বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ

হাঁটু বাকানাের যন্ত্রণা থেকে বাচবেনতাের মনে মায়া দয়া বলে কিছু নেইতুই আমার কষ্টটা বুঝতেই পারছিস। 

বৃষ্টি বিলাসচাচা এইসব বলে লাভ নেইডাক্তার আপনাকে বলেছেন প্রতিদিন আধঘণ্টা হাঁটতেই হবেআপনার যত কষ্টই হােক এই কাজটা আমি আপনাকে দিয়ে করাবআপনি হাঁটতে হাঁটতে ইন্টারেস্টিং কোনাে কথাবার্তা বলুনদেখবেন 

ব্যথা টের পাবেন না। 

মুত্তালিব সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু কখনাে ঘটে নিআল্লাহপাক কী করেন জানিস ? মানুষ বানিয়ে তার পিঠে একটা করে সীল দিয়ে দেনকারাে সীলে লেখা থাকে Interesting Life. তার জীবনটা ইন্টারেস্টিং হয়আবার কারাে সীলে লেখা থাকে Happy Life. তার জীবন হয় আনন্দময়। 

আপনার সীলে কী লেখা

কিছুই লেখা নেইশুধু একটা ক্রস চিহ্ন দেয়াএই ক্রস চিহ্নের মানে হলােএই লােকের সব বাতিল। 

শামা হেসে ফেললমুত্তালিব সাহেবও হাসলেনশামা বলল, মানুষহিসেবে আপনি খুব বােরিংবােরিং মানুষ সামান্য মজার কিছু বললেই মনে হয় অনেক মজার কিছু বলা হয়েছেআর আমি যেহেতু খুবই ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ, আমার খুব মজার কথাও লােকজনদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ

তুই এক কাজ করে বােরিং পারসন হবার চেষ্টা কর। 

চেষ্টা করছিলােকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছিআগে কেউ কোনাে প্রশ্ন করলে মজা করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতামএখন শুকনাে ধরনের উত্তর দেইকাঠখােট্টা জবাব। 

আধঘণ্টা শেষ হয়েছে ? হা হয়েছে। 

যা টেলিফোন করে আয়আধঘণ্টা না, আজ টেলিফোন করবি এক ঘণ্টাতারপর তাের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবপরীক্ষা করে দেখি তুই কী পরিমাণ বােরিং পারসন হয়েছিস। 

টেলিফোন করব না চাচাতাহলে আয় আমরা কথা শুরু করি আজ কথা বলব না চাচাবাসায় আজ খুব ঝামেলাবাসায় চলে যাব। 

ততার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ছিল। তাের বিয়ে ভেঙে গেছে শুনেছিকেন ভাঙল কিছুই জানি নাআবার শুনছি অন্য এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছেকী ঘটছে একটু বল শুনি। 

শামা সহজ গলায় বলল, সামারী এন্ড সাবসটেন্স বলে চলে যাইআতাউর রহমান নামে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল খোঁজ নিয়ে জানা গেল মানুষটা 

অসুস্থসারা বছর অসুস্থ থাকেন নামাঝে মাঝে থাকেনখুব বেশি যখন অসুস্থহয়ে পড়েন তখন তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়বুঝতে পারছেন 

অসুখটা কী

পারছিআমার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে বলে যেটা শুনেছেন, সেটা ঠিক বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে নাতবে তৃণা নামে আমার এক বান্ধবী আছে, ওর হবি হচ্ছে বান্ধবীদের বিয়ে দিয়ে দেয়াআমাদের তিন বান্ধবীর বিয়ের কলকাঠি সে নেড়েছেআমার ব্যাপারেও নাড়তে শুরু করেছেবিয়ের ব্যবস্থা করার তার কৌশলগুলি খুব সুন্দরমুগ্ধ হবার মতাে কৌশলএকেক জনের জন্যে একেক কৌশলআমার জন্যে একটা কৌশল বের করেছে, এবং অনেকদূর গিয়ে গেছেঅন্য এক সময় আপনাকে বলবআজ বলতে ইচ্ছা করছে নাচাচা আপনি কি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ

চাচা যাই

মুত্তালিব সাহেব কিছু বললেন নাতাঁর মন খুবই খারাপ হয়েছেএই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছেকী করবেন, কীভাবে করবেন কিছুই মাথায় আসছে নাতিনি জন্মগ্রহণ করেছেন পিঠে ক্রস চিহ্ন নিয়ে, ধরনের মানুষেরা ইচ্ছা থাকলেও কারাে জন্যে কিছু করতে পারে নাযে নিজের জন্যে কিছু করতে পারে না সে অন্যের জন্যে কী করবে

শামা বাসায় ঢুকে দেখে বাসার পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিকঅথচ সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে দোতলায় মুত্তালিব সাহেবের কাছে চলে গিয়েছিল তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়ঙ্করআবদুর রহমান সাহেব যে ব্যাপার কখনাে করেন না, তাই করছিলেনরেগে থালা বাসন ভাঙছিলেন, টেবিলের ওপর রাখা দুটা কাপ এবং একটা পানির জগ ছুঁড়ে মারলেন সুলতানার দিকেসুলতানা ক্ষীণ স্বরেবললেন, এরকম করছ কেন ? একটু শান্ত হয়ে বারান্দায় বসআবদুর রহমান সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কেন শান্ত হব ? আমাকে একটা কারণ দেখাও যার জন্যে শান্ত হব

সুলতানা এশার কাছে গিয়ে বললেন, মা যা তাের বাবাকে একটু শান্ত করএশা শাড়ি ইস্ত্রী করছিলসে শাড়ি ইস্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ না করে বলল, কোনাে দরকার নেইবাবা আপনা আপনি শান্ত হবে। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ

রকম করলেতাে স্ট্রোক হয়ে যাবেহয়ে গেলেও কিছু করার নেই। 

সুলতানা কাঁদো কাঁদো মুখে বড় মেয়ের কাছে গেলেনপ্রায় মিনতির গলায় বললেন, শামা তাের বাবাকে একটু সামলাসারা ঘরে ভাঙা কাচের টুকরাতাের বাবা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছেরাগের মাথায় কোনাে দিকে না তাকিয়ে হাঁটবেকাচের টুকরায় পা কাটবে। 

শামা বলল, বাবার সামনে গেলেই আমি এখন ধমক খাবআমার ধমক খেতে ইচ্ছা করছে নাআমি এখন ঘরেই থাকব না। 

তুই যাবি কোথায় ? বাড়িওয়ালা চাচার বাসায়উনাকে হাটাবতাের বাবার এই অবস্থা আর তুই যাচ্ছিস আরেকজনকে হাঁটাতে

শামা মাসামনে থেকে সরে দোতলায় চলে এলচল্লিশ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখে সব শান্তপশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্রুপ। 

আবদুর রহমান সাহেবের রাগের প্রধান কারণ মন্টুআজ দুপুরে সে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনে পরীক্ষা সকালে হয়ে গেছেকাজেই তার আর পরীক্ষা দেয়া হয় নিআবদুর রহমান সাহেব সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে এই ঘটনা শুনলেনশান্তভাবেই চা খেলেনতারপর ছেলের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে গেলেনচাপা গলায় বললেন, মানুষের সামনে লজ্জা না দিলে তাের হুশ হবে নারাস্তায় নিয়ে তােকে আমি নেংটা করে ছেড়ে দেব। 

তিনি এটা করলেন না, তবে যা করলেন তাও ভয়াবহছেলেকে কানে ধরে একশ বার ওঠবােস করালেনতাদের চারদিকে লােক জমে গেলরিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ঘণ্টা দিতে লাগল। 

আবদুর রহমান সাহেব পুত্রের শাস্তি পর্ব শেষ করার পর বললেন, খবরদার তুই বাড়িতে ঢুকবি নাতােকে ত্যাজ্য বাড়ি এবং ত্যাজ্য পুত্র করলামএখন যা, চরে খা। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ

মন্টু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল, তিনি বাড়িতে ঢুকে থালা বাসন ভাঙা শুরু করলেন। 

অল্প সময়ের ভেতরই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছেভাঙা কাচের টুকরা সরানাে হয়েছেভেতরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে সুলতানা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছেনকে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিরাট ঝড় গিয়েছেশামা বলল, বাবা কোথায় মা

সুলতানা বললেন, শুয়ে আছেরাগ কমেছে

মন্টু ফিরেছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *