাবা পান চাচ্ছে এখনাে পান দিচ্ছ না কেন? | শামা মাসামনে থেকে সরে গেলঢুকল বাথরুমেবাথরুমে গোসলের সরঞ্জাম সুন্দর করে সাজানােবালতি ভর্তি পানিনতুন একটা সাবান, এখনাে মােড়ক খােলা হয় নিসাবানের পাশে নতুন একটা টুথব্রাশবাথরুমের দড়িতে হালকা সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি ঝুলছেএই শাড়িটা শামার বাবা আজ কিনে এনেছেনবাবার রুচি খুবই খারাপকটকটে রঙ ছাড়া কোনাে রঙ তার চোখে ধরে নাকিন্তু এই শাড়ির রঙটা ভাল। 

মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে শামার মনে হলাে লাল কাচের চুড়ি থাকলে খুব ভাল হতসবুজ শাড়ির সঙ্গে হাত ভর্তি লাল চুড়ি খুব মানায়শাদা শাড়ির সঙ্গে মানায় নীল চুড়ি। 

বাড়িতে পানির খুব টানাটানিসাপ্লাইয়ের পানি ঝিরঝির করে তিন চার ঘণ্টা এসেই বন্ধজমা করে রাখা পানি খুব সাবধানে খরচ করতে হয়কেউ পানি বেশি খরচ করলে তার দিকে সবাই এমনভাবে তাকায় যেন চোখের সামনে মূর্তিমান পানিখেকো শয়তানআজ শামার সেই ভয় নেইপুরাে বালতি শেষ করলেও কেউ কিছু বলবে নাশামা মনের আনন্দে মাথায় পানি ঢালতে লাগলঠাণ্ডা পানিতে এত আরাম লাগছে! শামার ধারণা গায়ে প্রচুর পানি ঢাললে শুধু যে শরীরের নােংরা দূর হয় তানা, মনের ময়লাও খানিকটা হলেও ধুয়ে চলে যায়এই জন্যেই মন ভাল লাগে। 

যে ছেলেটা তাকে দেখতে আসবে তাদের বাড়িতে প্রচুর পানি আছেতাে? সবচেভাল হয় যদি বাড়িতে বাথটাব থাকেগরমের সময় বাথটাব ভর্তি করে সে পানি রাখবেবরফের দোকান থেকে চার পাঁচ কেজি বরফ এনে গুড়াে করে বাথটাবে ছেড়ে দেবেকয়েকটা টাটকা গােলাপ কিনে গােলাপের পাপড়ি 

পানিতে ছেড়ে দিয়ে সে ডুবে থাকবেহাতের কাছে টি পটে চা থাকবেমাঝে মাঝে চায়ে চুমুক দেবেক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজতে পারেনিশ্চয়ই বাথরুমে গান শুনতে ভাল লাগবেঅনেক মানুষই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই গান ধরে ভাল না লাগলে নিশ্চয়ই ধরত না। 

সুলতানা বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিলেনঅবাক হয়ে বললেন, শামা ভাততরকারি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছেএতক্ষণ কী করছিস? | শামা হালকা গলায় বলল, বালতির পানি সব শেষ হয়ে গেছে মাআরাে পানি লাগবে। 

আর পানি পাব কোথায়

বাড়িওয়ালা চাচার ঘর থেকে আনাওসারা গায়ে সাবান মেখে বসে আছিপানি শেষআরেকটা কথা মা, যে ছেলেটা আমাকে দেখতে আসছে তার নাম 

কী ?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *