বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৯)- হুমায়ূন আহমেদ

এত বেশি বােঝা কিন্তু ঠিক নাকিছু কিছু মানুষ আছে ভালর মধ্যে মন্দ খুঁজেতুইও তাদের মতাে হয়ে গেলি

তুমি রেগে যাচ্ছ মাকথা ছিল তুমি রাগবে না। 

বৃষ্টি বিলাসআমি রাগি নিতাের কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। মানুষের সম্পর্ক এত ছােট করে দেখতে নেই। 

এশা চুলায় হাঁড়ি বসাতে বসাতে বলল, মা শােন, একবার মুত্তালিব চাচার টেলিফোন নষ্ট ছিলপ্রায় এক মাস নষ্ট ছিলএই একমাসও কিন্তু বড় আপা প্রতিদিন একবার করে দোতলায় গেছে। 

তাতে কী হয়েছে ? কিছু হয় নি এমি বললামতুমি যে বললে আপা টেলিফোন করতে যায় এটা যে ঠিক না তা বােঝানাের জন্যে বললামতুমি রেগে যাচ্ছ বলে গুছিয়ে তােমাকে কিছু বলতে পারছি নামা শােন, আপা যখন শুনবে আজ বাসায় সর্ষে ইলিশ রান্না হচ্ছে সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে মুত্তালিব চাচার জন্যে তরকারি পাঠাতে। 

এতে দোষের কী আছে? উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতাে দেখেনমেয়ে 

কি বাবার জন্যে তরকারি নিয়ে যাবে না ? এক টুকরা মাছ মানুষটার জন্যে নিয়ে গেলে সেটা দোষের হয়ে যাবে

এশা বলল, মা সরি এই প্রসঙ্গটা তােলা ঠিক হয় নিতােমার মুখ থেকে রাগ রাগ ভাবটা দূর করে সহজভাবে তাকাওআমার মন আসলেই ছােটকী আর করামা, চা খাবে

চা খাওআমি তােমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছিচা বানানােটা আমি ভাল শিখেছি মাবানাই ? প্লীজ। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

বললামতাে না । 

তােমার সঙ্গে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে মাকঠিন মুখে না বলবে নাআমিতাে স্বীকার করেছি আমার মন ছােটতারপরেও রাগ করে থাকাটা কি 

ঠিক

এশা খালি চুলায় চায়ের কেতলি বসালশামা এসে উপস্থিত হলােখুশি খুশি গলায় বলল, চা হচ্ছে নাকি রে ? আমিও চা খাব আজ কি তুই রান্না করছিস

কী রান্না ? সর্ষে ইলিশইলিশ মাছে ডিম ছিল ? ছিল । 

ডিমটা আলাদা করে রাখবিমুত্তালিব চাচা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করেনডিমটা আমি উনাকে দিয়ে আসব। 

আচ্ছাসুলতানা এশার দিকে তাকিয়ে আছেনএশা একবারও মার দিকে তাকাল সে নিজের মনে চা বানাচ্ছে শামা বলল, মা শােন, চাচাকে একসারসাইজ করিয়ে এসেছিআমার কী মনে হয় জান মা? আমার মনে হয় একসারসাইজের চেয়েও উনার যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে সেঁককাল থেকে একসারসাইজও করাব, সেঁকও দেব। 

তুইতাে ডাক্তার না । তুই এসবের জানিস কী

শামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ছােটখাট ব্যাপার জানার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা। 

এশা বলল, আপা তুমি কী আতাউর ভাইকে টেলিফোন করছিলে

শামা বলল, নাআমার এত গরজ নেইবাবা শখ করে টেলিফোন নাম্বার এনেছেনএকবার টেলিফোন করশামা হালকা গলায় বলল, বাবার শখ থাকলে বাবা করুক। আমার শখ নেই। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

সুলতানা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলেনএশার কথাগুলি শােনার পর থেকে তার ভাল লাগছে নামনের মধ্যে কী যেন খচখচ করছেঅদৃশ্য কোনাে কাটা বিধে আছে। 

শােবার ঘর অন্ধকার করে আবদুর রহমান শুয়ে আছেনশুয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অস্বাভাবিকলম্বা হয়ে শুয়ে আছেনপায়ের বুড়াে আঙুল এবং নাক এক লাইনেসুলতানা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেনউদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে শরীর খারাপ নাকি

আবদুর রহমান উঠে বসতে বসতে বললেন, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছেমুখের ভেতরটা টক টক লাগছে। 

জ্বর আসে নি তাে

চা খাবে? নাও চা খাও, রান্নার দেরি হবে। অসুবিধা নেই, হােক দেরিআজ এশা রান্না করছেরান্না জানে

জানে না, শিখবেতােমার বড় মেয়ের রান্নাবান্নায় আগ্রহ নেইএশার আছে। 

দুই মেয়েকেই শিখিয়ে দাওআজকালকার মেয়েরা সব শিখতে রাজি, শুধু রান্না শিখতে রাজি নারান্না শেখাটা খুব দরকার। 

আমার মেয়েরা আজকালকার মেয়ের মতাে না। 

আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের খোঁজ নিয়েছিএক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতাে আছেএতে তােমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না

সব টাকা এক মেয়ের পেছনে খরচ করে ফেলবে ? তােমার তাে আরাে একটা মেয়ে আছে। 

প্রথম বিয়ে একটু ধুমধাম করে দেইআমি ঠিক করেছি বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবপালকির ব্যবস্থা করবপালকি করে জামাইবৌ যাবে। গ্রামের মানুষ ভিড় করবে। 

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

পালকি পাবে কোথায় ? দেশে কি পালকি আছে

আমাদের এদিকে আছেগ্রামের বাড়িটাও এই উপলক্ষে ঠিক করতে হবেগ্রামের মানুষরা তাে আর দলবেঁধে বিয়েতে আসতে পারবে নাএকটা গরু জবহ করে ওদের খাইয়ে দেব। 

তার কি দরকার আছে

আছেদরকার আছেসুলতানা শােন, এর মধ্যে আতাউরকে বলি একবেলা এসে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাক। 

বল। 

অফিস থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে আসবরাতে খেয়ে দেয়ে যাবেগল্পগুজব করবেআমিতাে আর গল্প করতে পারি নাতােমরা করবে। 

আচ্ছা। 

তােমার কিছু স্পেশাল রান্না যে আছে সেগুলি করশাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে বুঝুক রান্না কাকে বলে! কলার থাের বেটে তুমি যে জিনিসটা কর ওটা করবেআর মাছের টকও রাঁধবেনেত্রকোনার ছেলেতাে শুটকি পছন্দ করবেবেগুন দিয়ে শুটকি করবে। 

আবদুর রহমান চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেনসুলতানা বললেন, কী হয়েছে

বমি আসছেবলতে বলতেই তিনি ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন। 

মন্টু সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছেটিভির এই প্রােগ্রামটি তার খুব পছন্দেরসপ্তাহে একদিন মাত্র দেখায়আজ না দেখতে পেলে আরাে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবেবাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছেমানুষটা অনেকবার বমি করে এখন শুয়ে আছেতাঁর ঘর অন্ধকারমা তাঁর মাথার চুলে ইলিবিলি করে দিচ্ছেআর সে কিনা টিভি দেখছে! কাজটা খুবই অন্যায়মন্টুর নিজের কাছেই খারাপ লাগছে কিন্তু সে টিভি বন্ধ করতে পারছে নাসে অবশ্য তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে

বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ

ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছেডাক্তারের প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছেতারপরেও টিভি দেখাটা ঠিক হচ্ছে নাবড় আপা তাকে একবার দেখে গেছেবড় আপা কিছু বলে নিবড় আপা যদি বলতএই টিভি বন্ধ করসে বন্ধ করে দিতবাবার ঘরের দরজা বন্ধটিভির সাউন্ড সে ঘরে যাচ্ছে নাতাছাড়া সে সাউন্ড কমিয়ে রেখেছেনিজেই কিছু শুনতে পাচ্ছে নাবাবার শুনতে পাবার কোনাে কারণ নেই। 

মন্টু টিভি দেখে স্বস্তি পাচ্ছে নাবারবার চমকে চমকে উঠছেমনে হচ্ছে এই বুঝি বাবা বের হয়ে আসবেন! বের হয়ে তিনি কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলবেনআমি মারা যাচ্ছি আর তুই টিভি দেখছিস! টিভিটা এতই জরুরিদেখতেই হবে? বাবা অবশ্যি মারা যাচ্ছে না

দুতিনবার বমি করলে কেউ মারা যায় নাডাক্তার সাহেব বলেছেন, আজেবাজে খাবার খেয়ে পেট গরম হয়েছেতিনি ওরস্যালাইন খেতে দিয়েছেনআর ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। | খট করে শব্দ হলোবাবার ঘরের দরজা খুলছেমন্টু টিভির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিভি বন্ধ করলসুলতানা বের হয়ে এলেন

 

(চলবে)

বৃষ্টি বিলাস (পর্ব-৮)- হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *