ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

আচ্ছা এখন বলেন এই ধাধাটির মানে কি – 

আমার একটা পাখি আছে 

যা দেই সে খায়কিছুতেই মরে না পাখি 

জলে মারা যায়বুঝলেন ভাই সাহেব, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেলােএই আনন্দের কোনাে সীমা নাই

ভয় আমার মতাে নাদান মানুষের জন্য আল্লাহপাক এতাে আনন্দ রেখে দিয়েছেন আমি কল্পনাও করি নাইআমি কতােবার যে বললাম, আল্লাহপাক আমি তােমার নেয়ামত স্বীকার করিআমি তােমার নেয়ামত স্বীকার করি। 

বিয়ের পর আমি শ্বশুর বাড়িতেই থেকে গেলামআমার এবং লতিফার বড় দুঃখের সময় কাটতে লাগলােশ্বশুর বাড়ির কেউ আমাদের দেখতে পারে নাখুবই খারাপ ব্যবহার করে। আমার শাশুড়ী দিনরাত লতিফাকে অভিশাপ দেন মর মর তুই মর| আমার শ্বশুর সাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সকাল বেলায় তুমি আমার সামনে আসবা নাসকাল বেলায় তােমার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যায়। 

শ্বশুর বাড়ির কেউ আমার সংগে কথা বলে নাতারা এক সংগে খেতে বসেসেখানে আমার যাওয়া নিষেধসবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে লতিফা থালায় করে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসেসেই ভাত আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। 

লতিফা রােজ বলে চলাে অন্য কোথায়ও যাই গিয়া। 

আমি চুপ করে থাকিকই যাবাে বলেন? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে? যাওয়ার কোনাে জায়গা নাইলতিফা খুব কান্নাকাটি করে। 

একদিন খুঅপমানের মধ্যে পড়লামআমার শ্বশুর সাহেবের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এক হাজার টাকা চুরি গেছেতিনি আমারে ডেকে নিয়ে বললেন, এই যে দাড়িওয়ালা তুমি কি আমার টাকা নিয়েছাে? আমার চোখে পানি এসে গেলােএকি অপমানের কথাআমি দরিদ্রআমার যাওয়ার জায়গা নাই সবই সত্য কিন্তু তাই বলে আমি কি চোর? ছিঃ ছিঃ। 

ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

শ্বশুর সাহেব বললেন, কথা বলাে না কেন

আমি বললাম, আমারে অপমান কইরেন নাযতাে ছােটই হই আমি আপনার কন্যার স্বামী। 

শ্বশুর সাহেব বললেন, চুপচোর আবার ধর্মের কথা বলে। 

লতিফা সেইদিন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলােসে বললাে, এই বাড়ির ভাত সে মুখে দিবে না। 

আমার শাশুড়ী বললেন, ঢং করিস নাএই বাড়ির ভাত ছাড়া তুই ভাত পাইবি কই? | দুই দিন দুই রাত গেলাে লতিফা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয় নাআমারে বলে, তুমি আমারে অন্য কোথাও নিয়া চলােদরকার হইলে গাছতলায় নিয়া চলােএই বাড়ির ভাত আমি মুখে দিবাে না। 

আমি মহাবিপদে পড়লামসারারাত আল্লাহরে ডাকলামফজরের নামাজের শেষে আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠায়ে বললাম, হে মাবুদহে পাক পরােয়ারদিগার তুমি ছাড়া আমি কার কাছে যাবাে? আমার দুঃখের কথা কারে বলবাে? কে আছে আমার? তুমি আমারে বিপদ থাইক্যা বাচাও। 

আল্লাহপাক আমার প্রার্থনা শুনলেনভােরবেলায় চালের আড়তে গিয়েছিসিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমারে ডেকে বললেন, এই যে মৌলানা, আমার একটা উপকার করতে পারবে

আমি বললাম, জ্বি জনাব বলেনময়মনসিংহ শহরে আমি নতুন বাড়ি করেছিএখন থেকে বাড়িতে থাকবােসপ্তাহে সপ্তাহে এইখানে আসবােনেত্রকোনায় আমার যে বাড়ি আছে তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে পারবে? নেত্রকোনার বাড়ি আমি বিক্রি করতে চাই নাশুনলাম তুমি বিবাহ করেছে তুমি এবং তােমার স্ত্রী দুজন মিলে থাকো। 

ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

আমি বললাম, জনাব আমি অবশ্যই থাকবােতাহলে তুমি এক কাজ করাে আজকেই চলে আসসাএকতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে তুমি থাকোদুতলার ঘর তালাবন্ধ থাকুক। 

জি আচ্ছাবাড়িটা শহর থেকে দূরেতবে ভয়ের কিছু নেই, একজন দারােয়ান আছে। চব্বিশঘণ্টা থাকবেদারােয়ানের নাম বলরামভালাে লােক। 

জনাব আমি আজকেই উঠবাে। 

সেইদিন বিকালেই সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠলামবিরাট বাড়িবাড়ির নাম সরজুবালা হাউসহিন্দু বাড়ি ছিলােসিদ্দিক সাহেবের বাবা কিনে নিয়েছিলেন। 

আট ইঞ্চি ইটের দেয়ালে বাড়ির চারদিক ঘেরাদোতলা পাকা দালানবিরাট বড় বড় বারান্দাদেয়ালের ভেতরে নানান জাতের গাছ গাছড়াদিনের বেলায় অন্ধকার হয়ে থাকে। 

আমি লতিফাকে বললাম, বাড়ি পছন্দ হয়েছে লতিফা

লতিফা আনন্দে কেঁদে ফেললাে। দুই দিন খাওয়া দাওয়া না করায় লতিফার শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিলােচোখ ছােট ছােট, ঠোট কালচেমুখ শুকিয়ে এতােটুকু হয়ে গেছেএই অবস্থাতেই সে রান্নাবান্না করলােঅতি সামান্য আয়ােজনভাত ডাল পেঁপে ভাজাখেতে অমৃতের মতাে লাগলাে ভাই সাহেব। 

ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে হাত ধরাধরি করে বাগানে হটলামহাসবেন নাভাইসাব, তখন আমাদের বয়স ছিলাে অল্পমন ছিল অন্য রকম। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হলাে এই দুনিয়াতে আল্লাহপাক আমার মতাে সুখী মানুষ তৈরি করেন নাইআনন্দে বার বার চোখে পানি এসে যাচ্ছিলাে ভাই সাহেব। 

ক্লান্ত হয়ে একসময় একটা লিচুগাছের নিচে আমরা বসলামলতিফা বললাে, আমি যে মিথ্যা কথা বইলা আপনেরে বিবাহ করছি এই জন্যে কি আমার উপর রাগ করছেন

আমি বললাম, না লতিফাআমার মতাে সুখী মানুষ নাইযদি সুখী হন তাহলে এই ধাধাটা পারেন কিনা দেখেনবলেন দেখি – 

কাটলে বাচে, না কাটলে মরে 

এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?পারলাম না লতিফা ভালােমতাে চিন্তা কইরা বতে হটা পারা দরকারখুব দরকার – 

কাটলে বাচে, না কাটলে মরে _ এমন সুন্দর ফল কোন্ গাছেতে ধরে?পারবাে না লতিফা আমার বুদ্ধি কমএইটা হইলাে সন্তানের নাড়ি কাটাসন্তানের জন্মের পর নাড়ি কাটলে সন্তান বাঁচেনা কাটলে বাচেনাআচ্ছা এই ধাধাটা আপনেরে কেন জিজ্ঞেস করলাম বলেন 

তাে?” 

তুমি বলােআমার বিচার বুদ্ধি খুবই কম। 

এইটা আপনেরে বললাম কারণ আমার সন্তান হবে। 

লতিফা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললােকি যে আনন্দ আমার হলাে ভাই সাহেবকি যে আনন্দ। 

ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ

সেই রাতে লতিফার জ্বর আসলােবেশ ভালাে জ্বরআমি জ্বরের খবর রাখি নাঘুমুচ্ছিলতিফা আমারে ডেকে তুললােবললাে, আমার খুব ভয় লাগতেছে একটু উঠেন তাে। 

আমি উঠলামঘর অন্ধকারকিচ্ছু দেখা যায় নাহারিকেন জ্বলায়ে শুয়েছিলামবাতাসে নিভে গেছেহারিকেন জ্বালালাম। 

তাকিয়ে দেখি লতিফার মুখ ভয়ে শাদা হয়ে গেছেসে ফিস ফিস করে বললাে, ছাদের বারান্দায় কে যেন হাঁটে। 

আমি শােনার চেষ্টা করলামকিছু শুনলাম না। 

লতিফা বললাে, আমি স্পষ্ট শুনেছিএকবার না অনেকবার শুনেছিজুতা পায়ে দিয়া হাটেজুতার শব্দ হয়হাঁটার শব্দ হয়। 

বােধহয় দারােয়ান। 

না দারােয়ান নাঅন্য কেউকি করে বুঝলা অন্য কেউ? বললাম না জুতার শব্দদারােয়ান কি জুতা পরে?তুমি থাকোআমি খোজ নিয়া আসি? না নাএইখানে একা থাকলে আমি মরে যাবাে

(চলবে)

ভয় (পর্ব-১১)-হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *