কেন সে এই রকম করে? কেন বার বার আমার ঘরে আসে? লােকের চোখে পড়লে – নানান কথা রটবে। মেয়ে যতাে সুন্দর তারে নিয়া রটনাও ততাে বেশি।
লতিফা আমার বিছানায় বসতে বসতে বললাে, কই বলেন এটার উত্তর কি
‘পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়
এ কেমন ফল বলতাে আমায়? বলতে পারলেন না এটা হলাে – শশা। পাকা শশা কেউ খায় না। সবাই কাঁচা শশা চায়। আচ্ছা আপনার বুদ্ধি এতাে কম কেন? একটাও পারেন না। আপনি একটা ধাধা ধরেন আমি সংগে সংগে বলে দেবাে।
‘আমি ধাধা জানি না লতিফা। ‘আপনি কি জানেন? শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতে জানেন আর কিছু জানেন?
লতিফা তুমি এখন ঘরে যাও | ‘ঘরেই তাে আছি। এইটা ঘর না? এইটা কি বাহির ?” ‘যখন তখন তুমি আমার ঘরে আসাে – এটা ঠিক না।
“ঠিক না কেন? আপনি কি বাঘ না ভালুক?
আমি চুপ করে রইলাম। আধা–পাগল এই মেয়েকে আমি কি বলবাে? এই মেয়ে একদিন নিজে বিপদে পড়বে। আমাকেও বিপদে ফেলবে। লতিফা বললাে, আমি যে মাঝে–মধ্যে আপনার এখানে আসি–সেইটা আপনার ভালাে লাগে না – ঠিক না?
‘ঠিক। ‘ভালাে লাগে না কেন?” ‘নানান জনে নানান কথা বলতে পারে। “কি কথা বলতে পারে? আপনার সংগে আমার ভালােবাসা হয়ে গেছে? চুপ করে আছেন কেন বলেন।
‘তুমি এখন যাও লতিফা।
‘আচ্ছা যাই। কিন্তু আমি আবার আসবাে। রাত দুপুরে আসবাে। তখন দেখবেন – কি বিপদ।”
‘কেন এই রকম করতেছাে লতিফা?” | লতিফা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাে, যে ভয় পায় তাকে ভয় দেখাতে আমার ভালাে লাগে। এইজন্যে এরকম করি। আচ্ছা মৌলানা সাহের যাই। আসসালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়া বরকাতুহু হি হি হি। . ভাই, আপনার কাছে সত্য কথা গােপন করবাে না।
সত্য গােপন করা বিরাট অন্যায়। আল্লাহ পাক সত্য গােপনকারীকে পছন্দ করেন না। চাকরি পাওয়ার পরেও আমি মােক্তার সাহেবের বাড়িতে থেকে গেলাম শুধু লতিফার জন্য। তারে দেখার জন্য মনটা ছটফট করতাে। মনে মনে অপেক্ষা করতাম কোন সময় তারে এক নজর হলেও দেখব। তার পায়ের শব্দ শুনলেও বুক ধড়ফড় করতাে। রাত্রে ভাল ঘুম হত
শুধু লতিফার কথা ভাবতাম। বলতে খুব শরম লাগছে ভাই সাব তবু বলি – লতিফার চুলের একটা কাঁটা আমি সব সময় আমার সঙ্গে রাখতাম। আমার কাছে মনে হত এইটা চুলের কাটা না। সাতরাজার ধন। আমি আল্লাহপাকের দরবারে। কান্নাকাটি করতাম। বলতাম – হে পরােয়ারদিগার, হে গাফুরুর রহিম, তুমি আমাকে একি বিপদে ফেললা। তুমি আমারে উদ্ধার করাে।
আল্লাহপাক আমাকে উদ্ধার করলেন। লতিফার বিবাহের প্রস্তাব আসলাে। ছেলে এমবিবিএস ডাক্তার। বাড়ি গৌরিপুর। ভালাে বংশ। খান্দানি পরিবার। ছেলে নিজে এসে মেয়ে দেখে গেলাে। মেয়ে তার খুব পছন্দ হলাে। পছন্দ না হওয়ার কোনাে কারণ নাই। লতিফার মতাে রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেও দেখতে শুনতে ভালাে। শুধু গায়ের রঙটা একটু ময়লা। কথায় বার্তায়ও ছেলে অতি ভদ্র।
ভয় (পর্ব-১১)-হুমায়ূন আহমেদ
বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেলাে। বারােই শ্রাবণ। শুক্রবার দিবাগত রাত্রে বিবাহ পড়ান হবে।
আমার মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেলাে। আমি জানি এই মেয়ের সংগে আমার বিবাহের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি। চাকর–শ্রেণীর আশ্রিত একজন মানুষ। জমিজমা নাই, আত্মীয়–স্বজন নাই, সহায় সম্বল নাই। তারজন্য আমি কোনােদিন আফসােস করি নাই। আল্লাহপাক যাকে যা দেন তাই নিয়াই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমিও ছিলাম। কিন্তু যেদিন লতিফার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলাে সেদিন কি যে কষ্ট লাগলাে বলে আপনাকে বুঝাতে পারবাে না। সারারাত শহরের পথে পথে ঘুরলাম।
জীবনে কোনােদিন নামাজ কাজা করি নাই – এই প্রথম এশার নামাজ কাজা করলাম। ফজরের নামাজ কাজা করলাম। এতােদিন পরে বলতে লজ্জা লাগছে – আমার প্রায় মাথা খারাপের মতাে হয়ে গিয়েছিলাে। ভােরবেলা মােক্তার সাহেবের বাসায় গেলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এইখানে আর থাকবাে না। বাজারে চালের আড়তে থাকবাে।
মােক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, এখন যাবে কেন বাবা? মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কতাে কাজকর্ম। কাজকর্ম শেষ করে তারপর যাও। আমি মিথ্যা কথা বলি না। প্রথম মিথ্যা বললাম। আমি বললাম, মা ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমাকে আজই দোকানে গিয়ে উঠতে বলেছেন – উনি আমার মনিব। অন্নদাতা। উনার কথা না রাখলে অন্যায় হবে। বিয়ের সময় আমি চলে আসবে। কাজকর্মের কোনাে অসুবিধা হবে না মা।
সবার কাছ থেকেই বিদায় নিলাম। লতিফার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলাম । সে যখন সামনে এসে দাড়ালাে তখন চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না।
লতিফা বললাে, চলে যাচ্ছেন? আমি বললাম – হ্যা। ‘কেন, আমরা কি কোনাে দোষ করেছি? “ছিঃ ছিঃ দোষ করবে কেন? ‘আচ্ছা যাওয়ার আগে এই ধাধাটা ভাঙায়ে দিয়ে যান – বলেন দেখি –
‘ছাই ছাড়া শােয় না; | ‘লাথি ছাড়া উঠে না। এই জিনিশ কি?”। ‘জানি না লতিফা। ‘এতাে সহজ জিনিশ পারলেন না। এটা হলাে কুকুর। আচ্ছা যান। দোষ ঘাট হলে – ক্ষমা করে দিয়েন।
আমি আড়তে চলে আসলাম। রাত আটটার দিকে মােক্তার সাহেব লােক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি শােবার ঘরে চেয়ারে বসেছিলেন। আমাকে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হলাে। আমি খুবই অবাক হলাম। একটু ভয় ভয়ও করতে লাগলাে। তাকিয়ে দেখি – মােক্তার সাহেবের স্ত্রী খাটে বসে আছেন। নিঃশব্দে কঁদছেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। বুক ধড়ফড় করতে লাগলাে। না জানি কি হয়েছে।
মােক্তার সাহেব বললেন, তােমাকে আমি পুত্রের মতাে স্নেহ করেছি। তার বদলে তুমি এই করলে? দুধ দিয়ে কাল সাপ পােষার কথা শুধু শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
আমি মােক্তার সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, মা আমি কিছুই বুঝতেছি
মােক্তার সাহেব চাপা স্বরে বললেন, বােকা সাজার দরকার নাই। বােকা সাজবা । তুমি যা করেছে তা তুমি ভালােই জানাে। তুমি পথের কুকুরেরও অধম।
আমি বললাম, আমার কি অপরাধ দয়া করে বলেন। মােক্তার সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, মেথরপট্টিতে যে শুওর থাকে তুই তারচেয়েও অধম – তুই নর্দমার ময়লা। বলতে বলতে তিনিও কেঁদে ফেললেন।
মােক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন লতিফা সবই আমাদের বলেছে – কিছুই লুকায় নাই। এখন এই অপমান এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় লতিফার সংগে তােমার বিবাহ দেয়া। তুমি তাতে রাজি আছাে? না মেয়ের সর্বনাশ করে পালানােই তােমার ইচ্ছে।
আমি বললাম, মা আপনি কি বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না। লতিফা কি বলেছে আমি জানি না। তবে আপনারা যা বলবেন – আমি তাই করবাে। আল্লাহপাক উপরে আছেন। তিনি সব জানেন, আমি কোনাে অন্যায় করি নাই মা।
মােক্তার সাহেব চিৎকার করে বললেন, চুপ থাক শুওরের বাচ্চা। চুপ থাক।
সেই রাতেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানাে হলাে। বাসররাতে লতিফা বললাে, আমি একটা অন্যায় করেছি – আপনার সাথে যেন বিবাহ হয় এই জন্যে বাবা–মাকে মিথ্যা করে বলেছি – আমার পেটে সন্তান আছে। বিরাট অপরাধ করেছি, আপনার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি বললাম, লতিফা আমি তােমার অপরাধ ক্ষমা করলাম। তুমি আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাও। | ‘আপনি ক্ষমা করলেই আল্লাহ ক্ষমা করবেন। তাছাড়া আমি তেমন বড় অপরাধ তাে করি নাই। সামান্য মিথ্যা বলেছি। আপনাকে বিবাহ করার জন্য অনেক বড় অপরাধ করার জন্যেও আমি তৈরি ছিলাম।
(চলবে)