হাঁটু বাকানাের যন্ত্রণা থেকে বাচবেন। তাের মনে মায়া দয়া বলে কিছু নেই। তুই আমার কষ্টটা বুঝতেই পারছিস।
চাচা এইসব বলে লাভ নেই। ডাক্তার আপনাকে বলেছেন প্রতিদিন আধঘণ্টা হাঁটতেই হবে। আপনার যত কষ্টই হােক এই কাজটা আমি আপনাকে দিয়ে করাব। আপনি হাঁটতে হাঁটতে ইন্টারেস্টিং কোনাে কথাবার্তা বলুন। দেখবেন
ব্যথা টের পাবেন না।
মুত্তালিব সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু কখনাে ঘটে নি। আল্লাহপাক কী করেন জানিস ? মানুষ বানিয়ে তার পিঠে একটা করে সীল দিয়ে দেন। কারাে সীলে লেখা থাকে Interesting Life. তার জীবনটা ইন্টারেস্টিং হয়। আবার কারাে সীলে লেখা থাকে Happy Life. তার জীবন হয় আনন্দময়।।
আপনার সীলে কী লেখা ?
কিছুই লেখা নেই। শুধু একটা ক্রস চিহ্ন দেয়া। এই ক্রস চিহ্নের মানে হলাে— এই লােকের সব বাতিল।
শামা হেসে ফেলল। মুত্তালিব সাহেবও হাসলেন। শামা বলল, মানুষ। হিসেবে আপনি খুব বােরিং। বােরিং মানুষ সামান্য মজার কিছু বললেই মনে হয় অনেক মজার কিছু বলা হয়েছে। আর আমি যেহেতু খুবই ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ, আমার খুব মজার কথাও লােকজনদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ
তুই এক কাজ করে বােরিং পারসন হবার চেষ্টা কর।
চেষ্টা করছি। লােকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছি। আগে কেউ কোনাে প্রশ্ন করলে মজা করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতাম— এখন শুকনাে ধরনের উত্তর দেই। কাঠখােট্টা জবাব।
আধঘণ্টা শেষ হয়েছে ? হা হয়েছে।
যা টেলিফোন করে আয়। আধঘণ্টা না, আজ টেলিফোন করবি এক ঘণ্টা। তারপর তাের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলব। পরীক্ষা করে দেখি তুই কী পরিমাণ বােরিং পারসন হয়েছিস।
টেলিফোন করব না চাচা। তাহলে আয় আমরা কথা শুরু করি । আজ কথা বলব না চাচা। বাসায় আজ খুব ঝামেলা। বাসায় চলে যাব।
ততার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ছিল। তাের বিয়ে ভেঙে গেছে শুনেছি। কেন ভাঙল কিছুই জানি না। আবার শুনছি অন্য এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। কী ঘটছে একটু বল শুনি।।
শামা সহজ গলায় বলল, সামারী এন্ড সাবসটেন্স বলে চলে যাই। আতাউর রহমান নামে যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল খোঁজ নিয়ে জানা গেল মানুষটা
অসুস্থ। সারা বছর অসুস্থ থাকেন না। মাঝে মাঝে থাকেন। খুব বেশি যখন অসুস্থ। হয়ে পড়েন তখন তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। বুঝতে পারছেন
অসুখটা কী ?
পারছি। আমার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে বলে যেটা শুনেছেন, সেটা ঠিক । বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে না। তবে তৃণা নামে আমার এক বান্ধবী আছে, ওর হবি হচ্ছে বান্ধবীদের বিয়ে দিয়ে দেয়া। আমাদের তিন বান্ধবীর বিয়ের কলকাঠি সে নেড়েছে। আমার ব্যাপারেও নাড়তে শুরু করেছে। বিয়ের ব্যবস্থা করার তার কৌশলগুলি খুব সুন্দর। মুগ্ধ হবার মতাে কৌশল। একেক জনের জন্যে একেক কৌশল। আমার জন্যে একটা কৌশল বের করেছে, এবং অনেকদূর এগিয়ে গেছে। অন্য এক সময় আপনাকে বলব। আজ বলতে ইচ্ছা করছে না। চাচা আপনি কি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ
চাচা যাই ?
মুত্তালিব সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর মন খুবই খারাপ হয়েছে। এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে ইচ্ছা করছে। কী করবেন, কীভাবে করবেন কিছুই মাথায় আসছে না। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন পিঠে ক্রস চিহ্ন নিয়ে, এ ধরনের মানুষেরা ইচ্ছা থাকলেও কারাে জন্যে কিছু করতে পারে না। যে নিজের জন্যে কিছু করতে পারে না সে অন্যের জন্যে কী করবে?
শামা বাসায় ঢুকে দেখে বাসার পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। অথচ সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে দোতলায় মুত্তালিব সাহেবের কাছে চলে গিয়েছিল তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়ঙ্কর। আবদুর রহমান সাহেব যে ব্যাপার কখনাে করেন না, তাই করছিলেন। রেগে থালা বাসন ভাঙছিলেন, টেবিলের ওপর রাখা দু‘টা কাপ এবং একটা পানির জগ ছুঁড়ে মারলেন সুলতানার দিকে। সুলতানা ক্ষীণ স্বরে। বললেন, এরকম করছ কেন ? একটু শান্ত হয়ে বারান্দায় বস। আবদুর রহমান সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কেন শান্ত হব ? আমাকে একটা কারণ দেখাও যার জন্যে শান্ত হব ?
সুলতানা এশার কাছে গিয়ে বললেন, মা যা তাের বাবাকে একটু শান্ত কর। এশা শাড়ি ইস্ত্রী করছিল। সে শাড়ি ইস্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ না করে বলল, কোনাে দরকার নেই। বাবা আপনা আপনি শান্ত হবে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ
এ রকম করলেতাে স্ট্রোক হয়ে যাবে। হয়ে গেলেও কিছু করার নেই।
সুলতানা কাঁদো কাঁদো মুখে বড় মেয়ের কাছে গেলেন। প্রায় মিনতির গলায় বললেন, শামা তাের বাবাকে একটু সামলা। সারা ঘরে ভাঙা কাচের টুকরা। তাের বাবা খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগের মাথায় কোনাে দিকে না তাকিয়ে হাঁটবে। কাচের টুকরায় পা কাটবে।
শামা বলল, বাবার সামনে গেলেই আমি এখন ধমক খাব। আমার ধমক খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন ঘরেই থাকব না।
তুই যাবি কোথায় ? বাড়িওয়ালা চাচার বাসায়। উনাকে হাটাব। তাের বাবার এই অবস্থা আর তুই যাচ্ছিস আরেকজনকে হাঁটাতে ?
শামা মা’র সামনে থেকে সরে দোতলায় চলে এল। চল্লিশ মিনিট পরে ফিরে এসে দেখে সব শান্ত। পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্রুপ।
আবদুর রহমান সাহেবের রাগের প্রধান কারণ মন্টু। আজ দুপুরে সে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনে পরীক্ষা সকালে হয়ে গেছে। কাজেই তার আর পরীক্ষা দেয়া হয় নি। আবদুর রহমান সাহেব সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে এই ঘটনা শুনলেন। শান্তভাবেই চা খেলেন। তারপর ছেলের হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় বললেন, মানুষের সামনে লজ্জা না দিলে তাের হুশ হবে না। রাস্তায় নিয়ে তােকে আমি নেংটা করে ছেড়ে দেব।
তিনি এটা করলেন না, তবে যা করলেন তাও ভয়াবহ। ছেলেকে কানে ধরে একশ বার ওঠবােস করালেন। তাদের চারদিকে লােক জমে গেল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ঘণ্টা দিতে লাগল।
আবদুর রহমান সাহেব পুত্রের শাস্তি পর্ব শেষ করার পর বললেন, খবরদার তুই বাড়িতে ঢুকবি না। তােকে ত্যাজ্য বাড়ি এবং ত্যাজ্য পুত্র করলাম। এখন যা, চরে খা।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২২)- হুমায়ূন আহমেদ
মন্টু রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল, তিনি বাড়িতে ঢুকে থালা বাসন ভাঙা শুরু করলেন।
অল্প সময়ের ভেতরই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। ভাঙা কাচের টুকরা সরানাে হয়েছে। ভেতরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে সুলতানা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছেন। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিরাট ঝড় গিয়েছে। শামা বলল, বাবা কোথায় মা ?
সুলতানা বললেন, শুয়ে আছে। রাগ কমেছে?
মন্টু ফিরেছে ?