শামার মনে হল যে কোনাে মুহূর্তে সে হাত থেকে পানির গ্লাস ফেলে দেবে। বিয়ের পাকা কথার দিন হাত থেকে পড়ে গ্লাস ভাঙা শুভ না অশুভ কে জানে! শামার হঠাৎ করেই আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করল।
তার চেহারাটা কি আগের মতােই আছে না বদলাতে শুরু করেছে ? ছেলেদের চেহারা সমগ্র জীবনে খুব একটা পাল্টায় না, কিন্তু মেয়েদের চেহারা পাল্টাতে থাকে। কুমারী অবস্থায় থাকে এক রকম চেহারা, বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক হবার সময় হয় অন্য এক রকম চেহারা, বিয়ের পর আরেক রকম চেহারা। মা হবার পর চেহারা আবার পাল্টায়। যখন শাশুড়ি হয় তখন আরেক দফা চেহারা বদল।
আবদুর রহমান সাহেব ভেতরের বারান্দায় রাখা দুটা বেতের চেয়ারের একটায় বসে আছেন। অন্যটায় বসেছেন সুলতানা। আবদুর রহমান সাহেবের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট খান না। আজ বিশেষ দিন উপলক্ষে মন্টুকে দিয়ে তিনটা সিগারেট আনানাে হয়েছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট টেনে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন। সুলতানা বললেন, চা খাবে ? আবদুর রহমান তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যায়। তােমার চা বানানাের দরকার নেই। বড় মেয়েকে বল চা বানিয়ে আনুক। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাজ কর্ম শিখবে না ?
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
সুলতানা বললেন, মেয়েকে এখন আমি মরে গেলেও চুলার কাছে যেতে দেব বিয়ের পাকা কথা হবার পর মেয়েদের চুলার কাছে যেতে দেয়া হয় না।
তাই নাকি?
অনেক নিয়মকানুন আছে। চুল খােলা রেখে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। রাতে বিছানায় একা থাকা নিষেধ। | বল কী! জানতাম নাতাে। | সুলতানা চা বানানাের জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। আবদুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, চা কিন্তু দুই কাপ আনবে। চা খেতে খেতে বুড়ােবুড়ি গল্প করি। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এখনতাে আমরা বুড়ােবুড়িই তাই ? আর এশাকে একটু পাঠাও ওর সঙ্গে কথা আছে।
ওর সঙ্গে কী কথা?
আছে, কথা আছে। সব কথা তােমাকে বলা যাবে না–কি ? বাপ–মেয়ের আলাদা কথা থাকবে না! শুধু মা-মেয়ে রাত জেগে গুটুর গুটুর, তা হবে না। হা হা হা।
স্বামীর আনন্দ দেখে সুলতানার মন কেমন কেমন করতে লাগল । অনেকদিন পর মানুষটাকে তিনি এত আনন্দিত দেখলেন। মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় কোনাে বাবা কি এত আনন্দিত হয় ? তিনি নিজে আনন্দ পাচ্ছেন না। ছেলেটাকে তার তেমন পছন্দ হয় নি। তার ধারণা শামার মতাে রূপবতী মেয়ের জন্য অনেক ভাল পাত্র পাওয়া যেত। একটু শুধু খোজ খবর করা। মানুষটা তার কিছুই করল না। অফিসের কোনাে একজনকে ধরে এনে বলল, এর সাথে বিয়ে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
এশা বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। আবদুর রহমান হাসিমুখে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাের আপার বিয়েতাে ঠিক হয়ে গেল। নেক্সট টার্গেট তুই। তৈরি হয়ে যা।
এশা গম্ভীর মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার হালকা রূপ দেখে সে
অভ্যস্ত না । তার অস্বস্তি লাগছে ।
ছেলেটাকে কেমন দেখলি ? ভাল। শামা কি কিছু বলেছে ছেলে পছন্দ হয়েছে কি–না।
কিছু বলে নি। ও আছে কোথায় ? দোতলায় । বাড়িওয়ালা চাচার বাসা থেকে কাকে যেন টেলিফোন করবে।
আবদুর রহমান টেলিফোনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন। খুবই আগ্রহের সঙ্গে গলা সামান্য নামিয়ে বললেন, এক কাজ করতাে পাঞ্জাবির পকেটে আমার মানিব্যাগ আছে। মানিব্যাগ খুলে দেখ— হলুদ এক পিস কাগজ আছে। কাগজে টেলিফোন নাম্বার লেখা। কাগজটা শামাকে দিয়ে দিস।
কার টেলিফোন নাম্বার ? ঐ ছেলের ?
হা আতাউরের। সে তার বড়বােনের সঙ্গে এখন আছে। বড়বােনের টেলিফোন নাম্বার। শামা যদি ছেলের সঙ্গে কিছু বলতে চায় বলুক। বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, এখন টেলিফোনে কথাবার্তা বলা দোষনীয় কিছু না। তবে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আর কিছু বলবে বাবা?
আবদুর রহমান সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিল। মেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন তার কোনাে কথা হয় না। কথা বলার মতাে সুযােগই তৈরি হয় না। আজ একটা সুযােগ তৈরি হয়েছে। তিনি সুযােগটা ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। সেটা সম্ভব হলাে না। এশা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বােধ করছে না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাচে। যেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলছে না, কথা বলছে তার স্কুলের রাগী এসিসটেন্ট হেডমাস্টারের সঙ্গে।
আবদুর রহমান সাহেবের মন সামান্য খারাপ হলাে, তবে তিনি মন খারাপ ভাবটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। মেয়েরা বড় হলে বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জগতের অনেক সাধারণ নিয়মের মধ্যে একটা নিয়ম হলাে মেয়েরা বড় হলে মার দিকে ঝুঁকে পড়ে, ছেলেরা ঝুকে বাবার দিকে। তার ক্ষেত্রে এটাও সত্যি হয় নি।
মন্টু তার ধারে কাছে আসে না। মন্টু হয়ত টিভি দেখছে, বাবার পায়ের শব্দ শুনলে ফট করে টিভি বন্ধ করে দেবে। চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকবে। বাবা ঘরে ঢুকলে সে উঠে পাশের ঘরে চলে যাবে। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। আবদুর রহমান ঠিক করলেন এখন ।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
থেকে সম্পর্ক সহজ করার চেষ্টা করবেন। মন্টুকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে টিভি প্রােগ্রাম দেখবেন। ডিশের লাইন না–কি নিয়েছে অনেক কিছু দেখা যায়। তা ই বাপ বেটায় মিলে দেখবেন। তিনি এখনাে কিছু দেখেন নি। টিভির সামনে বসলেই তার মাথা ধরে যায়। মনে হয় চোখের কোনাে সমস্যা। ডাক্তার দেখাতে হবে। ছানি পড়ার বয়স হয়ে গেছে। চোখে ছানি পড়ে গেছে হয়ত।
সুলতানা চা নিয়ে এলেন না। মন্টু এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে দাড়াল। সে চায়ের কাপটা বাবার হাতে দেবে না মেঝেতে নামিয়ে রাখবে সেটা বুঝতে পারছে না। বাবার সামনে কোনাে টেবিল নেই ।
আবদুর রহমান ছেলের হাত থেকে কাপ নিতে নিতে বললেন, তাের মা কোথায় ?
রান্না করছেন।
আবদুর রহমান বিরক্ত বােধ করলেন। ছেলেকে দিয়ে চা পাঠানাে ঠিক হয় নি। বাবাকে চা নাশতা দেয়া মেয়েদের কাজ। ছেলেকে দিয়ে এইসব কাজ করালে ছেলেদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব চলে আসে। আজকাল একটা কথা খুব শুনতে পাচ্ছেন— ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, ছেলেও যা মেয়েও তা। খুবই হাস্যকর কথা বলে তার মনে হয়। ছেলেমেয়ে যদি একই হয় তাহলে ছেলেগুলি মেয়েদের মতাে শাড়ি ব্লাউজ পরে না কেন ?
মন্টু চলে যাচ্ছিল, আবদুর রহমান বললেন, এই তাের পড়াশােনা কেমন হচ্ছে রে ?
মন্টু বাবার দিকে তাকাল না। চলে যেতে যেতে বলল, ভাল।
তার একটাই ভয়, বাবা যদি ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন! আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেন। এবারের চা ভাল হয় নি। তিতা তিতা লাগছে। সিগারেট টেনেও মজা পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে। ড্যাম্প সিগারেট।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
শামাদের বাড়িওয়ালা মুত্তালিব সাহেবের বয়স পাঁচপঞ্চাশ। তিনি চুলে কলপ দিয়ে রঙিন শার্টটার্ট পরে বয়সটাকে কমিয়ে রাখার নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তেমন কোনাে লাভ হচ্ছে না। বয়স মােটেই কম দেখাচ্ছে না। বরং যা বয়স তাঁর চেয়েও বেশি দেখাচ্ছে। এই বয়সে কারােই সব দাঁত পড়ে না।
তার প্রায় সব দাতই পড়ে গেছে। সামনের পাটির দু’টা দাত ছিল। বাঁধানাে দাঁত ফুল সেট থাকলে অনেক সুবিধা এই রকম বুঝিয়ে দাঁতের ডাক্তার সেই দু’টা দাঁতও ফেলে দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি বাঁধানাে দাঁত পরেন। তার কাছে মনে হয়
তিনি কলকজা মুখে নিয়ে বসে আছেন।
(চলবে)