পেছনের গাড়িটার খুব বেশি দোষ ছিল না। বেশ কয়েকবার হেডলাইট জ্বালিয়ে নিবিয়ে সিগন্যাল দিয়েছে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তবু সামনের ফিয়াট গাড়িটা হেলতে-দুলতে চলেছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। যেন ওদের পেরিয়ে আর কোনও গাড়ির যাওয়ার অধিকার নেই।
আলো ফেললে দেখা যাচ্ছে, ফিয়াট গাড়িটায় রয়েছে দুজন। এক পুরুষ ও এক মহিলা, দুজনেই মাথা ঝাঁকাচ্ছে মাঝে-মাঝে, যেন খুব হাসাহাসিতে ব্যস্ত। সন্ধে হয়ে এসেছে, জঙ্গলের রাস্তা, এই রাস্তায় সকলেই ব্যস্ত থাকে, শুধু গাড়িটার কোনও তাড়া নেই মনে হয়।
পেছনের জিপ গাড়িটা এক জায়গায় রাস্তাটা একটু চওড়া পেয়ে জোর হর্ন দিয়ে ওভারটেক করতে গেল। ফিয়াট গাড়িটা যেন কোনও অপটু ড্রাইভার চালাচ্ছে, বাঁ-দিকে যথেষ্ট জায়গা থাকতেও সে কেন যেন ডান দিকে চলে আসতে চাইল। তার পেছনের জিপটার সঙ্গে ধাক্কা খাবার ঠিক আগের মুহূর্তে সে হঠাৎ এমন সাপটে বাঁ-দিকে ঘোরালো যে আর তাল সামলাতে পারল না। রাস্তা ছেড়ে বাঁ-দিকের ঢালু দিয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল নীচে।
জিপটা তীব্র ব্রেক কষে থামিয়ে দিয়ে দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে তার ড্রাইভার বলল, কী হল? কোন উল্লুকের বাচ্চা চালাচ্ছে ওই গাড়িটা?
জিপে চার-পাঁচ জন লোক। তাদের মুখগুলি উদগ্রীব। তারা রাস্তার বদলে ঘর-বাড়ি ভালোবাসে, তারা থামতে চায় না। তারা পৌঁছতে চায়।
ড্রাইভারের পাশের লোকটি বলল, তুই ওকে টাচ করেছিস, টের পেলাম না তো। ড্রাইভার জোর দিয়ে বলল, মোটেই না। আমার গাড়ি ওই ফিয়াট একটুও টাচ করেনি। আমার ডান দিকে গাছ, আর একটু হলে আমারই অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত!
পাশের লোকটি বলল, নিশ্চয় ড্রাংক! নবাবের মতন সারা রাস্তা জুড়ে গাড়ি চালাচ্ছে!
পেছন থেকে একজন বলল, একবার নেমে দেখবে নাকি ওদের কী হল?
ড্রাইভারের পাশের লোকটি দলপতি। সে বলল, আমাদের কী দায় পড়েছে? আমাদের কোনও দোষ নেই। কিন্তু তুই ওদের সঙ্গে কথা বলতে যা, অমনি ওরা বলবে, আমরাই ওভার টেক করতে গিয়ে ওদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি!
পেছন থেকে আর-একজন বলল, রাস্তাটা এখানে বেশ উঁচু। দুপাশ ঢালু হয়ে অনেকখানি নেমে গেছে। ঠিক মতন হ্যান্ড ব্রেক না দিতে পারলে গড়িয়ে পড়ে যাবে!
দলপতি বলল আমাদের ওসব ঝুটঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী? শুধু-শুধু ফেঁসে যাব! তা ছাড়া আটটার মধ্যে না পৌঁছতে পারলে…চল। সুধীর চল…
ড্রাইভার আবার স্টার্ট দিল। জিপ গাড়িটা হুশ করে মিলিয়ে গেল সামনের অন্ধকারে।
ফিয়াট গাড়িটা গড়াতে-গড়াতে চলছে, প্রথমে স্টিয়ারিং-এ কপাল ঠুকে যাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গেছে অবনী। আর ভয়ে চিৎকার করছে কেতকী। তার প্রসাধন চর্চিত সুন্দর মুখখানি এখন আতঙ্কে বীভৎস, সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মৃত্যু। পাহাড়ি রাস্তা নয়। এ-গাড়ি যেন। নেমে যাচ্ছে নরকে।
একটা মহুয়া গাছে ধাক্কা লেগে গাড়িটা থামল। ঝনঝন করে ভেঙে গেল হেড লাইটের কাচ। রেডিয়েটার ফুটো হয়ে ঝরঝর করে পড়তে লাগল জল, কেতকীও চেতনা হারিয়েছে।
কিছুক্ষণ বাদে কেতকীরই আগে জ্ঞান ফিরে এল। প্রথমেই তার মনে হল সে কি মরে গেছে? এই কী মৃত্যু! খুব বেশি যন্ত্রণা হল না তো! তারপর সে হাত বুলিয়ে দেখল, তার নাক-চোখ-চিবুক কিছুই নষ্ট হয়নি। পাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, স্টিয়ারিং-এর ওপর এলিয়ে পড়ে আছে অবনী। তবে কি অবনী বেঁচে নেই! অবনীর গায়ে হাত ছোঁয়াতে গিয়েই কেতকী দেখতে পেল, ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছেদুজন লোক। লুঙ্গি পরা, খালি গা।
আবার বুকটা ধক করে উঠল কেতকীর। মুসলমান! গুণ্ডা! ওরা খুন করবে, তার আগে রেপ করবে!
সে পাগলের মতন অবনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেলতে-ঠেলতে চ্যাঁচাতে লাগল, অবনী, শিগগির ওঠো, মরে যাব, আমরা মরে যাব, ওঠো…
অবনীর শরীর নিথর। সেই অবস্থাতেও কেতকী দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। অবনী সঙ্গে একটা রিভলভার রাখে, সেটা কোথায়, ড্যাসবোর্ডে না অবনীর পকেটে? সে রিভলভার চালাতে জানে না, তবু সেটা পেলে ওদের ভয় দেখাতে পারত।
এবারে বাইরের লোক দুটির পাশে এসে দাঁড়াল একজন স্ত্রী লোক। সে জিগ্যেস করল, কী হল, বেঁচে আছে?
স্ত্রী লোকটিকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে চিৎকার থামাল কেতকী। তার খটকা লেগেছে ডাকাত দলের সঙ্গে কি স্ত্রীলোক থাকে?
গাড়িটা কাত হয়ে গিয়েছিল, বাইরের তিনজন প্রাণপনে ঠেলে সেটা সোজা করে। একটা দরজা খুলে ফেলল। একজন পাঁজা কোলা করে অবনীকে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিল ঘাসের ওপর।
কেতকী এসব দেখে দৌড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল অবনীর বুকের কাছে। হ্যাঁ। অবনীর নিশ্বাস ঠিকই পড়ছে। কপালটা ফুলে গেছে তার। এছাড়া শরীরে আর কোনও ক্ষত নেই। খুব গোপনে কেতকী অবনীর প্যান্টের পকেট ও কোমর হাতড়েও দেখে নিল, না, রিভলভারটা অবনীর সঙ্গে নেই।
একজন পুরুষ বলল, অজ্ঞান হয়ে গেছে গো! চোখে মুখে পানি দিতে হবে!
স্ত্রীলোকটি বলল, আমাদের ঘরে নিয়ে চলো। এসো গো বউদি!
মাত্র শ-দুয়েক গজ দূরেই একটা ছোট গ্রামের মতন। কাছাকাছি চার-পাঁচখানা ঘর, সামনে একটা ডোবা একটি গরুর গোয়াল। দুজন লোক ধরাধরি করে এনে অবনীকে শুইয়ে দিল। উঠোনে পাতা খাঁটিয়ার ওপর। স্ত্রী লোকটি একটা চকচকে পেতলের ঘটি ভরতি জল এনে কেতকীকে বলল। দাও গো বউদি। তুমি ভালো করে পানি ছিটিয়ে দাও!
স্ত্রী লোকটি কেতকীর চেয়ে বয়েসে ঢের বড়। তবু সে বিশেষ ভূমিকায় কেতকীকে বউদি সম্বোধন করতে শুরু করেছে। অবনীর মাথায় ও চোখে এক ঘটি জল ঢেলে দেওয়ার পরেও কেতকী ওর। জামার বোতাম খুলে ওকে জলের ঝাপটা দিতে লাগল। তবু অবনীর জ্ঞান ফিরল না। কেতকীর খুব অসহায় লাগছে। এরা কেমন লোক এখনও বোঝা যাচ্ছে না। পুরুষগুলো প্যাট-প্যাট করে তাকিয়ে আছে তার শরীরের দিকে। অবনীর জ্ঞান না ফিরলে সে তো কিছুই করতে পারবে না।
একজন বলল একটু গরম দুধ খাওয়ালে কাজ হত না?
সঙ্গে-সঙ্গে আরও দু-তিনজন বলে উঠল, গরম দুধ, গরম দুধ খাওয়াও!
গোয়াল ঘর থেকে একজন একটা গাভীকে নিয়ে এল বাইরে। আকাশে খানিকটা জ্যোৎস্না উঠেছে। সব কিছুই এখন ছায়া-ছায়া দেখায়।
চ্যাঁ-চোঁ শব্দে দুধ দোওয়া হতে লাগল। কেতকী অনেকদিন এরকম দুধ দোওয়া দেখেনি। দুধ। দুইছে স্ত্রী লোকটি। এই উঠানেরই এক কোণে জ্বলছে একটা কাঠের উনুন। এদের বুঝি রান্না ঘর নেই? বৃষ্টি হলে কী করে? একটা ছোট ডেকচির অর্ধেকটা দুধে ভরে গেলে স্ত্রীলোকটি সেটাকে বসিয়ে দিল উনুনে।
কেতকী দ্রুত অনেক কিছু চিন্তা করে যাচ্ছে। অবনী আসার পথে অনেকটা হুইস্কি খেয়েছে। বোতল থেকে নিট, এর পর দুধ খাওয়া কি ঠিক হবে? হুইস্কির পর দুধ কি চলে? বমি হয়ে যাবে না? দেখাই যাক না, বমি হলেও হয়তো তাতে খানিকটা উপকার হবে।
এরা দুধ দুয়েই সঙ্গে-সঙ্গে উনুনে চড়িয়ে দিল! জল মেশাল না? জল না মেশানো খাঁটি দুধ কেউ খায় পৃথিবীতে? কেতকীর মনে পড়ল, ছেলেবেলায় সে তার মাকে দেখেছে, উনুনে দুধ গরম করার সময় মা নিজেই খানিকটা জল মিশিয়ে দিত। সবাইকে একটু-একটু দুধ দিতে গেলে জল মেশালে কুলোত না তার সঙ্গে গোয়ালারাও নিশ্চয়ই জল মেশাত।
জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম হলেও এদের কাছে কাচের গ্লাস আছে। একটা গ্লাস দুধে ভরতি করে, গরম হওয়ার জন্য সেটা একা ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে এনে স্ত্রীলোকটি বলল, একটু-একটু করে খাইয়ে দাও গো বউদি। আমি বাবুর মাথাটা তুলে ধরছি।
অবনীয় গায়ে ছোট-ছোট চড় মেরে, তার ঠোঁট জোর করে ফাঁক করিয়ে দিয়ে তাতে খানিকটা গরম দুধ ঢালতেই অবনী ছটফটিয়ে উঠল। চোখ মেলে বলল, আরে কী হচ্ছে? এটা কী?
কেতকী বলল, সব ঠিক হয়ে গেছে। তুমি দুধটা খেয়ে নাও!
তারপর সে যোগ করল, একদম খাঁটি দুধ। এইমাত্র দেওয়া হল!
অবনী চারপাশটা চোখ বুলিয়ে জিগ্যেস করল, কেতকী, কী হয়েছে?
কেতকী বলল, গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। মনে নেই? বেশি কিছু ক্ষতি হয়নি। এখন কেমন লাগছে?
অবনী দু-তিন ঢোঁক দুধ খেল। তার বমি হল না বটে, কিন্তু এরপর হাত দিয়ে গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে বলল, আর না।
ধপাশ করে সে শুয়ে পড়ল আবার।
গ্লাসের বাকি দুধটা ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না কেতকীর। এঁটো দুধ, ওরা নিশ্চয়ই ফেলে দেবে। সে নিজেই একটু-একটু চুমুক দিতে লাগল। খাঁটি দুধের এরকম স্বাদ? এরকম দুধ সে জীবনে খায়নি।
অবনী আবার চোখ বুজেছে। খানিক বাদেই তার একটু-একটু নাক ডাকতে লাগল।
আরও কয়েকবার তাকে ঠ্যালাঠেলি করল কেতকী। অবনীর কোনও সাড়া নেই। এটা নেশার ঘুম। ওরকম ভাবে কাঁচা হুইস্কি খেতে কতবার বারণ করেছিল কেতকী। অবনী গর্ব করে। বলেছিল, সে কক্ষনো আউট হয় না।
কেতকী দুর্বল গলায় জিগ্যেস করল, কাছাকাছি কোনও ডাক্তারখানা আছে?
একজন বলল, এখানে তো ডাক্তার নেই, সেই শহরে যেতে হবে।
আর-একজন বলল, একটু ঘুমিয়ে নিতে দাও না। ঠিক হয়ে যাবে।
যার নাক ডাকে, সে তো গুরুতর অসুস্থ নয়। তা গ্রামের লোকেও বোঝে। কেতকীরও খুব ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু সে তো এতগুলো চোখের সামনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে না।
ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে তাদের ঘিরে। কেতকী ওদের সঙ্গে কথা বলছে টুকিটাকি। এটা একটা মুসলমান গোয়ালাদের গ্রাম। দুধ বিক্রিই জীবিকা। তবে দুধ নিয়ে এদের শহরে যেতে হয় না। প্রতিদিন সকালে পাইকার এসে এদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। সব মিশিয়ে মোট আটটি পরিবার। কিছু চাষের জমিও আছে।
কয়েকটি অল্প বয়েসি মেয়ে একেবারে কাছে এসে পড়ল কেতকীর। কেতকীর দুকানে নকল হিরের দুল, আংটিতে ঝুটো মুক্তো, রোল্ড গোল্ডের ব্যান্ডের ঘড়ি, সেইসব ওরা অবাক হয়ে দেখছে।
একজন বলল, বাবু আর দিদিমণিটা দুজনেই দেখতে কী সুন্দর! কেমন মানিয়েছে দ্যাখ। সিনেমার মতো!
আর একজন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কতদিন বিয়ে হয়েছে গো?
একটু দ্বিধা করে কেতকী বলল, আড়াই বছর!
–ছেলেমেয়ে হয়নি?
কেতকী হেসে বলল, না!
বয়স্কা স্ত্রী লোকটি এসে অন্যদের তাড়া দিয়ে বলল এই যা, যা, ওনাদের একটু বিশ্রাম নিতে দে! আল্লার দয়ায় বেঁচে গেছে।
তারপর সে খানিকটা কুণ্ঠিতভাবে বলল, বউদি, তোমার খিদে পায়নি? রাত তো বাড়ছে। আমরা অল্পরাতে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ি। খুব সকাল-সকাল উঠতে হয় তো। তোমাকে কী খেতে দিই, ভাত তো খাবে না।
কেতকী জিগ্যেস করল, তোমরা রাত্রে কী খাও?
স্ত্রীলোকটি বলল, আমরা তো এখন ভাত বানব, খাব। কিন্তু তোমরা…ঘরে তো চিড়ে-মুড়ি কিছু নাই আর।
কেতকী ক্ষীণভাবে হাসল। এরা কী ভাবছে, এরা মুসলমান বলে কেতকীরা এদের হাতের ভাত খাবে না? অবনীর বাড়ির বাবুর্চি মুসলমান। স্টুডিওর অধিকাংশ কর্মীই মুসলমান। ওসব জায়গায় যাওয়ার সময় কে হিন্দু, কে মুসলমান মনেই থাকে না। গ্রামে বোধহয় এইসব তফাত এখনও চলে।
এখন ভাত খাবার একটুও ইচ্ছে নেই। কোনওক্রমে এখান থেকে চলে যেতে পারলে হয়।
ভয় আর লাগছে না বটে, অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু যাওয়া হবে কী করে? অবনীর স্বভাব সে জানে, নেশার ঝোঁকে একবার অজ্ঞান হলে, দু-তিন ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফিরবে না। আশ্চর্য নেশা, এতবড় একটা কাণ্ডের পরও কেউ ঘুমোতে পারে? অবনীনা জাগলে গাড়িটার কী অবস্থা হয়েছে, তাও বোঝা যাচ্ছে না।
ভাত খেতে আপত্তি করলে এরা ভাববে কেতকী মুসলমানের হাতের ছোঁয়া খায় না। কী জ্বালা, এরা এত ভালো ব্যবহার করছে। কেতকী কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাত খাব না কেন?
স্ত্রীলোকটি বিস্মিত-খুশির সঙ্গে বলল, খাবে? ভাত খাবে? চল এনে দিই, তুমি নিজেই ফুটিয়ে নাও তবে!
কেতকী বলল, আলাদা রাঁধতে হবে কেন? একসঙ্গেই করে নাও, তোমাদের থেকেই একটু দিও।
আমাদের পেঁকি ছাঁটা চাল, একটু লাল হয়, মোটা খেতে পারবে তো?
চেঁকি ছাঁটা চাল তো খুব ভালো।
পাশ থেকে একজন পুরুষ বলল ভাত তো খেতে বললে, খাবে কী দিয়ে? ওবেলার ডাল আর সবজি। সে কি ওনারা খেতে পারবেন?
স্ত্রীলোকটি ঝংকার দিয়ে বলল, পুকুরে একবার জাল ফেলে দ্যাখ না, যদি দুটো মাছ পাস। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিস কী? কত রাত হল খেয়াল আছে?
কেতকী বারণ করতে গেল, কিন্তু কেউ কর্ণপাত করল না, দু-তিনজন হইহই করে চলে গেল।
হঠাৎ বেশ জ্যোৎস্না উঠে গেছে। একেবারে অচেনা জায়গায়, এতগুলো মানুষের মধ্যে কেতকী কখনও বসে থাকেনি। তার খাঁটিয়ার চারপাশে বসে পড়েছে অনেকগুলো বাচ্চা এখন তারা কেউ কেতকীর হাত ধরেছে, কেউ তার হাত ধরে শাড়িটায় হাত বুলিয়ে দেখছে। তাদের গ্রামে এরকম মানুষ কখনও আসে না, তারা তাই একটা মজার খেলা পেয়েছে। শবনম নামে একটি কিশোরী। নানা প্রশ্ন করতে লাগল কেতকীকে। শহর সম্পর্কে তার দারুণ কৌতূহল। মেয়েটির মুখের গড়ন। অনেকটা পান পাতার মতন বেশ সুশ্রী, ঠিক মতন সাজগোজ করালে একে খুবই সুন্দর দেখাবে।
পুকুরের পাড়ে একটা বেশ আনন্দ কলরব শোনা গেল। শবনম কেতকীর হাত ধরে টেনে বলল মাছ উঠেছে। চল দেখতে যাবে! এসো না!
কেতকী উঠে গেল ওদের সঙ্গে। অবনীর নাম ডাকা থেমে গেছে সে কি চোখ বুজে সব শুনছে?
একটা মাঝারি আকারের রুই মাছ ধরা পড়েছে! পুকুরটার চেহারা দেখলে মনেই হয় না যে এখানে এরকম মাছ থাকতে পারে। ছেলে-মেয়েদের চ্যাঁচামেচি শুনে বোঝা যায় যে এরকম মাছ ধরার ঘটনা খুবই বিরল। বিশেষ বিশেষ উৎসবেই হয়। কেতকীরা এসেছে বলে আজ এলাকার ছেলেমেয়েরাও একটুকরো মাছ খেতে পাবে।
রান্না হয়ে গেল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। গরম ভাত, গরম মুসুরির ডাল আর পাতলা মাছের ঝোল। অবনীকে দু-একবার ডাকতেই সে উঠে পড়ল। তার কপালই ফুলে আছে এখনও, চোখও লাল।
খাঁটিয়ার ওপরে বসেই খাওয়া। ভাতের থালা ওদের দুজনের হাতে তুলে দেওয়ার পর বয়স্কা মহিলাটি শবনম-এর কানে-কানে কী যেন বলল। সে ছুটে গিয়ে নিয়ে এল একটা টিনের কৌটো। তার থেকে কয়েক চামচ ঘি তুলে দেওয়া হল ওদের পাতে। টাটকা ঘিয়ের গন্ধে আমোদিত হয়ে গেল হাওয়া।
প্রায় রাত্রেই অবনীর কিছু খাওয়া হয় না। আজ সে তৃপ্তি করে খেল। চর্বি কমাবার জন্য সে সপ্তাহে একদিন মাত্র কয়েক চামচ ভাত খায়, আজ সে ভাত চেয়ে নিল এবং দ্বিতীয়বার ঘি নিতেও সে আপত্তি করল না।
খেয়ে উঠে হাত ধোওয়ার পর সে নিজে একটি সিগারেট ধরিয়ে তার প্যাকেট থেকে উদার হস্তে অন্যদের সিগারেট বিলিয়ে দিল। তারপর বলল। তোমরা ভাই অনেক উপকার করলে। এখন। একটু গাড়িটায় হাত লাগাবে?
একটা বেশ বড় দল নিয়ে সে গেল গাড়িটার কাছে। গাড়িটার ইঞ্জিন চালু করতে কোনও অসুবিধে হল না। গাড়িতে একটা সাবান ছিল, সেটা দিয়ে কোনওক্রমে আটকানো হল রেডিয়েটারের ফুটো। হেডলাইট ছাড়াই কাজ চলে যাবে।
কেতকী এসে বসল গাড়িতে। জানলার ধারে ব্যাকুল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে শবনম আর অন্যান্য বাচ্চারা। অবনী ঘড়ি দেখল। মাত্র সাড়ে নটা। এ রাস্তা দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত গাড়ি চলে, ভয়ের কিছু নেই।
গাড়ি থেকে খানিকটা সরে এসে সে মানিব্যাগটা বার করে প্রথমে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট দু আঙুলে তুলে একটু দ্বিধা করল। তারপর একটা রেখে দিয়ে বাকিটা তুলে সে মুরুব্বি জাতীয়। একজনের কাঁধ ধরে বলল, ভাই তোমরা যা উপকার করলে…কী আর বলব…এই সামান্য কিছু…
লোকটি জিভ কেটে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, না, না, এ কী বলছেন বাবু…আপনারা আমাদের মেহমান, এখন রমজান মাস…
অবনী খানিকটা পিড়াপিড়ি করলে, লোকটি প্রবল মাথা নেড়ে আপত্তি জানাতে লাগল। এরপর আর কিছু করা যায় না, ব্যাগটা পকেটে ভরে ফেলল অবনী।
ওপরের দিকে খাড়াভাবে রাস্তায় ওঠা যাবে না, পাশ দিয়ে-দিয়ে যেতে হবে খানিকটা। সেই রাস্তা ওরাই এগিয়ে দিল। গাড়ি চলার পর সঙ্গে-সঙ্গে কিছুক্ষণ দৌড়ে এল বাচ্চারা।
ওপরের রাস্তায় উঠে স্বাচ্ছন্দে গাড়ি চলার পর একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল অবনী। কেতকীর সাংঘাতিক বিপদ হয়ে যেতে পারত আজ, কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই হল না। কেতকীকে নিয়ে সারারাত বাড়ির বাইরে থাকতে হলেই তো একটা কেলেংকারি হয়ে যেত। নিজের স্ত্রীর কাছে কী জবাবদিহি করত অবনী? আর আহত হয়ে দুজনে একসঙ্গে যদি ভরতি হত হাসপাতালে, তাহলে সে খবর ছাপা হয়ে যেত অনেক কাগজে।
আর-একটি সিগারেট ধরিয়ে অবনী বলল, বেশ লোকগুলো তাই না? সরল, হসপিটেবল। কেতকী জিগ্যেস করল, তুমি ওদের কিছু দিলে তো?
ধোঁয়া ছেড়ে অবনী বলল, দিতে চাইলুম তো, নিল না কিছুতেই। অবশ্য বাচ্চাগুলোকে মিষ্টি খাবার জন্য কিছু দিয়ে এলে হত!
কেতকী বলল, ইস, ওখানে একটি মেয়ের আমার হাতের চুড়িগুলো খুব পছন্দ হয়েছিল। এগুলোর এমন কিছু তো দাম নয়। ওকে দিয়ে দিলে পারতুম, তখন মনে পড়ল না। চল, একটু ফিরে যাবে?
পাগল নাকি? এখন আবার অতটা নীচে নামা যায়? অনেক দেরি হয়ে যাবে না? জোরে চালিয়ে গেলে বারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব!
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কেতকী বলল, আজ যা ঘি খেলাম, এরকম ঘি জীবনে খাইনি বোধহয়। এত সুন্দর গন্ধ!
অবনী বলল, খাঁটি ঘি, তবে বিক্রি করার আগে নিশ্চয়ই ভ্যাজাল মেশায়। এরকম খাঁটি জিনিস কেউ বাজারে ছাড়ে না আজকাল। লোকে স্বাদই বুঝবে না।
দুধটাও এত ভালো। সদ্য দোওয়া দুধ।
গয়লাপাড়া তো। এ দুধও যখন শহরে যায়, তখন আর এতটা খাঁটি থাকে না। মাছটারও কি ফাস্টক্লাস টেস্ট ছিল। একেবারে সদ্য-সদ্য পুকুর থেকে ধরা…অপূর্ব, তাই না? কোথায় আক্সিডেন্টে মারা যেতে বসেছিলুম, তার বদলে এমন সব চমৎকার খাবার পেঁকি ছাটা চালের গরম ভাত…। জানো কেতকী, এত টাটকা ভালো খাবার টাটা বিড়লাও খেতে পারে না বোধহয়। শহরে বসে তুমি যত টাকা দামই দাও, এরকম সবকিছু খাঁটি কিছুতেই জোগাড় করতে পারবে
…তারা আমাদের কাছে কোনও পয়সাই নিল না…
হঠাৎ হেঁচকি তুলে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল কেতকী। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়েও অবনী আবার রাস্তার দিকে মন দিল। আর একবার অ্যাক্সিডেন্ট না হয়! মদ খেয়ে সে আর কোনওদিন গাড়ি চালাবে না।
একটু পরে সে একটা হাত বাড়িয়ে কেতকীর পিঠে চাপড় মেরে জিগ্যেস করল, এই কী হল?
কেতকী দুদিকে মাথা ঝাঁকাল শুধু, মুখে কিছু বলল না।
অবনীর মুখে শহুরে সভ্য মানুষের একটা হাসি ফুটে উঠল। সে বুঝেছে। সেন্টিমেন্ট একেবারে বাদ দেওয়া যায় না জীবন থেকে, তবে, একদিন সন্ধেবেলা অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটল বলেই
তো বদলে ফেলা যায় না জীবনটা। মানুষ তার জীবনে যে ফ্রেম তৈরি করে নেয়, তার থেকে নিজেও সে বেরুতে পারে না। এটাকেই বোধহয় নিয়তি বলে। আজকের সন্ধেবেলাটাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে ভুলে যাওয়াই ভালো!
কেতকী বিজ্ঞাপনের মডেলের কাজ করে। আজ বিকেলেই একটা সুটিং ছিল। ক্যামেরার সামনে তাকে যত না বে-আব্রু হতে হয়, তার চেয়েও অনেক বেশি জামাকাপড় খুলতে হয় কয়েকটি বড় বড় ক্লায়েন্টের কাছে। নইলে কেতকীর মতন মেয়ে তো কতই আছে। সবাই কি কাজ পায়?
অবনী একটি বিজ্ঞাপন কোম্পানির ম্যানেজার। বেবিফুড, চুলের তেল, সাবান, ঘি, সিগারেটের। মনোহারি বিজ্ঞাপন তৈরি করা তার কাজ। ওইসব বেবিফুড যে বাচ্চাদের পক্ষে ভালো নয়, ওই সব চুলের তেলে যে চুলের কোনও উপকারই হয় না, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে অবনী কি তা জানে না? তবু কাজ হচ্ছে কাজ, জীবিকা হচ্ছে জীবিকা! এর মধ্যে সেন্টিমেন্টের স্থান নেই।
কেতকীর পিঠে আর-একটা চাপড় মেরে সে হাসতে-হাসতে বলল, আমাদের ওরা স্বামী-স্ত্রী ভেবেছিল, তাই না? আদর্শদম্পতি! হা-হা-হা-হা।
কেতকী মুখটা ফেরাল অবনীর দিকে। গ্লিসারিন না মেখেও তার চোখ দিয়ে বেশ ঝরঝর করে জল পড়ে।