তুই এত রাগ করছিস কেন? জানি না কেন রাগ করছি। আমার ভাল লাগছে না। বাবা আমি উঠলাম।
আবদুর রহমান সাহেব চাপা গলায় বললেন, ছেলে যােগাযােগ করার চেষ্টা করতে পারে। উল্টাপাল্টা বােঝানাের চেষ্টা করতে পারে। একেবারেই পাত্তা দিবি না। কী সর্বনাশ! আমার মেয়েটাকে আরেকটু হলে একটা পাগলের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম!
শামা বাবার সামনে থেকে উঠে চলে এল।
হ্যালাে আমি এশা।
বুঝতে পারছি। তুমি কেমন আছ ?
আমি ভাল আছি। আপনার গলাটা এমন লাগছে কেন ? মনে হচ্ছে আপনি , অন্য কেউ কথা বলছে।
আমার মন ভাল নেই। মন ভাল না থাকলে আমার গলার স্বর বদলে যায়। মন ভাল নেই কেন ? বিয়ে ভেঙে গেছে বলে ?
আতাউর জবাব দিল না। শামা কিছুক্ষণ জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল। জবাবের জন্যে অপেক্ষা করে ভালই হলাে। পরের প্রশ্নটা কী করা যায় ভাবার সময় পাওয়া যাচ্ছে । কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্ন করা উচিত। কঠিন প্রশ্নগুলি মাথায় আসছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে, শামার গলা ভার ভার হয়ে আসছে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২১)- হুমায়ূন আহমেদ
এশা! জি। তােমরা সবাই আমাকে খুব খারাপ ভাবছ তাই না? আমি ভাবছি না, তবে অন্যরা ভাবছে। তুমি ভাবছ না কেন?
কারণ আমি আপনাকে খুব ভাল কখনাে মনে করি নি। বাবা মনে করেছেন, এই জন্যেই বাবা মনে কষ্ট পাচ্ছেন। আর আপা খুব কষ্ট পেয়েছে।
সে অবশ্যি কষ্টের কথাটা কাউকে বলে নি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।
ও আচ্ছা।
আমি বয়সে অনেক ছােট। কিন্তু আমি কি আপনাকে একটা উপদেশ দেব ?
দাও। আপনার বিয়ে করা উচিত হবে না। আপনিতাে মােটামুটি ধরনের অসুস্থ । বেশ অসুস্থ। আমার কথা কি ভুল?
ভুল না । আমি যখন অসুস্থ হই, বেশ ভালই অসুস্থ হই। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। অসুখটা সেরে গেলে পুরনাে অনেক কিছু ভুলে যাই।
এই অসুখ সারবে ডাক্তাররা কি এমন কথা বলেছেন ? | না বলেন নি। বরং উল্টোটা বলেছেন। বলেছেন— বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অসুখটা বাড়বে।
অসুখের ব্যাপারটা গােপন করাটা কি আপনার ঠিক হয়েছে ?
ঠিক হয় নি। খুব অন্যায় হয়েছে। অন্যায়টা করলেন কেন? তােমার আপাকে দেখে মনে হলাে আমার অসুখটা সেরে গেছে। আর
কোনােদিন হবে না। যে অসুখ হবে না আগ বাড়িয়ে সে অসুখের কথা বলতে ইচ্ছা করল না।
আপার আগে আপনার আরাে একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। তাদেরকেও আপনার অসুখের কথা জানান নি। ঐ মেয়েটিকে দেখেও কি মনে হয়েছিল আপনার অসুখ সেরে গেছে ?
আতাউর চুপ করে রইল। এশা বলল, আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। আপনি কিছু বলতে চাইলে বলুন, আমি টেলিফোন রেখে দেব।
আমি তােমার আপার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তুমি কি ব্যবস্থা করে দেবে ? তাকে দু‘একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা ? এটা তােমার আপাকে বলব। তােমাকে না।
আপার সঙ্গে কথা বলার সুযােগ পাবেন না। কারণ আপা আপনার সঙ্গে কখনাে কথা বলবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আপার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে । ছেলের নাম আশফাকুর রহমান। ছেলে মেরীলেন্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় কি আপার উচিত আপনার সঙ্গে যােগাযােগ রাখা ?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২১)- হুমায়ূন আহমেদ
উচিত না। আমি আজ রাখি ? আপনি ভাল হয়ে যান এর বেশি আর কী বলব।
সেটা সম্ভব না। আমি খুবই অসুস্থ। শােন এশা, তােমার সঙ্গে সরাসরি আমার কখনাে কথা হয় নি শুধু টেলিফোনে কথা হয়েছে। শুধুমাত্র তােমার কথা শুনে আমি তােমাকে যে কী পরিমাণ পছন্দ করেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। তােমাকে আমার মনে হয়েছে খুবই কাছের একজন।
এখনাে কি মনে হচ্ছে ? হ্যা, এখনাে মনে হচ্ছে। বড় আপার বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দিলে আপনি কি আসবেন ?
আসব। আপনার লজ্জা করবে না ?
করবে। তারপরেও আসব। তােমার আপার কাছে শুনেছি তুমি একটা ছেলেকে খুব পছন্দ কর। তােমরা খুব শিগগিরই না–কি বিয়ে করবে। তােমার বিয়েতেও আমি আসব। দাওয়াত না করলেও আসব।
শামা টেলিফোন নামিয়ে রাখল । সে অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নিজের ওপরই তার রাগ লাগছে। এর কোনাে মানে হয় ? কেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়বে?
মুত্তালিব সাহেবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি কয়েকবার বলেছেন, শামা ছেড়ে দে। আর সম্ভব না। শামা বলেছে, আধঘণ্টা আপনাকে হটানাের কথা। আমি আধঘণ্টা হাটাব। মুত্তালিব সাহেব হতাশ গলায় বললেন, হাঁটু যে রকম ছিল সে রকমই আছে। হেঁটে লাভ কী ?
লাভ ক্ষতি দেখবেন আপনি। আমার আপনাকে হাঁটানাের কথা, আমি হাঁটাব।
তাের হাঁটানাের কথা কেন ? তােকেতাে কেউ বলে দেয় নি।
এই কাজটা আমি ইচ্ছা করে নিয়েছি। আপনাকে আধঘণ্টা হাঁটালে আমি আধঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলতে পারব। আমার লাভ আমি দেখছি।
কাজটা তাহলে নিঃস্বার্থ না ? না। আজকালতাে তােকে টেলিফোন করতে দেখি না।
এখন দেখেন না পরে দেখবেন। আমি কাগজে কলমে হিসাব রাখছি মােট কত ঘন্টা টেলিফোন পাওনা।
কত ঘণ্টা ? আজকের আধঘণ্টা ধরলে হবে বারাে ঘণ্টা। তাের ধৈর্য আছে। আধঘণ্টা পার হতে বাকি কত ? এখনাে দশ মিনিট। শামা আজ ছেড়ে দে। মনে হচ্ছে পা‘টা হাঁটু থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে । খুলে পড়ে গেলেতাে ভালই।