বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

 ছেলের নাম আতাউর । 

কী সর্বনাশ খাতাউর আবার মানুষের নাম হয় ? নাম শুনলেই মনে হয় খাতাউর সাহেব হাঁ করে আছেনখেয়ে ফেলার জন্যে

বৃষ্টি বিলাস

খাতাউর না, আতাউরশামা তুই ইচ্ছা করে ফাজলামি করছিস। এইসব ঠিক না। 

পানি আনার ব্যবস্থা কর মাআসল কথা বলতে ভুলে গেছিমা শশান, লাল চুড়ি আছে ? তােমার ট্রাংকেতাে অনেক জিনিস আছেখুঁজে দেখতে লাল চুড়ি আছে নাকিআমি লাল চুড়ি পরব। 

সুলতানা আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেনমেয়ে সহজভাবে কথা বলছেতিনি কাজের মেয়েকে বালতি দিয়ে পানি আনতে পাঠালেন। মেয়েটা শখ মিটিয়ে গােসল করুকমেয়েদের অতি তুচ্ছ শখও সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হয়মেয়েরা মাবাপের সংসারে থাকে নাঅন্য সংসারে চলে যায়যে সংসারে যায় সেখানে সে হয়ত মুখ ফুটে শখের কথাটা বলতেও পারে না। 

অতিথিরা পাঁচটার সময় উপস্থিত হলেনতখন শামার চুল বাঁধা হচ্ছেচুল বেঁধে দিচ্ছে শামার ছােট বােন এশাএশা বছর ক্লাস টেনে উঠেছেসে খুবই হাসি খুশি মেয়েগত দুদিন ধরে কী কারণে যেন সে মুখ ভোঁতা করে আছেকারাে সঙ্গেই কথাবার্তা বলছে নাএশার মুখ ভোতার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা কেউ করছে নাকারণ চেষ্টা করে লাভ নেই। এশা নিজ থেকে মুখ না খুললে কেউ তার মুখ খােলাতে পারবে না। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

লােকজন চলে এসেছে এই খবরটা দিল শামার ছােট ভাই মন্টুসে গত বছর এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিলটাইফয়েড় হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষা শেষ করতে পারে নিএবার আবারাে দিচ্ছেআগামী বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরুমন্টুর ধারণা এবারে পরীক্ষার মাঝখানে তার কোনাে বড় অসুখ হবে, সে পরীক্ষা দিতে পারবে নাএরকম স্বপ্নও সে দেখে ফেলেছেস্বপ্নে পরীক্ষার হল থেকে এম্বুলেন্সে করে তাকে সরাসরি হাসপাতালে নেয়া হয়হাসপাতালে ডাক্তাররা ছােটাছুটি শুরু করেনকারণ তাকে রক্ত না দিলে সে মারা যাবেকারাে রক্তের সঙ্গেই তার রক্ত মিলছে নাশেষে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিললসেই একজন তাদের স্কুলের হেড স্যারতিনি রক্ত দিতে এসে তাকে দেখে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, কীরে তুই বছরও পরীক্ষা দিচ্ছিস না ? ফাজলামি করিস

মন্টু এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আপা, এসে গেছেচারজন এসেছে। 

শামা বিরক্ত গলায় বলল, চারজন এসেছে খুব ভাল কথাতুই ফিসফিস করছিস কেন? এর মধ্যে ফিসফিসানির কী আছে

ট্যাক্সি করে এসেছেশুনে খুশি হলামট্যাক্সি করেইতাে আসবেঠেলাগাড়িতে করে তাে আসবে নাকি তুই ভেবেছিলি ঠেলাগাড়ি করে আসবে

অনেক মিষ্টি এনেছেপাঁচ প্যাকেট

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

সামনে থেকে যা তাে, কানের কাছে বিজবিজ করবি নাকয় প্যাকেট মিষ্টি এনেছেদাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুণেছিস। শুনতেইতাে লজ্জা লাগছে। 

মেহমানরা বসার ঘরে বসেছেনতাদেরকে চা নাস্তা এখনাে দেয়া হয় নিআরাে দুজন নাকি আসবেনতাদের জন্য অপেক্ষামজার গল্প হচ্ছেহাসি শােনা যাচ্ছে। 

শামা সেজেগুজে অপেক্ষা করছেচা নিয়ে যেতে বললেই সে ট্রেতে করে চা নিয়ে যাবেএই উপলক্ষে বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সুন্দর একটা ট্রে আনাহয়েছেছােট্ট একটা সমস্যা হয়েছেএক ধরনের চায়ের কাপ আছে ছটাচারজন গেস্ট আছেনআরাে দুজন আসবেনটা কাপ হয়ে গেলআবদুর রহমান সাহেবকে চা দিতে হবে, তার জন্যে একটা কাপ লাগবেতারা হয়ত শামাকেও চা খেতে বলবেনআরাে দুটা ভাল কাপ দরকার। 

সুলতানা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেনতিনি ঠিক করেছেন মেহমানদের কোনাে বাইরের খাবার দেবেন নাসব খাবার ঘরে তৈরি হবে। তিনি কলিজার সিঙ্গাড়া বানানাের চেষ্টা করছেনসিঙ্গাড়ার তিনটা কোণা ঠিক মতাে উঠছে না। 

সিঙ্গাড়া তিনি আগেও বানিয়েছেনতখন ঠিকই কোণা উঠেছেএখন কেন উঠছে না ? বিয়েতে কোনাে অলক্ষণ নেই তাে? আজ সকালবেলা বেশ কয়েকবার তিনি এক শালিক দেখেছেনএক শালিকের ব্যাপারটা অনেকেই বিশ্বাস করে নাতিনি খুব করেনছােটবেলা থেকেই তিনি লক্ষ করেছেন যতবার এক শালিক দেখেছেন ততবারই ঝামেলা হয়েছে। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

এশা এসে মাকে সাহায্য করার জন্যে বসলএশার মুখ আগের চেয়েও গম্ভীরচোখ ফোলা ফোলামনে হয় কেঁদেকেঁদে এসেছে এশার কী হয়েছে কে জানে! এমন চাপা মেয়ে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলেও সে মুখ খুলবে না। 

সুলতানা বললেন, কী সমস্যা হয়েছে দেখ নাসিঙ্গাড়ার কোণা উঠছে না। 

এশা বলল, খেতে ভালই হলকোণা ওঠার দরকার নেইদোকানের সিঙ্গাড়ায় লােকজন কোণা খোঁজেঘরের সিঙ্গাড়ায় খোঁজে না। 

সুলতানা বললেন, একটা খেয়ে দেখখেতে ইচ্ছা করছে নাতাের কি কোনাে কারণে মন টন খারাপ

নাএক কথা পাচ লক্ষবার জিজ্ঞেস করাে না তাে মা আমার মন খারাপকিনা এটা তুমি এই ক’দিনে পাঁচ লক্ষবারের বেশি জিজ্ঞেস করে ফেলেছ। 

সুলতানা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, শামা কী করছে ? খাটে বসে আছেসাজার পর তাকে কেমন দেখাচ্ছেরে

পরীদের রাণীর মতাে লাগছে। 

সুলতানা তৃপ্তির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, শামাকে যেই দেখবে সেপছন্দ করবেমাঝে মাঝে ওর দিকে তাকালে বুকে ধাক্কার মতাে লাগেভেবেই পাই না এত সুন্দর মেয়ে আমার পেটে জন্মাল কীভাবে

এশা বলল, আপা বেশি সুন্দরবেশি সুন্দরকে আবার মানুষ পছন্দ করে নাসুলতানা অবাক হয়ে বললেন, পছন্দ করবে না কেন

এশা উত্তর দিল নাসুলতানা বললেন, পছন্দ করবে না কেন বল ? কারণ জানিস না

কারণ জানি কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে নামা শােন, তুমি আর বাবা, তােমরা দুজন কি আসলেই চাও যে ছেলেটা এসেছে তার সঙ্গে আপার বিয়ে হােক

 তাের বাবা চায়, তার ধারণা ছেলেটা খুবই ভালঅসম্ভব ভদ্র, বিনয়ীফ্যামিলিও ভালছেলের অবশ্যি বাবা নেইকিছুদিন হলাে মারা গেছেনশামা শ্বশুরের আদর পাবে নাতােরাতাে জানিস না শ্বশুরের আদর বাপের আদরের চেয়েও বেশি হয়। 

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-২)- হুমায়ূন আহমেদ

আপা যেভাবে সাজগােজ করেছেএভাবে সাজগােজ করে থাকলে কিন্তু ওরা আপাকে পছন্দ করবে নাআপার উচিত খুব সাধারণ একটা শাড়ি পরে ওদের সামনে যাওয়াচোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক এইসব কিছু না। 

কী বলছিস তুই

কোনােরকম সাজগােজ ছাড়া আপা যখন ওদের সামনে দাঁড়াবে তারা বলবে, বাহ্ কী সহজ সরল সাধারণ একটা মেয়ে! বউ হিসেবে সবাই সাধারণ মেয়ে খোজেআপার ঠোটে লিপস্টিক, গালে পাউডার কোনাে কিছুরই দরকার নেই| গােসল করে আপা যখন ভেজা চুলে বের হলাে তখন তাকে যে কী সুন্দর লাগছিল। 

লক্ষ কর নি

সুলতানা অবাক হয়েই মেয়ের দিকে তাকালেনতার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছেমনে হচ্ছে এই যেন সেদিন মেয়েটা ছােট্ট ছিলসারারাত ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদতমুখে দুধ গুঁজে দিলেও কান্না থামত নাদুধ খাচ্ছে, ফাঁকে ফাঁকে কাঁদছেকান্নাটা যেন তার বিশ্রামআর আজ এই মেয়ে গুটগুট করে কী সুন্দর কথা বলছে! কথাগুলি মনে হচ্ছে সত্যি। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *