এশা বলল, মা আপাকে সাধারণ ঘরে পরার একটা শাড়ি পরতে বলব ?
বল। তাের বাবা আবার রাগ না করে। শখ করে একটা শাড়ি কিনে এনেছে।বাবা কিছু বুঝতে পারবে না। বাবা খুব টেনশনে আছে তাে। টেনশনের সময় মানুষ কিছু বুঝতে পারে না। বাবা ভালমতাে আপার দিকে তাকাবেই না । মেয়েরা যখন বড় হয়ে যায় তখন বাবারা মেয়েদের দিকে কখনাে ভালমতাে তাকায় না। বাবাদের মনে হয় তাকাতে লজ্জা করে।
সুলতানা ছােটমেয়ের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই মেয়েটার ভাল বুদ্ধি আছে। মেয়েটার বুদ্ধির খবর এই পরিবারে আর কেউ জানে না। শুধু তিনি জানেন। এই নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও আছে। মেয়েদের বেশি বুদ্ধি ভাল না। বেশি বুদ্ধির মেয়ে কখনাে সুখী হয় না। সংসারে যে মেয়ের বুদ্ধি যত কম সে তত সুখী।
শামা খুব সহজ ভঙ্গিতেই চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সে ধরেই নিয়েছিল ঘরে ঢােকা মাত্র সবাই এক সঙ্গে তার দিকে তাকাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাত পা শক্ত হয়ে যাবে। দেখা গেল সবাই তার দিকে তাকাল না। আতাউর নামের ছেলেটা মাথা
নিচু করেই বসেছিল, সে মাথাটা আরাে খানিকটা নিচু করে ফেলল। শামা তার দিকে এক ঝলক তাকাল। এক ঝলকে তার অনেকখানি দেখা হয়েছে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
ছেলেটা ছায়ার কচুগাছের মতাে ফর্সা। হাতের নীল নীল শিরা বের হয়ে আছে। অতিরিক্ত রােগা। ঘুমের সমস্যা মনে হয় আছে। চোখের নিচে কালি। বাম চোখের নিচে বেশি কালি। ডান চোখে কম। মাথায় অনেক চুল আছে। চেহারা ভাল। গোঁফ নেই— এটাও ভাল। পুরুষ মানুষের নাকের নিচে গোঁফ দেখলেই শামার গা শিরশির করে। মনে হয় ঘাপটি মেরে মাকড়সা বসে আছে। তাড়া দিলেই নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে যাবে।
কালাে আচকান পরা মুখভর্তি দাড়ি এক ভদ্রলােক শামার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে মা, আমাদের জন্যে চা নিয়ে চলে এসেছ। কেমন আছ গাে মা ?
শামা বলল, জি, আমি ভাল আছি।
বােস মা, তুমি আমার পাশে বােস। এমন সুন্দর কন্যা পাশে নিয়ে বসাও এক ভাগ্যের ব্যাপার।
আচকান পরা ভদ্রলােক সরে গিয়ে শামার জন্যে জায়গা করলেন। শামা সহজ গলায় বলল, আমি খাবারটা হাতে হাতে দিয়ে নি। তারপর বসি?
ঠিক আছে মা। ঠিক আছে। আগে কাজ তারপর বসা, তারপর আলাপ। আর এই জগতে খাওয়ার চেয়ে বড় কাজতাে কিছু নেই। কী বলেন আপনারা ? | কেউ কিছু বলল না। শুধু আতাউর নামের ছেলেটা কাশতে লাগল। শামা মনে মনে বলল, এই যে খাতাউর ভাইয়া, আপনার এই কাশি ঠাণ্ডার কাশি, না যক্ষাটক্ষা আছে ?
প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে শামা ভাবল খাবারের প্লেট সবার আগে যিনি মুরুব্বি তার হাতে দেয়া দরকার। তা না করে সে যদি যক্ষারােগী খাতাউরের হাতে দেয় তাহলে কেমন হয় ? যক্ষারােগী নিশ্চয়ই ভাবছে না তাকে প্রথম দেয়া হবে। তার কাশি আরাে বেড়ে যাবে। আচকান পরা মওলানা বেশি ফটফট করছে। মওলানার ফটফটানি কিছুক্ষণের জন্য হলেও কমবে। মওলানা হয়ত মনে মনে বলবে— নাউজুবিল্লাহ, মেয়েটাতাে মহানির্লজ্জ। বলুক যার যা ইচ্ছা।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
শামা খাবারের প্লেট আতাউরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লেগেছে ? এত কাশছেন কেন ?
শামা যা ভেবেছিল তাই হলাে। আচকান পরা মওলানা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি শামার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। যক্ষারােগীর কাশি কিছুক্ষণের জন্য হলেও থেমেছে। শামার বাবাও অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মনে হচ্ছে ঘটনা কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না। | আচকান পরা মওলানা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, মা শােন, পুরুষ মানুষের কাশিকে তুচ্ছ করতে নাই। পুরুষ মানুষ চেনা যায় কাশি দিয়ে। কথায় আছে—
ঘােড়া চিনি কানে। রাজা চিনি দানে কন্যা চিনি হাসে
পুরুষ চিনি কাশে। আতাউরকে চিনতেছি তার কাশিতে আর তােমারে চিনতেছি তােমার হাসিতে। হা হা হা।
শামা লক্ষ করল সবাই হাসতে শুরু করেছে। এমনকি তার বাবাও হাসছেন। যিনি কখনাে হাসেন না। কারণ হাসিকে তিনি চারিত্রিক দুর্বলতা মনে করেন। সবাই হাসছে, শুধু যক্ষারােগীর মুখে কোনাে হাসি নেই। সে মাথা আরাে নিচু করে ফেলেছে।
কালাে আচকান পরা মওলানা পাত্রের মেজো চাচা। সৈয়দ আওলাদ হােসেন। নেত্রকোনা কোর্টে ওকালতি করেন। তিনিই পাত্রের অভিভাবক। বিয়ের কথাবার্তার সময় পাত্রের অভিভাবকরা ক্রমাগত কথা বলেন। সৈয়দ সাহেব তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দাড়ি কমা ছাড়াই কথা বলে গেলেন এবং বিদায়ের আগে আগে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। কন্যা আমাদের সবারই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আলহামদুলিল্লাহ। শুধু কন্যা পছন্দ হয়েছে বললে ভুল বলা হবে— কন্যার পিতাকেও পছন্দ হয়েছে। বেয়ান সাহেবের সাথে দেখা হয় নাই, তার রান্না পছন্দ হয়েছে। সিঙ্গাড়া অনেক জায়গায় খেয়েছি। এরকম স্বাদের সিঙ্গাড়া খাই নাই। বেয়ান সাহেবকে দূর থেকে জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে মােবারকবাদ। এখন বিবাহের তারিখ নিয়ে দু‘টা কথা। আমি সবচে’ খুশি হতাম আজকে রাতেই বিবাহ দিতে পারলে সেটা সম্ভব না।
আমাদের নিজেদের কিছু আয়ােজন আছে। আমরাতে শহরের লােক না, গ্রামের লােক। বিয়ে শাদি সবাইকে নিয়ে দিতে হয়। কাজেই বিবাহ হবে ইনশাল্লাহ আষাঢ় মাসে। আবদুর রহমান সাহেব আপনার কিছু বলার থাকলে বলেন। আবদুর রহমান সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, আপনারা যা ঠিক করবেন তাই হবে। এই মেয়ে এখন আপনাদের মেয়ে।
আওলাদ হােসেন সবগুলি দাঁত বের করে দিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ
এই যে আপনি বললেন— আপনাদের মেয়ে, এতে সব কথা বলা হয়ে গেল। মেয়েতাে আমাদের অবশ্যই, আপনাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। হা হা হা।
আওলাদ সাহেব আচকানের পকেট থেকে আংটি বের করে শামার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। শুধু আংটি না, আংটির সঙ্গে খামে ভর্তি টাকাও আছে। এক হাজার এক টাকা ।।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আওলাদ সাহেব বললেন, এই যে এক হাজার এক টাকা দিলাম এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাস না বললে বুঝবেন না। হয়ত ভাববেন টাকা দিচ্ছে কেন? ছােটলােক না–কি? এখন ইতিহাসটা বলি। আজ আমাদের খুবই গরিবি হালত। সব সময় এরকম ছিল না। আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ঈশ্বরগঞ্জের ন‘আনি জমিদার। তাদের নিয়ম ছিল কন্যাকে এক হাজার একটা আশরাফি দিয়ে মুখ দেখা।
এই নিয়মতাে এখন আর সম্ভব না। তারপরেও পুরনাে স্মৃতি ধরে রাখা। শামা বাবার চোখের ইশারায় তার হবু চাচা শ্বশুরকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বােকার মতাে দাঁড়িয়ে রইল। তার কাছে মনে হচ্ছে সে একটা নাটকে পাঠ করছে যে নাটকে তার চরিত্রটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কোনাে সংলাপ নেই। পরিচালক তাকে বুঝিয়েও দেন নি স্টেজে উঠে কী করতে হবে। এক হাজার এক টাকা ভর্তি খামটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এটা যদি কোনাে হাসির নাটক হত তাহলে সে খাম খুলে টাকাগুলি বের করে গুণতে শুরু করত এবং একটা নােট বের করে বলত, এই নােটটা ময়লা, বদলে দিন। কিন্তু এটা কোনাে হাসির নাটক না।
খুবই সিরিয়াস নাটক। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের একজন ঈশ্বরগঞ্জের ন’আনি জমিদারের উত্তরপুরুষ সৈয়দ ওয়ালিউর রহমান এখন আবেগে আপ্লুত হয়ে কাঁদছেন এবং রুমালে চোখের পানি মুছছেন। নাটকের আরেক চরিত্র শামার বাবা আবদুর রহমান সাহেবের চোখেও পানি। অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রেরাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মন্টুকে দেখা যাচ্ছে। সে ব্যাপার দেখে পুরােপুরি হকচকিয়ে গিয়েছে। তার হাতে একটা পানির গ্লাস।
(চলবে)