ভগীরথ-সমরেশ মজুমদার

ভগীরথ-সমরেশ মজুমদার

চিৎ হয়ে শুয়েছিল শিবনাথ। পা থেকে চাদরটা কপাল অবধি টানটান করে টানা, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকার আরামটা পাওয়া যায়। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে কেলে পঞ্চাননের চিঙ্কারে। পাশে হরেকেষ্টর চায়ের দোকানে চা খেতে এসে এমনভাবে দাঁড়-কাকিয়ে ডাকে যে। শান্তিতে ঘুমোবে তার জো নেই। আর হরেদারও হয়েছে এক ঢং, চারটে বাজতে-না-বাজতে দোকান খুলে বসে থাকে ঝিগুলোর জন্য। সাত বাড়িতে কাজ করতে যাওয়ার পথে হরেদার দোকানের চা গিলে যায়। চোখ বন্ধ করে আর একটু ঘুমুতে চেষ্টা করল শিবনাথ। কিন্তু ভোরের ঘুম শালা যৌবনের মতো, একবার গেলে ফেরাবে কার সাধ্যি! চোখ থেকে চাদরটা নামিয়ে পিটপিটিয়ে তাকাল সে। ওটা কী দেখা যায়, একদম চোখের সামনে? ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা করে চোখ বন্ধ করল শিবনাথ। দিলে দিনটাকে নষ্ট করে। এই শালা পাড়াটা হয়েছে ভাগাড়খানা। দিনভর পলিটিকস, সন্ধেবেলায় মালটানা আর ভোররাতে লুঙ্গি কোমরের ওপর তুলে ফুটে শুয়ে থাকা কারোর আর লাজ-লজ্জা রইল না। এখন এই লুঙ্গি তোলা পাছা দেখে চোখ বন্ধ হবে আর?

পাশ ফিরতে গিয়ে চোখ আটকে গেল। আহা, দেহ নয় তো মর্তমান কলা। মাথা নিচু করে কলের তলায় ধরেছে, জল পড়ছে সারা গায়ে, পিঠ-কোমর উদোম। কোমরের থেকে পাক খেয়ে আঁচলটা বুকের ওপর জড়ো–সেদিকটা অবশ্য শিবনাথ দেখতে পাচ্ছে না। রাস্তার ওপর এই কলটায় বস্তির কোনও মেয়ে দিনদুপুরে স্নান করে না। আহা, ভোরবেলায় চোখ মেললে কত। সুন্দর-সুন্দর জিনিস দেখা যায়। লোকজন নেই, অন্ধকার সরে গেল মাত্র, স্নানের সময় লজ্জাটাও তাই কম। ভোরবেলায় মানুষের মনমেজাজ নরম থাকে, সারারাত বিশ্রামের পর জল পড়ে শরীরেরও চেকনাই বাড়ে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে বেশ রসালো হওয়ার পরই শিবনাথ মনে-মনে নিজের গালে চড় মারল। শালা কে বলে তার ঘুম গেছে! নইলে চোখ চেয়েও সাত বছর ঘর-করা বউটাকে চিনতে পারে না! নিজের বউ কাকভোরে দেহ ভেজাচ্ছে আর সে ভাবছে মত্তমান কলা! হঠাৎ সব রস ভুস করে উবে গেল যেন, পাশ ফিরল সে। পরপর ফুটপাথ জুড়ে ঘুমন্ত আধা-ঘুমন্ত মানুষের ছড়াছড়ি। এই বস্তির ঘরগুলোর ফ্যামিলিকে জায়গা করে দিতে খোলা আকাশের তলায় ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুমটা বেশ হয়। শিবনাথ দেখল, খানিক দূরে কে একজন চোখে হাত চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। মদন না? গোঁফ গজায়নি ভালো করে, এখন থেকে পরের বউ-এর স্নানের শরীরে চোখ লেপটে বসে আছে চাঁদ! আবার চোখে আড়াল দেওয়া হয়েছে! ও গতরটাকেও তো দেখছ কিন্তু ওর ভিতরে যে মালটা আছে তাকে খেয়াল রেখো হে, মনে-মনে বলল শিবনাথ, . বাপকেলে শ্বশুটা ওর গলার ভিতরে একডজন তাড়কাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল জন্মাবার সময়। নইলে কোনও বউ তার স্বামীকে হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা বলার সাহস পায়! আর তা ফিসফিস করে নয়, পাড়ার সবাইকে জানিয়ে। স্বামীকেই যখন এই কথা বলে তখন তুই মদনা সেদিনের পুঁচকে তোকে কী বাক্য দেবে একবার ভাব দিকিনি। মনে-মনে নিজেই বাক্যটার। তল্লাশ করতে-করতে আনন্দে চোখ বুজল শিবনাথ।

বস্তির অনেকটা ভিতরে একখানা ঘর তবে সেটা বেশির ভাগ সময় বন্ধই থাকে। বৃষ্টিবাদল হলে রান্নাবান্না আর খুব ঝগড়াঝাঁটি হলে এক-এক রাতে শোয়ার জন্য দরকার হয়। তা ছাড়া এই ঘরটা আছে বলে এই ব্লকের বাথরুম ল্যাটিনের ওপর হক আছে গঙ্গার। সি. এম. ডি. এ থেকে ঝকঝকে সিমেন্টের ল্যাটিন করে দিয়েছে। পায়খানা শোয়ার ঘরের মতো চেহারা নিলে সাহেবরা ল্যাটিন বলে এটা বস্তির সবাই শিখে নিয়েছে। ব্যাটাছেলেদের তো কোনও বালাই নেই, রাস্তার পাশে বসে গেলেই হল, শুধু ল্যাটিনটাই পারে না ওরা। শিবনাথ অনেকবার চেয়েছে ঘরটা ছেড়ে দিতে, কুড়িটা টাকা নাকি ফালতু মাসে-মাসে গলে যায়। গঙ্গার জন্য পারেনি। গঙ্গার জন্য অনেককিছু পারে না গেঁজেলটা, নইলে অ্যাদ্দিনে এই সংসার দোকান সব পগারপার হয়ে যেত।

