কী সমস্যা ? জানি না কী সমস্যা, বাবা বলেন নি।
শামা আবারাে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার নিজের মেয়েটার কথা ভাবতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তার একটা মেয়ে আছে। এবং মেয়েটা এখন গুটিসুটি মেরে তার পাশে শুয়ে আছে।
মেয়েটার গায়ের গন্ধ পর্যন্ত তার নাকে লাগছে। গাদাফুলের পাতা কচলালে যে গন্ধ আসে সেই গন্ধ। আচ্ছা মেয়েটার সুন্দর একটা নাম থাকা দরকার না ? তার যেমন দুই অক্ষরে নাম সে রকম দু’অক্ষরের নাম। দু‘অক্ষরের নাম হলে নামটা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যাবে।
টেনে লম্বা করা যাবে। তার নামটা যেমন— শামা...আ–টা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যায়। ইচ্ছামত টেনে লম্বা করা যায়। আচ্ছা মেয়েটার নাম আশা হলে কেমন হয় ? আতাউরের আ আর শামার শা। কী অদ্ভুত কাণ্ড! আতাউর এখন এল কীভাবে ? শামা দু‘হাত দিয়ে কল্পনার মেয়েটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মেয়েটা উহ‘ বলে চিৎকারও করল, কারণ তার চুল মা’র বালিশের নিচে আটকে গেছে। এইসব চিন্তার কোনাে মানে হয়! না থাক, নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তাটা আপাতত থাকুক। অন্য কোনাে বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যাক।
মজার কোনাে বিষয়। আনন্দের কোনাে বিষয়। | শামার ঘুম পাচ্ছে। এখন আর ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। এখন ঘুমিয়ে পড়লে দশটার আগে আর ঘুম ভাঙবে না। আতাউরকে টেলিফোন করা যাবে না । টেলিফোন করতেই হবে। এশা সেজে টেলিফোন। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা। এই মজার টেকনিকটা শামা তার মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে যাবে। শামার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। দরজার কড়ায় সামান্য শব্দ হলাে। তারপরই সুলতানার গলা শােনা গেল। তিনি কোমল স্বরে বললেন, শামা চা খাবি ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২০)- হুমায়ূন আহমেদ
শামা বলল, হ্যা। আয় তাের বাবার সঙ্গে চা খা। তাের বাবা তােকে ডাকছে। শামা দরজা খুলে বের হলাে। মার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে জেগে
আছি তুমি জানতে ?
সুলতানা বললেন, হঁ্যা।
কীভাবে জানতে ? আমার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি কোনাে সাড়া শব্দও করি নি।
সুলতানা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তােরা তিন ভাইবােনের যে–কোনাে একজন জেগে থাকলে বুঝতে পারি। আমার নিজেরাে তখন ঘুম হয় না। ততাদের মধ্যে সবচে বেশি রাত জাগে এশা।
বাবা আমার সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছেন কেন ?
মনে হয় কিছু বলবে । বিয়ে যে ভেঙে গেল— কেন ভাঙল। এইসব হয়ত তােকে বলবে।
আমি বাবার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি শুনে নাও। তারপর যদি ইচ্ছা করে আমি তােমার কাছ থেকে শুনব। ইচ্ছা না করলে শুনব না।
সুলতানা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা ডাকলে কখনাে না করতে নেই। তােকে ডেকেছে তারপর যদি না যাস তাহলে মনে কষ্ট পাবে। মা’র মনে কষ্ট দিলে কিচ্ছু হয় না, কিন্তু বাবার মনে কষ্ট দিলে তার ফল খুব খারাপ হয়। আবদুর রহমান সাহেব শামাকে দেখে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তার হাতে চায়ের কাপ। কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন। চুমুক না দিয়ে কাপ নামিয়ে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। শামা বলল, তুমি কিছু বলবে?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২০)- হুমায়ূন আহমেদ
আবদুর রহমান সাহেব নরম গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আগে বােস তারপর বলি। শামা বসল। আবদুর রহমান সাহেব নিজেই মেয়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বললেন, আমি হলাম বােকা মানুষ । আমি নিজে বােকা তাের মাও বােকা। দুই বােকা মিলে বিরাট ভুল করে ফেলেছি। এই ভুলের মা বাপ নেই। খোজ খবর না নিয়ে তাের বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। ছেলেও আসা যাওয়া শুরু করল। কী অবস্থা!
শামা বলল, আসা যাওয়া শুরু করে নি বাবা। একদিনই এসেছিল।
সেই একদিন আসাটাও তাে ঠিক না। তাের মা যত্ন করে আবার ভাত খাইয়েছে। তুই আবার তাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে বান্ধবীর জন্যে উপহার কিনতে গেলি। তাের মার কাছে শুনেছি এক রিকশায় গিয়েছিস। কী ঘিন্নাকর অবস্থা! তাের অবশ্যি দোষ নেই। দোষটা আমার। আমি গ্রীন সিগন্যাল দেয়ার কারণেইতাে বাসায় এসে ভাত খাওয়া শুরু করল। চিন্তা করলেই আমার কেমন যেন লাগে।
একটা মানুষ একবেলা ভাত খেয়েছে এটা এমন কোনাে ব্যাপার না বাবা। কতজনইতাে আমাদের বাসায় খেয়েছে। তাতে কী হয়েছে ?
আবদুর রহমান সাহেব মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। হতাশ গলায় বললেন, অনেক কিছুই হয়েছে। এতাে নরম্যাল ছেলে
পাগল।
সুলতানা হতভম্ব গলায় বললেন, পাগল মানে?
মাথার অসুখ। প্রায়ই হয়। তখন কাউকে চিনতে পারে না। দরজা তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। এমন অবস্থা! এরা অসুখ গােপন করে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল। মানুষের ধারণা আছে না— বিয়ে দিলে পাগল ভাল হয়। তাই ভেবেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে। পাগল ভাল হয়ে যাবে। আমার মেয়ে হবে পাগল ভাল করার ট্যাবলেট।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২০)- হুমায়ূন আহমেদ
এই ছেলের আগেও একবার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। পানচিনি হয়েছে। মেয়েপক্ষ খবর পেয়ে পরে বিয়ে ভেঙে দেয়। গতকাল আমি ছেলের বড় বােনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ঘটনা স্বীকার করেছেন। ছেলে যেমন বজ্জাত, আত্মীয়স্বজনরাও বজ্জাত। ধরে এদের চাবকান উচিত। জুতা পেটা করা উচিত। এরা শিয়াল কুকুরেরও অধম।
শামা বলল, এইসব কেন বলছ ? বলব না ?
বলবে না। বিয়ে ভেঙে গেছে ফুরিয়ে গেছে। গালাগালি করবে কেন ? আমি এমন কী গালাগালি করলাম।