ভেলা-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ভেলা-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বিশশো পঁচাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালে আচমকা কোকিলের ডাক শোনা গেল।

ধরিত্রী তার দুশো তলার ওপরকার ফ্ল্যাটের ঘরদোর পরিষ্কার করছিল। তার হাতে একটা টর্চের মতো ছোট যন্ত্র। সুইচ টিপলে যন্ত্র থেকে একটা অত্যন্ত ফিকে বেগুনি প্রায় অদৃশ্য রশ্মি বেরিয়ে আসে। সেই রশ্মি চারদিকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ফেললেই ঘর পরিষ্কার হয়ে যায়, জীবাণু থাকে না। ঘর জীবাণুমুক্ত করার পর দেওয়ালে একটা সুইচ টিপল ধরিত্রী। কোনও শব্দ হল না, কিন্তু ছাদের গায়ে লাগানো মৌচাকের মতো একটা যন্ত্র জীবন্ত হয়ে উঠল ঠিকই। দুশো তলার ওপরে বদ্ধ ফ্ল্যাটে কোনও ধুলো বালি নেই। তবু ওই যন্ত্রটা তার প্রবল বায়বীয় প্রশ্বাসে ঘরের যাবতীয় সূক্ষ্ম ধুলো ময়লা টেনে নিতে লাগল।

এইসব ঘরের কাজ শেষ করে ধরিত্রী তাদের খাওয়ার ঘরে এল। খাওয়ার ঘরের উত্তরদিকে দুটো দরজা। একটা দরজা ধরিত্রী হাত দিয়ে ছোঁয়ামাত্র সরে গেল দেওয়ালের মধ্যে। ওপাশে অবিরল একটা কনভেয়ার বেল্ট বয়ে যাচ্ছে। খুব ধীর তার গতি। তার ওপর থরেথরে খাবার সাজানো। যা খুশি তুলে নেওয়া যায়। একরাশ ডিম চলে গেল, এক ঢিবি মাখন, কিছু আপেল একটার পর একটা। ধরিত্রী খুব বিরক্তির সঙ্গে চেয়ে রইল। অন্তহীন খাবার বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনওটাই তার ছুঁতে ইচ্ছে করল না। দরজাটা বন্ধ করে সে দ্বিতীয় দরজাটা খুলল। দরজার ওপাশে অগাধ শূন্যতা, দুশো তলার ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত একটা ভারী বাতাস থম ধরে আছে। ধরিত্রী একটু ঝুঁকে চারদিকে তাকাল। জলে যেমন নৌকো ভাসে তেমনি বাতাসে ইতস্তত কিছু ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই বাতাসী ভেলার একটা খুব কাছ দিয়েই ভেসে যাচ্ছিল, তাতে এক বুড়ো হালের মতো একটা যন্ত্রের হাতল ধরে বসে আছে। লোকটা একবার ধরিত্রীর দিকে উদাস চোখে তাকাল। ধরিত্রী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

লোকটা হাতলটায় সামান্য চাপ দিতেই ভেলাটা মুখ ঘুরিয়ে ভেসে এল ধরিত্রীর দিকে। ব্যাটারিচালিত ভেলাটায় কোনও শব্দ নেই। নিঃশব্দে স্থির হয়ে হালকা ধাতুর তৈরি সাদা গোল লাইফ বেল্টের মতো দেখতে যানটি দরজার গায়ে লেগে রইল।

বুড়ো লোকটা কথা বলল না, ধরিত্রীর দিকে চেয়ে একটু হাসল মাত্র। খুব নিরাবেগ হাসি।

ধরিত্রী বলল—আমার কিছু ফুল দরকার। আসল ফুল।

লোকটা মাথা নাড়ল। তারপর একটু ভারী গলায় বলল—কোন ঋতুর ফুল?

ধরিত্রী একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল—এটা তো বসন্তকাল।

লোকটা মাথা নাড়ল—হ্যাঁ।

—তাহলে বসন্তের ফুল। কিন্তু আসল ফুল, সিন্থেটিক নয়।

লোকটা হাসল। মাথা নাড়ল। বলল—আমি আসল ফুল জানি। আমি তো উনিশশো পঁচাত্তরের লোক।

ধরিত্রী সামান্য কৌতূহলের সঙ্গে বলল—তাই নাকি! তাহলে তো বেশ পুরোনো হয়েছেন।

—হ্যাঁ। লোকটা মাথা নেড়ে বলে—আমার চারবার মৃত্যু হয়েছে। আমার হৃদযন্ত্র, চোখ, ফুসফুস আর লিভার সব ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা। মেডিক্যাল বোর্ড থেকে নোটিশ দিয়েছে, আমার ব্রেনটাও এবার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। যদি সেটা করতে হয় তবে আমার সব শৈশবস্মতি চলে যাবে। আশি নব্বই বছর আগেকার কোনও কিছুই মনে থাকবে না। এমনকী আমার আত্মপরিচয় পর্যন্ত পালটে যাবে। আমি নতুন মানুষ হয়ে যাব।

ধরিত্রী একটু দুঃখিত হল। লোকটী ভাবপ্রবণ, তাই পুরোনো কথা সব ধরে রাখতে চায়। বলল—উপায় কী বলুন।

লোকটা মাথা নাড়ল, বলল—না, উপায় নেই। কিন্তু তখন আর আসল ফুল কাকে বলে তা বুঝতেই পারব না হয়তো। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফুল পেয়ে যাবেন।

লোকটা হাতলটা বুকের কাছে ধরে চাপ দিল। ভেলাটা উল্কার মতো ছিটকে বাতাসে মিলিয়ে গেল। ধরিত্রী ঝুঁকে লোকটার গতিপথ লক্ষ করতে গিয়ে টাল সামলাতে পারল না। দরজায় কোনও চৌকাঠ বা হাতল নেই যে ধরবে। ভারসাম্য হারিয়ে পিছলে দরজার বাইরে শূন্যতায় পড়ে গেল। কিন্তু ভয়ের কিছু ছিল না। এখানে ভারী কৃত্রিম বাতাসে আর কমিয়ে রাখা মাধ্যাকর্ষণে কেউ খুব জোরে পড়ে না। ধরিত্রীও পড়ল না। মাত্র আর ফ্ল্যাট থেকে দুতলা পর্যন্ত নীচে ধীরে-ধীরে পড়ে গিয়েছিল সে। একটা বাতাসী ভেলা ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিল। এ-ভেলায় একজন যুবক রয়েছে। সে একটু হেসে বলল কী হয়েছিল?

ধরিত্রী হেসে বলল—হঠাৎ।

যুবকটি মাথা নাড়ল। বুঝেছে।

ভেলাগুলো চমৎকার লাইফ বেল্টের মতো দেখতে হলেও মাঝখানটা ফাঁকা নয়, সেখানে একটা বাটির মতো আধার লাগানো। আর চমৎকার নরম কুশনের তৈরি বসবার জায়গা। ধরিত্রী বসল। ভেলাটা ধীরে-ধীরে তার ফ্ল্যাটের দরজায় তুলে দিল তাকে। আর তখনই ধরিত্রী কোকিলের ডাক শুনতে পেল। একটা দুটো কোকিল ডাকছে। ধরিত্রী আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য দেখা যাচ্ছে, আকাশের নীল প্রতিভাত। কিন্তু সবই দেখা যাচ্ছে একটা অতি স্বচ্ছ ফাইবার গ্লাসের ডোম-এর ভিতর দিয়ে। শহরের সিকি মাইল উঁচুতে ফাইবার গ্লাসের ঢাকনিটা রয়েছে। তাই বাইরের আবহাওয়া কিছুতেই বোঝা যায় না। ঝড় বৃষ্টি টের পাওয়া যায় না। অবশ্য তবু চাঁদ সূর্য তারা দেখা যায়। সবই পরিসুত হয়ে আসে। কোনও ক্ষতিকারক মহাজাগতিক রশ্মি এখানে। প্রবেশ করতে পারে না, কোনও চৌম্বক ঝড় অলক্ষে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। সব বড় শহরই ওই ফাইবার গ্লাসের ঢাকনি দিয়ে ঢাকা।