ভেজা শাড়ি পরে দ্রুত দোকানে ফিরে এল গঙ্গা। দেরি হয়ে যাচ্ছে, ঠিক ছটার সময় যাওয়ার কথা। ফুটপাথের ওপর একটা বড় পাথরে পা রেখে সামান্য লাফিয়ে দোকানের ওপর উঠতে হয়। ঝটপট দোকানে উঠে ভিতরদিকে চলে গেল ও। তিন-তিনটে শরীর কাঠের মেঝেতে শুয়ে আছে। ছোটদুটো উদোম, বড়টা শুধুইজের পরা। গঙ্গা একদম দোকানের শেষ প্রান্তে চলে এসে দ্রুত হাতে কাপড় ছাড়তে লাগল। এই রাবণের গুষ্টি পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে, কারও ওঠবার নাম নেই। বিড়বিড় করে কথাগুলো উচ্চারণ করে কোমরে সায়ার গিঁট বাঁধতে-বাঁধতে ওর খেয়াল হল গতবার রথের মেলা থেকে যে চার ফুট বাই দুই ফুট আয়নাটা কেনা হয়েছিল, সেটার দিকে রাস্তা থেকে যে-কেউ তাকালে ওর সবকিছু দেখতে পাবে। কিন্তু গঙ্গা সরল না জায়গাটা থেকে জামাকাপড় পরা শেষ না-হওয়া অবধি। এই বস্তির কোনও লোক তার শরীরের দিকে অন্য চোখে তাকাবার সাহস রাখেনা। গরম বেশি পড়লে দোকানে বসে ছোটটাকে বুকের দুধ খাওয়াতো ও, সিগারেট বিড়ি কিনতে এসে ছোঁকরাগুলো সেদিকে ফিরেও তাকাত না। গঙ্গার গলার জোর জানে না এমন কেউ নেই। হরেদা তো বলে, মাইরি শিবুর বউ, তোমার খিস্তির স্টক থেকে আমাকে কিছু দাও। বলে আর ওর দিকে তাকায় না। হ্যাঁ, এই বস্তিতে ওই হরেদাই যা একটু প্রশ্রয় পায়। গঙ্গার কাছে, হাজার হোক বউ-মরা পুরুষ তো আর বয়সও হয়েছে বেশ।

সেজেগুঁজে একমাথা সিঁদুর পরে গঙ্গা প্রায় লাফিয়ে মাটিতে নেমে হনহন করে হরেদার দোকান পেরিয়ে চলে এল। হরেদার দোকানে এখন রস ফুটছে টগবগ করে। পদ্মবালা এসেছে চা খেতে। দু-চক্ষে দেখতে পারে না গঙ্গা। যে বাড়িতে কাজ করে সেই বুড়োবাবু রোজ পাঁচটাকা করে দেয় পদ্মকে গিন্নিকে লুকিয়ে। হাত-পা নেড়ে আবার বলে, কি করব ভাই, বুড়ো মানুষটা বুকে মুখ। রেখে এমন ছেলেমানুষের মতো কাঁদে না! ঝাঁটা মার, ঝাঁটা মার! শরীর দেখিয়ে একটা ঘাটের মড়ার কাছে টাকা নিচ্ছে, জানে ভয়ের কিছু নেই, আর তাই খলবলিয়ে বলে বেড়ায়! স্বামীটা হল এক নম্বরের ম্যাদামারা। হরেদারও পদ্ম এলে চা বানানো শেষ হয় না। ব্যাটাছেলে জাতটার। ওপর ঘেন্না ধরে গেল গঙ্গার। কারও চরিত্তির বলে কিছু নেই।

এক হ্যাঁচকা টানে চাদরটা মুখ থেকে টেনে সরিয়ে আনল গঙ্গা। টানের চোটে মুন্ডুটা নড়ে উঠল কিন্তু চোখ খুলল না। হাতের মুঠোয় ধরা চাদরের দিকে তাকিয়ে গা ঘিনঘিন করে উঠল ওর। কী নোংরা আর দুর্গন্ধ, বাপের জন্মে কাঁচাকাচি হবে না গঙ্গানা করে দিলে। শরীরের দিকে চেয়ে দ্যাখো, এক ইঞ্চি ময়লা চামড়া কামড়ে বসে আছে। কতদিন যে শরীরে জল ঠেকায় না, যেন সেটাও গঙ্গার দায়। এখন দ্যাখো, কেমন হারামজাদা লোক, চাদর ধরে এত যে টান দিল গঙ্গা, মরা মানুষও চিতায় উঠে বসে, এনার চোখ খুলল না। হাড়ে-হাড়ে বজ্জাত, ইচ্ছে করে চোখ এঁটে শুয়ে আছে, ভোরবেলা গঙ্গার মুখ দেখবে না! এ-কথা চিন্তা করতেই গুলতির বাঁট থেকে পাথরটা। ছিটকে বেরিয়ে এল, কটা বাজে খেয়াল আছে? দুপুর গড়িয়ে এল, এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুম মারছ? রাত্রে ফুটে শোয়ার নাম করে ফের গ্যাঁজা টেনেছে রে-এ-এ। প্রথমটায় বেশ চোখ বন্ধ। করেছিল শিবনাথ, কিন্তু শেষেরটা শুনে প্রতিবাদ না করে থাকতে পারল না। পট করে চোখ খুলে আস্তে অথচ গঙ্গা যাতে শুনতে পায় এমন গলায় বলল, মাইরি বলছি খাইনি।

খাওনি? খেঁকিয়ে উঠল গঙ্গা, চেহারা দেখেছ নিজের? এত দাম দিয়ে আয়নাটা কিনলাম সেদিকে একবার ভুলেও তাকায় না রে! এমন একটা গেঁজেল আমার কপালে ছিল।

না, আর শোয়া যাবে না। এমন মেয়েছেলে যে কোন মায়ের গব্বে পয়দা হয় কে জানে! চট করে ও মদনার দিকে তাকাল। ছোঁড়া এখন গঁদের আঠায় চোখ এঁটে ঘুমুচ্ছে! বউ-এর পায়ের দিকে তাকিয়ে শিবনাথ যা বলল সেটা শুধু গঙ্গাই যেন শুনতে পেল।

নিমতলায়। প্রায় ভেংচে বলে উঠল গঙ্গা, এখন বাপের জমিদারি থেকে গতর তুলে দোকানে ঢোকো, আমি বেরুচ্ছি। কথাটা শেষ করে হাতের চাদর শিবনাথের দিকে ছুঁড়ে ফেলে গঙ্গা দপদপিয়ে চলে গেল।

চাদরটা নাকের কাছে ধরল শিবনাথ, বোধ হয় একটু গন্ধ হয়েছে। তা পুরুষমানুষের শরীরে থাকলে গন্ধ হবে না? সেই সেবার ঝগড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকে ও গঙ্গাকে বলে দিয়েছিল ওর জামাকাপড় যেন সে না কাঁচে। কিন্তু চাদরটা কি জামাকাপড়ের মধ্যে পড়ে? স্বামীভক্তি বলে কিছু অবশিষ্ট নেই আর। প্রথম বাচ্চা হওয়ার আগে শরীর ছিল, বেড়ালের মতো নরম ছিল মনটাও, দ্বিতীয়টা হওয়ার পরও শরীরটা টিকে ছিল, মুখটার বাপ-মা চলে গেল। আর তিন নম্বর বাঁশটা আসার পর শিবনাথের ইহকাল পরকাল ঝরঝরে। গাঁজার আড্ডার কালীদা রেস খেলে, প্রায়ই সে শিবনাথকে বলে, ভাই শিবু, পেডিগ্রি না দেখে বিয়ে করলে এমনটা তো হবেই। ঝগড়াঝাঁটি মেয়েদের এক জন্মে খোলে না, পেডিগ্রিতে সেটা থাকতে হয়। শিবনাথ মনে-মনে মাকে ডেকেছিল, তুমি মাইরি মা, দেখে এসে বললে আর আমি বিয়ে করলাম। ঠিক হ্যায়, কিন্তু তোমার সাত-তাড়াতাড়ি পটল তোলার দরকার ছিল কি? তুমি থাকলে গঙ্গাটা যিশুখ্রিস্ট হয়ে থাকত, নট নড়নচড়ন–পেরেক পোঁতা। তোমার সঙ্গে পারতে হলে আরও তিনটে জন্ম নিয়ে আসতে হত। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় শিবনাথের, মা জেনেশুনেই এই মেয়েটাকে ঘরে এনেছে।

সারা শরীরে আলস্যি নিয়ে শিবনাথ দোকানের সামনে এসে পুঁটলি পাকানো চাদরগুলো ভিতরে। ছুঁড়ে ফেলে রাস্তার কলে মুখ ধুতে গেল। ইদানীং আর দাড়ি কামায় না ও, মাঝে-মাঝে আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করে। স্নানটান সাজগোজ এসবের ইচ্ছেটাই আর করে না। মনে-মনে ভাবে সে, ছেলেমেয়ে দোকান সব গঙ্গার, তার কাজ শুধু বিড়ি বেঁধে যাওয়া। দোকানের মুখটাতে বসে। কুলোটাকে কোলের ওপর রেখে পাতা কাটা আর দুলে-দুলে তামাক পুরে গোটা-গোটা বিড়ি তৈরি করা। এই সারাটা দিন একভাবে বসে কাজ করে যাওয়া, শিবনাথ কারও সঙ্গে বাক্য ব্যবহার করে না। হ্যাঁ, এ পাড়ার কেউ শিবনাথের মুখে কথা শোনেনি দুটো ছেড়ে তিনটে। কালীদা বলে, তুই মাইরি একদিন ঠিক বোবা হয়ে যাবি। গ্যালপ না করালে ঘোড়া নষ্ট হয়ে যায়। তা বিড়ির হাত কিন্তু বেশ ভালো ওর। আগে মানিকতলার বিপিন ঘোষের দোকানে বিড়ি বাঁধত ও। ঠিকমতো টাকাপয়সা দিত না অথচ তাই নিয়ে খুব একটা ঝগড়া করত না সে। শেষ পর্যন্ত একদিন গঙ্গা ঝাঁটা মারি অমন চাকরির মুখে বলে ওকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে নিজের দোকানেই বসিয়ে দিল। দোকানটা এত ছোট, নড়তে-চড়তে অসুবিধে হয়, তা ছাড়া গঙ্গার সামনে সারাদিন বসে থাকা আসতে চায়নি সে। কিন্তু দোকানে তাকে বসিয়ে গঙ্গা গোরাপঞ্চাননকে দিয়ে ছোট্ট সাইনবোর্ড লিখিয়ে নারকোল দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল, শিবনাথের নেশার বিড়ি। নেশা কথাটা আছে বলেই বোধ হয় বিক্রি ভালো হয় গঙ্গার, রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে দ্যাখে পড়ে নেই কিছু। সংসার-টংসার টাকাপয়সা সব দায়িত্ব গঙ্গার, ওর শুধু। মাঝে-মাঝে সিগারেট আর খিদের সময় খাওয়া চাই, ব্যস! শিবনাথ সাতও জানে না পাঁচও জানে না।

লুঙ্গিটাকে পেটের ওপর আলতো করে বেঁধে একটু লুকিয়ে দোকানে উঠে ও দেখল গঙ্গার তিন কন্যা ফেলাট হয়ে পড়ে আছে। ওদের দেখে এক-এক সময় মনটা খারাপ হয়ে যায় শিবনাথের। ঘুম ভাঙলেই নিচে ফুটপাথে নামে, রাত না হওয়া অবধি ফুটেই চরে বেড়ায়। বস্তির ভিতরের। অন্ধকার ঘরটায় কেউ যেতে চায় না। বড়টাকে গঙ্গা এ বছর কর্পোরেশন স্কুলে ভরতি করেছে। প্রত্যেক সকালে গঙ্গার মুখ আর হাত চলে মেয়েটার ওপর। বহুৎ ধড়িবাজ মেয়ে। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে শিবনাথ লক্ষ করেছে দোকানের ক্যাশ থেকে মেয়েটা পাঁচ-দশ পয়সা সরায় মাঝে-মাঝে। কিছু বলেনি কখনও, ওর কি! স্কুল-ফেরত শিবনাথের সামনেই মেয়েটাকে দোকানে বসায় গঙ্গা। দোকান বলতে বাইশ বয়াম কেক-বিস্কুট-লজেন্স, এক ঝুড়ি পুঁইশাক, কুমড়োর ফালি, ঝিঙে, আলু আর কাঠের আসনের ওপর সিগারেটের স্থূপ, বিড়ির বান্ডিল। যেন শিবনাথ দোকান সামলাতে পারে না বলেই মেয়েটাকে এসব শেখাচ্ছে গঙ্গা।

বিড়ির কুলোটা টেনে নিয়ে বাবু হয়ে বসল শিবনাথ। এখন হাত মেশিন হয়ে গিয়েছে। কাঁচি দিয়ে পাতা কাটার সময় একটা ছোট বড় হয় না, চোখ বেঁধে বিড়ি বাঁধতে পারে। মেয়েগুলোকে একবার ডাকবে কিনা ভাবল সে, তারপরই চিন্তাটা ত্যাগ করল। শালা ঘুম থেকে উঠলেই ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এককাপ চা পেলে হতো। মুখ বাড়িয়ে দেখল হরেদার দোকানের। সামনে পুরো বস্তিটাই যেন গেলাস-মগ হাতে উঠে এসেছে। বড়টাকে ওঠালে ওর ফাঁক গলে এনে দিতে পারত। দারুণ সেয়ানা মেয়ে। মা না থাকলে মুখ খারাপ করে বেশ। বাপ যে বসে আছে। খেয়াল করে না, যেন শিবনাথ আর একটা বয়াম। মনে-মনে মজা পায় শিবনাথ, দেখে যাওয়ার মতো আরাম আর কি আছে, পৃথিবীতে যারা ঝুট-ঝামেলায় জড়ায় তাদের মধ্যে সে নেই।

দুলতে-দুলতে কুঁজো হয়ে বসে শিবনাথ বিড়ি বাঁধছিল, এমন সময় চিৎকারটা শুনতে পেল। বাবুদা রাস্তার ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে কী একটা বলতে-বলতে এদিকে আসছে। বাবুদা যখন রাস্তায় হাঁটে তখন সবসময় তিন-চারজন চামচে সঙ্গে রাখে। এ পাড়ায় সবরকম ভালোমন্দের ভার। বাবুদার ওপর। বয়সে ওর চেয়ে অনেক ছোট, সুন্দর চেহারার বাবুদা যখন টাই ফাঁই পরে অফিসে বেরোয় তখন সাহেব-সাহেব দেখায়। তা এ পাড়ার আবালবৃদ্ধবণিতা ওকে বাবুদা বলেই ডাকে। আজ অবধি ওকে মারপিট করতে দ্যাখেনি শিবনাথ কিন্তু ওর চামচেরা এক-একজন গব্বর সিং। এক-একটা ডায়ালগ রকে পা তুলে এমনভাবে বলে যে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। চামচেগুলোর নাম রেখেছে গঙ্গা। শিবনাথ সিনেমা দ্যাখেনি অনেকদিন।

বাবুদা এসে ওর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফিলটার সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিল। বিড়ি বাঁধতে-বাঁধতে সেদিক থেকে চট করে চোখ সরিয়ে নিল শিবনাথ। কিন্তু পেছনের আয়নায় চোখ পড়তে দেখল বাবুদার মুখ খুব গম্ভীর, নখ দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুলছে। এ পাড়ার উঠতি ছোকরারা এসে প্যাকেট খুলে নিজের হাতে সিগারেট বের করে পয়সা রেখে চলে যায়। গঙ্গা থাকলেও এটা চলে তবে গঙ্গা লক্ষ রাখে যাতে পয়সাটা ঠিকঠাক পড়ে। তা শিবনাথের বাবার কটা পাঁজর আছে যে বাবুদা নিজে না দিলে সিগারেটের দাম চাইবে। তবে ব্যাপার সুবিধের নয়। বাবুদার মুখ গম্ভীর, পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ শিবনাথের কাল রাত্রের ঘটনা মনে পড়ল, সেই কেলোটা নয় তো!

সিগারেট ধরিয়ে বাবুদা হাঁক দিল, কেষ্টদা!

হরেকেষ্টর চায়ের দোকানে তখন খদ্দের থিকথিক করছে কিন্তু ডাকটা সবার মাথা টপকে ঠিক। আসল জায়গায় পৌঁছে গেল। অন্য কেউ হলে যা কখনওই হতো না। হরেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ বাড়িয়ে ওদিক তাকিয়ে বাবুদাকে দেখতে পেয়ে সুড়সুড় করে নিচে নেমে গেল। ওকে দেখতে। পেয়েই বাবুদার গলা বাজখাই হয়ে গেল, কাল রাত্রে কে উড়ছিল? হরেকেষ্ট ঘাড় নাড়ল, আমি জানি না, মাইরি বলছি।

সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বাবুদা চিৎকার করল, এটা কী ভদ্রলোকের পাড়া না বেশ্যাপাড়া? আমাদের মান ইজ্জত বলে কিছু নেই? ।

হরেকেষ্ট বলল, আমি তখন দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছিলাম।

বাবুদা বলল, কিন্তু কোনও কথা শুনব না। নেহাত আমার পাড়া বলে পুলিশ আসেনি, এই আমার মুখ চেয়ে, বুঝেছেন? সে মাল কোথায়?

হরেকেষ্ট বলল, কে?

সঙ্গে-সঙ্গে বাবুদার একনম্বর গব্বর বলে উঠল, গুরু, একে স্লাইট মেরামত করা দরকার, কেমন নেকু হয়ে আছে দেখছ?

ঘাড় নাড়ল বাবুদা, তারপর তিন চার পা পায়চারি করে গলা তুলে বলল, কাল রাত্রে যা হয়েছে তার সাক্ষী কে আছে, কে দেখেছে? এতক্ষণে আরও ভিড় জমেছে। পিলপিল করে বস্তি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে। শিবনাথের দোকানের সামনে একটু লোক কম কারণ সেখানে স্বয়ং বাবুদা দাঁড়িয়ে।

কাউকে উত্তর দিতে না দেখে বাবুদা আবার চিৎকার করে উঠলেন, মাল খেয়ে একজন মেয়েছেলের হাত ধরে টানছে আর তোমরা সব ভেড়ুয়া তা হজম করছ–পুরো বস্তি জ্বালিয়ে দেব বলে দিলাম, একটাকেও এখানে থাকতে দেব না। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবুদা বলল, এই শিবুদা, তুমি কাল রাত্রে গাঁজা খেয়েছ।

বিড়ি বাঁধতে-বাঁধতে ঘাড় নাড়ল সে, না। এত লোকের সামনে আবার এসব কথা কেন? খিঁচিয়ে উঠল বাবুদা, তা তখন কি চোখের মধ্যে কল্কে ঢুকিয়ে বসেছিলে, নাইট শো ভাঙার আগে কোন শালা ফুটে ঘুমোয়?

হঠাৎ কী হল শিবনাথ কুলোটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই ঝুকুকে পাওয়া যাচ্ছেনা সকাল থেকে তাহলে ওরা এখানে আসত না। ঝুকু ছেলেটা খারাপ নয় কিন্তু বাবুদা যেরকম গরম হয়ে আছে তাতে মনে হয় ওর অর্ডার হয়ে গিয়েছে। সত্যি কথাটা যদি বলে দেওয়া যায় তাহলে। হয়তো ঝুকু বেঁচে যেতে পারে। শিবনাথকে ওইভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাবুদা একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিড়ি বাঁধা ছাড়া অন্য কোনও ভঙ্গিতে একে সে দ্যাখেনি, মুখে বাক্যি শোনেনি। নিশ্চয়ই অরিজিনাল কিছু পাওয়া যাবে।

দোকান থেকে নেমে শিবনাথ চারপাশে তাকাল। সমস্ত ভিড়টা ওর দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে আছে এখন। নিজেকে বেশ অন্যরকম মনে হচ্ছে। এতক্ষণে খেয়াল হল ওর গায়ে গেঞ্জি অবধি নেই। আর লুঙ্গির পিছনে বেশ কিছুটা ফেঁসে গেছে। আর এই প্রথম মনে হল ওর শরীরটা খুব ছোট, বাবুদার পাশে খুব অসহায় লাগে।

একনম্বর গব্বর শিবনাথের কাছে এগিয়ে এল, কেসটা কী? অনেকদিন পর নিজের কণ্ঠস্বর শুনল শিবনাথ, হরেদার দোকানের ওপাশে আমি বিছানা করে শুয়েছিলাম। এমন সময় নাইট শো ভাঙল আর রিকশা, লোকজন যেতে লাগল। তারপর ঝুকু এল, এসে বলল সিগারেট দাও। ও খুব মাল খেয়েছিল, টলছিল, কিন্তু আমি যখন বললাম দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে তখন বুঝদারের মতো ঘাড় নেড়ে বলল, আমার জন্যে কিছু খোলা নেই।

একনম্বর বলল, অ্যাই সর্টকাট কর।

শিবনাথ বলল, সর্টকাট করতে গিয়েই তো গণ্ডগোল হয়। আমি বললাম, ঝুকু তুই বাড়ি যা। ঝুকু বলল, তাই যাই। বলে এদিক দিয়ে না গিয়ে রাস্তা পেরিয়ে সর্টকাট করতে গেল। তা নেশার জন্যে পা ঠিক ছিল না, এদিক ওদিক হচ্ছিল দেহ, ঠিক সেই সময় দুটো মারোয়াড়ি বউ সিনেমা দেখে গল্প করতে-করতে আসছিল। আমি দেখলাম একজনকে বাঁচাতে গিয়ে আর একজনের গায়ে এটুখানি টাচ লেগে গেল ঝুকুর। সঙ্গে-সঙ্গে বউদুটো চেঁচিয়ে উঠতে ঝুকু সর্টকাট করে কেটে পড়ল। হাঁপিয়ে পড়েছিল শিবনাথ, বলা শেষ হওয়ামাত্র দোকানে উঠে পড়ার জন্য ঘুরে। দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু একনম্বর গব্বর বলল, শালা ফের কথা বলছে। হাত ধরে টানা আর টাচ লাগা এক হল? বলে শিবনাথের বুকের খাঁচায় আলতো করে ধাক্কা দিল। টাল সামলাতে পারল না শিবনাথ, ঘুরে গিয়ে ছিটকে ফুটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। পড়ার সময় চাপ লেগে লুঙ্গিটা আরও ফেটে গেল শব্দ করে। বুকে হাঁটুতে একটা ব্যথা তুবড়ির মতো ছিটকে উঠল। আর সেই। সময় একটা কচি গলায় কানফাটা চিৎকার উঠল, বাবাকে মেরে ফেলল, ও মা বাবাকে মারছে। শোয়া অবস্থায় মুখ ফিরিয়ে শিবনাথ দেখল বড় মেয়ের মুখটা হাঁ হয়ে আছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে মায়ের গলায়। কখন ঘুম ভেঙেছে টের পায়নি শিবনাথ। দুই নম্বর। গব্বর ধমকে উঠতে চুপ করে গেল মেয়েটা। খুব আস্তে যেন কিছুই হয়নি এমন মুখ করে শিবনাথ উঠে তাকাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে মন না দিয়ে ও বাবুদার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে পাশে দাঁড়াল।

বাবুদা জনগণকে বলল, আজ আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গেলাম, এই বস্তির কেউ যদি মেয়েমানুষের ইজ্জত নষ্ট করে তাহলে আমি পাশে দাঁড়াব না। কাল রাত্রে যাঁদের ঝুকু বেইজ্জত করেছে তারা আমাদের ওয়েল উইশার, তাই ঝুকুর কপালে ভোগ হয়ে গেছে। আপনারা সবাই মনে রাখবেন আগে মা বোনের ইজ্জত তারপর অন্য কিছু। ঝুকু শালা দোষ না করলে পালাল। কেন? আপনি আমি তো পালাইনি–হা হা হা।

অনেকটা শাসিয়ে ওরা চলে গেল। শিবনাথ দেখল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হরেদা এগিয়ে এল, আমি মাইরি তাজ্জব হয়ে গিয়েছি, আমাদের শিবু কথা বলছে তাও আবার ঝুকুকে সাপোর্ট করে বাবুদার সামনে। তুমি দেখালে, শিবু।

শিবনাথ মাথা নিচু করে লাফিয়ে দোকানে উঠে পড়ল। বসতে গিয়ে টের পেল, তার পাছা একদম কাঠের ওপর ঠেকছে। মাঝখানে কাপড়ের আড়ালটা নেই। ছোট-মেয়েদুটো উঠে বসে পিটির-পিটির করে তার দিকে দেখছে, বড়টা খ্যানখেনিয়ে বলল, তোমাকে মারল তুমি কিছু বললে না শালাদের।

সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় রক্ত চড়ে গেল শিবনাথের, ওইটুকুনি পুঁচকে মেয়ে মায়ের প্রশ্রয়ে কোথায় উঠেছে। গম্ভীর হয়ে ইঙ্গিত করে কাছে ডাকল ওকে শিবনাথ। বাপ কোনওদিন এভাবে ডাকে না, কিন্তু একটা গোলমাল আঁচ করে মেয়েটা কাছে এল না, দূরে দাঁড়িয়ে বলল, কী বলছ?

রাগটা শিবনাথের দাঁত গলে বেরিয়ে এল, ফের মুখ খারাপ করলে মেরে হাড় ভেঙে দেব। হারামজাদী। সঙ্গে-সঙ্গে শিবনাথ অবাক হয়ে শুনল দুটো কচি গলা তোতাপাখির মতো আওড়াচ্ছে, হারামজাদী, হারামজাদী।

চিৎকারটা হঠাৎই শুরু হয়ে গেল। বিড়ি বাঁধতে-বাঁধতে সময়টা খেয়াল ছিল না শিবনাথের কিন্তু গঙ্গার গলাটা কানে যেতেই সোজা হয়ে বসল। দ্রুত চিৎকারটা দোকানের দিকে আসছে, কি মতিচ্ছন্ন রে, আমাকে সাত তাড়াতাড়ি বিধবা করানোর মতলব রয়েছে, হারামজাদার। আবার কুঁজো হল শিবনাথ, হাত চালাতে-চালাতে বুঝতে পারল বড় মেয়েটা শালা আগবাড়িয়ে মাকে রিপোর্ট করেছে। তারপরই গঙ্গার থমথমে মুখ আয়নায় দেখতে পেল সে। সরাসরি দেখার চেয়ে আয়নায় দেখা অনেক ভালো। সুন্দর দেখায়।

তুমি এই গুণ্ডাদের সঙ্গে লড়তে গিয়েছিলে, খুব রস হয়েছে না? দুদণ্ড দোকানে নেই আর আমার পিণ্ডি চটকাবার মতলব গো! কি দরকার ছিল তোমার বলতে যাবার, সবাই ঠুলি পরে ছিল আর তুমি কোথাকার মাতব্বর এলে অ্যা। মেরে ফেলে দিল মাটিতে, লজ্জা করল না? প্রায় হামলে পড়ে গঙ্গা গায়ের ওপর। কোনওরকমে পাশ ফিরে শিবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, মারেনি।

ও বাবা এ যে দেখছি বুলি ফুটেছে গো, মারেনি–প্রেম করেছে।

অ্যাকটিং করছিলাম। শিবনাথ না তাকিয়ে বলে।

কী করছিলে? হাঁ হয়ে যায় গঙ্গা।

ওমা! কি মিথ্যেবাদী গো। গায়ে এক বিন্দু ক্ষ্যামতা নেই আবার মিথ্যে কথা বলে। হারামজাদা মিনসে আমার ঠিক সর্বনাশ করবে একদিন। বাপ মা কেন গেঁজেলটার সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল রে। চিক্কারটা কতক্ষণ চলত ঠিক নেই কিন্তু হরেকেষ্ট গঙ্গাকে এই সময় ডাকল, ও শিবুর বউ, অত রাগ করে না।

কি বলো হরেদা, আমার কপাল পুড়বে আমি দেখব বসে-বসে, অ্যাঁ?

কিন্তু এসব কথা এত জোরে-জোরে কেউ বলে? নাও, সকাল থেকে চা খাওনি, এই গেলাসটা ধরো।

গজগজ করতে লাগল গঙ্গা, এত করে বলেছি, কারোর সঙ্গে কথা বলবে না, হাড় জ্বালিয়ে খেল। চা খেয়েছ?

ঘাড় নাড়ল শিবনাথ। গঙ্গা বলল, তাতেই এত! হরেদাদুটো চা দাও।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল শিবনাথ, আমি খাব না।

কেন?

ইচ্ছে নেই। শালা কোন ব্যাটাচ্ছেলে সংসার করে? স্তূপ করে রাখা চাদর দুটো টেনে বগলে নিয়ে শিবনাথ দোকান ছেড়ে দুপ-দুপ করে নেমে এল। শ্যাম পার্কে সারাদিন এখানে-ওখানে ছায়া থাকে। এক ছিলিম খেয়ে যদি শুয়ে পড়া যায়, ব্যস দিনটা কেটে যাবে।

গঙ্গা ওর চলে যাওয়া শরীরের পিছনটা দেখে খানিকক্ষণ চোখ বড় করে থেকে বলল, বয়েই গেল।

গাঁজার আড্ডায় পুলিশ হামলা করে তিনজনকে তুলে নিয়ে গেল। রাত্রে শ্যাম পার্ক থেকে উঠে সেখানে গিয়ে খবরটা পেল শিবনাথ। সকালে যখন খেয়ে গেল তখন এসবের আঁচ পায়নি। সারাদিন না খেয়ে এখন গাঁজা না পেয়ে শালা পেটের ভেতরটা প্রাইভেট বাস হয়ে গেছে। এই প্রচণ্ড খিদের সময় ট্যাঁকে একটা পয়সাও নেই। শিবনাথের হঠাৎ খেয়াল হল যে দোকানটা তার। গঙ্গা পরের বাড়ির মেয়ে। দোকান থেকে কয়েকটা টাকা যদি সে গিয়ে নিয়ে আসে কারোর চৌদ্দ পুরুষের তাতে কিছু বলার নেই।

কাছাকাছি হতে শিবনাথ থমকে দাঁড়াল, কোথায় গেলি রে তোরা, নিমতলায় না ক্যাওড়াতলায়? না তাকে নয়, মেয়েগুলোকে খেতে ডাকছে গঙ্গা। সে যে সারাদিন নেই তাতে কিছু এসে যায় না। দূর থেকে মেয়ে তিনটেকে দেখতে পেল, দোকানের ভিতর পাট হয়ে ঘুমুচ্ছে। ওকে দেখতে। পেয়ে গঙ্গা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াল, তারপর বলল, ভাত আর পোস্ত আছে, গিলবে তো গেলো।

দোকানের তলায় গঙ্গার রান্নাঘর। সেদিকে তাকিয়ে শিবনাথ কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় হাউমাউ করে একটা কান্না শুরু হল। এখন রাত বেশ হয়েছে তবে নাইট শো ভাঙেনি। আশেপাশের দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় আলো কম। শুধু তাদের দোকানের আলোটাই চোখে পড়ে। শিবনাথ দেখল ঝুকু টলতে-টলতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ওর শরীরের চাপে আর কান্নার দমকে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। সেইরকম গলায় ঝুকু বলল, তুমি মাইরি আমার গুরু। এই বস্তির সব শালা মাইরি হিজড়ে, কারোর হিম্মত নেই, সত্যি কথা বলার। তুমি মাইরি, শিবুদা, দেখিয়ে দিলে মরদ কাকে বলে।

কোনওরকমে শিবনাথ বললে, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

না মাইরি, ঠিক নেই। তোমাকে প্রণাম করতে আমি লাইফ রিস্ক করে ছুটে এসেছি। শালা বাবুদা আমাকে খতম করতে চায়, আমিও শালা সঙ্গে মাল রেখেছি তাই, বদলা হয়ে যাবে। শিবনাথ। দেখল ঝুকুর হাতে একটা বড় ছোরা চকচক করছে। গঙ্গা এতক্ষণ কথা বলেনি, শিবনাথ আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল গঙ্গা তাকে ইঙ্গিতে চুপ করে থাকতে বলছে। ঝুকু বলল, কই গুরু, তোমার পা কোথায়, প্রণাম করব। মানুষের বাচ্চা তুমি, পা-টা দাও। ঝুঁকে তার পা ছুঁতে গিয়ে কাণ্ডটা হয়ে গেল। টাল রাখতে না পেরে ঝুকু উলটে পড়তে-পড়তে গঙ্গার সঙ্গে ধাক্কা খেল। গঙ্গা। আঁতকে উঠে চিৎকার করতেই ঝুকু দাঁড়াতে গিয়ে একটা কিছু অবলম্বন ধরতে চেয়ে গঙ্গার শাড়ি ধরে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে মাথায় রক্ত উঠে গেল শিবনাথের। গঙ্গা কাপড় বাঁচিয়ে চেঁচাচ্ছে সমানে। দৌড়ে গিয়ে দুমদাম লাথি মারল শিবনাথ ঝুকুর পিঠে। ঝুকু কোনওরকমে মুখ তুলে কে মারছে দেখতে চেষ্টা করলে ও হেঁচকা টানে ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল।

সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সমস্ত শক্তি দিয়ে শিবনাথ ঝুকুর গালে একটা চড় মেরে ফিসফিস করে বলল, যা পালা।

ঝুকুর এক হাতে তখনও ছোরাটা ধরা। সেদিকে একবার তাকিয়ে সে মাথা ঝাঁকিয়ে থু-থু করে থুতু ফেলে শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, যাক, প্রণামটা হয়ে গেল। বলে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল টলতে-টলতে।

এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল একটা লোকও কাছে এল না। হরেদার দোকান বন্ধ কিন্তু ফুটপাথ জুড়ে সবাই ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। শিবনাথের শরীর উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। পেটের ভিতর ব্যথা-ব্যথা লাগছিল। উত্তেজিত হলেই এটা হয়। লুঙ্গিটা ভাঁজ করে হাঁটু থেকে কোমরে এনেছে তবু ঝুকুটা পা খুঁজে পেল না, আশ্চর্য।

দোকানের ওপর জিনিসপত্র সরিয়ে খাওয়া-দাওয়া হয়। খিদের জ্বালায় অনেকটা ভাত সাঁটিয়ে কিছুটা তৃপ্তি হল শিবনাথের। ঝুকুটাকে মারা ঠিক হয়নি। আজ অবধি কাউকে মারেনি ও, . আয়নায় একটা রোগা পাঁজর বের করা খোঁচা দাড়ি আর না-ধোয়া জটা চুলের একটা মানুষের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাল সে।

মেয়েদের মুখে প্রায় ঠেসে খাবার পুরে গঙ্গা খাওয়াচ্ছিল। শিবনাথকে বালিশ চাদর বগলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, দাঁড়াও, দরকার আছে। শিবনাথ কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু গঙ্গাকে একটু অন্যরকম লাগছে এখন। ঝুকু চলে যাওয়ার পর একটি বাক্য মুখ থেকে বের হয়নি। এখন এই বলাটার মধ্যে চিৎকার নেই। আজ শালা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। খাওয়া শেষ করে গঙ্গা যখন মেঝেমুছছিল তখন শিবনাথের সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মেয়ে তিনটে ঘামে জবজব করছে, গরমে ঘামাচি বেরিয়ে গেছে গায়ে, তবু ঘুমের কোনও ব্যাঘাত নেই এদের।

নাইট শো ভাঙল। রিকশার ভিড় হঠাৎ শুরু হয়ে গেল। খানিক বাদেই চারধার আবার নিঝুম হয়ে যাবে। এই ক্যাচক্যাচ না থেমে গেলে ফুটে শুয়ে ঘুম আসবে না কিছুতেই।

অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শিবনাথ হঠাৎ কনুইয়ের ওপরে হাতে কিছু একটা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল। ও দেখল গঙ্গা ওর হাতে একটা লাল সুতো বাঁধছে, সুতোর মাঝখানে একটা ছোট্ট কিছু বাঁধা।

এটা কী? খিঁচিয়ে উঠল শিবনাথ।

মায়ের তাগা।

সেই সক্কালবেলায় গেলাম না স্নান করে নিয়ে এসেছি। ভীষণ জাগ্রত।

আদুরে-আদুরে ভঙ্গি নিয়ে বলল গঙ্গা।

হারামজাদা, জানোয়ার, শুয়োরের বাচ্চা। গালাগালগুলো স্মরণ করে গঙ্গার মুখের দিকে তাকাল শিবনাথ। ঝুকুর ওপর হাত-পা চালানোর পর থেকে মনে বেশ আত্মবিশ্বাস এসে গিয়েছে। একটু ওলটপালট করেছ কি আজ ছেড়ে কথা নেহি বোলে-গা। গঙ্গার বাঁধা শেষ হলে ঝট করে উঠে। দাঁড়াল শিবনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে গঙ্গা বলল, থাক আজকে আর ফুটে শুতে হবে না।

কেন? মেঘ নেই আকাশে, শোব না কেন? গঙ্গা সরে না গেলে দোকান থেকে নামতে পারছে না শিবনাথ।

মায়ের এই তাগাটা যে রাত্রে বাঁধে সে রাত্রে আলাদা শুতে নেই। আজ দিনটাও ভালো। বেড়ালের মতো ভঙ্গি গঙ্গার।

কী পিণ্ডি হবে এতে? ঠিক বুঝতে পারছিল না শিবনাথ।

পুত্র হবে। গঙ্গা হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, আমার কি, এই তিনটে নিয়ে হাড়ভাজা হয়ে গেছি! তবু বাপের পিণ্ডি দেবার জন্যে একটা ছেলেও থাকবে না–তাই সাত সকালে স্নান করে নিয়ে এলাম। তাগাটা।

পাদুটো হঠাৎ ভারী হয়ে গেল শিবনাথের। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে-ধীরে সে উচ্চারণ করল, সেটাও তো জানোয়ার, হারামজাদা হবে।

গঙ্গা বলল, জানিই তো।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *