০৫/০৩/২০২২
আমি মনে করি আজকের লেখাটি পড়ার আগে ছোট্ট একটা ভূমিকা দেওয়া প্রয়োজন।
অনেকরকম অভ্যেসের সঙ্গে সঙ্গে আমার আরও অনেক বেশিরকম বদভ্যেস আছে। তার মধ্যে একটি হল বাড়ির বাইরে বেরোলে নিজের শ্রবণশক্তিকে একটু বেশিরকম তীক্ষ্ণ করে রাখা। ভালো মন্দ সবই কানে ঢোকাতে ইচ্ছে করে, একেবারে নির্ভেজাল ফর্মে। এই বদভ্যেসটি পালন করতে গিয়ে কদাচিৎ এমন কিছুকিছু সংলাপ কানে ঢোকে যেগুলো, আমার ব্যক্তিগত ধারণায়, মানুষের চিন্তাশক্তির ব্যপ্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বছর পাঁচেক আগে এইভাবেই কানে এসেছিল দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিতের মধ্যেকার বার্তালাপ।
নীচের লেখায় আমি চেষ্টা করেছি সেই বার্তালাপটিকে আমার মত করে ধরে রাখতে। কাজে কাজেই সেই অর্থে এই লেখার কাহিনী বা ঘটনা আমার মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। আমার চেষ্টা শুধুমাত্র শোনা একটি বার্তালাপকে জামাকাপড় পরিয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে, কাগজের ওপর কলমের দাগ দিয়ে ধরে রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বার্তালাপটি আমি শুনেছিলাম বোধহয় ২০১৭র দ্বিতীয়ার্দ্ধে। এই লেখাটা আমি প্রথমে ইংরেজিতে লিখেছিলাম ২০১৮ সালে। কিছুদিন আগে সেটার বাংলা রূপ দেবার চেষ্টা করেছি। আজ বাংলাটা পড়ব।
যেহেতু কোনো গল্পের পরিচিতি তার একটা নামের মধ্যে দিয়ে হয়, তাই আমি এই গল্পের নাম দিয়েছি –
ভোলার বাবা
আমাদের দেশের প্রত্যন্ত্য কোন এক অঞ্চলের এক নাম-না-জানা গ্রাম। সেই গ্রামের একেবারে সীমানার ধারে একটি ইস্কুল চলে। বলতে গেলে ইস্কুলের একদিকের বেড়া দেওয়া পাঁচিলটাই হচ্ছে গ্রামের সীমানা। তার পরে যতদূর চোখ যায় ক্ষয়াটে সবুজ ধূধূ প্রান্তর। মাঝেমধ্যে ছিটেফোঁটা জলের মতো কয়েকটা বড়বড় গাছ। একমাত্র ব্যতিক্রম বলতে ঐ পাঁচিলটার ওপারে কাছের এবং দূরের এবং অনেক দূরের ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা বস্তিতে দু’চার ঘর করে সমাজের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত কিছু মানুষের বাস।
এইরকম একটা প্রান্তিয় ইস্কুলের কাছ থেকে খুব উঁচুমানের পড়াশোনার আশা করাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। তবে যেটুকু খামতি সেটা মাষ্টাররা সবাই মিলে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ছেলেমেয়েদের মানসিক কাঠামোগুলোর সযত্নে পরিচর্যা এবং লালনপালন করে।
প্রতি বছরের মত সেবছরও সেপ্টেম্বর মাস এসেছিল। এই মাসটা ঘুড়ি ওড়ানোর মাস বলে প্রকৃতিও ঘুড়ি ওড়ানোর আদর্শ আবহওয়া তৈরী করে রেখেছিল। পূজোর গন্ধ বয়ে আনতে ছেলেমেয়েরা আকাশ ঢেকে ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল। সেবছর আমাদের ইস্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর ইণ্টারক্লাস কম্পিটিশনের আয়োজন করেছিল। রোজ টিফিনের সময় প্র্যাকটিস চলত জোরকদম। ভোকাট্টা হয়ে উড়ে যাওয়া কিছু ঘুড়ি কাছের এবং দূরের বস্তিগুলোর বাচ্চারা কুড়িয়ে নিয়ে মহা আনন্দে উড়িয়ে বেড়াত।
সবচেয়ে কাছের বস্তিটাতে থাকে আমাদের ভোলা। বছর আষ্টেকের হবে, আবার নয়ও হতে পারে; তবে তার বেশি নয়। বাবা অনেক দূরে, প্রায় দিন দুয়েকের দূরত্বে, কোথায় যেন ইঁটভাটায় কাজ করে। হাতে কিছু পয়সা জমাতে পারলে ছমাসে নমাসে একবার করে ছেলে-বৌএর কাছে আসে, না জমলে আসতে পারে না। মা গ্রামের দুএকটা বাড়িতে একটু আধটু কাজটাজ করে। পরিস্থিতির বদান্যতায় আমাদের ভোলা সারাদিন মুক্তবিহঙ্গ। নিজের মনে ঘুরে বেড়ায়, খেলে বেড়ায় আর ঘুড়ির সময় কাটা ঘুড়ি পেলে বন্ধুদের সঙ্গে উড়িয়ে বেড়ায়।
