বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৪)- হুমায়ূন আহমেদ

শামার মনে হল যে কোনাে মুহূর্তে সে হাত থেকে পানির গ্লাস ফেলে দেবেবিয়ের পাকা কথার দিন হাত থেকে পড়ে গ্লাস ভাঙা শুভ না অশুভ কে জানে! শামার হঠাৎ করেই আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করল

বৃষ্টি বিলাসতার চেহারাটা কি আগের মতােই আছে না বদলাতে শুরু করেছে ? ছেলেদের চেহারা সমগ্র জীবনে খুব একটা পাল্টায় না, কিন্তু মেয়েদের চেহারা পাল্টাতে থাকেকুমারী অবস্থায় থাকে এক রকম চেহারা, বিয়ের কথাবার্তা ঠিকঠাক হবার সময় হয় অন্য এক রকম চেহারা, বিয়ের পর আরেক রকম চেহারামা হবার পর চেহারা আবার পাল্টায়যখন শাশুড়ি হয় তখন আরেক দফা চেহারা বদল। 

আবদুর রহমান সাহেব ভেতরের বারান্দায় রাখা দুটা বেতের চেয়ারের একটায় বসে আছেনঅন্যটায় বসেছেন সুলতানাআবদুর রহমান সাহেবের হাতে জ্বলন্ত সিগারেটতিনি সিগারেট খান নাআজ বিশেষ দিন উপলক্ষে মন্টুকে দিয়ে তিনটা সিগারেট আনানাে হয়েছেতাঁকে দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট টেনে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেনসুলতানা বললেন, চা খাবে ? আবদুর রহমান তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, চা এক কাপ খাওয়া যায়তােমার চা বানানাের দরকার নেইবড় মেয়েকে বল চা বানিয়ে আনুকবিয়ে হয়ে যাচ্ছে কাজ কর্ম শিখবে না

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

সুলতানা বললেন, মেয়েকে এখন আমি মরে গেলেও চুলার কাছে যেতে দেব বিয়ের পাকা কথা হবার পর মেয়েদের চুলার কাছে যেতে দেয়া হয় না। 

তাই নাকি

অনেক নিয়মকানুন আছেচুল খােলা রেখে বাইরে বের হওয়া নিষেধরাতে বিছানায় একা থাকা নিষেধ| বল কী! জানতাম নাতাে| সুলতানা চা বানানাের জন্যে উঠে দাঁড়ালেনআবদুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, চা কিন্তু দুই কাপ আনবেচা খেতে খেতে বুড়ােবুড়ি গল্প করিমেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এখনতাে আমরা বুড়ােবুড়িই তাই ? আর এশাকে একটু পাঠাও ওর সঙ্গে কথা আছে। 

ওর সঙ্গে কী কথা

আছে, কথা আছেসব কথা তােমাকে বলা যাবে নাকি ? বাপমেয়ের আলাদা কথা থাকবে না! শুধু মা-মেয়ে রাত জেগে গুটুর গুটুর, তা হবে নাহা হা হা। 

স্বামীর আনন্দ দেখে সুলতানার মন কেমন কেমন করতে লাগল অনেকদিন পর মানুষটাকে তিনি এত আনন্দিত দেখলেনমেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় কোনাে বাবা কি এত আনন্দিত হয় ? তিনি নিজে আনন্দ পাচ্ছেন নাছেলেটাকে তার তেমন পছন্দ হয় নিতার ধারণা শামার মতাে রূপবতী মেয়ের জন্য অনেক ভাল পাত্র পাওয়া যেত। একটু শুধু খোজ খবর করামানুষটা তার কিছুই করল নাঅফিসের কোনাে একজনকে ধরে এনে বলল, এর সাথে বিয়ে। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

এশা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালআবদুর রহমান হাসিমুখে তার কন্যার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাের আপার বিয়েতাে ঠিক হয়ে গেলনেক্সট টার্গেট তুইতৈরি হয়ে যা। 

এশা গম্ভীর মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলবাবার হালকা রূপ দেখে সে 

অভ্যস্ত না তার অস্বস্তি লাগছে । 

ছেলেটাকে কেমন দেখলি ? ভালশামা কি কিছু বলেছে ছেলে পছন্দ হয়েছে কিনা। 

কিছু বলে নিআছে কোথায় ? দোতলায় বাড়িওয়ালা চাচার বাসা থেকে কাকে যেন টেলিফোন করবে। 

আবদুর রহমান টেলিফোনের কথায় নড়েচড়ে বসলেনখুবই আগ্রহের সঙ্গে গলা সামান্য নামিয়ে বললেন, এক কাজ করতাে পাঞ্জাবির পকেটে আমার মানিব্যাগ আছেমানিব্যাগ খুলে দেখহলুদ এক পিস কাগজ আছেকাগজে টেলিফোন নাম্বার লেখাকাগজটা শামাকে দিয়ে দিস। 

