আমি লতিফার হাত ধরে বসে রইলাম। এই প্রথম বুঝলাম লতিফার খুব জ্বর। জ্বর আরাে বাড়লাে। একসময় জ্বর নিয়ে ঘুমায়ে পড়লাে। তখন আমি নিজেই শব্দটা শুনলাম। ঝন ঝন শব্দ। জুতার শব্দ না। অন্যরকম শব্দ। ঝন ঝন ঝন – ঝন।
একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লাম। তিনবার আয়াতুল কুরসি পড়ে হাত তালি দিলে – সেই হাত তালির শব্দ যতদূর যায় ততােদূর কোনাে জ্বীন ভূত আসে না। হাত তালি দেয়ার পর ঝন ঝন শব্দ কমে গেলাে, তবে পুরাপুরি গেলাে না। আমি সারারাত জেগে কাটালাম।
ভােরবেলা সব স্বাভাবিক। রাতে যে এতাে ভয় পেয়েছিলাম মনেই রইলাে না। লতিফার গায়েও জ্বর নেই। সে ঘর দোয়ার গুছাতে শুরু করলাে। একতলার সর্বদক্ষিণের দুটা ঘর আমরা নিয়েছি। বারান্দা আছে। কাছেই কলঘর। লতিফা নিজের সংসার ঠিকঠাক করতে
ব্যস্ত হয়ে পড়লাে। দারােয়ান বলরাম সাহায্য করার জন্য চলে আসলাে। বলরামের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আদি বাড়ি নেপালে। দশ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছে আর ফিরে যায়নি। এখন পুরােপুরি বাঙালী। বাঙালী একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলাে। সে মেয়ে মরে গেছে। বলরামের এক ছেলে আছে। খুলনার এক ব্যাংকের দারােয়ান। ছেলে বিয়ে–শাদী করেছে। বাবার কোনাে খোজ–খবর করে না।
ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
বলরামের সংগে অতি অল্প সময়ে লতিফার ভাব। বলরাম লতিফাকে মা ডাকা শুরু করলাে। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে চলে গেলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলাে।
বাড়িতে ঢুকে দেখি বারান্দায় পা ছড়িয়ে লতিফা বসে আছে। তার মুখ শুকনা। আমি বললাম, কি হয়েছে?
‘ভয় লাগছে। ‘কিসের ভয়?” ‘বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। ‘কি স্বপ্ন?” ‘দেখলাম আমি ঘুমাচ্ছি। একটা লম্বা, কালাে এবং খুব মােটা লােক ঘরে ঢুকলাে। লােকটার সারা শরীরে বড় বড় ললাম। কোনাে দাত নেই। চোখগুলা অসম্ভব ছােট ছােট। দেখাই যায় না – এরকম। হাতের থাবাগুলিও খুব ছােট। বাচ্চা ছেলেদের মতাে। আমি লােকটাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সে বললাে, এই ভয় পাস কেন? আমার নাম কফিল।
আমিতাে তাের সাথেই থাকি। তুই টের পাস না? তুই বিয়ে করেছিস আমি কিছু বলি নাই। এখন আবার সন্তান হবে। ভালােমতাে শুনে রাখ – তাের সন্তানটারে আমি শেষ করে দিবাে। এখনি শেষ করতাম। এখন শেষ করলে তাের ক্ষতি হবে। এইজন্যে কিছু করছি না। সন্তান জন্মের সাতদিনের ভিতর আমি তারে শেষ করবাে। এই বলেই সে আমারে ধরতে আসলাে। আমি চীৎকার করে জেগে উঠলাম। তারপর থেকে এইখানে বসে আছি।
আমি বললাম, স্বপ্ন হলাে স্বপ্ন। কতত খারাপ খারাপ স্বপ্ন মানুষ দেখে। সবচে’ বেশি খারাপ স্বপ্ন দেখে পােয়াতী মেয়েছেলে। তাদের মনে থাকে মৃত্যুভয়।
কথাবার্তা বলে লতিফাকে মােটামুটি স্বাভাবিক করে তুললাম। সে ঘরের কাজকর্ম করতে লাগলাে। রান্না করলাে। আমরা সকাল সকাল খাওয়া–দাওয়া করলাম। তারপর বাগানে হাঁটতে বের হলাম। লতিফা বললাে, এই বাড়িতে একটা দোষ আছে সেইটা কি আপনি জানেন?
ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
‘কি দোষ?
‘এই বাড়িতে একটা খারাপ কুয়া আছে। সিদ্দিক সাহেবের চার বছর বয়সের একটা ছােট্ট মেয়ে কুয়ায় পড়ে মারা গিয়েছিলাে। কুয়াটা দোষী। | ‘কি যে তুমি বলাে। কুয়া দোষী হবে কেন? বাচ্চা মেয়ে খেলতে খেলতে পড়ে
গেছে।
‘তা না, কুয়াটা আসলেই দোষী। ‘কে বলেছে?
‘বলরাম বলেছে। কুয়াটার মুখ সিদ্দিক সাহেব টিনদিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। সেই টিনে রাতের বেলা ঝনঝন শব্দ হয়। মনে হয় ছােট কোনাে বাচ্চা টিনের উপরে লাফায়। তুমি গত রাতে কোনাে ঝনঝন শব্দ শােনাে নাই ?
আমি মিথ্যা করে বললাম, না। ‘আমি কিন্তু শুনেছি।
আমি বলরামের উপর খুব বিরক্ত হলাম। এইসব গল্প বলে ভয় দেখানাের কোনাে মানে হয়? ঠিক করলাম ভােরবেলায় তাকে ডেকে শক্তভাবে ধমক দিয়ে দেবাে।
রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে লক্ষ্য করলাম লতিফার জ্বর এসেছে। সে কেমন ঝিম মেরে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলাে। হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমুতে গেলাম। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলাে। লতিফা আমাকে ঝাকাচ্ছে। ঘর অন্ধকার। লতিফা বললাে, হারিকেন আপনা আপনি নিভে গেছে। আমার বড় ভয় লাগতেছে।
আমি হারিকেন জ্বালালাম। আর তখনি ঝনঝন শব্দ পেলাম। একবার না। বেশ কয়েকবার।
লতিফা ফিসফিস করে বললাে, শব্দ শুনলেন? আমি জবাব দিলাম না। লতিফা কাদতে লাগলাে। যতােই দিন যেতে লাগলাে লতিফার অবস্থা ততােই খারাপ হতে লাগলাে। রােজ সে কফিলকে স্বপ্ন দেখে। কফিল তাকে শাসিয়ে যায়। বারবার মনে করিয়ে দেয় – বাচ্চা হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সে বাচ্চা নিয়ে নিবে। মনের শান্তি পুরােপুরি নষ্ট হয়ে গেলাে।
ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি লতিফাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলাম, সে রাজি হলাে না। প্রয়ােজনে সে এইখানেই মরবে কিন্তু বাবার বাড়িতে যাবে না। আমি ভাই জন্যে তাবিজ কবচের ব্যবস্থা করলাম, বাড়ি বন্ধনের ব্যবস্থা করলাম। আমি দরিদ্র মানুষ তবু একটা কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করলাম যেন সে সারাক্ষণ লতিফার সংগে থাকে।
কিছুতেই কিছু হলাে না।
এক সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে দেখি – লতিফা খুব সাজগােজ করেছে। লাল একটা শাড়ি পরেছে। পান খেয়ে ঠোট লাল করেছে। বেণী করে চুল বেঁধেছে। বেণীতে চারপাচটা জবা ফুল। সে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরে বলরাম এবং কাজের মেয়েটা। তারা দুজন ভীত চোখে তাকিয়ে আছে লতিফার দিকে।
আমাকে দেখেই লতিফা খিলখিল করে হেসে উঠলাে। হাসি আর থামতেই চায় । আমি বললাম, কি হয়েছে লতিফা? লতিফা হাসি থামালাে এবং আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পুরুষের গলায় বললাে, মৌলানা আসছে। মৌলানারে অজুর পানি দেও। নামাজের পাটি দেও। কেবলা কোন দিকে দেখাইয়া দাও। টুপী দেও, তসবি দেও।
আমি বললাম, এইরকম করতেছাে কেন লতিফা?
লতিফা আবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে বললাে, ওমা মেয়েছেলের সংগে দেখি মৌলানা কথা বলে। ছিঃছিঃছিঃ। মৌলানার লজ্জা নাই।
আমি আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে লতিফা চিৎকার করে বললাে, চুপ করাে। আমার নাম কফিল। তাের মতাে মৌলানা আমি দশটা হজম কইরা রাখছি। গােটা কোরান শরীফ আমার স্থ। আমার সংগে পাল্লা দিবি? আয় পাল্লা দিলে আয়। প্রথম থাইকা শুরু করি ... ই–হি হি। ভয় পাইছস? ভয় পাওনেরই কথা।
ভয় (পর্ব-১৩)-হুমায়ূন আহমেদ
বেশি ভয় পাওনের দরকার না। তােরে আমি কিছু বলবাে না। তাের বাচ্চাটারে শেষ করবাে। তুই মৌলানা মানুষ, তুই বাচ্চা দিয়া কি করবি? তুই থাকবি মসজিদে। মসজিদে বইস্যা তুই তাের আল্লাহরে ডাকবি। পুলাপান না থাকাই তাের জন্যে ভালাে। হি–হি–হি –1
একটা ভয়ংকর রাত পার করলাম ভাইসাব।
(চলবে)