এত বেশি বােঝা কিন্তু ঠিক না। কিছু কিছু মানুষ আছে ভালর মধ্যে মন্দ খুঁজে। তুইও তাদের মতাে হয়ে গেলি ?
তুমি রেগে যাচ্ছ মা। কথা ছিল তুমি রাগবে না।
আমি রাগি নি। তাের কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছি। মানুষের সম্পর্ক এত ছােট করে দেখতে নেই।
এশা চুলায় হাঁড়ি বসাতে বসাতে বলল, মা শােন, একবার মুত্তালিব চাচার টেলিফোন নষ্ট ছিল। প্রায় এক মাস নষ্ট ছিল। এই একমাসও কিন্তু বড় আপা প্রতিদিন একবার করে দোতলায় গেছে।
তাতে কী হয়েছে ? কিছু হয় নি এমি বললাম। তুমি যে বললে আপা টেলিফোন করতে যায় এটা যে ঠিক না তা বােঝানাের জন্যে বললাম। তুমি রেগে যাচ্ছ বলে গুছিয়ে তােমাকে কিছু বলতে পারছি না। মা শােন, আপা যখন শুনবে আজ বাসায় সর্ষে ইলিশ রান্না হচ্ছে সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে মুত্তালিব চাচার জন্যে তরকারি পাঠাতে।
এতে দোষের কী আছে? উনি শামাকে নিজের মেয়ের মতাে দেখেন। মেয়ে
কি বাবার জন্যে তরকারি নিয়ে যাবে না ? এক টুকরা মাছ মানুষটার জন্যে নিয়ে গেলে সেটা দোষের হয়ে যাবে?
এশা বলল, মা সরি । এই প্রসঙ্গটা তােলা ঠিক হয় নি। তােমার মুখ থেকে রাগ রাগ ভাবটা দূর করে সহজভাবে তাকাও। আমার মন আসলেই ছােট। কী আর করা। মা, চা খাবে ?
চা খাও। আমি তােমাকে চা বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। চা বানানােটা আমি ভাল শিখেছি মা। বানাই ? প্লীজ।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
বললামতাে না ।
তােমার সঙ্গে আমার চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। কঠিন মুখে না বলবে না। আমিতাে স্বীকার করেছি আমার মন ছােট। তারপরেও রাগ করে থাকাটা কি
ঠিক?
এশা খালি চুলায় চায়ের কেতলি বসাল। শামা এসে উপস্থিত হলাে। খুশি খুশি গলায় বলল, চা হচ্ছে না–কি রে ? আমিও চা খাব । আজ কি তুই রান্না করছিস ?
কী রান্না ? সর্ষে ইলিশ। ইলিশ মাছে ডিম ছিল ? ছিল ।
ডিমটা আলাদা করে রাখবি। মুত্তালিব চাচা ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করেন। ডিমটা আমি উনাকে দিয়ে আসব।
আচ্ছা। সুলতানা এশার দিকে তাকিয়ে আছেন। এশা একবারও মার দিকে তাকাল । সে নিজের মনে চা বানাচ্ছে । শামা বলল, মা শােন, চাচাকে একসারসাইজ করিয়ে এসেছি। আমার কী মনে হয় জান মা? আমার মনে হয় একসারসাইজের চেয়েও উনার যেটা বেশি দরকার সেটা হচ্ছে সেঁক। কাল থেকে একসারসাইজও করাব, সেঁকও দেব।
তুইতাে ডাক্তার না । তুই এসবের জানিস কী ?
শামা চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, ছােটখাট ব্যাপার জানার জন্যে ডাক্তার হওয়া লাগে না মা।
এশা বলল, আপা তুমি কী আতাউর ভাইকে টেলিফোন করছিলে ?
শামা বলল, না। আমার এত গরজ নেই। বাবা শখ করে টেলিফোন নাম্বার এনেছেন। একবার টেলিফোন কর। শামা হালকা গলায় বলল, বাবার শখ থাকলে বাবা করুক। আমার শখ নেই।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
সুলতানা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে উঠে গেলেন। এশার কথাগুলি শােনার পর থেকে তার ভাল লাগছে না। মনের মধ্যে কী যেন খচখচ করছে। অদৃশ্য কোনাে কাটা বিধে আছে।
শােবার ঘর অন্ধকার করে আবদুর রহমান শুয়ে আছেন। শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের বুড়াে আঙুল এবং নাক এক লাইনে। সুলতানা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে শরীর খারাপ না–কি ?
আবদুর রহমান উঠে বসতে বসতে বললেন, মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। মুখের ভেতরটা টক টক লাগছে।
জ্বর আসে নি তাে ?
চা খাবে? নাও চা খাও, রান্নার দেরি হবে। অসুবিধা নেই, হােক দেরি। আজ এশা রান্না করছে। ও রান্না জানে ?
জানে না, শিখবে। তােমার বড় মেয়ের রান্নাবান্নায় আগ্রহ নেই। এশার আছে।
দুই মেয়েকেই শিখিয়ে দাও। আজকালকার মেয়েরা সব শিখতে রাজি, শুধু রান্না শিখতে রাজি না। রান্না শেখাটা খুব দরকার।
আমার মেয়েরা আজকালকার মেয়ের মতাে না।
আবদুর রহমান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের খোঁজ নিয়েছি। এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতাে আছে। এতে তােমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না ?
সব টাকা এক মেয়ের পেছনে খরচ করে ফেলবে ? তােমার তাে আরাে একটা মেয়ে আছে।
প্রথম বিয়ে একটু ধুমধাম করে দেই। আমি ঠিক করেছি বিয়ের পর মেয়ে জামাইকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব। পালকির ব্যবস্থা করব। পালকি করে জামাই–বৌ যাবে। গ্রামের মানুষ ভিড় করবে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
পালকি পাবে কোথায় ? দেশে কি পালকি আছে ?
আমাদের এদিকে আছে। গ্রামের বাড়িটাও এই উপলক্ষে ঠিক করতে হবে। গ্রামের মানুষরা তাে আর দলবেঁধে বিয়েতে আসতে পারবে না। একটা গরু জবহ করে ওদের খাইয়ে দেব।
তার কি দরকার আছে ?
আছে। দরকার আছে। সুলতানা শােন, এর মধ্যে আতাউরকে বলি একবেলা এসে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাক।
বল।
অফিস থেকে ফেরার সময় ওকে নিয়ে আসব। রাতে খেয়ে দেয়ে যাবে। গল্প–গুজব করবে। আমিতাে আর গল্প করতে পারি না। তােমরা করবে।
আচ্ছা।
তােমার কিছু স্পেশাল রান্না যে আছে সেগুলি কর। শাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে বুঝুক রান্না কাকে বলে! কলার থাের বেটে তুমি যে জিনিসটা কর ওটা করবে। আর মাছের টকও রাঁধবে। নেত্রকোনার ছেলেতাে শুটকি পছন্দ করবে। বেগুন দিয়ে শুটকি করবে।
আবদুর রহমান চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। সুলতানা বললেন, কী হয়েছে ?
বমি আসছে। বলতে বলতেই তিনি ঘর ভাসিয়ে বমি করলেন।
মন্টু সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে টিভিতে এক্স ফাইল দেখছে। টিভির এই প্রােগ্রামটি তার খুব পছন্দের। সপ্তাহে একদিন মাত্র দেখায়। আজ না দেখতে পেলে আরাে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ আছে। মানুষটা অনেকবার বমি করে এখন শুয়ে আছে। তাঁর ঘর অন্ধকার। মা তাঁর মাথার চুলে ইলিবিলি করে দিচ্ছে। আর সে কি–না টিভি দেখছে! কাজটা খুবই অন্যায়। মন্টুর নিজের কাছেই খারাপ লাগছে কিন্তু সে টিভি বন্ধ করতে পারছে না। সে অবশ্য তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছে।
বৃষ্টি বিলাস হুমায়ূন আহমেদ
ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছে। তারপরেও টিভি দেখাটা ঠিক হচ্ছে না। বড় আপা তাকে একবার দেখে গেছে। বড় আপা কিছু বলে নি। বড় আপা যদি বলত— এই টিভি বন্ধ কর— সে বন্ধ করে দিত। বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। টিভির সাউন্ড সে ঘরে যাচ্ছে না। তাছাড়া সে সাউন্ড কমিয়ে রেখেছে। নিজেই কিছু শুনতে পাচ্ছে না। বাবার শুনতে পাবার কোনাে কারণ নেই।
মন্টু টিভি দেখে স্বস্তি পাচ্ছে না। বারবার চমকে চমকে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি বাবা বের হয়ে আসবেন! বের হয়ে তিনি কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলবেন— আমি মারা যাচ্ছি আর তুই টিভি দেখছিস! টিভিটা এতই জরুরি। দেখতেই হবে? বাবা অবশ্যি মারা যাচ্ছে না।
দু‘তিনবার বমি করলে কেউ মারা যায় না। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, আজেবাজে খাবার খেয়ে পেট গরম হয়েছে। তিনি ওরস্যালাইন খেতে দিয়েছেন। আর ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। | খট করে শব্দ হলো। বাবার ঘরের দরজা খুলছে। মন্টু টিভির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টিভি বন্ধ করল। সুলতানা বের হয়ে এলেন।
(চলবে)