আচ্ছা এখন বলেন এই ধাধাটির মানে কি –
‘আমার একটা পাখি আছে
যা দেই সে খায়। কিছুতেই মরে না পাখি
জলে মারা যায়। বুঝলেন ভাই সাহেব, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেলাে। এই আনন্দের কোনাে সীমা নাই।
আমার মতাে নাদান মানুষের জন্য আল্লাহপাক এতাে আনন্দ রেখে দিয়েছেন আমি কল্পনাও করি নাই। আমি কতােবার যে বললাম, আল্লাহপাক আমি তােমার নেয়ামত স্বীকার করি। আমি তােমার নেয়ামত স্বীকার করি।
বিয়ের পর আমি শ্বশুর বাড়িতেই থেকে গেলাম। আমার এবং লতিফার বড় দুঃখের সময় কাটতে লাগলাে। শ্বশুর বাড়ির কেউ আমাদের দেখতে পারে না। খুবই খারাপ ব্যবহার করে। আমার শাশুড়ী দিন–রাত লতিফাকে অভিশাপ দেন – মর মর তুই মর। | আমার শ্বশুর সাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সকাল বেলায় তুমি আমার সামনে আসবা না। সকাল বেলায় তােমার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যায়।
শ্বশুর বাড়ির কেউ আমার সংগে কথা বলে না। তারা এক সংগে খেতে বসে। সেখানে আমার যাওয়া নিষেধ। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে লতিফা থালায় করে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। সেই ভাত আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না।
লতিফা রােজ বলে চলাে অন্য কোথায়ও যাই গিয়া।
আমি চুপ করে থাকি। কই যাবাে বলেন? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে? যাওয়ার কোনাে জায়গা নাই। লতিফা খুব কান্নাকাটি করে।
একদিন খুব অপমানের মধ্যে পড়লাম। আমার শ্বশুর সাহেবের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এক হাজার টাকা চুরি গেছে। তিনি আমারে ডেকে নিয়ে বললেন, এই যে দাড়িওয়ালা তুমি কি আমার টাকা নিয়েছাে? আমার চোখে পানি এসে গেলাে। একি অপমানের কথা। আমি দরিদ্র। আমার যাওয়ার জায়গা নাই – সবই সত্য কিন্তু তাই বলে আমি কি চোর? ছিঃ ছিঃ।
ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ
শ্বশুর সাহেব বললেন, কথা বলাে না কেন?
আমি বললাম, আমারে অপমান কইরেন না। যতাে ছােটই হই আমি আপনার কন্যার স্বামী।
শ্বশুর সাহেব বললেন, চুপ। চোর আবার ধর্মের কথা বলে।
লতিফা সেইদিন থেকে খাওয়া–দাওয়া বন্ধ করে দিলাে। সে বললাে, এই বাড়ির ভাত সে মুখে দিবে না।
আমার শাশুড়ী বললেন, ঢং করিস না। এই বাড়ির ভাত ছাড়া তুই ভাত পাইবি কই? | দুই দিন দুই রাত গেলাে লতিফা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয় না। আমারে বলে, তুমি আমারে অন্য কোথাও নিয়া চলাে। দরকার হইলে গাছতলায় নিয়া চলাে। এই বাড়ির ভাত আমি মুখে দিবাে না।
আমি মহাবিপদে পড়লাম। সারারাত আল্লাহরে ডাকলাম। ফজরের নামাজের শেষে আল্লাহপাকের দরবারে হাত উঠায়ে বললাম, হে মাবুদ। হে পাক পরােয়ারদিগার – তুমি ছাড়া আমি কার কাছে যাবাে? আমার দুঃখের কথা কারে বলবাে? কে আছে আমার? তুমি আমারে বিপদ থাইক্যা বাচাও।
আল্লাহপাক আমার প্রার্থনা শুনলেন। ভােরবেলায় চালের আড়তে গিয়েছি। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমারে ডেকে বললেন, এই যে মৌলানা, আমার একটা উপকার করতে পারবে?
আমি বললাম, জ্বি জনাব বলেন। ‘ময়মনসিংহ শহরে আমি নতুন বাড়ি করেছি। এখন থেকে ঐ বাড়িতে থাকবাে। সপ্তাহে সপ্তাহে এইখানে আসবাে। নেত্রকোনায় আমার যে বাড়ি আছে – তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে পারবে? নেত্রকোনার বাড়ি আমি বিক্রি করতে চাই না। শুনলাম তুমি বিবাহ করেছে – তুমি এবং তােমার স্ত্রী দুজন মিলে থাকো।
ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি বললাম, জনাব আমি অবশ্যই থাকবাে। ‘তাহলে তুমি এক কাজ করাে আজকেই চলে আসসা। একতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে তুমি থাকো। দু‘তলার ঘর তালাবন্ধ থাকুক।
‘জি আচ্ছা। ‘বাড়িটা শহর থেকে দূরে। তবে ভয়ের কিছু নেই, একজন দারােয়ান আছে। চব্বিশঘণ্টা থাকবে। দারােয়ানের নাম – বলরাম। ভালাে লােক।
‘জনাব আমি আজকেই উঠবাে।
সেইদিন বিকালেই সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠলাম। বিরাট বাড়ি। বাড়ির নাম ‘সরজুবালা হাউস। হিন্দু বাড়ি ছিলাে। সিদ্দিক সাহেবের বাবা কিনে নিয়েছিলেন।
আট ইঞ্চি ইটের দেয়ালে বাড়ির চারদিক ঘেরা। দোতলা পাকা দালান। বিরাট বড় বড় বারান্দা। দেয়ালের ভেতরে নানান জাতের গাছ গাছড়া। দিনের বেলায় অন্ধকার হয়ে থাকে।
আমি লতিফাকে বললাম, বাড়ি পছন্দ হয়েছে লতিফা?
লতিফা আনন্দে কেঁদে ফেললাে। দুই দিন খাওয়া দাওয়া না করায় লতিফার শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। চোখ ছােট ছােট, ঠোট কালচে। মুখ শুকিয়ে এতােটুকু হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই সে রান্নাবান্না করলাে। অতি সামান্য আয়ােজন। ভাত ডাল পেঁপে ভাজা। খেতে অমৃতের মতাে লাগলাে ভাই সাহেব।
ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ
খাওয়া–দাওয়ার পর দুজনে হাত ধরাধরি করে বাগানে হটলাম। হাসবেন না। ভাইসাব, তখন আমাদের বয়স ছিলাে অল্প। মন ছিল অন্য রকম। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হলাে এই দুনিয়াতে আল্লাহপাক আমার মতাে সুখী মানুষ তৈরি করেন নাই। আনন্দে বার বার চোখে পানি এসে যাচ্ছিলাে ভাই সাহেব।
ক্লান্ত হয়ে একসময় একটা লিচুগাছের নিচে আমরা বসলাম। লতিফা বললাে, আমি যে মিথ্যা কথা বইলা আপনেরে বিবাহ করছি এই জন্যে কি আমার উপর রাগ করছেন?
আমি বললাম, না লতিফা। আমার মতাে সুখী মানুষ নাই। ‘যদি সুখী হন তাহলে এই ধাধাটা পারেন কিনা দেখেন। বলেন দেখি –
‘কাটলে বাচে, না কাটলে মরে
এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?” ‘পারলাম না লতিফা ‘ভালােমতাে চিন্তা কইরা বতে হটা পারা দরকার। খুব দরকার –
কাটলে বাচে, না কাটলে মরে _ এমন সুন্দর ফল কোন্ গাছেতে ধরে?” ‘পারবাে না লতিফা আমার বুদ্ধি কম। ‘এইটা হইলাে সন্তানের নাড়ি কাটা। সন্তানের জন্মের পর নাড়ি কাটলে সন্তান বাঁচে। না কাটলে বাচেনা। আচ্ছা এই ধাধাটা আপনেরে কেন জিজ্ঞেস করলাম বলেন
তাে?”
‘তুমি বলাে। আমার বিচার বুদ্ধি খুবই কম।
‘এইটা আপনেরে বললাম – কারণ আমার সন্তান হবে।
লতিফা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললাে। কি যে আনন্দ আমার হলাে ভাই সাহেব। কি যে আনন্দ।
ভয় (পর্ব-১২)-হুমায়ূন আহমেদ
সেই রাতে লতিফার জ্বর আসলাে। বেশ ভালাে জ্বর। আমি জ্বরের খবর রাখি না। ঘুমুচ্ছি। লতিফা আমারে ডেকে তুললাে। বললাে, আমার খুব ভয় লাগতেছে একটু উঠেন তাে।
আমি উঠলাম। ঘর অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। হারিকেন জ্বলায়ে শুয়েছিলাম। বাতাসে নিভে গেছে। হারিকেন জ্বালালাম।
তাকিয়ে দেখি লতিফার মুখ ভয়ে শাদা হয়ে গেছে। সে ফিস ফিস করে বললাে, ছাদের বারান্দায় কে যেন হাঁটে।
আমি শােনার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনলাম না।
লতিফা বললাে, আমি স্পষ্ট শুনেছি। একবার না অনেকবার শুনেছি। জুতা পায়ে দিয়া হাটে। জুতার শব্দ হয়। হাঁটার শব্দ হয়।
‘বােধহয় দারােয়ান।
না দারােয়ান না। অন্য কেউ। কি করে বুঝলা অন্য কেউ? ‘বললাম না – জুতার শব্দ। দারােয়ান কি জুতা পরে?” ‘তুমি থাকো। আমি খোজ নিয়া আসি? “না না। এইখানে একা থাকলে আমি মরে যাবাে।
(চলবে)