থ্যাংক য়ু।
না, আপনাকে করতে হবে। আমি চাই আপনি আপাকে চমকে দিন। আপার একটা শিক্ষা হােক। আপনাকে কলেজের গেটের সামনে দাঁড়াতে হবে না। একটা কনফেকশনারির দোকান আছে নাম ‘নিরালা। আপনি দোকানে ঢুকে একটা কোক বা পেপসি খাবেন। আপা সেখানে উপস্থিত হবে।
সে শুধু শুধু সেখানে যাবে কেন ?
যাবে কারণ আমি তাকে বলে দেব ঐ দোকান থেকে আমার জন্যে একটা জিনিস আনতে। পারবেন ?
পারব না। আপনাকে পারতেই হবে। প্লিজ। আগামীকাল দুপুর দেড়টায়। একটা চল্লিশে অপার ক্লাস শেষ হবে। দোকানে আসতে আসতে তার লাগবে দশ মিনিট।
এশা আমি এই কাজটা করতে পারব না। না পারলে কী আর করা। আমার অফিস আছে। অফিস কামাই দিয়ে দোকানে বসে কোক খাওয়া! কোক খাওয়ার জন্যেতাে অফিস কামাই দিচ্ছেন না। যে মেয়েটিকে বিয়ে
করতে যাচ্ছেন তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে যাচ্ছেন।
বিয়ের পরতাে গল্প করবই। বিয়ের পর গল্প করা আর বিয়ের আগে গল্প করা কি এক?
এক না ? না এক না। আকাশ পাতাল তফাত। তুমি বুঝলে কী করে? তুমিতাে বিয়ে কর নি। বিয়ে না করলেও বুঝতে পারছি। এইসব ব্যাপারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বােঝে। আপনি যাবেন কিন্তু।
ধর আমি গেলাম। তারপর দেখলাম তােমার আপা আসে নি। আপা যাবে। আমি ব্যবস্থা করে রাখব। আর না গেলে দেখা হবে না। তুমি দেখি খুবই ইন্টারেস্টিং মেয়ে। দুলাভাই আপনি যাবেন তাে? মাই গড এখনি দুলাভাই ডাকছ কেন ? একদিনতাে ডাকতেই হবে, একটু প্র্যাকটিস করে নেই । আগেভাগে প্র্যাকটিস করতে হবে না। আমার খুবই লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগলে ডাকব না। আচ্ছা শুনুন, আপনি কাল যাচ্ছেন তাে ? এখনাে বলতে পারছি না।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
আপনাকে যেতে হবে। না গেলে আমি খুবই রাগ করব। আমি আপনার একটা মাত্র শালী। আমাকে রাগালে তার ফল শুভ হবে না। টেলিফোন রাখি। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেললাম, আপনি বােধহয় আমাকে ফাজিল টাইপ মেয়ে ভাবছেন। দুলাভাই আমি কিন্তু ফাজিল টাইপ না। সরি, আবার দুলাভাই বলে ফেললাম।
শামা টেলিফোন রেখে খানিক্ষণ হাসল । ছােটবােন সেজে টেলিফোন করার এই বুদ্ধিটা হঠাৎ তার মাথায় এসেছে। বুদ্ধিটা যে এমন কাজে লাগবে আগে বুঝতে পারে নি। মানুষটার গলার স্বর সুন্দর। শুনতে ভাল লাগছিল। আরাে কিছুক্ষণ কথা বললে হত। আরেক দিন বললেই হবে। প্রথম দিন এত কথা বলা ঠিক না। এশাকে সে ফাজিল মেয়ে ভাববে। এশা মােটেই ফাজিল মেয়ে না ।
মুত্তালিব সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন। শামা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মুত্তালিব সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বললি ?
শামা হাসল। মুত্তালিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, প্রশ্ন করলে প্রশ্নের জবাব দিবি। হেসে
ফেলবি না। এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বললি?
বলা যাবে না।
এ দুনিয়াতে নানান ধরনের ব্যাধি আছে। তার একটা হলাে টেলিফোন ব্যাধি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে কথা বলা ব্যাধি। এটা ভাল না।
আপনার পায়ের অবস্থা কী ? আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম তার জবাব কিন্তু এখনাে পাই নি। আসুন আপনাকে হাঁটাই। তুই তাের কাজে যা। আমাকে হাঁটাতে হবে না।
আমি টেলিফোনে যতক্ষণ কথা বলেছি ঘড়ি ধরে ঠিক ততক্ষণ আপনাকে হাঁটাব। নগদ বিদায়।
শামা মুত্তালিব সাহেবকে টেনে দাঁড় করালাে। শামা বলল, আমার কাঁধে হাত রাখুন। আমাকেইতাে ধরে আছেন আবার দেয়াল ধরছেন কেন ? ভেরি গুড়। একী দু’টা পা এক সঙ্গে ফেলছেন কেন ? আমি ওয়ান টু বলব। ওয়ান হলাে ডান পা, টু হলাে বাম পা। ওয়ান-টু। ওয়ান–টু। হাঁটি হাঁটি পা পা ।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
সুলতানা রান্নাঘরে। আবদুর রহমান সাহেব আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ইলিশ মাছ কিনে এনেছেন। তার হঠাৎ সর্ষে ইলিশ খেতে ইচ্ছা করছে। কাঁচা বাজার থেকে রাই সরিষা, কাঁচা মরিচ কিনেছেন। দুই কেজি আতপ চালও কিনেছেন। সর্ষে ইলিশ না–কি আতপ চালের ভাত দিয়ে খেতে মজা। ইলিশ সর্ষে রান্না হচ্ছে। এশা খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। সুলতানা বললেন, রান্নাঘরে বসে আছিস কেন ?