কম্পিটিশনের দিন ইস্কুলের মাঠ হয়ে উঠেছিল মনুষ্যসম্প্রদায়ের সবরকম অনুভূতির এক জগাখিচুড়ির প্রকাশস্থল। চেঁচামেচি, উচ্ছাস, দুঃখ, রাগ, অভিমান, আনন্দ, হাসি, কান্না এবং আরও জানা-অজানা কতসবকিছু অনুভূতির এক আজব মিলনস্থল। পাঁচিলের ওদিকে একটু দূরে ভোলারাও ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। তবে সেখানে সেই অর্থে কোন কম্পিটিশন ছিল বলে মনে হচ্ছিল না, ছিল একসাথে মিলেমিশে এক সুন্দর নির্ভেজাল আনন্দের উপভোগ; যদিও একটু অদ্ভুতরকমের আনন্দ।
অনেকক্ষণ ধরে মনযোগ সহকারে ভোলাদের লক্ষ্য করে ইস্কুলের একজন মাষ্টার নজর করলেন যে ভোলাদের আনন্দটা উল্লাসে পরিণত হয় যখনই ওদের নিজেদের কারুর ওড়ানো ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে যায়। অনেক ভেবেও এই অতি উল্লাসের কারণ সম্বন্ধে কিছু কুলকিনারা করতে না পেরে তিনি বাঁশের গেট দিয়ে বেরিয়ে ভোলাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। অর্দ্ধউলঙ্গ সবকটা বাচ্চা গুটিগুটি কাছে এসে দাঁড়াল। মাষ্টার ওদের কাছে জানতে চাইলেন নিজেদের ঘুড়ির ভোকাট্টাতে ওদের এত খুশি হওয়ার কারণ। ছেলেগুলো এরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে একটু হতচকিত। নিজেদের মধ্যে আড়চোখে চোখাচোখি করে সামান্য লাজুক লাজুক মুচকি হাসি দিল, কিন্তু বলল না কিছুই। তা আমাদের মাষ্টারকে আরেকটু কাঠখড় পোড়াতে হল। অবশেষে ভোলা ওনাকে ওদের ঘরে নিয়ে গেল; পেছন পেছন ফিসফিস করতে করতে পুরো দঙ্গল।
ঘরের মেঝেতে গোটা কয়েক ঘুড়ি ইতস্তত ছড়ানো। বোঝাই যায় কোনটাই নতুন নয়, সবগুলোই কুড়িয়ে পাওয়া কাটাঘুড়ি। ভোলাদের চেয়ে আরও কিছুটা ছোট একটা ছেলে একনিষ্ঠ মনে, নিজের কাঁচা হাতের লেখায় প্রতিটা ঘুড়িতে কয়লা দিয়ে একজন একজন করে প্রত্যেক বন্ধুর নাম, আর সবশেষে গ্রামের নাম লিখছিল। এদিকে আমাদের মাষ্টারের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না; প্রথমে ভোকাট্টাতে উল্লাস, তারপরে আবার এই ঘুড়িগুলোতে নামধাম লেখা। ইতিমধ্যে মাষ্টারের অবস্থা দেখে ছেলেগুলোর মুখের মুচকি হাসিগুলো ততক্ষণে আরও জাঁকিয়ে বসেছে।
অবশেষে সেই বিকেলের সব রহস্যের উন্মোচন আমাদের ভোলাই করল। ভোলার কথাতেই বলি। “আমাদের ঘুড়িগুলো ভোকাট্টা হলে কোথায় কোন দিকে ভেসে গিয়ে পড়ে, কে কোথায় কুড়িয়ে পায় আমরা জানতে পারি না। কিন্তু যারা কুড়িয়ে পায় তারা আমাদের নাম আর আমাদের গাঁয়ের নাম জানতে পারে। তাদের কেউ কেউ আমাদের কাছে আসে; আমরা বন্ধু পাতাই। এইতো এই বলাই, কেষ্ট, স্বপন, গৌর, মধু আমরা সবাই এমনি করে বন্ধু পাতিয়েছি।”
পরের দিন ইস্কুল ছুটি ছিল। সেদিন দুপুরবেলা চারদিক একটু নিঃঝুম হওয়ার পর আমাদের মাষ্টার ভোলার কাছে এসে জানতে চেয়েছিল ভোকাট্টার খেলাটা ওরা কোথায় শিখেছে। ভোলা বলেছিল ওর বাবা আগেরবার যখন ঘর এসেছিল তখন ভোলা ঘুড়ি কেনার পয়সা চেয়েছিল। পয়সা না পেয়ে ভোলা খুব কান্নাকাটি করেছিল; যার জন্য মা’র কাছে বেশকিছু চড়থাপ্পড়ও খেয়েছিল। আর পয়সা না দিতে পেরে, ইঁটভাটায় ফিরে যাবার আগের দিন বাবা এই খেলাটা ভোলাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছিল। বাবা শিখিয়েছিল এই খেলায় একটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হলে কাটা ঘুড়ির সাথে একজন নতুন বন্ধু পাওয়া যায়। তাছাড়া এই খেলায় ঘুড়ি কিনতেও হয় না, আবার ঘুড়ি শেষও হয় না, ভোকাট্টা হলেও।