তবু শীত বসন্ত সবই টের পাওয়া যায়। একটা পরোক্ষ আবহনিয়ন্ত্রক যন্ত্র দিয়ে শহরের আবহাওয়া যথাসাধ্য প্রাকৃতিক রাখা হয়। এমনকী বর্ষায় কখনও-কখনও বৃষ্টিপাতও করানো হয়ে থাকে।

কোকিলের ডাক শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল ধরিত্রী। ভেলা থেকে নামতে গিয়েও একটু থমকে রইল সে। একটা কোকিল উড়ে এসে ভেলার ওপর বসেছে। ধরিত্রী হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারে। কোকিলটা মুখ তুলে তাকে বধির করে দিয়ে ডাকতে লাগল। ধরিত্রী পাখিটার দিকে চেয়ে হাসে। পলিথিন আর কৃত্রিম পশম দিয়ে তৈরি এই সব পাখির পেটে যন্ত্র, বুকে ব্যাটারি, মুখে খুদে স্পিকার বসানো। রিমোট কন্ট্রোল বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সাহায্যে এইসব পাখিকে ওড়ানো হয়, ডাকানো হয়। কারণ অধিকাংশ পাখির প্রজাতিই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তবু মানুষকে প্রাকৃতিক স্পর্শ থেকে বঞ্চিত না রাখার জন্যই এইসব ব্যবস্থা। নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় চমৎকার রাস্তাঘাটের পাশে গাছের সারি। পার্কে সবুজ ঘাস। ওখানে যে কিছু আসল গাছ নেই তা নয়। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শহরের যে ভিত তৈরি করতে হয়েছে তাতে গাছ জন্মানো দুষ্কর। তাই শতকরা নব্বই ভাগ গাছই কৃত্রিম। রবার পলিথিন বা ফাইবার গ্লাসের তৈরি। ঘাসও কৃত্রিম। তবু এক যান্ত্রিক কৌশলে ওইসব কৃত্রিম গাছে চমৎকার সব কৃত্রিম মরশুমি ফুল হয়। ফল ফলে। হুবহু আসলের মতো। সেইসব ফুল গন্ধময়, ফল সুস্বাদু। শহরে বসন্তকাল এল।

ভেলা ছেড়ে ধরিত্রী উঠে এল ঘরে। দরজা বন্ধ করে চলে এল শোওয়ার ঘর পার হয়ে তাদের বসবার ঘরে। সেখানে চল্লিশ বছর বয়স্ক বিপুল নামে ব্যক্তিটি বসে আছে। তার মাথায় একটা হেডফোনের মতো যন্ত্র লাগানো, সেটা ডান কানের ওপরে মাথায় আলতোভাবে স্পর্শ করে থাকে। যন্ত্রটার আসল নাম ইনফর্মেশন পিন, সংক্ষেপে ইন পিন। খবরের কাগজ পড়ে বা রেডিও শুনে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। চোখ এবং কানকে অন্য কাজে রেখেও নিঃশব্দে এবং বিনা আয়াসে, প্রায় অজান্তে মস্তিষ্কের কোষে সব খবর জমা হয়ে যায়। ইন পিন হচ্ছে ইন্দ্রিয়মুক্তির যন্ত্র। চোখ কানকে মুক্ত রেখেই সব জানা যায়।

ধরিত্রীকে দেখে বিপুল যন্ত্রটা খুলে রাখল।

ধরিত্রী মৃদু গলায় বলল—আমি কিছু আসল ফুল আনতে ভেলা পাঠিয়েছি।

বিপুল কিছু অন্যমনস্ক ছিল, বলল—আসল ফুল! কেন?

–বাঃ, আজ যে পনেরোই ফেব্রুয়ারি। আজ যে আমাদের—

এইটুকু বলল ধরিত্রী, আর বলল না। বিপুল বুঝল। ভ্রু কুঁচকে একটু চেয়ে রইল ধরিত্রীর দিকে। তার চোখে মুখে সবসময়ে একটা নিস্তব্ধ উত্তেজিত ভাব। বিপুল ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বলে—ধরিত্রী ভেলাওলাকে বলোনি তো যে আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী!

