ছেলের নাম আতাউর ।
কী সর্বনাশ খাতাউর আবার মানুষের নাম হয় ? নাম শুনলেই মনে হয় খাতাউর সাহেব হাঁ করে আছেন— খেয়ে ফেলার জন্যে।
খাতাউর না, আতাউর। শামা তুই ইচ্ছা করে ফাজলামি করছিস। এইসব ঠিক না।
পানি আনার ব্যবস্থা কর মা। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। মা শশান, লাল চুড়ি আছে ? তােমার ট্রাংকেতাে অনেক জিনিস আছে। খুঁজে দেখতে লাল চুড়ি আছে নাকি। আমি লাল চুড়ি পরব।
সুলতানা আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়ে সহজভাবে কথা বলছে। তিনি কাজের মেয়েকে বালতি দিয়ে পানি আনতে পাঠালেন। মেয়েটা শখ মিটিয়ে গােসল করুক। মেয়েদের অতি তুচ্ছ শখও সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হয়। মেয়েরা মা–বাপের সংসারে থাকে না। অন্য সংসারে চলে যায়। যে সংসারে যায় সেখানে সে হয়ত মুখ ফুটে শখের কথাটা বলতেও পারে না।
অতিথিরা পাঁচটার সময় উপস্থিত হলেন। তখন শামার চুল বাঁধা হচ্ছে। চুল বেঁধে দিচ্ছে শামার ছােট বােন এশা। এশা এ বছর ক্লাস টেনে উঠেছে। সে খুবই হাসি খুশি মেয়ে। গত দু‘দিন ধরে কী কারণে যেন সে মুখ ভোঁতা করে আছে। কারাে সঙ্গেই কথাবার্তা বলছে না। এশার মুখ ভোতার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করছে না। কারণ চেষ্টা করে লাভ নেই। এশা নিজ থেকে মুখ না খুললে কেউ তার মুখ খােলাতে পারবে না।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ
লােকজন চলে এসেছে এই খবরটা দিল শামার ছােট ভাই মন্টু। সে গত বছর এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল। টাইফয়েড় হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা শেষ করতে পারে নি। এবার আবারাে দিচ্ছে। আগামী বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরু। মন্টুর ধারণা এবারে পরীক্ষার মাঝখানে তার কোনাে বড় অসুখ হবে, সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। এরকম স্বপ্নও সে দেখে ফেলেছে। স্বপ্নে পরীক্ষার হল থেকে এম্বুলেন্সে করে তাকে সরাসরি হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে ডাক্তাররা ছােটাছুটি শুরু করেন। কারণ তাকে রক্ত না দিলে সে মারা যাবে। কারাে রক্তের সঙ্গেই তার রক্ত মিলছে না। শেষে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিলল। সেই একজন তাদের স্কুলের হেড স্যার। তিনি রক্ত দিতে এসে তাকে দেখে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কীরে তুই এ বছরও পরীক্ষা দিচ্ছিস না ? ফাজলামি করিস?
মন্টু এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপা, এসে গেছে। চারজন এসেছে।
শামা বিরক্ত গলায় বলল, চারজন এসেছে খুব ভাল কথা। তুই ফিসফিস করছিস কেন? এর মধ্যে ফিসফিসানির কী আছে ?
ট্যাক্সি করে এসেছে। শুনে খুশি হলাম। ট্যাক্সি করেইতাে আসবে। ঠেলাগাড়িতে করে তাে আসবে । না–কি তুই ভেবেছিলি ঠেলাগাড়ি করে আসবে ?
অনেক মিষ্টি এনেছে। পাঁচ প্যাকেট!
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ
সামনে থেকে যা তাে, কানের কাছে বিজবিজ করবি না। কয় প্যাকেট মিষ্টি এনেছে—দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুণেছিস। শুনতেইতাে লজ্জা লাগছে।
মেহমানরা বসার ঘরে বসেছেন। তাদেরকে চা নাস্তা এখনাে দেয়া হয় নি। আরাে দু’জন নাকি আসবেন। তাদের জন্য অপেক্ষা। মজার গল্প হচ্ছে। হাসি শােনা যাচ্ছে।
শামা সেজেগুজে অপেক্ষা করছে। চা নিয়ে যেতে বললেই সে ট্রেতে করে চা নিয়ে যাবে। এই উপলক্ষে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সুন্দর একটা ট্রে আনা। হয়েছে। ছােট্ট একটা সমস্যা হয়েছে। এক ধরনের চায়ের কাপ আছে ছটা। চারজন গেস্ট আছেন। আরাে দু’জন আসবেন। ছ‘টা কাপ হয়ে গেল। আবদুর রহমান সাহেবকে চা দিতে হবে, তার জন্যে একটা কাপ লাগবে। তারা হয়ত শামাকেও চা খেতে বলবেন। আরাে দু‘টা ভাল কাপ দরকার।
সুলতানা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। তিনি ঠিক করেছেন মেহমানদের কোনাে বাইরের খাবার দেবেন না। সব খাবার ঘরে তৈরি হবে। তিনি কলিজার সিঙ্গাড়া বানানাের চেষ্টা করছেন। সিঙ্গাড়ার তিনটা কোণা ঠিক মতাে উঠছে না।
সিঙ্গাড়া তিনি আগেও বানিয়েছেন। তখন ঠিকই কোণা উঠেছে। এখন কেন উঠছে না ? বিয়েতে কোনাে অলক্ষণ নেই তাে? আজ সকালবেলা বেশ কয়েকবার তিনি এক শালিক দেখেছেন। এক শালিকের ব্যাপারটা অনেকেই বিশ্বাস করে না। তিনি খুব করেন। ছােটবেলা থেকেই তিনি লক্ষ করেছেন যতবার এক শালিক দেখেছেন ততবারই ঝামেলা হয়েছে।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ
এশা এসে মাকে সাহায্য করার জন্যে বসল। এশার মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর। চোখ ফোলা ফোলা। মনে হয় কেঁদেকেঁদে এসেছে । এশার কী হয়েছে কে জানে! এমন চাপা মেয়ে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলেও সে মুখ খুলবে না।
সুলতানা বললেন, কী সমস্যা হয়েছে দেখ না। সিঙ্গাড়ার কোণা উঠছে না।
এশা বলল, খেতে ভালই হল। কোণা ওঠার দরকার নেই। দোকানের সিঙ্গাড়ায় লােকজন কোণা খোঁজে। ঘরের সিঙ্গাড়ায় খোঁজে না।
সুলতানা বললেন, একটা খেয়ে দেখ। খেতে ইচ্ছা করছে না। তাের কি কোনাে কারণে মন টন খারাপ?
না। এক কথা পাচ লক্ষবার জিজ্ঞেস করাে না তাে মা । আমার মন খারাপ। কি–না এটা তুমি এই ক’দিনে পাঁচ লক্ষবারের বেশি জিজ্ঞেস করে ফেলেছ।
সুলতানা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, শামা কী করছে ? খাটে বসে আছে। সাজার পর তাকে কেমন দেখাচ্ছেরে ?
পরীদের রাণীর মতাে লাগছে।
সুলতানা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, শামাকে যে–ই দেখবে সে–ই পছন্দ করবে। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকালে বুকে ধাক্কার মতাে লাগে। ভেবেই পাই না এত সুন্দর মেয়ে আমার পেটে জন্মাল কীভাবে!
এশা বলল, আপা বেশি সুন্দর। বেশি সুন্দরকে আবার মানুষ পছন্দ করে না। সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, পছন্দ করবে না কেন?
এশা উত্তর দিল না। সুলতানা বললেন, পছন্দ করবে না কেন বল ? কারণ জানিস না ?
কারণ জানি কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। মা শােন, তুমি আর বাবা, তােমরা দু’জন কি আসলেই চাও যে ছেলেটা এসেছে তার সঙ্গে আপার বিয়ে হােক ?
তাের বাবা চায়, তার ধারণা ছেলেটা খুবই ভাল। অসম্ভব ভদ্র, বিনয়ী। ফ্যামিলিও ভাল। ছেলের অবশ্যি বাবা নেই। কিছুদিন হলাে মারা গেছেন। শামা শ্বশুরের আদর পাবে না। তােরাতাে জানিস না শ্বশুরের আদর বাপের আদরের চেয়েও বেশি হয়।
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ
আপা যেভাবে সাজগােজ করেছে— এভাবে সাজগােজ করে থাকলে কিন্তু ওরা আপাকে পছন্দ করবে না। আপার উচিত খুব সাধারণ একটা শাড়ি পরে ওদের সামনে যাওয়া। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক এইসব কিছু না।
কী বলছিস তুই!
কোনােরকম সাজগােজ ছাড়া আপা যখন ওদের সামনে দাঁড়াবে তারা বলবে, বাহ্ কী সহজ সরল সাধারণ একটা মেয়ে! বউ হিসেবে সবাই সাধারণ মেয়ে খোজে। আপার ঠোটে লিপস্টিক, গালে পাউডার কোনাে কিছুরই দরকার নেই। | গােসল করে আপা যখন ভেজা চুলে বের হলাে তখন তাকে যে কী সুন্দর লাগছিল।
লক্ষ কর নি ?
সুলতানা অবাক হয়েই মেয়ের দিকে তাকালেন। তার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে এই যেন সেদিন মেয়েটা ছােট্ট ছিল। সারারাত ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদত। মুখে দুধ গুঁজে দিলেও কান্না থামত না। দুধ খাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে কাঁদছে। কান্নাটা যেন তার বিশ্রাম। আর আজ এই মেয়ে গুটগুট করে কী সুন্দর কথা বলছে! কথাগুলি মনে হচ্ছে সত্যি।