এশা বলল, রান্না শিখছি। মা, আজ আমি রাঁধব। তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও।
সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এশার মুখ থেকে অন্ধকার দূর হয়েছে। গত কয়েকদিন চিমসে মেরে ছিল। এখন হাসি খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে। তার যে সমস্যা ছিল সেই সমস্যা নিশ্চয়ই দূর হয়েছে। সুলতানার সামান্য মন খারাপ হলাে। তার মেয়েগুলির খুবই চাপা স্বভাব। মনের কথা কেউ মা‘র সঙ্গে বলে না।
এশা বলল, লবণের অনুমানটা কীভাবে কর মা ? কোনাে নিয়ম কি আছে ?
সুলতানা বললেন, পুরােটাই আন্দাজ। মাখানাের পর জিবে নিয়ে লবণ দেখে নিতে হয়।
ওয়াক থু, কাঁচা মাছের রস মুখে দেব ? পরে পানি দিয়ে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করবি ।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
এশা মাছ মাখাচ্ছে। সুলতানা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের কাজ দেখছেন। সময় কত দ্রুত পার হচ্ছে। এতটুকু মেয়ে ছিল, দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে!
একজনের তাে বিয়েই ঠিক হয়ে গেল।
মা দেখতে লবণ কি এতটুক দেব ?
বেশি হয়ে গেছে। আরাে কম। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবি। লবণ কম হলে পরে দেয়া যায়। বেশি হলে কিন্তু কমানাে যায় না।
বেশি হলে পানি দিয়ে ঝােল বাড়িয়ে দেব। সর্ষে বাটায় পানি দিবি কীভাবে ? তাওতাে কথা।
সুলতানা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কাঁচা মরিচের একটা ব্যাপার তােকে শিখিয়ে দেই। কাঁচা মরিচ আস্ত দিলে মরিচের ঘ্রাণটা তরকারিতে যায়। তরকারি ঝাল হয় না। আর যদি মাঝখান দিয়ে কেটে দিস তাহলে মরিচের ঘ্রাণও যায় তরকারি ঝালও হয়।
আমরা কী করব মা? ঝাল করব, না মরিচের গন্ধওয়ালা তরকারি করব ? তুই রান্না করছিস, তুই ঠিক কর ।
এশাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে ভুরু কুঁচকে আছে। এশা বলল, মা আমার খুব আশ্চর্য লাগছে।
কেন ? সামান্য রান্না, তার মধ্যে ডিসিশান নেয়ার ব্যাপার আছে। আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে কী করব। ঝাল তরকারি করব, না–কি মরিচের ঘ্রাণওয়ালা তরকারি করব। মা, আমি তাে খুবই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছি।
সুলতানা তার চিন্তাগ্রস্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার খুবই মজা লাগছে।
এশা বলল, মা তুমি যদি এখন বারান্দায় যাও তাহলে খুব মজার একটা দৃশ্য দেখবে।
কী দৃশ্য দেখব ?
আপা বাড়িওয়ালা চাচাকে হাঁটা শেখাচ্ছে। ধরে ধরে হাঁটাচ্ছে। আর মুখে মুখে বলছে হাঁটি হাঁটি পা পা । আপা খুবই মজা পাচ্ছে। বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাখায় যাচ্ছে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
সুলতানা ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মুত্তালিব সাহেব বেচারা পা নিয়ে ভাল সমস্যায় পড়েছেন। কী অদ্ভুত রােগ— হাঁটু বাঁকে না!
এশা বলল, মা তােমাকে একটা কথা বলব ? তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবে। যদি প্রমিজ কর রাগ করবে না, তাহলেই কথাটা বলব।
রাগ করার মতাে কথা ?
আমার কথা শুনে তােমার হয়ত মনে হবে আমার মন ছােট বলে এ ধরনের কথা বলছি।
কথাটা কী ? বাড়িওয়ালা চাচার সঙ্গে আপার এত মেশা ঠিক না। মেশামেশি বেশি হচ্ছে।
সুলতানা বিস্মিত হয়ে বললেন, এইসব কী বলছিস! উনি শামাকে নিজের মেয়ের মত দেখেন। মা ডাকেন।
এশা বলল, মা ডাকলেও ঠিক না। ঠিক না কেন?
আমি তােমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না মা। আমার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক । মুত্তালিব চাচা আপাকে খুব পছন্দ করেন আবার আপাও উনাকে খুব পছন্দ করেন। তুমি কি লক্ষ করেছ দিনের মধ্যে একবার দোতলায় না গেলে আপা থাকতে পারে না?
ও যায় টেলিফোন করতে। টেলিফোন করতে যাওয়াটা আপার একটা অজুহাত।
তুই বেশি বেশি বােঝার চেষ্টা করছিস এশা।
(চলবে)
বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৭)- হুমায়ূন আহমেদ