ভয়ার্ত ধরিত্রী বলল—না-না। তাই কি বলতে পারি! তারপর ধরিত্রী একটু চুপ করে থেকে বলে—অবশ্য লোকটা আসল ফুল চাই শুনে একটু অবাক হয়েছিল। কিন্তু ভয় নেই, এ লোকটার উনিশশো পঁচাত্তর সালে জন্ম। শরীরে অনেকগুলো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। এ লোকটা সন্দেহ করলেও ক্ষতিকর কিছু বলে বেড়াবে না। ও তো মানুষের বিয়ে দেখেছে এককালে। ওর মা-বাবারও বিয়ে হয়েছিল। হয়তো ওর নিজেরও।

বিপুল উত্তর দিল না। উঠে জানলার কাছে এল। জানলা প্রায় সবসময়েই খোলা থাকে। একটা দূরবিন তুলে বিপুল নীচেটা দেখতে লাগল। পার্কে কিছু নগ্ন নারী-পুরুষ এখানে সেখানে বসে আছে। কাছেই বাচ্চারা খেলছে। একটি রমণী কেবলমাত্র একজোড়া স্কেটিং জুতোর মতো জুতো পায়ে চলে যাচ্ছে। ফুটপাথ চলন্ত। রমণীটি তবু সেই চলন্ত ফুটপাথের ওপর দিয়ে আরও জোরে যাচ্ছে। জুতো জোড়া ইলেকট্রনিক শক্তিতে চলে। রমণীটি হাসছে, চিৎকার করে পথচারীদের কী যেন বলছে। কী বলছে তা অবশ্য বিপুল জানে। ও বলছে—শরীর নেবে? শরীর! পার্কের কাছে এক প্রৌঢ় সেই রমণীটিকে ধরে পার্কের মধ্যে নিয়ে গেল। বিপুল দূরবিন রেখে ঘরের মধ্যে সরে এল।

উনিশশো নিরানব্বই সালে এই যৌন-বিপ্লবের শুরু। প্রাচীনপন্থীরা এই মুক্তমিলনে বাধা দিতে চেয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলেছিল লড়াই। বিবাহের সঙ্গে বিবাহহীনতার। তারপর একখানা রাষ্ট্রযন্ত্র বিশশো ঊনপঞ্চাশ সালে বিবাহ নিষিদ্ধ করলেন। পবিত্র যৌন-বিপ্লব স্বীকৃতি পেল ইতিহাসে। শুধু তাই নয়, নরনারীর দীর্ঘকালীন একসঙ্গে বসবাসও কার্যত নিষিদ্ধ। কোনওখানে নর বা নারীর মধ্যে দখলদারি প্রবৃত্তি দেখলে তাকে শাস্তিদানের আওতায় আনারও। চেষ্টা চলছে।

বিপুল বলল—আমরা দশ বছর একসঙ্গে আছি, না ধরিত্রী?

—হ্যাঁ।

বিপুল একটা ছোট্ট বোতাম টিপল। বসবার ঘরে আর শোওয়ার ঘরের মাঝখানের অস্বচ্ছ কাচের পাতলা দেওয়ালটা নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল মেঝের মধ্যে। ফলে দুই ঘর মিলে একটা বিশাল হলঘরের সৃষ্টি হল। বিপুল পায়চারি করতে লাগল। একবার থেমে বসবার ঘরের দেওয়ালে একটা চৌখুপির মধ্যে বসানো ট্যাপ থেকে এক পাত্র গরম সবুজ চা ভরে নিল পেয়ালায়। খানিকটা খেল, বাকিটা মেঝেয় ফেলে দিল। ধরিত্রী প্রশ্বাস যন্ত্রটা চালু করে দিতেই মেঝের তরলটুকু মিলিয়ে গেল। পায়চারি করতে-করতে বিপুল বলে—তুমি যখন খাওয়ার ঘরে গিয়েছিলে তখন এনকোয়ারি কমিশন থেকে একটা ফোন এসেছিল। ওরা জানতে চাইছে, আমার এই ফ্ল্যাটে একজন মহিলা দশ বছর যাবত বাস করছে কেন? এটা প্রচণ্ড বেআইনি। উপরন্তু ওরা যে পবিত্র যৌন-বিপ্লবের মাধ্যমে যৌনমুক্তি এনেছে সে আদর্শ এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে। ওদের নির্দেশ, আমরা যেন অবিলম্বে ভিন্ন হয়ে যাই।