কার টেলিফোন নাম্বার ? ছেলের

হা আতাউরেরসে তার বড়বােনের সঙ্গে এখন আছেবড়বােনের টেলিফোন নাম্বারশামা যদি ছেলের সঙ্গে কিছু বলতে চায় বলুকবিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে, এখন টেলিফোনে কথাবার্তা বলা দোষনীয় কিছু নাতবে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

আর কিছু বলবে বাবা

আবদুর রহমান সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছা ছিলমেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন তার কোনাে কথা হয় নাকথা বলার মতাে সুযােগই তৈরি হয় নাআজ একটা সুযােগ তৈরি হয়েছেতিনি সুযােগটা ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেনসেটা সম্ভব হলাে নাএশা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ বােধ করছে নাতার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে বাচেযেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলছে না, কথা বলছে তার স্কুলের রাগী এসিসটেন্ট হেডমাস্টারের সঙ্গে। 

আবদুর রহমান সাহেবের মন সামান্য খারাপ হলাে, তবে তিনি মন খারাপ ভাবটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন নামেয়েরা বড় হলে বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে এটাই স্বাভাবিকজগতের অনেক সাধারণ নিয়মের মধ্যে একটা নিয়ম হলাে মেয়েরা বড় হলে মার দিকে ঝুঁকে পড়ে, ছেলেরা ঝুকে বাবার দিকেতার ক্ষেত্রে এটাও সত্যি হয় নি

মন্টু তার ধারে কাছে আসে নামন্টু হয়ত টিভি দেখছে, বাবার পায়ের শব্দ শুনলে ফট করে টিভি বন্ধ করে দেবেচোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকবেবাবা ঘরে ঢুকলে সে উঠে পাশের ঘরে চলে যাবে। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় নাআবদুর রহমান ঠিক করলেন এখন ।

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

থেকে সম্পর্ক সহজ করার চেষ্টা করবেনমন্টুকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে মধ্যে টিভি প্রােগ্রাম দেখবেনডিশের লাইন নাকি নিয়েছে অনেক কিছু দেখা যায়তা বাপ বেটায় মিলে দেখবেনতিনি এখনাে কিছু দেখেন নিটিভির সামনে বসলেই তার মাথা ধরে যায়মনে হয় চোখের কোনাে সমস্যাডাক্তার দেখাতে হবেছানি পড়ার বয়স হয়ে গেছেচোখে ছানি পড়ে গেছে হয়ত। 

সুলতানা চা নিয়ে এলেন নামন্টু এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাবার সামনে দাড়ালসে চায়ের কাপটা বাবার হাতে দেবে না মেঝেতে নামিয়ে রাখবে সেটা বুঝতে পারছে নাবাবার সামনে কোনাে টেবিল নেই । 

আবদুর রহমান ছেলের হাত থেকে কাপ নিতে নিতে বললেন, তাের মা কোথায়

রান্না করছেন। 

আবদুর রহমান বিরক্ত বােধ করলেনছেলেকে দিয়ে চা পাঠানাে ঠিক হয় নিবাবাকে চা নাশতা দেয়া মেয়েদের কাজছেলেকে দিয়ে এইসব কাজ করালে ছেলেদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব চলে আসেআজকাল একটা কথা খুব শুনতে পাচ্ছেনছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু নেই, ছেলেও যা মেয়েও তাখুবই হাস্যকর কথা বলে তার মনে হয়ছেলেমেয়ে যদি একই হয় তাহলে ছেলেগুলি মেয়েদের মতাে শাড়ি ব্লাউজ পরে না কেন

মন্টু চলে যাচ্ছিল, আবদুর রহমান বললেন, এই তাের পড়াশােনা কেমন হচ্ছে রে

মন্টু বাবার দিকে তাকাল নাচলে যেতে যেতে বলল, ভাল। 

তার একটাই ভয়, বাবা যদি ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করে বসেন! আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালেনএবারের চা ভাল হয় নিতিতা তিতা লাগছেসিগারেট টেনেও মজা পাচ্ছেন নামনে হচ্ছেড্যাম্প সিগারেট। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

শামাদের বাড়িওয়ালা মুত্তালিব সাহেবের বয়স পাঁচপঞ্চাশতিনি চুলে কলপ দিয়ে রঙিন শার্টটার্ট পরে বয়সটাকে কমিয়ে রাখার নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেনতেমন কোনাে লাভ হচ্ছে নাবয়স মােটেই কম দেখাচ্ছে নাবরং যা বয়স তাঁর চেয়েও বেশি দেখাচ্ছে। এই বয়সে কারােই সব দাঁত পড়ে না

তার প্রায় সব দাতই পড়ে গেছেসামনের পাটির দুটা দাত ছিলবাঁধানাে দাঁত ফুল সেট থাকলে অনেক সুবিধা এই রকম বুঝিয়ে দাঁতের ডাক্তার সেই দুটা দাঁতও ফেলে দিয়েছেঘুম থেকে উঠে তিনি বাঁধানাে দাঁত পরেনতার কাছে মনে হয় 

তিনি কলকজা মুখে নিয়ে বসে আছেন

(চলবে)

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৩)- হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *