এশা কী করছে ? রান্না করছে। তােমার শরীর ঠিক আছে মা? হ্যা।
শামা রান্নাঘরে চলে গেল। এশা বােনকে দেখে হাসল। যেন এ বাড়িতে কিছুই হয় নি। শামা বলল, কী রান্না করছিস ?
মাংস। বাবা আজ বাংলাদেশের সবচে‘ প্রবীণ গরুর মাংস নিয়ে এসেছেন। এক ঘন্টার ওপর জ্বাল হয়ে গেছে। যতই জ্বাল হচ্ছে মাংস ততই শক্ত হচ্ছে।
গন্ধতাে খুব সুন্দর বের হয়েছে। গন্ধে গন্ধেই খেতে হবে।
শামা বােনের পাশে বসতে বসতে বলল, তুইতাে ভাল রান্না শিখে যাচ্ছিস। ঐ দিন মাছের ঝােল রান্না করলি, আমি বুঝতেই পারি নি তাের রান্না। আমি ভেবেছি মা বেঁধেছে।
রান্না শেখার কাজটা আমি মন দিয়ে শিখছি আপা। কারণ শুনতে চাও ? কারণ হচ্ছে বিয়ের পর আমাদের সংসারে খুব গরিবি হালত চলবে। কাজের বুয়া রাখতে পারব না। রান্নাবান্না আমাকেই করতে হবে। আমি এমন রান্না কখনাে রাধব না যে মাহফুজ মুখে দিয়ে বলবে— কী বেঁধেছ ?
তুই এত কিছু চিন্তা করিস ?
এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি তােমার মতাে না আপা। আমি খুবই চিন্তাশীল তরুণী।
তাের বিয়েটা কবে হচ্ছে ?
তােমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি বিয়ে করব না। তুমি যদি বিয়ে করতে দশ বছর দেরি কর, আমিও ঠিক দশ বছরই দেরি করব।
বৃষ্টি বিলাস (শেষ-পর্ব)- হুমায়ূন আহমেদ
কারণ কী ? বললাম না, আমি খুব চিন্তাশীল তরুণী। চিন্তাশীল তরুণী বলেই তােমার
বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করব।
কেন অপেক্ষা করবি ? আমার সঙ্গে তাের কী ? সেদিন না বললি আমি আলাদা, তুই আলাদা ?
এই সংসারে যতদিন আছি ততদিন আলাদা না। সংসার থেকে বের হলে আলাদা। আপা শােন, আমি কখনাে হুট করে কিছু করি না। যাই করি খুব ভেবে চিন্তে করি। আমার সব কিছুর পেছনে একটা পরিকল্পনা থাকে।
শামা আগ্রহ নিয়ে বলল, তাের বিয়ের পরিকল্পনাটা শুনি। থাক এখন না, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় শুনব।
এশা হাঁড়িতে পানি দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, রাতে ঘুমুতে যাবার সময় কিছু শুনতে পারবে না আপা। তখন বাসায় খুব হৈচৈ হতে থাকবে। কান্নাকাটি হতে থাকবে। এর মধ্যে গল্প শুনবে কি ?
হৈচৈ কান্নাকাটি হবে কেন ?
কারণ মন্টু রাতে বাসায় ফিরবে না। বাবা ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে পড়বেন। তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে। রাত বারটা একটার সময় কাদতে কাঁদতে নিজেই ছেলের সন্ধানে বের হবেন। বের হলেও লাভ হবে না। আগামী এক সপ্তাহ তিনি ছেলে খুঁজে পাবেন না।
শামা বলল, তুই তাকে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিস ?
হ্যা। আমি তাকে মুত্তালিব চাচার ঘরে রেখে এসেছি। তাঁকে বলে এসেছি মন্টুকে যেন এক সপ্তাহ লুকিয়ে রাখেন। আমি চাই বাবার একটা ভাল শিক্ষা হােক। ছেলের ওপর তিনি যত রাগই করেন, অচেনা অজানা একদল মানুষের সামনে তিনি তাকে লজ্জা দিতে পারেন না।
বৃষ্টি বিলাস (শেষ-পর্ব)- হুমায়ূন আহমেদ
মা জানে যে, মন্টুকে তুই লুকিয়ে রেখেছিস ? জানেন।
আমিতাে এই মাত্রই মুত্তালিব চাচার কাছ থেকে এলাম। তুই কখন মন্টুকে নিয়ে গেলি ?
আমি খুব দ্রুত কাজ করি আপা।
তাইতাে দেখছি। এখন শুনি তাের বিয়ের পরিকল্পনা। তুই কথা শুরু করার আগে আমি তােকে একটা কথা বলে নেই। মাথায় আঁচল দিয়ে তুই রান্না করছিস। তােকে বউ বউ লাগছে। মনে হচ্ছে তুই একটা বিরাট বড় বাড়ির বড় বউ। এবং বাড়িটার সমস্ত ক্ষমতা তাের হাতের মুঠোয়।
আমাকে সুন্দর লাগছে কি–না সেটা বল ?
তােকে পরীর মতাে লাগছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি শাড়ির ফাক দিয়ে তাের পাখা বের হয়ে আসবে।
এশা ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তােমার সবচে‘ বড় গুণ কী জান আপা? তােমার সবচে‘ বড় গুণ হলাে তুমি চট করে মানুষকে খুশি করে ফেলতে পার। আমি পারি না। তুমি খুব সুন্দর করে মিথ্যা কথা বল। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি না। যে মিথ্যা কথা বলতে পারে না তাকে মানুষ ভয় পায়। ভালবাসে না, পছন্দও করে না।
জ্ঞানের কথা বন্ধ করে তাের বিয়ের পরিকল্পনাটা বল, আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
এশা বােনের দিকে ফিরল । সে বসেছিল পিঁড়িতে। পিড়ি আরেকটু টেনে নিল শামার দিকে। গলা সামান্য নামিয়ে বলল, আপা শােন, আমি খুব খারাপ ধরনের, খুবই বাজে টাইপ একটা ছেলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। কারণ তাকে আমার খুবই পছন্দ।
বৃষ্টি বিলাস (শেষ-পর্ব)- হুমায়ূন আহমেদ
কেন পছন্দ ?
কেন পছন্দ সেটা আরেকদিন বলব। এখন পরিকল্পনাটা শােন। আমি ঠিক করেছি তাকে বিয়ে করব কাজি অফিসে। তার বিরুদ্ধে পুলিশের বেশ কয়েকটা মামলা আছে। সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি ব্যবস্থা করে রাখব যেন কাজি অফিসে বিয়ের পর পর পুলিশ তার খোঁজ পায়। কাজি অফিস থেকেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। যেন পরের দুই বা তিন বছর সে জেল থেকে বের হতে
পারে ।
বলিস কী ?
এটা ছাড়া আমার কোনাে পথ নেই আপা। বিয়ের পর পর সে যদি জেলে চলে যায়, যদি অনেকদিন সে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পারে, তাহলে সে যে কষ্টটা পাবে তার কোনাে তুলনা নেই। এই কষ্টটাই তাকে বদলে ফেলবে। বাকি জীবন সে চেষ্টা করবে যেন এক মুহূর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে থাকতে
হয়।
তাের কষ্ট হবে না ?
আমি ভবিষ্যতের আনন্দটা দেখতে পাচ্ছিতাে। আমার কষ্ট হবে না। তােমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি কেন বিয়ে করতে পারছি না তা বুঝতে পারছছাতাে? যে পরিবারের একটা মেয়ে এমন একজনকে বিয়ে করে, যাকে বিয়ের দিনই পুলিশ ধরে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়, সেই পরিবারের মেয়েরা কেমন ? সেই পরিবারের