ধরিত্রীর মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল। সে বলল—তুমি ওদের বলোনি তো যে তুমি যৌন-বিপ্লবকে যৌন দাঙ্গা বলে আড়ালে বলে বেড়াও।

বিপুল ভ্রু কুঁচকে বলেনা। তবে ওরা হয়তো কিছু গন্ধ পেয়েছে। ওরা আরও লক্ষ করেছে যে, তুমি আর আমি সব সময়ে জামা-কাপড় পরে বেরোই। ওরা এটাকেও ভালো চোখে দেখছে না। সম্ভবত ওরা শিগগিরই আসবে আমাদের প্রকৃত সম্পর্ক জানতে।

ধরিত্রী চুপ করে রইল।

.

জানলায় টোকা পড়তেই দুজনে ভয়ংকর চমকে ওঠে। তাকায়। খোলা জানলার বাইরে সাদা গোল ভেলাটা ভাসছে। এক বোঝা রজনীগন্ধা বুকে করে সেই বুড়ো লোকটা দাঁড়িয়ে হাসছে। ওরা তাকাতেই লোকটা ভেলা থেকে জানলায় পা রেখে ঘরের মধ্যে নেমে এল। ধরিত্রীর হাতে ফুলের গোছা দিয়ে বলল—আসল ফুল।

ধরিত্রী ফুলগুলো বুকে চেপে রইল। তারপর উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকল বিপুলের দিকে। বিপুল চিন্তিতভাবে ফুলগুলো দেখছিল।

বুড়ো দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে দেখছিল। হঠাৎ একটু হেসে বলল—কোনও বিপদ?

বিপুল মাথা নেড়ে বলল—আমরা দশ বছর একসঙ্গে আছি। তাই এনকোয়ারি কমিশন আসবে।

—খুব খারাপ।

বলে বুড়ো চিন্তিতভাবে মাথা চুলকোলো। তারপর বিপুল আর ধরিত্রীর ঘরদোর ঘুরে ফিরে দেখল একটু। কোনও খাটপালঙ্ক নেই। চেয়ার টেবিল বা আসবাবও নেই বললেই হয়। দেওয়ালের গায়ে-গায়ে কিছু বোতাম ছাড়া কোনও যন্ত্রপাতি দেখা যায় না। অবশ্য বোতাম টিপলেই প্যানেলের ভিতর থেকে সবরকম যন্ত্রপাতি বেরিয়ে আসে। আসবাবপত্রও। বসবার ঘরের এককোণে কিছু কৃত্রিম ফুল সাজিয়ে রাখা। সে ফুল বাসি হয় না, তাতে চিরস্থায়ী গন্ধ। এমনকী সেই ফুলের আশেপাশে খুদে ব্যাটারিচালিত গোটাকয়েক মৌমাছি আর একটা ফরমায়েশি সাদা প্রজাপতি অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো ফুলের সঙ্গেই পাওয়া যায়। ওইসব কলের কীটপতঙ্গের আয়ু দীর্ঘ। ব্যাটারি ফুরোলে আবার চার্জ করে নেওয়া যায়। বুড়ো এইসব দেখছিল। হঠাৎ বলল—আমি জানি আপনারা স্বামী-স্ত্রী।

বিপুল বলল—চুপ। বোলোনা।

ধরিত্রী খুব জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—বলবেই তো। আমি তোমার স্ত্রী, তুমি আমার স্বামী। দশ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।

বাইরে একটা কোকিল ডাকল। যন্ত্রের কোকিল। বুড়ো দুজনের দিকে তাকাল। তারপর দুজনের মাঝখানের শূন্যতার দিকে চেয়ে বলল—আমার মাথাটা একশো বছরের পুরোনো। খুব ধোঁয়াটে। তবু বলি দশ বছর আগে বিয়ে বেআইনি ছিল। মন্ত্র নেই, পুরুত নেই, রেজিস্ট্রার নেই, তবে আপনাদের বিয়ে হয়েছিল কীভাবে?

—হয়নি। বিপুল বলে।

–হয়েছিল। ধরিত্রী চেঁচিয়ে বলল—আমরা ফুলের মালাবদল করেছিলাম, আর তুমি কয়েকটা সংস্কৃত মন্ত্র বলেছিলে, যেগুলোর অর্থ আমি বুঝিনি। কিন্তু তবু সেটা বিয়েই।

–ধরিত্রী।

বিতর্ক শুনে বুড়ো মাথা চুলকোয়। বিড়বিড় করে বলে—আমার হৃদযন্ত্র নতুন, ফুসফুস নতুন, কিন্তু মাথাটা পুরোনো। বড্ড ধোঁয়াটে। কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এভাবেও বিয়ে হতে পারে। আগে হত।

—এখন হয় না! বিপুল বলল।

ধরিত্রী কথা বলতে পারল না। কিন্তু ফুলগুলি বুকে চেপে চেয়ে রইল। বিপুল তার দিকে চেয়ে বলল—ধরিত্রী, আমাদের কিছুই লুকিয়ে রাখা যাবে না। তার চেয়ে তুমি চলে যাও।

বুড়ো মাথা চুলকোচ্ছিল। বিড়বিড় করে বলল—আরও হয়তো পঁচিশ বছর এরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। বারবার শরীরের যন্ত্র বদলে দেবে। আমি সব ভুলে যাব। অন্য মানুষ, ফের অন্য মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। ভীষণ মুশকিল।

বুড়োর কথা কেউ শুনছিল না। বিপুল চেয়ে আছে ধরিত্রীর দিকে, ধরিত্রী বিপুলের দিকে।

জানলার বাইরে একটা লাল রঙের ভেলা এসে থেমেছে। ভেলার গায়ে লেখা—অনুসন্ধান। ভেলা থেকে চারজন লোক জানলাটপকে ভিতরে এল। এনকোয়ারি কমিশন।

বুড়ো সেই চারজনকে দেখে সরে এল জানলার কাছে। একটু কষ্টে নিজের ছোট সাদা ভেলাটায় চড়ে বসল। তারপর ভেসে যেতে লাগল। মাথাটা বড্ড ধোঁয়াটে। অনেক কালের কথা জমে পাথর হয়ে আছে। শিগগির এই মাথাটা তার থাকবে না। একদম অন্যরকম হয়ে যাবে। বুড়ো ভাবল—আমাকে কোথাও চলে যেতেই হবে। এরা আমাকে কেবলই বাঁচিয়ে রাখবে। যতদিন এদের খুশি। কিন্তু মরাটাও যে ভয়ংকর দরকার তা এরা কবে বুঝবে?

সেই রাতে বুড়ো একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখল। তার বাবা রাস্তা সমান করার রোলার চালাত। ঘট-ঘটাং করে প্রচণ্ড শব্দে সেই রোলারটা পুরোনো পৃথিবীর রাস্তাঘাট সমান করত। বুড়ো দেখল, সেই রোলারটায় সে আবার চড়েছে। প্রচণ্ড শব্দে সে রোলারটা চলছে। সামনে শূন্য প্রান্তর, মাঝখানে অফুরান মুক্তির মতো রাস্তা। পিছনে তাড়া করে আসছে বাতাসী ভেলা, রকেট, সন্ধানী আলো, মৃত্যুরশ্মি। বুড়ো ডাকল—বাবা! রোলার চালাতে-চালাতে বাবা একবার পিছু ফিরে চেয়ে বললেন—ভয় নেই! আমরা ওদের ছাড়িয়ে যাব। বুড়ো একটু হাসল, তারপর নিশ্চিন্তে চোখ বুজল।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *